গত ২৪ নভেম্বর জাতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও নীতি-আয়োগের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত হল পঞ্চম জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা (এনএফএইচএস) ২০২০-২১ সালের রিপোর্ট। এই রিপোর্টে জনসংখ্যা, প্রজনন ও শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার কল্যাণের মত সূচকের উপর সংগৃহীত তথ্যকে সামনে রেখে উল্লিখিত সরকারি মন্ত্রণালয়গুলি দাবি করছে যে ইউএন নির্দেশিত সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ওরফে এসডিজি-র লক্ষ্যে ভারত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত জুড়ে মোট ৭০৭টি জেলা স্তরে ৭,২৪,১১৫ জন মহিলা ও ১,০১,৮৩৯ জন পুরুষের সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে এই রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। মোট ১৩১টি সূচকের উপর বিভিন্ন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
২০২১ সালে প্রকাশিত জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মহিলাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের নিরিখে ১৫৬টি দেশের মধ্যে ভারত ১৪০ তম স্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে খারাপ ফল করা তিনটি দেশের মধ্যে একটি ভারত। বাকী দুটি পাকিস্তান ও আফগানিস্থান। বিশ্ব অর্থনৈতিক মঞ্চের পরিচালিত রিপোর্টের স্বাস্থ্য বিষয়ক সূচক অনুযায়ী ভারতের র্যাংক ১৫৬টি দেশের মধ্যে ১৫৫ স্থানে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, মহামারী চলাকালীন ভারতের মেয়েদের কাজে অংশগ্রহণের হার সংকটজনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ১৫ জন মহিলা বাইরে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। মেয়েদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্বাধীকারের বিষয়ে সংগঠিত সমীক্ষা, গবেষণাগুলি থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বিজেপি চালিত কেন্দ্রীয় সরকারকে দেশের ভিতরে ও বাইরে চাপে ফেলে দেয়। কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের নারীদের ক্ষমতায়ন, স্বায়ত্ব ও গতিশীলতার প্রমাণ হিসাবে পঞ্চম এনএফএইচএস সমীক্ষা রিপোর্টের নির্দিষ্ট কিছু পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি-আকর্ষণ করতে চাইছে।
এই রিপোর্ট দাবি করছে যে, মেয়েদের সন্তান প্রসবের হার আগের থেকে কমেছে। অর্থাৎ সন্তান-ধারণের ভার থেকে মেয়েরা মুক্ত হচ্ছেন। ৭০ শতাংশের বেশি মহিলার ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। অর্থাৎ মেয়েদের অর্থনৈতিক সচেতনতা গড়ে উঠছে। প্রসূতি মায়েরা আগের থেকে অনেক বেশি সংখায় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা পরিষেবা নিতে যাচ্ছেন এবং অস্ত্রোপচার করে সন্তান জন্ম দেওয়ার হার বেড়েছে আগের থেকে। হন। সিজারিয়ানের অস্বাভাবিক সংখ্যাবৃদ্ধি বা ব্যাংক-একাউন্ট ব্যবহারকারী মহিলাদের ভাবমূর্তি দিয়েও কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের মেয়েদের দুর্দশার আসল ছবিকে চাপা দিতে পারছে কী?
