প্রতিবেদন
নাগাল্যান্ড হত্যাকাণ্ডে জোরালো হল আফস্পা বাতিলের দাবি
Nagaland killings

স্বাধীনতা লাভের এক দশক পরই নাগা পার্বত্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ দমনে ১৯৫৮ সালে চালু হয় সেনা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন বা আফস্পা। এই আইন জঙ্গি কার্যকলাপ দমনে তল্লাশি, গ্ৰেপ্তারি ও গুলি চালানোর যথেচ্ছ ক্ষমতা সেনাদের দিয়েছে। চালু হওয়ার ছ-দশক পরও বিভিন্ন রাজ্যে ঐ আইনের সচলতায় কোনো ছেদ নেই। এই ছ-দশকেরও বেশি সময়কালে আফস্পার ইতিহাস দেশের নাগরিকদের রক্ত ঝড়ানোর ইতিহাস — এই আইন সেনাদের শাস্তিহীনতার সুরক্ষা দেওয়ায় তারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে এবং কাশ্মীরে সৃষ্টি করে চলে নির্মম নিপীড়নের নিরবচ্ছিন্ন আখ্যান। ফলে আফস্পা-লাঞ্ছিত রাজ্যগুলো থেকে বারবারই উঠেছে আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি। সেনাদের নৃশংস আচরণে নিযুক্ত তদন্ত কমিটি এবং মানবাধিকার রক্ষার সংস্থাগুলোও আফস্পা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছে। গত ৪ ডিসেম্বর নাগাল্যান্ডের মন জেলার ওটিং গ্ৰামে সেনাদের হাতে ঘরে ফেরা শ্রমিক ও প্রতিবাদী গ্ৰামবাসীদের হত্যা (ঐ ঘটনায় নিহতের মোট সংখ্যা ১৭) এবং আরও বহু সংখ্যককে গুরুতর রূপে আহত করার পর আফস্পা বাতিলের দাবি আরও একবার উঠল জোরালো ভাবে। উত্তর-পূর্বের সব রাজ্যেই বিজেপি এখন শরিকদের নিয়ে ক্ষমতাসীন, সেই শরিকরাও এখন আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে সোচ্চার, একই দাবি তুলেছেন নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী এনপিএফ নেতা নিফিউ রিও এবং মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী এনপিপি নেতা কনরাড সাংমা। মিজোরাম থেকেও প্রত্যাহারের দাবি শোনা গেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আট ছাত্র সংগঠনের যৌথ সংস্থা ‘নেসো’ ৯ ডিসেম্বর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটা রাজ্য রাজধানীতে মন জেলার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করে এবং আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। সেনাদের দৌরাত্ম্যে সবচেয়ে উৎপীড়িত রাজ্যগুলোর অন্যতম মনিপুরের “উইমেন গান সারভাইভারস নেটওয়ার্ক”-এর নেত্রী বীণালক্ষ্মী নেপ্রামের অভিজ্ঞতায় সেনাদের কার্যধারা এই রকম — “বিনা বিচারে, বিনা প্ররোচনায় বছরের পর বছর সামরিক বাহিনী সাধারণ মানুষকে হত্যা করে চলেছে। আজ পর্যন্ত কারো শাস্তি হয়নি। মানুষ মারার অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে তাদের।” যে আফস্পা সেনাদের এমন নারকীয় নৃশংসতার অধিকারী করেছে, গণতন্ত্রে আদৌ তার ঠাঁই হতে পারে না।

আফস্পা প্রথমে নাগা অধ্যুষিত অঞ্চলে চালু হলেও পরে, ১৯৭২ সালে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমস্ত রাজ্যেই তা বলবৎ হয়। এই রাজ্যগুলো হল — আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশ। বর্তমানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে আফস্পা বহাল রয়েছে আসাম, নাগাল্যান্ড, মনিপুর (ইম্ফল পৌর অঞ্চল বাদে) এবং অরুণাচল প্রদেশের তিনটে জেলা ও আটটা থানা অঞ্চলে। এরপর জম্মু ও কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যকলাপ দমনে রাজ্যপাল করে পাঠানো হয় জগমোহনকে এবং সেই সময়ই, ১৯৯০ সালে ঐ রাজ্যে আফস্পা চালু হয়। তারপর থেকেই জম্মু ও কাশ্মীর কার্যত সেনা শাসনের অধীন হয় যা আজও চলছে। এবং বর্তমানে রাজ্যের মর্যাদা হারানো জম্মু ও কাশ্মীর সেনা কার্যকলাপের চরমতম বর্বরতা ভোগ করছে। মাঝে খালিস্তানি আন্দোলন দমনে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত পাঞ্জাবও আফস্পার জোরে সেনা বর্বরতা ভোগ করে। তবে, সেনা বাহিনীর পৈশাচিকতা অব্যাহতভাবে চলার পাশাপাশি আফস্পা-বিরোধী প্রতিবাদ এবং তার প্রত্যাহারের দাবিও লাগাতার ভাবেই উঠতে থাকে।

