(১০ ডিসেম্বর হল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। সারা ভারতের জনগণ যখন ২০২১’র আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালন করবেন, তখন তাঁরা মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের ওপর মোদী সরকারের নামানো সরাসরি যুদ্ধর দিকেই আঙুল তুলবেন। এই যুদ্ধক্ষেত্রের সাম্প্রতিক অবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করছে লিবারেশন।)
অক্টোবর মাসে পেরিয়ে গেল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠা দিবস। প্রতিষ্ঠা দিবস উদযাপনের দিন অনুষ্ঠানের এক মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদী একেবারে নিজস্ব ধারায় আক্রমণ হানলেন মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের ওপর। তিনি তাদের এই অভিযোগে অভিযুক্ত করলেন যে তারা ‘বেছে বেছে’ মানবাধিকারের ইস্যুগুলোকে তোলে আর তার উদ্দেশ্য হল “দেশের ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করা”। মাত্রাহীন মানবাধিকার লঙ্ঘনই বিজেপি’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলেও মোদীর মোসাহেবরা তাদের প্রভুর মতোই মানবাধিকারের ধারণার নতুন রূপ দিতে চাইছে। সিদ্ধার্থ ভরদরাজন যেমন বলেছেন, “সরকারের কাজ যখন সাংবিধানিক শাসনধারা মেনে হবে না তখন আপনি কি করবেন? আপনি তখন নতুন তত্ত্ব বানাবেন।”
ডোভাল তত্ত্ব
কাজে নতুন যোগ দেওয়া পুলিশ অফিসারদের সামনে কিছু কথা বলতে গিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল বললেন যে, “যুদ্ধের নতুন সীমানা হল নাগরিক সমাজ, যাদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে জাতির স্বার্থে আঘাত ঘটানো যায়।” মোদী জমানায় চালু হয়েছিল ‘শহুরে নকশাল’ কথাটা, যেটাকে বানিয়েছিল মোদী অনুগত সংবাদ মাধ্যমের লোকজন। নতুন পুলিশ অফিসারদের সামনে বলা কথাগুলো দিয়ে ডোভাল এই অভিধার ব্যঞ্জনাকেই তীব্রতর করে তুললেন। এর অর্থ হল: কেউ মোদী জমানাকে মানবাধিকার নীতির প্রতি দায়বদ্ধ করতে চাইলে তিনিই দেশের স্বার্থর প্রতি বিপদ বলে প্রতিপন্ন হবেন। যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তারাই হল একমাত্র মানুষ যাদের জীবনের মূল্য আছে, আর তারা যাদের ওপর নিপীড়ন চালায় বা যাদের হত্যা করে তারা হল ‘সন্ত্রাসবাদী’ যাদের কোনো মানবাধিকার থাকতে পারেনা। মানবাধিকারের রক্ষকরা অতএব সেই সমস্ত মানুষদের অধিকারকেই লঙ্ঘন করছে যাদেরই একমাত্র অধিকারের হক আছে। মানবাধিকারের লঙ্ঘন যারা করছে তারা তাই হয়ে পড়ছে ‘নাগরিক সমাজের’ বলি; মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার মানুষজন হল সন্ত্রাসবাদী, এবং যারা মানবাধিকারের লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে ও আপত্তি জানাচ্ছে তারা অতএব হচ্ছে ‘শহুরে সন্ত্রাসবাদী’।
অধিকারের নতুন সংজ্ঞা দিলেন রাওয়াত
প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াতই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন, মোদী জমানার স্তুতি করে থাকে এমন একটা চ্যানেল টাইমস নাও’এর সঞ্চালক রাহুল শিবশঙ্করকে তিনি বললেন, “কাশ্মীরের মানুষজন বলছে যে তাঁরা সন্ত্রাসবাদীদের গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলবেন, তাঁরা এমন ব্যবস্থা করবেন বলছেন যার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদীরা গণপ্রহারের শিকার হয়। এটা একটা ইতিবাচক লক্ষণ। সন্ত্রাসবাদীকে হত্যা করলে সেটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন হবে কেমন করে? আপনার এলাকায় কোনো সন্ত্রাসবাদী সক্রিয় হলে তাকে আপনি হত্যা করতে পারবেন না কেন?” গণপিটুনি অনেকদিন ধরেই হিন্দু আধিপত্যবাদীদের দেশপ্রেমের প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (দাদরির গণপিটুনির ঘটনায় যুক্ত একজনের দেহ যখন তেরঙা পতাকায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল)। প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রধান এখন ‘পরিকল্পিত’ গণপিটুনির কথা বলছেন, যেখানে গণপিটুনির শিকারদেরই সন্ত্রাসবাদী বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে!