আলোচ্য রিপোর্ট বলছে, এই বর্ধিত সিজারিয়ান অস্ত্রোপাচারের ৪৭ শতাংশ লক্ষ্য করা গেছে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রে। অন্যদিকে সরকারি স্বাস্থ্য-কেন্দ্রে ১৪ শতাংশ সন্তান প্রসবে অস্ত্রোপচার ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে, পরিবার-পিছু সন্তানের সংখ্যা কমলেও, পরিবার প্ল্যানিং-এ পুরুষের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবেই কম। মেয়েদের মধ্যেই কন্ট্রাসেপ্টিভ বা নিরোধের ব্যবহার বেড়েছে। এখনো বেশিরভাগ পুরুষ নিরোধ ব্যবহারে অনিচ্ছুক। এখনো গড়ে ৫৮ থেকে ৬৭ শতাংশ শিশু, ৫৩ থেকে ৫৭ শতাংশ মহিলা ও ২২ থেকে ২৫ শতাংশ পুরুষ রক্তাল্পতার শিকার। ব্যাংক-একাউন্ট মহিলাদের নামে তৈরি হলেও বেশিরভাগ পরিবারের পুরুষদের হাতেই থাকছে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের রাশ।
এনএফএইচএস-৫ রিপোর্টের প্রথম দফার তথ্য থেকে জানা গিয়েছিল ১৮-৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে ৩০ শতাংশের বেশি মেয়েরা গৃহ-হিংসার শিকার। মহামারীতে গৃহ-হিংসার মাত্রা বেড়েছে। পরিবারের অবাধ্য হওয়া, বাচ্চার যত্নে ঘাটতি, ‘স্বামী’র অনুমতি ছাড়া ঘরের বাইরে পা রাখা, যৌনতায় রাজি না হওয়া, মনপসন্দ রান্না না করতে পারা, স্বামীর মনে সন্দেহ তৈরি করা — মূলত এই কারণ গুলির উপর ভিত্তি করে পুরুষদের পাশাপাশি ৫২ শতাংশ মহিলারা গৃহ-হিংসাকে ন্যায্য মনে করেন। দেখা গেছে, মেয়েদের গায়ে সবচেয়ে বেশি হাত ওঠে পরিবারের কাজ না করতে পারা ও পরিবারের অবাধ্যতার জন্য।
সম্প্রতি জাতীয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দশম শ্রেণীর পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে — আজকের যুগের মহিলারা পরিবারে পুরুষের কর্ত্বত্ব মেনে নিয়ে, ঘরের কাজে সময় দিয়ে পরিবারের নিয়ম ও গতানুগতিকতা ভাঙ্গছেন বলেই বাচ্চা ও গৃহ-কর্মীদের আয়ত্বে রাখা কঠিন হয়ে উঠেছে। নারীবাদ বিবাহিত মেয়েদের স্বায়ত্তের ইচ্ছাকে জাগিয়ে তুলেছে বলেই পরিবারের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ছে। প্রবল প্রতিবাদের মুখে পড়ে এই প্রবন্ধ সংক্রান্ত প্রশ্ন বাতিল করার কথা ঘোষণা করলেও, প্রশ্নপত্র তৈরি করা, মূল্যায়ন ও অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা শিক্ষক ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। মনে রাখতে হবে সবটাই হয়েছে জাতীয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নজরদারিতে। অর্থাৎ, মনুবাদী বিজেপির প্রত্যক্ষ্য প্ররোচনায় বিদ্যালয় স্তর থেকেই পাঠ চলছে পরিবারবাদের, যেখানে সমাজের ক্ষুদ্রতম ইউনিট হিসাবে পরিবারের শাসন চালাবে পুরুষ, নারী, শিশু ও গৃহ-কর্মীরা থাকবেন পুরুষের অধীনে। সাম্প্রতিক লোকসভা মহিলা উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকার বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও প্রকল্পে অনুমোদিত ৪৪৭ কোটির টাকার প্রায় ৮০ শতাংশ টাকা ব্যয় করেছে বিজ্ঞাপনী প্রচারে। অন্যদিকে, সরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, কলেজ, ইউনিভার্সিটি থেকে লিঙ্গ-সচেতনতা বিষয়ক পাঠ্যক্রমগুলির (যেমন মানবী-বিদ্যা, জেন্ডার স্টাডিস) তহবিল ও শিক্ষার্থী আসন কমিয়ে নারীবাদ চর্চা বা লিঙ্গ-সংবেদনশীল জ্ঞান তৈরির পরিসরগুলিকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বদলে, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিসহ অন্যান্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে গৃহ-কর্মের উপর পাঠ্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
বর্তমানে ভারতে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বায়ত্তের সংকটের সাথে মোকাবিলা করতে হলে লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজন। কিন্তু ভারতের মসনদে বসে থাকা ফ্যাসিবাদের তল্পিবাহকদের স্বার্থ নারী-মুক্তির পরিপন্থী। সমাজের পিছিয়ে পড়া, অসংবেদনশীল মানসিকতাকে হাওয়া দিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে ফ্যাসিবাদ। নারীর সমানাধিকারের লক্ষ্যে, ভারতকে নতুন দিশায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে ঘরের ভিতরে ও বাইরে ফ্যাসিবাদ ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব হওয়া জরুরি।
- সম্প্রীতি মুখার্জী