২০০০ সালের ৫ নভেম্বর চোখের সামনে সেনাদের হাতে ১০ জন নিরীহ নিরপরাধ নাগরিকের নৃশংস হত্যা দেখে মনিপুরের ইরম চানু শর্মিলা আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন এবং তাঁর সেই লড়াই চলে টানা ১৬ বছর। সেনাদের হাতে মনিপুরেরই মনোরমা থাংজামের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে ১২ জন মহিলা ২০০৪ সালের ১৫ জুলাই নগ্ন দেহে আসাম রাইফেলস-এর সদর দপ্তর কাংলা ফোর্টের সামনে অভিনব ও সাহসী প্রতিবাদ সংগঠিত করেন। মনিপুরের জনগণের এই শক্তিশালী আন্দোলনের পরিণতিতে কেন্দ্রীয় সরকার আফস্পার পুনর্বিবেচনার জন্য জীবন রেড্ডি কমিটি তৈরি করে যা আফস্পা বাতিলের পক্ষে মত দেয়। বীরাপ্পা মইলির নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনও আফস্পা বাতিলের পক্ষে রায় দেয়।

ঔপন্যাসিক মির্জা ওয়াহিদ ২০১১ সালে তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, “মাত্র এক ধরনের সন্ত্রাসই আছে যা কাশ্মীরের যুবকদের মা-বাবার হৃদয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বওয়াতে পারে — সেটা হল উর্দিধারীদের সন্ত্রাস।” সেনা বাহিনীর এই সন্ত্রাসের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে কাশ্মীরের সর্বত্র — ভুয়ো সংঘর্ষে হাজার-হাজার যুবকের হত্যার মধ্যে, স্বীকৃত নয় এমন অচিহ্নিত কবরগুলোয় অগুণতি যুবকের শায়িত থাকার মধ্যে, হেফাজত থেকে বিপুল সংখ্যক যুবকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আখ্যানে, ধর্ষণের কতশত ঘটনার মধ্যে। জঙ্গি হামলার বাস্তবতা সত্ত্বেও দেশের অসামরিক নাগরিকদের ওপর নামানো এই লাগামহীন সন্ত্রাসের কোনো ন্যায্যতা থাকতে পারে না এবং গণতন্ত্রও তাকে অনুমোদন করে না। রাজ্যের জনগণ এবং দেশের কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিকরা সঙ্গত ভাবেই সীমাহীন নিপীড়ন চালানোয় সেনাদের সক্ষম করে তোলা আফস্পাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তার বিলোপ সুনিশ্চিত করার দাবি উঠিয়েছেন।

AFSPA in Nagaland killings

শুরুতে উল্লিখিত আফস্পা প্রত্যাহারের জোরালো দাবি ছাড়াও নিরীহ, নিরপরাধ শ্রমিক ও গ্ৰামবাসীদের হত্যায় আরও কিছু প্রতিক্রিয়া আমাদের নজরে এসেছে। এগুলোর একটা হল নাগা জনগণের মানবাধিকার আন্দোলন নামক সংস্থার একটা বিবৃতি। কোহিমা থেকে ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিবৃতিতে সেনাদের হাতে নাগা জনগণের ভোগ করা নৃশংসতার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকেই দায়ী করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ভারতীয় সংসদ প্রদত্ত দানবীয় ও পৈশাচিক অব্যাহতির অধিকারে সজ্জিত হয়ে ভারত সরকার তার সুবিধামতো যে কোনো সময়ে ও স্থানে অসামরিক ও সাধারণ জনগণকে হত্যা করে চলেছে।… অসামরিক জনগণের ওপর চালানো সন্ত্রাস ও যুদ্ধর ভারতীয় রাষ্ট্রের শাসনকে আবারও জাহির করা হল যখন সবচেয়ে ভালোভাবে প্রশিক্ষিত সেনারা কর্মস্থল থেকে ট্রাকে করে বাড়ি ফেরা দীনহীন মানুষদের নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করল।… ওটিং গ্ৰামের যে নিরপরাধ জনগণ সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে জীবিকা উপার্জনে নিয়োজিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো অপরাধ করেননি, তাদের ছিন্নভিন্ন করার উদ্দেশ্যে নিজেদের যুদ্ধ লড়ার কুকুরগুলোকে লেলিয়ে দেওয়ার জন্য তার দানবীয় ও ফ্যাসিস্ত আইনগুলো সহ ভারত সরকারকেই আমরা দায়ী করছি।…” ঐ বিবৃতিতে নাগা জনগণের শান্তিকামিতাকে তুলে ধরা হয়েছে এবং পৃথিবীর কোনো শক্তিই নাগা স্পিরিটকে অবদমিত করতে পারবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

