উত্তরপ্রদেশের 'সিট' (বিশেষ তদন্তকারী দল) অনুসন্ধান চালিয়ে অবশেষে আদালতকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আসলে কী ঘটেছিল! লখিমপুর-খেরীতে যা সংঘটিত হয়েছিল সেটা পূর্ব পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র অনুসারেই। গত তেসরা অক্টোবর সেখানে জমায়েত ছিল পণ করা সংগ্রামী কৃষকদের। মুখ্যত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার ও ফসলের দামে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে। রয়েছে আরও কিছু শ্রেণীগত ও গণতান্ত্রিক দাবিও। ওই জমায়েত বানচাল করতেই ভীড় জনতার ওপর গাড়ি চালিয়ে দেওয়া হয়। তাতে চাপা পড়ে মারা যান এক সাংবাদিক সহ চার কৃষক। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জমায়েতের কৃষক জনতা, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা, দেশজুড়ে গণতান্ত্রিক শক্তি ও বিবেকবান মহল। প্রত্যক্ষদর্শীদের দৌলতে জ্বলন্ত দাবি ওঠে, ওই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলে আশিস মিশ্র ও তার খুনে মাফিয়া দলবলই, অতএব তাদের গ্রেপ্তার করে, বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। এরা সব বিজেপির। একইসঙ্গে জোর দাবি ওঠে, কেন্দ্রের মন্ত্রর থেকে অজয় মিশ্রের অবিলম্বে পদত্যাগ চাই, নয়ত বরখাস্ত। আশিসকে ‘নির্দোষ’ দাবি করতে অজয় অজেয় হওয়ার প্রচুর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই কসরত কোনও ফল দেয়নি। বিপরীতে, দাবি আদায়ে নাছোড় জনতার প্রশ্নাঘাত যোগী-মোদী সরকারকে হ্যাঁচকা টান দেয়। প্রথম কদিন বহু বাহানা দেখানোর পর যোগী সরকার বাধ্য হয় কিছুটা স্বর ঝোঁকাতে, দাবিগুচ্ছের একাংশ মেনে নিতে। যোগীর পুলিশ অগত্যা বাধ্য হয় অভিযুক্ত মোট তেরজন সমেত আশিসকে গ্রেপ্তার করে বিচারাধীন হেফাজতে ঢোকাতে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত লাগু করা হয়েছিল অনেক লঘু অভিযোগ। ঘটনা ঘটে গেছে নাকি নিতান্তই অসাবধানতাবশত! মামলায় প্রথমে যুক্ত করা হয়েছিল ফৌজদারী আইনের অপেক্ষাকৃত কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ ধারা। অন্যদিকে ‘শ্রীঘরে’ স্থান হওয়া তেরজনের একজনকে দিয়ে পাল্টা এফ আই করা হয় কৃষকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু চাতুরি করে পার পাওয়া যায়নি। ইতিমধ্যে মামলা গড়ায় রাজ্যের আদালত ছাড়িয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দেয় বিশেষ তদন্তের। সেই মোতাবেক যোগী সরকার বাধ্য হয় ‘সিট’ গঠন করতে। কারণ, রয়েছে উপর্যূপরি চাপ — ন্যায়বিচারের দাবিতে কৃষক জনতার মায় বৃহত্তর গণপরিসরের আর উত্তরপ্রদেশে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের। উভয় চাপের মুখে মুখ্যমন্ত্রী যোগী প্রথমে গররাজি হলেও অগত্যা পদক্ষেপ করেন ‘সিট’-তদন্তের। সেখানেও শয়তানি ছিল পেটোয়া অফিসারদের নিয়ে দল গঠনের, তদন্ত রিপোর্টে যাতে বিজেপির অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভেস্তে দেওয়া যায়। তবে সেই অভিলাষ বানচাল হয়ে যায় সুপ্রীম কোর্টের হস্তক্ষেপে।সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের দেওয়া শর্তে তদন্ত দল ফের ঢেলে সাজানো হয়। উত্তরপ্রদেশ ক্যাডারের হলেও ওই রাজ্যের বাসিন্দা নয় এমন অফিসারদের নিয়ে তদন্ত দল তৈরি হয়। তার ফলে তদন্ত রিপোর্টে অন্তত এই সার সত্য বেরিয়ে এসেছে যে, ভয়ঙ্করভাবে হতাহত সংঘটিত করা হয়েছিল পরিকল্পনা করেই। আর, মামলায় নতুন করে জোড়া হয় ফৌজদারী আইনের কিছু গুরুতর ধারা। তবে তদন্ত রিপোর্ট উদঘাটিত করেছে এক শিলাখন্ডকে মাত্র, এখনও বাকি রয়েছে গোপন ছক কষার মধ্যে আরও কী মাথাচক্র কাজ করেছে তার সনাক্তকরণ।
এবার অভিযুক্ত খুনীদেরকে বাঁচাবে! যোগী সরকার কি বলবে, কি করবে? কথায় আছে, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। এবার খুনী-পুত্রের মন্ত্রী-পিতা কি জবাব দেবেন? তাঁর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের দাবির কি হবে? তিনি কি পদত্যাগ করবেন? মন্ত্রী অজয়ের ওপর থেকে প্রধানমন্ত্রীর অভয়দানের হাত কি সরবে? বেকারির দূর্দশায়, হিন্দুত্ব-জাতিবাদী-বর্ণবাদী ও লিঙ্গগত উৎপীড়নে সারা ভারতে সবচেয়ে কুখ্যাতি কুড়িয়েছে যোগী রাজত্ব। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্ট আরও কী বলছে? গত তিন বছরে কুখ্যাত ইউএপিএ-তে উত্তরপ্রদেশে যত গ্রেপ্তার হয়েছে তার সত্তর শতাংশ ত্রিশ বছরের নিচের। এ তথ্যতে-রাত্তির আগে লোকসভায় জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অনুজ মন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই, তবে আগ বাড়িয়ে নয়, প্রশ্নোত্তরের ঠ্যালায়। এসব হল একটা যুব প্রজন্মকে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা লাগিয়ে দিয়ে কারাবন্দী করে রাখার অপচেষ্টা, এক নারকীয় রাজত্বকে প্রতিবাদবিহীন করে তোলার নজীর। লখিমপুর-খেরীর হত্যালীলা ঘটেছে শাসনের এই চূড়ান্ত অমানবিক হাওয়াতেই। স্বভাবতই প্রসঙ্গত যে দাবিসব উঠেছে, আন্দোলনের যে গুরুত্ব রয়েছে তা জারী রাখতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে লখিমপুর-খেরীর খুনি আর নেপথ্যে থাকা মুনিদের রেহাই দেওয়া চলবে না।