ধানকাটার মরশুমের মধ্যপর্বে উপর্যুপরি বৃষ্টিপাতে যে অভূতপূর্ব বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তারফলে চাষিরা অনেকেই পাকা ধান খামারে তুলতে পারেননি এবং আলু চাষের অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে। বহু কষ্ট করে চাষিরা যে জমিতে আলু বসিয়েছিলেন সে সবই সম্পূর্ণত নষ্ট হয়ে গেছে। হুগলী ও পূর্ব বর্ধমানে আলুই হল প্রধান অর্থকরী ফসল। যেকোনও মূল্যে কৃষকদের এই ফসলের আবাদ করতেই হবে। নতুন করে আবার কীভাবে চাষ করা যাবে সেই চিন্তায় ঋণগ্রস্ত চাষিদের রাতের ঘুম চলে গেছে। কৃষকদের এই মহাদুর্দিনে, কৃষিঋণ মকুবের দাবিতে সারা ভারত কিষাণ মহাসভার পান্ডুয়া ব্লক কমিটি গত ২৬ ডিসেম্বর বৈঁচিতে এক গণকনভেনশন সংগঠিত করে। কনভেনশনে উত্থাপিত প্রস্তাবনায় বলা হয়, “সমবায় সমিতি বা ব্যাঙ্ক কর্তৃক প্রদত্ত সমস্ত কৃষিঋণ যদি মকুব করা হয় তাহলে এই ভয়াবহ সঙ্কট থেকে কৃষকরা, কিছুটা হলেও, রেহাই পেতে পারেন। বলা বাহুল্য, কৃষকদের এক বড় অংশই ভাগচাষি বা ঠিকাচাষি। নিজস্ব কোনও জমি না থাকায় সরকারি/প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ থেকে তাঁরা বঞ্চিত। সে কারণে তাঁদের ক্ষতিপূরণে সরকারকে নগদ অর্থ সাহায্যে উদ্যোগী হতে হবে। এরই সাথে সাথে অভাবি বিক্রি রোধের জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সরকারকে সহজ ও মসৃণ পদ্ধতিতে ধান সংগ্রহ করতে হবে।” কনভেনশনের প্রস্তাবে সরকারের নিকট সুনির্দিষ্ট দাবি জানানো হয়।
১) অবিলম্বে সমস্ত কৃষিঋণ মকুব করতে হবে। নিজস্ব জমি নেই এমন গরিব চাষি — যারা ঠিকা বা অন্য প্রথায় চাষ করেছেন তাদেরও (শস্যহানির জন্য) আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে হবে।
২) বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত আলু ও ধান সহ সমস্ত ফসলের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩) ন্যায্যমূল্যে সার ও বীজ সরবরাহে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৪) প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে সরকারি উদ্যোগে, কমপক্ষে একটি করে ধান সংগ্রহের স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে এবং সরকারি উদ্যোগে ধান সংগ্রহে হয়রানিমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।
কনভেনশনের মূল প্রস্তাবের সমর্থনে বক্তব্য রাখার সময় বক্তারা প্রত্যেকেই দিল্লীর ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে আনেন এবং বলেন, এরাজ্যেও কৃষক সমস্যার প্রতি নির্বিকার যে রাজ্য সরকার তার বিরুদ্ধেও ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়পণ সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন আয়ারলা’র হুগলী জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন বাগ, কিষাণ মহাসভার (এআইকেএম) রাজ্য যুগ্ম-সম্পাদক তপন বটব্যাল, সারা ভারত কিষাণ সভার পান্ডুয়া ব্লক সভাপতি গোপাল হেমরম ও সঞ্জীব ব্যানার্জী এবং খেতমজুর ইউনিয়নের সুভাষ ক্ষেত্রপাল।
কনভেনশনের মূল প্রস্তাবের পাশাপাশি অপর এক প্রস্তাবে দেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্পে পরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নকে লঙ্ঘন করে ও ২০১৩’র সংশ্লিষ্ট আইনকে পাশ কাটিয়ে, গ্রামবাসীদের সম্মতি ছাড়াই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে দেওয়ানগঞ্জে প্রতিবাদী মহিলাদের ওপর পুলিশী বর্বরতার নিন্দা জানানো হয় এবং প্রকল্প এলাকার সংগ্রামী জনগণের ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি সহমর্মীতা জ্ঞাপন করা হয়। ভালো সংখ্যক কৃষক ও কৃষিজীবী মানুষের উপস্থিতিতে এই কনভেনশনের শুরুতে ‘হরাল আদিবাসী গাঁওতা’র শিল্পীদের পরিবেশিত লোকনৃত্য কনভেনশনকে আকর্ষণীয় করে তোলে। এছাড়া গণসংস্কৃতি পরিষদের ‘সংযোগ সাংস্কৃতিক সংস্থা’র শিল্পীদের গণসঙ্গীত ছিল কনভেনশনের সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই। সবশেষে কনভেনশন মঞ্চ থেকে, মূল দাবিগুলির সপক্ষে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে নতুন বছরের শুরুতে ডিএম ডেপুটেশনের কর্মসূচি ঘোষিত হয়।