কাশ্মীরে অসামরিক নাগরিক হত্যাকে চালানো হচ্ছে ‘সংঘর্ষ হত্যা’ বলে
রাওয়াত যখন বলছেন যে কাশ্মীরের স্থানীয় জনগণ গণপিটুনির ‘পরিকল্পনা’ করে, তখন সেটা কি এটাই বোঝাচ্ছে যে বাস্তবে গণপিটুনিগুলো পুলিশ অথবা সেনারাই চালায়? আসল ঘটনা হল, তথাকথিত ‘সংঘর্ষ হত্যা’য় নিহত স্বজনদের দেহ তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানানোর জন্য সশস্ত্র বাহিনীগুলো স্থানীয় কাশ্মীরী জনগণের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ দাবি করেছিল, হায়দারপোরায় তারা “দুজন জঙ্গি এবং দুজন জঙ্গি-সহযোগীকে হত্যা করেছে”। এই দাবির বিরুদ্ধে গ্ৰামবাসীরা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে যে, নিহতদের মধ্যে অন্তত তিনজনের একজন হল স্থানীয় এক ব্যবসায়ী, দাঁতের এক ডাক্তার এবং এক পিওন যাদের হত্যা করার পর ‘সংঘর্ষ হত্যা’ বলে চালানো হয় এবং নিহতদের ‘জঙ্গী’ ও ‘সহযোগী’ বলে অভিহিত করা হয়! হায়দারপোরার ঘটনা ডোভাল-রাওয়াত তত্ত্বের বাস্তবায়নের সাম্প্রতিকতম নিদর্শন মাত্র। অসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা হয়, পুলিশ ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠলে নিহতদের ‘জঙ্গী’ এবং নাগরিক সমাজের ‘জঙ্গী সহযোগী’ বলে ছাপ মেরে তার উত্তর দেওয়া হয়! এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত হলে জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন ‘সংঘর্ষ হত্যা’র ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেয় এবং ব্যবসায়ী ও দাঁতের ডাক্তারের দেহ নিকটজনের হাতে তুলে দেয়। অবশ্য, হাথরাসে ধর্ষিতার দেহকে মাঝরাতে পোড়ানো/সমাধিস্থ করার মত ঘটনা কাশ্মীরে যে খুবই সাধারণ ব্যাপার সেটা মনে পড়িয়ে দিয়ে এই ঘটনাতেও পরিবারের সদস্যদের প্রিয়জনদের দেহ রাতের অন্ধকারেই সমাধিস্থ করতে বাধ্য করা হয়।
হায়দারপোরার ঘটনা ঘটেছিল ১৫ নভেম্বর। এর দশদিনেরও কম সময়ে, ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় হায়দারপোরা থেকে মাত্র দু’কিমি দূরে শ্রীনগরের রামবাগ সেতুর কাছে পুলিশের গুলিতে নিহত হল তিন কাশ্মীরী যুবক। কাশ্মীরের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ বিজয় কুমার জানিয়েছেন, “শ্রীনগরের সংঘর্ষে নিহত তিন জঙ্গির মধ্যে একজন হল মেহরান (মেহরান ইয়াসিন সালা), টিআরএফ’এর (দ্য রেজিস্টান্স ফ্রন্ট) শীর্ষ কমাণ্ডার যে এই শহরের দুই শিক্ষক ও অন্যান্য নাগরিকদের হত্যায় জড়িত ছিল।” নিহত অন্য দু’জন হল মনজুর আহমেদ মীর ও আরাফত আহমেদ শেখ, পুলওয়ামার বাসিন্দা। পুলিশের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, তারা একটা গাড়িকে থামতে বলে। কিন্তু গাড়ি না থামিয়ে “জঙ্গিরা গাড়ির ভিতর থেকে নির্বিচারে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে আর ছুঁড়তে-ছুঁড়তে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। গুলির পাল্টা জবাব দেওয়া হয় যা বন্দুকের লড়াইয়ে পরিণতি লাভ করে।” পুলিশ এটাকে ‘সংঘর্ষ হত্যা’ বললেও প্রত্যক্ষদর্শীরা এটাকে একতরফা গুলিচালনার মধ্যে দিয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বলে বর্ণনা করেছেন। কেউ-কেউ জানিয়েছেন, তিনজনের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না এবং গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় তাদের হত্যা করা হয়। এক মহিলা প্রত্যক্ষদর্শী ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে বলেছেন, “পুলিশরা এল এবং তিনজনের ওপর যথেচ্ছ গুলি চালাতে শুরু করল। আমরা প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না যে কি ঘটছে, কিন্তু পুলিশরা তিনজনের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করল, ওরা একটা গলির দিকে ছুটল, কিন্তু পুলিশরা ওদের পিছনে ছুটে আহত অবস্থায় ওদের রাস্তায় নিয়ে এল এবং যতক্ষণ না মারা যায় ততক্ষণ রাস্তাতেই ফেলে রাখল, তারপর দেহগুলোকে নিয়ে চলে গেল।” এই হত্যাকাণ্ডর বিরুদ্ধে দু’দিন, ২৪ ও ২৫ নভেম্বর শ্রীনগরে প্রতিবাদ সংগঠিত হয় এবং বিক্ষোভ প্রশমনে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থানীয় জনগণের এই প্রতিবাদ পুলিশ ও প্রশাসনের এই দাবিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে যে, পুলিশের গুলিতে নিহত ‘জঙ্গিদের’ পিছনে জনগণের কোনো সমর্থন নেই।
(সূত্র: লিবারেশন, ডিসেম্বর ২০২১)
হেফাজতে হত্যা ও তাকে ধামাচাপা দেওয়া
উত্তরপ্রদেশের কাশগঞ্জে এক মুসলিম যুবক আলতাফ এক হিন্দু অপ্রাপ্তবয়স্কাকে অপহরণ করেছে বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। পরদিন সকালে কাশগঞ্জ পুলিশ দাবি করল, যে আলতাফ (প্রায় ছ-ফুট লম্বা) থানার বাথরুমের দু’ফুট উঁচু কল থেকে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, এবং তা করতে গিয়ে কাজে লাগিয়েছে ‘ওর জ্যাকেটের টুপির দড়িকে’, যদিও তা ছিল বিশ্বাসের অযোগ্য। পরে এটাও জানা গেল যে ঘটনায় যুক্ত মেয়েটা ১৬ বছরের অপ্রাপ্তবয়স্কা ছিলনা, সে ছিল প্রাপ্তবয়স্কা। ভারতে নাবালিকা ও নারীদের ‘অপহরণ’ এবং ‘ধর্ষণের’ যত ঘটনা নথিবদ্ধ হয় তার ৪০ শতাংশ যথার্থ অর্থেই হল পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ভিন্ন জাত বা ধর্মের ছেলে-মেয়েদের পলায়ন, যেটাকে নাবালিকা বা প্রাপ্তবয়স্কার বাবা-মা ধর্ষণের অপরাধ করে তোলে। এই সব ঘটনায় উত্তরপ্রদেশের পুলিশ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয় যিনি ভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষের মধ্যে সমস্ত প্রেমের ঘটনাকেই ‘লাভ জিহাদ’ বলে থাকেন এবং ‘সংঘটকদের’ হত্যার আহ্বান জানান।
সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা জানানোর জন্য ইউএপিএ প্রয়োগ
ত্রিপুরায় মুসলিম-বিরোধী অনেক ঘটনাই ঘটল, যারমধ্যে মসজিদে আগুন লাগানোর ঘটনাও ছিল। সাংবাদিক এবং অন্যান্য যাঁরা ঐ সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে টুইট করলেন, ত্রিপুরা পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ’র ধারায় অভিযোগ দায়ের করল, ঐ ধরনের টুইট বা পোস্টের জন্য বিশেষভাবে নিশানা বানানো হল মুসলিমদের। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হল, ত্রিপুরা পুলিশ নিজেদের রাজ্য থেকে আসামে গিয়ে দুই মহিলা সাংবাদিককে গ্ৰেপ্তার করল, তাদের অপরাধ ছিল এই যে, মুসলিমদের মসজিদ ও সম্পত্তির ওপর ধ্বংসোন্মাদনা চালানো ও অগ্নি সংযোগের ঘটনার রিপোর্ট তারা করেছিল।