আফস্পা বিলোপের দাবি উঠেছে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিশ্বের নজরদারি সংস্থার দিক থেকেও। নিউ ইয়র্কে সদর দপ্তর চালানো এনজিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর দক্ষিণ এশিয়ার ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, “সেনাদের হাতে ১৪ জন মানুষের ভয়াবহ হত্যার তদন্ত করার যে অঙ্গীকার ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী করেছে তা নিষ্ফলাই হবে যদি না যারা দায়ী তাদের বিচার করা হয়। সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন যতদিন জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা থেকে সেনাদের সুরক্ষা যুগিয়ে যাবে, ততদিন এই ধরনের নৃশংসতা ঘটতে থাকবে।” আফস্পায় সংঘটিত অপরাধের বিচার করতে গেলে অপরাধীদের বিচারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতির প্রয়োজন এবং “যারা দোষী” তাদের বিচারের অনুমতি কেন্দ্রীয় সরকার দেবে কি না তা অমিত শাহ খোলসা করে বলেননি। আফস্পা বাতিলের দাবি সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে থেকে আফস্পা দীর্ঘদিন ধরে সেনাদের আড়াল করে এসেছে এবং ক্ষতিগ্ৰস্ত পরিবারগুলোকে ন্যায় বিচার লাভ থেকে বঞ্চিত করেছে। নাগাল্যান্ডের হত্যাকাণ্ডে এক নিরপেক্ষ অসামরিক তদন্ত যাতে হয় তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে এবং আরও অনেক জীবন রক্ষার জন্য আফস্পাকে অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।”

উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও কাশ্মীর উভয় স্থানেই বিদ্রোহ বলুন, অভ্যুত্থান বলুন বা গণ বিক্ষোভ বলুন, সবের মধ্যেই কিছু যদি নিহিত থেকে থাকে তবে তা হল আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খা। ভারতীয় রাষ্ট্র এই আকাঙ্খাকে বৈর জ্ঞান করে রাজনৈতিক বিষয়টার সামরিক সমাধানে প্রয়াসী হয়েছে। সেনা, তাদের বন্দুক ও বেয়নেটের ওপর ভর করে ভারতীয় রাষ্ট্র দেশের জনগণের এক বড় অংশের অন্তর্নিহিত ও ন্যায্য আকাঙ্খার দমনের পথকেই আরাধ্য করলেও ছয় দশক ধরে অনুসরণ করা সেই পথ শুধু গণতন্ত্র-বিরোধীই নয়, তা অকার্যকরী বলেও প্রতিপন্ন হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মদন বি লকুর ও উদয় উমেশ ললিত ২০০৮ সালের ৮ জুলাই তাঁদের এক রায়ে বলেন, “স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসাটা কখনই দীর্ঘকাল ধরে, স্থায়ীভাবে বা অনির্দিষ্টকাল ব্যাপী সেনাবাহিনী নিযুক্ত করার আবরণ হতে পারে না (বিশেষভাবে সামাজিক শৃঙ্খলা অথবা আইন শৃঙ্খলার উদ্দেশ্যে), কেননা, তা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই উপহাস করবে।…” অতএব, অসামরিক অঞ্চল থেকে সেনাদের প্রত্যাহার করে নিয়ে এবং অবিলম্বে আফস্পাকে বিদায় জানিয়ে সংশ্লিষ্ট জনগণের সঙ্গে আলোচনায় বসার সময় সমুপস্থিত। সমস্যার সমাধানে আন্তরিক হতে হলে এই পদক্ষেপই হবে একমাত্র অভিপ্রেত পথ।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-28
সংখ্যা-44