সেনার বিশেষ সশস্ত্র বাহিনী নাগাল্যাণ্ডের মন জেলার ওটিং গ্রামে খনি শ্রমিকদের গণহত্যা সংগঠিত করেছে। এ এক হীন অপরাধ। সেনা যেভাবে এই গণহত্যাকে ‘এনকাউন্টার’ বলে সাজাতে চেয়েছে তাতে অপরাধ আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও আর্মি অফিসাররা “ভুল করে হয়ে গেছে” বলে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। কিন্তু উত্তর-পূর্বের বিজেপি সদস্য ও তাদের জোটসঙ্গীদের কাছে পর্যন্ত এই ব্যাখ্যা মোটেই গ্রহণযোগ্য হয়নি।
সশস্ত্র বাহিনী দাবি করেছে যে তাঁরা ট্রাকভর্তি নাগরিকদের (কাজ থেকে ফেরা খনি শ্রমিক) ওপর গুলি চালিয়ে ঘটনাস্থলেই ৬ জনকে মেরে ফেলেছেন কারণ সেনার কাছে “গুপ্তচর বিভাগের বিশ্বস্ত খবর” ছিল জঙ্গীদের যাতায়াত বিষয়ে। কিন্তু সেনার দেওয়া এই অজুহাত নানা কারণেই মেনে নেওয়া যায় না।
প্রথমত, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এক ব্যস্ত রাস্তার ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় পুলিশকে অপারেশনে যুক্ত না করে সেনা প্রথাবদ্ধ নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। অধিকন্ত, ট্রাকের আরোহীদের দিক থেকে কোনোরকম আক্রমণের চিহ্নমাত্র না দেখেও এবং তাঁদের প্রতি কোনোরকম সতর্কতামূলক ঘোষণা জারি না করেই সেনা গুলি চালিয়েছে, আরোহীদের প্রকৃত পরিচিতি যাচাই করে নেওয়া তো অনেক দূরের কথা। যদি ওই ট্রাকে বাস্তবতই জঙ্গিরা থাকত তবুও এই অপারেশন মানবাধিকার উল্লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হত।
যখন স্থানীয় নাগরিকেরা এই হত্যার খবর পেয়ে খোঁজখবর নিতে আসেন তখন তাঁরা সশস্ত্র বাহিনীকে ‘এনকাউন্টার’ সাজানোর কাজে ব্যস্ত হিসেবে দেখতে পান। খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রামবাসীরা ক্রুদ্ধ হয়ে স্থানীয় সেনা দপ্তরে প্রতিবাদ দেখাতে শুরু করেন। সেনা এখানে আবার প্রতিবাদরত নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়, ৭ জনকে হত্যা করে। খবরে প্রকাশ, এরপর ওই সশস্ত্র বাহিনী পালাতে শুরু করে এবং পালানোর সময় এমনকি রাস্তার ধারের খনিশ্রমিক বসতির দিকে গুলি ছুঁড়তে যায়। সব মিলিয়ে সেনার অতর্কিত হামলা ও তার পরবর্তী ঘটনাক্রমে মোট ১৫ জন নাগরিকের প্রাণ গেছে। আরও অনেকে মারাত্মক জখম।
এই ঘটনা কোনও ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে অথবা কাশ্মীর ও বস্তার সহ অন্যান্য সংঘর্ষের এলাকায় সাজানো এনকাউন্টারে নাগরিকদের হত্যা করা খুবই সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আফস্পা)’র উৎস ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে দমন করার লক্ষ্যে ব্রিটিশের চালু করা ‘সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স’এর মধ্যে। লজ্জার কথা হল এই ঔপনিবেশিক উৎসের আইনটি ১৯৫৮ সাল থেকে ভারতীয় আইন হিসেবে উত্তর-পূর্ব ভারতে লাগু আছে।
খুন, অত্যাচার এমনকি ধর্ষণের অপরাধেও বিচার থেকে ছাড় পাওয়ার বিশেষ রক্ষাকবচ সশস্ত্র বাহিনীকে দেয় আফস্পা। সেই কারণেই, ওটিং গণহত্যার বিষয়ে নাগাল্যাণ্ড পুলিশের পক্ষ থেকে স্পেশাল ফোর্সের বিরুদ্ধে এফআইআর করা সত্ত্বেও শাস্তির লক্ষ্যে পুলিশ এগোতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত না কেন্দ্রীয় সরকার অনুমতি দিচ্ছে। আর, এই অনুমতি প্রায় কখনই দেওয়া হয় না। এমনকি ২০০৪ সালে মণিপুরের থাংজাম মনোরমাকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্তে আসাম রাইফেলসের জওয়ানেরা দোষী সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত অফরাধীরা শাস্তি না পেয়ে বহাল তবিয়তে আছে আফস্পার কারণে।
নাগরিকদের ওপর সেনার নিষ্ঠুর নিপীড়নের মুখ্য হাতিয়ার এই ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’এর বিরুদ্ধে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন যাবত প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। আসাম রাইফেলসের সদর দপ্তরের সামনে মনিপুরের মহিলারা শরীরের সমস্ত পোশাক ত্যাগ করে “ইণ্ডিয়ান আর্মি রেপ আস” (ভারতীয় সেনা এসো আমাদের ধর্ষণ করো) লেখা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই প্রতিবাদ আফস্পা খারিজ করার এক জোরালো আবেদন হিসেবে আজও জনমানসে উজ্জ্বল। কিন্তু বিভিন্ন রঙের একের পর এক সরকার আফস্পা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে গেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চল, কাশ্মীর ও বস্তার সহ অন্যত্র নাগরিকদের ওপর অপরাধের ক্ষেত্রে সেনা ও আধাসেনাকে দায়বদ্ধ করতে অস্বীকার করে গেছে সরকারগুলো। গত দু’দশকে কেবলমাত্র মনিপুরে ভূয়ো সংঘর্ষের প্রায় ১,৫০০ মামলা সুপ্রিম কোর্টে পড়ে আছে সুবিচারের অপেক্ষায়।
সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা সাজানো সংঘর্ষ ও ধর্ষণের বিষয়ে মানবাধিকার কর্মীরা প্রশ্ন তুললে বিজেপি তাঁদের ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’ বলে দেগে দেয় এবং রাজদ্রোহ আইন দিয়ে তাঁদের ভয় দেখায়। কাশ্মীরের মানবাধিকার রক্ষার অগ্রণী যোদ্ধা জেকেসিএস’র খুররম পারভেজকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হল মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে অগণতান্ত্রিক ইউএপিএ আইনে। জেকেসিএস কাশ্মীর উপত্যকায় মানবাধিকারের জোরালো ওকালতি করে থাকে এবং এখন ওটিং’এ যেরকম হল ঠিক সেরকম ‘সংঘর্ষ’ হিসেবে সাজানো বহু গণহত্যা ও অন্যান্য লঙ্ঘনের অনুপুঙ্খ তথ্য সংকলনের কাজ করে থাকে।
এখন এমনকি নাগাল্যাণ্ড ও মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীরা — উভয়েই বিজেপি’র জোটসঙ্গী — আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন, আর ‘মন’ জেলার বিজেপি নেতা অভিযোগ করেছেন যে সেনা তাঁকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করেছে এবং ভূয়ো সংঘর্ষ সাজিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে সুবিচার নিশ্চিত করতে হলে আফস্পা প্রত্যাহার করার পাশাপাশি সমগ্র অঞ্চলের বে-সামরিকীকরণ ও বিগত সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সেনাকে দায়বদ্ধ করাটা একান্ত জরুরি। অতীতে উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলির যেসব ক্ষেত্রে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সেসব তদন্তও পরিহাসে পর্যবসিত হয়েছে এবং অপরাধীরা কোনও শাস্তি ছাড়াই পার পেয়ে গেছে।
উপরন্ত, ওটিং মামলা সহ সশস্ত্র বাহিনীর অন্যান্য অপরাধের বিচার অবশ্যই অসামরিক আদালতে প্রকাশ্যে হওয়া দরকার। এবং সমস্ত চলমান সশস্ত্র সংঘর্ষের পদ্ধতিকে অবশ্যই মানবিকতাপন্থী ও মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন এবং সাংবিধানিক মান্যতার সাথে সাজুয্যপূর্ণ হতে হবে।
সামরিক সমাধানের বিরুদ্ধে সারা দেশের উঠে দাঁড়ানোর এবং সেনাবাহিনীর কাছে দায়বদ্ধতা দাবি করার এখনই উপযুক্ত সময়। সারা দেশকে অবশ্যই উঠে দাঁড়াতে হবে আফস্পাকে এক চূড়ান্ত ধাক্কা দেওয়ার লক্ষ্যে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন করার এই সময়টাই আফস্পার মতো ঔপনিবেশিক শাসনধারার আইন থেকে মুক্ত হওয়ার সময়, সংঘর্ষের এলাকায় সবরকম হেফাজত-হিংসার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর দায়বদ্ধতা ও মানুষের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করার সময় এখন।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৭ ডিসেম্বর ২০২১)