৬ ও ৭ ডিসেম্বর নদীয়ায় যুব সম্মেলন ছিল প্রাণবন্ত ও প্রতিশ্রুতিময়। দীর্ঘ লকডাউনের পর ধুবুলিয়া মুক্তমঞ্চ প্রাঙ্গনে সম্মেলনস্থলে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা প্রায় দুই শত যুব প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক ও অতিথি দুদিন ধরে খোলামেলা আলাপ আলোচনা ও পারস্পরিক আদানপ্রদানে মিলিত হন। বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণীঝড় জনিত প্রতিকুল আবহাওয়ার বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করেই নির্ধারিত সময়ে সকলে এসে পৌঁছান। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই এক উদ্দীপ্ত মিছিলে ধুবুলিয়া বাজার এলাকা পরিক্রমা করে এসে শহিদ স্মরণ কর্মসূচি দিয়ে শুরু হয় সম্মেলনের কাজ।
৬ ডিসেম্বর একই সাথে ডক্টর আম্বেদকরের প্রয়াণ দিবস ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কুখ্যাত দিন। সমগ্র সম্মেলন জুড়ে ভারতীয় গণতন্ত্রে হিন্দুত্ববাদী বিপর্যয়ের ভয়ানক বাস্তবতা ও তার বিরুদ্ধে আম্বেদকরের সতর্কীকরণ ও শিক্ষার প্রসঙ্গ বিভিন্নভাবে উঠে আসে। মুক্তমঞ্চে প্রকাশ্য অধিবেশনে সিপিআই(এমএল)'র রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার আরএসএস-এর সংকীর্ণ ও সম্প্রদায়-বিদ্বেষী ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার এই ৭৫ বছরে নতুন শক্তি নিয়ে তাকে প্রতিরোধ গড়ার ডাক দেন। অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় সভাপতি তথা বিহার বিধানসভার তরুণ বিধায়ক মনোজ মঞ্জিল দেশজুড়ে গড়ে ওঠা যুব আন্দোলন, বিশেষত কর্মসংস্থানের প্রশ্নে রাজ্যে রাজ্যে গড়ে ওঠা আন্দোলনের খবর দিয়ে পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতির দিকে আঙুল তোলেন। তিনি চাকরির প্রশ্নে রাজ্য সরকারের আচরণ তথা নিয়োগ দুর্নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং শহুরে বাহ্যিক চাকচিক্যর আড়ালে চিকিৎসা ব্যবস্থার সামগ্রিক দুর্দশার দিকে নজর টানেন। এসএসসি যুবছাত্র অধিকার মঞ্চের দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা তথা রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে বহুস্তরীয় ও গভীর দুর্নীতির এক সুস্পষ্ট ও ক্রোধ উদ্রেককারী বর্ণনা দেন মঞ্চের অন্যতম নেতা শেখ সিরাজ।
সভাকক্ষে ১৬৬ জন প্রতিনিধি ও আরও বেশ কিছু সংখ্যক পর্যবেক্ষক ও অতিথিদের উপস্থিতিতে দু’দিনের অধিবেশনে মোট পাঁচ ঘন্টা নিবিড় সময়ের আলোচনায় ৩১ জন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ দ্বারা জীবনের অবমাননার অভিজ্ঞতা ও আক্রোশ; পাড়া প্রতিবেশি বা আত্মীয়স্বজনের চিকিৎসা করাতে গিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠা; ঋণ ও ঋণমুক্তি আন্দোলনের আশা নিরাশার বাস্তবতা; রেশনকার্ডে আধার লিঙ্কে আঙুলের ছাপ মেলার বাধ্যবাধকতার ফলে গ্রামাঞ্চলে ডিজিটাল ডামাডোল, ওটিপি পেতে ফোন আর ফোনে মাসিক ৯৯ টাকা বাধ্যতামূলক রিচার্জের কর্পোরেট লুন্ঠন; বহুধরণের এককালীন তাৎক্ষণিক নিয়োগের গিগ এমপ্লয়মেন্টে নতুন সুযোগ ও নবতর শোষণ মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ; দেশজুড়ে যুব আন্দোলনের ভেতর থেকে উঠে আসা নতুন উপাদানগুলি, বিশেষত দলিত ও আদিবাসী সমাজের প্রশ্ন সংগঠনে আত্মস্থ করা; একদিকে বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী প্রচার ও অন্যদিকে টিএমসির দিক থেকে সামান্য কিছু সরকারি অনুদান দিয়ে যুবসমাজের চেতনাকে বন্ধক নিয়ে নেওয়া প্রচেষ্টা — এই দুই দিককে মোকাবিলা করে মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও রোজগারের অধিকার ঊর্ধ্বে তুলে ধরা; বামপন্থার নামে সরকারপন্থী অবক্ষয় সম্পর্কে শিক্ষিত সচেতন থাকা; সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও লড়াইএর বার্তা জোরালোভাবে যুবসমাজের মাঝে প্রচারে নিয়ে যাওয়া; সমাজের সবার লড়াইই যুবদের লড়াই; সমাজ বদলের লড়াইএর মধ্যেই আছে নব প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ঠিকানা; – এই সমস্ত বিষয় ও দিক থেকে সমৃদ্ধ আলোচনা, পরামর্শ ও প্রস্তাব উঠে আসে। শ্রমিক তথা যুব আন্দোলনের কর্মী রাজা ওরফে শেখ সাবিরের গাওয়া গানগুলি সম্মেলনের গভীরে আত্মবিশ্বাস ও অঙ্গীকার সঞ্চারিত করে দেয়। সম্মেলন ৩৯ জনের রাজ্য পরিষদ নির্বাচিত করে। নবনির্বাচিত পরিষদ ১৭ জনের কার্যনির্বাহী পরিষদ ও ৭ জনের সম্পাদকমণ্ডলী গঠন করে এবং রণজয় সেনগুপ্তকে সম্পাদক ও সজল দে’কে সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করে। দ্রুত বিকাশমান নতুন পরিস্থিতিতে রাজ্যে সম্ভাবনাময় যুব আন্দোলনে সংগঠনকে ব্যাপক গণভিত্তির মাঝে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়ে ষষ্ঠ সম্মেলন সম্পন্ন হয়।