লোকসভায় নির্বাচন আইন (সংশোধনী) বিল ২০২১’র পাশ করানোটা ভারতের গণতন্ত্রের ধ্বংস সাধনের লক্ষ্যে এক বিপজ্জনক পদক্ষেপ। এই প্রস্তাবিত সংশোধনীটি ভোটাধিকারের সাথে আধার যাচাইয়ের সংযুক্তির পক্ষে। অনেকজন বিরোধী সাংসদের দাবি ছিল এই বিলটিকে একটি সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানোর, যে কমিটি এর প্রয়োগ সম্পর্কে পর্যালোচনা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারতো। কিন্তু বিরোধীদের এই দাবিকে ধামাচাপা দিয়ে অন্যান্য অনেক জনবিরোধী আইনের মতোই এই বিলটাকেও লোকসভায় ধ্বনি ভোটে পাশ করিয়ে যাবতীয় আপত্তিকে উড়িয়ে দেওয়া হল।
২০১৭-তে ঐতিহাসিক সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ে বলা হয় যে গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার — ভারত সরকার এই আধার সংযোগের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেই অধিকারকেই নাকচ করে দিচ্ছে। ২০১৮-তে শীর্ষ আদালত আধারের সাংবিধানিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরে এবং এর ব্যবহারকে কেবল রাষ্ট্রচালিত কল্যাণমূলক কর্মসূচির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ করে। ভোটার আইডি’র সঙ্গে আধার সংযোগের লক্ষ্যে ভোটার তালিকা সংশোধন ও যাচাইয়ের উপর ২০১৫-তে শীর্ষ আদালতেরই জারি করা একটি স্থগিতাদেশের কথাও আদালত ২০১৮-তে তুলে ধরে। ঐবছরেই তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশিকা লঙ্ঘন করে ভোটার পরিচয়পত্রের সঙ্গে আধার সংযোগ করায় — ফলে অন্ততপক্ষে ৫৫ লক্ষ ভোটারের নাম যথেচ্ছভাবে ভোটার তালিকা থেকে মুছে যায়।
ইতিমধ্যেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আধার সংযোগের ফলে গণবণ্টন ও কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের সুযোগসুবিধা থেকে গণহারে প্রচুর দরিদ্র ও অভাবী মানুষ বাদ পড়ে গিয়েছেন যার পরিণতিতে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা অবধি ঘটেছে। আধার সংযোগ তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে বিপুল সংখ্যক ভোটারকে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। উপরন্তু এটাও স্পষ্ট যে এই আধার ভোটার পরিচয়ের সাথে মোবাইল ফোন ও তার মারফত সোশ্যাল মিডিয়ারও সংযোগ করবে যা অনিবার্যভাবেই ভোটারের সামাজিক অবস্থান ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সহ অন্যান্য বিষয়কে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েই তার প্রোফাইল তৈরিতে সাহায্য করবে। এরফলে ভোটার তালিকায় শাসকের পছন্দ-অপছন্দ অনুসারে কারচুপির বা নাম মুছে ফেলার অবকাশও তৈরি হবে। এই পদক্ষেপ সমস্ত ভোটারকে শাসকদলের দয়াদাক্ষিণ্য বা ক্ষমাপ্রার্থী করে তোলার দিকেই এগোবে যেহেতু শাসকদলের হাতে আধার মারফত কল্যাণমূলক প্রকল্প ও ভোটাধিকার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ থাকবে।
আধার সংযোগ বিষয়টি নাকি ‘ঐচ্ছিক’ — এতকিছুর পরেও সরকারের এই দাবিটা কার্যত বিভ্রান্তিকর। ভোটদানের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণ এটাকে তো বাধ্যতামূলকই করে তুলবে, যেভাবে সামাজিক প্রকল্পের সঙ্গে এর সংযুক্তিকরণ শেষবিচারে বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধার নাকি তথ্যভিত্তিকে ‘পরিশোধন’ করে — এই দাবিটাও অবান্তর কারণ যেহেতু আধার ডেটাবেসের মধ্যেই মনুষ্যসৃষ্ট বহু ত্রুটি এমনকি ভুয়ো তথ্যের প্রমাণ রয়েছে, যা ভোটার তালিকায় থাকা অসঙ্গতির থেকেও বেশি।
আধার নাগরিকত্বের কোনো প্রামাণ্য নথি নয়। তাই ভোটদানের সঙ্গে এর সংযুক্তিকরণ গণতন্ত্রের জন্য একটা বড় ধাক্কা। সুতরাং গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরার লক্ষ্যে এই দাঁত, নখ বের করা পদক্ষেপকে যেকোনো মূল্যে আটকাতেই হবে। আধার বাতিল করার দাবি তুলুন! ভোটদানের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণের উদ্যোগকে মুখের উপর নাকচ করে দিন!
- সিপিআই (এম-এল) কেন্দ্রীয় কমিটি