মমতা সরকার ঘোষণা করেছে ‘পাড়ায় সমাধান’ কর্মসূচি। তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে ভোটকুশলীবিদ প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শে প্রথমে ‘দিদিকে বলো’ চ্যানেল নামানো দিয়ে শুরু, তারপর থেকে সেই ধাঁচেই সরাসরি সুবিধাপ্রকল্প বন্টণে নামানো হয়েছে ‘দুয়ারে সরকার’, ‘দুয়ারে রেশন’। এর নবতর সংযোজন হিসেবে কর্মসূচি নামানো হয়েছে ‘পাড়ায় সমাধান’। এই ধ্বনি তোলার মাধ্যমে মানুষকে আকর্ষণ করার এক অভিনব রূপ থাকতে পারে, কিন্তু প্রকল্পসুবিধা কার্যত কতটা নেমেছে, মানুষ তার কেমন হদিশ পাচ্ছে, তাতে উপকৃত হচ্ছে, আর কী পরিমাণ ছলনা-বঞ্চনা চলছে, সবকিছু মেপে পর্যালোচনা চালিয়ে যাওয়া দরকার। ‘দিদিকে বলো’, ‘দুয়ারে সরকার’ সুযোগ থেকে উপশম পাওয়া-না পাওয়া জনিত মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে সরকার তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরার পরে ‘দিদিকে বলো’ গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে, ‘দুয়ারে সরকার’কে একরকম ঝিমিয়ে রাখা হয়েছে। ‘দুয়ারে রেশন’ এখনও টুকটাক চালু হয়েছে মাত্র, তার পরিকাঠামো থেকে শুরু করে পরিচালন ব্যবস্থায় বলতে গেলে কোনও গতিই তৈরি করা হয়নি। ‘পাড়ায় সমাধান’ প্রকল্প নিয়ে সরকারের মতিগতি কী, পরিস্কার নয়। প্রকল্পটি প্রণয়নের পেছনে দুর্নীতির কারণে ভালোরকম চাপে পড়ার পরিঘটনা ভুলিয়ে দেওয়া যাবে না। বিশেষ করে আমপান ক্ষতিপূরণের টাকা দেদার আত্মসাৎ করেছিল শাসকদলের পঞ্চায়েতের ‘দাদা-কাকা-মামা’রা। গোড়ায় তা মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করতে চাননি, চেয়েছিলেন ভেতরে ভেতরে ম্যানেজ করে দুর্নীতি চাপা দিতে। পরে বঞ্চিত মানুষের গণক্ষোভ নাছোড় হয়ে পঞ্চায়েত মোড়লদের বাড়ি বাড়ি ঘেরাও করলে সরকার ও শাসকদলের টনক নড়ে। তখন মুখ বাঁচাতে ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে ফতোয়া দেওয়া হয়, ঘুঘুরাও অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য হন। তবে সব টাকা যে উদ্ধার হয়েছে তা সরকার হলফ করে বলতে পারেনি, সমস্ত হিসাব-কিতাব করে তেমন কোনো শ্বেতপত্র প্রকাশ করেনি। দুর্নীতির অভিযোগের তাড়া খাওয়া থেকে সরকার ও তৃণমূল কখনই নিস্কৃতি পায়নি। ভাবমূর্তিতে লেপা কালি তুলতে অগত্যা ধূর্ত কৌশলের আশ্রয় নিতে মুখ্যমন্ত্রী শুনিয়েছিলেন আবার এক চমকের ভিন্ন সুর। বলেছিলেন সুবিধাপ্রকল্প বণ্টন পঞ্চায়েতের মাধ্যমে না করে সরাসরি ব্লক প্রশাসনের মাধ্যমে করার কথা। উপর্যূপরি কী সব স্ববিরোধী অবস্থান গ্রহণের প্রহসন! ২০১৮-র নির্বাচনে ব্যাপক সন্ত্রাস চাালিয়ে যে পঞ্চায়েতরাজের দখল হাসিল করেছিল তৃণমূল, সেই পঞ্চায়েতের এক বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দূর্যোগের পরিস্থিতিতে পুনরায় উন্মোচিত হয় ন্যক্কারজনক দুর্নীতিগ্রস্ত চেহারা। তার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা জনপ্রতিক্রিয়ার চাপ সামাল দিতে ঘোষণা করতে হয়েছিল সুবিধাপ্রকল্প বণ্টনের পরিচালন-ক্ষমতা থেকে পঞ্চায়েতকে বিরত রাখা, পরিবর্তে সেই কাজ কেবলমাত্র ব্লক প্রশাসন দিয়ে সারার কথা। গৃহীত এই কৌশলের মধ্যে আসলে উদ্দেশ্য ছিল পঞ্চায়েতকে তথাকথিত নিয়ন্ত্রণে রাখার বহিরঙ্গ দেখিয়ে অন্যদিকে সরকার বহির্ভূত কোনরকম গণতদারকি অনুমোদন না করা। এখন আবার ‘পাড়ায় সমাধান’ প্রকল্প নামানোর বেলায় পঞ্চায়েতকে সামনে আনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ খুব ভালো কাজ করছে! এত চটজলদি ভালো কাজের প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়ার কারণ কি! আসলে ভাবাচ্ছে অন্য কারণ অন্য উদ্দেশ্য। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কয়েক কোটি করে টাকা আসবে পঞ্চায়েতে। আর, পরবর্তী পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ার কথা দুু'বছর বাদে।
প্রশ্ন হল, ‘পাড়ায় সমাধান’ হবে কোন পথে? প্রশাসন-পঞ্চায়েতের আমলাতান্ত্রিক ছড়ি ঘোড়ানো ছকে দেওয়া পথে? যাতে উপরন্তু থাকে শাসকদলের উপদ্রব। এর বিপরীতে প্রকৃত সমাধানের একমাত্র চাবিকাঠি হল গণতান্ত্রিক পথ ও প্রক্রিয়া। যার ভিত্তি হল বহুমতের অধিকার, পঞ্চায়েত-প্রশাসন ও শাসকদলের মাতব্বরির বাইরে বিভিন্ন দলের-মতের ও সামাজিক শক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ মত প্রকাশের অধিকার। বিশেষ করে গরিব মানুষদের অধিকার, ন্যায়সঙ্গত যুক্তিপূর্ণ হস্তক্ষেপের অধিকার। দুর্নীতি-দলতন্ত্রে নিমজ্জিতরা তাদের আখের গোছানোর জমি ছাড়বে না। তাই ‘পাড়ায় সমাধান’ নির্ধারিত হওয়ার বিষয়টি পাল্টা হস্তক্ষেপ সংগঠিত করার দাবি রাখে। শাসকপক্ষের স্বজনপোষণ চোখরাঙানো খবরদারি গাজোয়ারির বিরুদ্ধে, জনগণের সপক্ষে, গণতান্ত্রিক স্বার্থে।