দীর্ঘদিন পর চিলিতে ক্ষমতায় ফিরলেন বামপন্থীরা। সত্তর দশক থেকে অধিকাংশ সময়ে চিলিতে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী সরকারের শাসন চলেছে। সেই দিক থেকে এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং বাম জোট প্রার্থীর জয়ের ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। এই তাৎপর্য ভালোভাবে বুঝতে আমাদের একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে।
সেটা ছিল ১৯৭৩ সাল। চিলিতে তখন রাষ্ট্রপতির আসনে জনপ্রিয় বামপন্থী নেতা সালভাদর আলেন্দে। কিউবায় এক দশকের বেশি হয়ে গেছে ফিদেল কাস্ত্রোর সরকারের স্থায়িত্ব। নিকারাগুয়া সহ লাতিন আমেরিকার নানা দেশে চলছে বিপ্লবীদের লড়াই। দুনিয়া জুড়ে রয়েছে ঠান্ডাযুদ্ধের আবহ। নানা দেশে সোভিয়েত আনুগত্যের ভূত দেখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অপছন্দের সরকারগুলিকে ছলে বলে কৌশলে সরিয়ে দিতে মরীয়া সিআইএ’র গোয়েন্দা বিভাগ। এর পেছনে তারা ব্যয় করছিল কোটি কোটি ডলার। চিলিতেও তাই করল তারা। এক ‘মিলিটারি ক্যু’র মাধ্যমে আলেন্দেকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসায় পিনোচেতকে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত চলে চিলিতে পিনোচেতের স্বৈরশাসন। বদলে ফেলা হয় সংবিধান। মিলটন ফ্রিডম্যানের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দিয়ে তৈরি করা হয় চিলির নয়া আর্থিক নীতির নকশা। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের জায়গাগুলোকে ধ্বংস করে নয়া উদারনীতিমালাকে বরণ করে নেওয়া হয়।
১৯৯০-এ পিনোচেত জমানার অবসানের পর কেটে গেছে আরো তিরিশ বছর। এক কোটি নব্বই লক্ষ মানুষের দেশ চিলিতে সেই জমানার রেশ মুছে যায়নি। সংবিধানে কিছু কিছু বদল এসেছে, কিন্তু মূল কাঠামোটা তেমন বদলায়নি। আর্থিক নীতিমালাও পিনোচেত জমানার থেকে তেমন কিছু সরে আসেনি। দেশজুড়ে চূড়ান্ত বৈষম্য সেখানে।
এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিল চিলির বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে মুখোমুখি লড়াই। দক্ষিণপন্থী প্রার্থী ছিলেন হোসে আন্তোনিও কাস্ত। তাঁর দাদা মিগুয়েল ছিলেন পিনোচেতের অন্যতম সহযোগী আর বাবা ছিলেন জার্মান নাৎসি দলের সদস্য। কাস্ত তাঁর নির্বাচনী প্রচারে পিনোচেত জমানার উদারনৈতিক নীতিমালার পক্ষেই ওকালতি করেন। কাস্ত’র সমর্থনে ছিল ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ফ্রন্ট, ক্রিশ্চিয়ান কনজারভেটিভ পার্টি।
বামপন্থী জোটের প্রার্থী ছিলেন ৩৫ বছরের তরুণ প্রাক্তন ছাত্রনেতা গ্যাব্রিয়েল বোরিক। এই বাম জোটের শরিক ছিল চিলির কমিউনিস্ট পার্টিও। এছাড়া এর অন্যান্য শরিকদের মধ্যে ছিল সোশ্যাল কনভারজেন্স, সোশ্যাল গ্রিন রিজিওনালিস্ট ফেডারেশান, ডেমোক্রেটিক রিভোলিউশন, হিউম্যানিস্ট অ্যাকশান প্রমুখ দল। বোরিক তাঁর প্রচারে নিওলিবারাল অর্থনীতির বিরুদ্ধে প্রচার করেন এবং অতি ধনীদের ওপর বেশি করে কর বসানোর কথা বলেন। নির্বাচনের ফল বেরনোর পর দেখা গেল কাস্ত পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ ভোট। আর বারো শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে তাঁকে পরাস্ত করেছেন বোরিক।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তীব্র অসাম্যর অবসানের আশায় বোরিককে তাঁরা ভোট দিয়েছে — এরকম প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমের তরফে নেওয়া সাক্ষাৎকারগুলিতে। পেনশন প্রকল্প বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষাও তাঁরা ব্যক্ত করেছেন।
চিলির সংবিধান ও নিওলিবারাল নীতিমালাকে কতটা বদলাতে পারবে বাম শাসনের এই অধ্যায় তা আগামীদিনে দেখা যাবে। তবে রাষ্ট্রপতি পদে বিজয়ী হবার পরেই যে কটি দৃঢ় মত বোরিক প্রকাশ করেছেন, তাতে চিলিতে বড় ধরনের রদবদলের সম্ভাবনা প্রবল। পরিবেশ ধ্বংস করে খনি প্রকল্পর বিরুদ্ধে বোরিক বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছেন। চিলি গোটা বিশ্বে তামার সবচেয়ে বড় উৎপাদক এবং নতুন করে ২৫০ কোটি ডলারের খনি প্রকল্প সেখানে চালু করার কথাবার্তা চলছে। এর বিরুদ্ধে বোরিকের দৃঢ় অবস্থান বুঝিয়ে দেয় প্রচলিত উন্নয়ন মডেলকে প্রশ্ন করা, পরিবেশচেতনা ও সমতার আদর্শ তাঁর জমানাকে ঘিরে থাকবে।
চিলিতে খনি বিরোধী এইসমস্ত কথাবার্তা যখন চলছে, তখন বীরভূমে দেউচা-পাঁচামী কয়লাখনি প্রকল্প নিয়ে বিক্ষোভ ও সংশয় ক্রমশ দানা বাঁধছে। কেন কয়লাখনি ও তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশ ও সভ্যতার সঙ্কট তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে নানা জায়গায়। চিলিতে বাম বিজয়ের বার্তা এদেশের সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে যেমন উৎসাহ জোগাবে, তেমনি বিজয়ী রাষ্ট্রপতির খনি বিরোধী দৃঢ় অবস্থান নির্দিষ্টভাবে শক্তি দেবে দেউচা-পাঁচামী খনি প্রকল্পর বিরোধীদের।
- সৌভিক ঘোষাল