সম্প্রতি চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে কেন্দ্রীয় কমিটির এক প্লেনামের আয়োজন করে। এই প্লেনাম যেমন কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে, তেমনি আগামী বছরের পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি নিয়েও সেখানে আলাপ আলোচনা হয়।
এই প্লেনাম আয়োজনের সময় গোটা বিশ্বের মতো চীনের অর্থনীতিও কোভিড পরিস্থিতির সঙ্কটকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। গত দু’দশক ধরে চীনে আর্থিক বৃদ্ধি বার্ষিক আট শতাংশের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু কোভিডের সময় এই বৃদ্ধি থমকে যায় এবং সাম্প্রতিক সময়ে এই বৃদ্ধিহার পাঁচ শতাংশের কাছে ঘোরাফেরা করছে। বিশেষ সঙ্কটে পড়ে সম্পত্তির বাজার। চীনের সম্পত্তি ব্যবসার সবচেয়ে বড় কোম্পানি এভারগ্রেনেড প্রায় দেউলিয়া হয়ে যায়। চীনে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছুটা কমলেও ধনী দরিদ্রের মধ্যেকার ব্যবধান এখনো প্রবল। চীনের কমিউনিস্ট সরকার এর মোকাবিলায় শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার অন্যতম একচেটিয়া পুঁজির ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ চাপানো। আলিবাবা বা টেনসেন্ট-এর মতো কোম্পানীগুলি তাদের একচেটিয়া আধিপত্য কিছুটা হারাতে বাধ্য হয়েছে। সবার বিকাশের যে লক্ষ্যমাত্রা সামনে রাখা হয়েছে, তা এরমধ্যে দিয়ে খানিকটা প্রকাশিত হয়েছে।
এই প্লেনাম শি জিনপিং-এর নেতৃত্বকে আরো সুদৃঢ় করেছে। কেন্দ্রীয় কমিটির ৩৭০ সদস্যের সকলেই এই প্লেনামে উপস্থিত ছিলেন। আগামী পার্টি কংগ্রেসে মাও-এর মতোই তিনিও যে তৃতীয়বারের জন্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব হতে যাচ্ছেন — তাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বস্তুতপক্ষে ২০১৮ সালেই পার্টি সংবিধানে রদবদল করে সত্তর দশক থেকে বলবৎ থাকা সর্বোচ্চ দু’বারের জন্য পার্টি প্রধান হবার নিয়মটি সরিয়ে দেওয়া হয়।
এই প্লেনাম শি জিনপিংকে মাও সে তুং ও দেং শিয়াও পিং-এর উচ্চতায় অভিষিক্ত করল। ১৯৪৫ সালে মাও এবং ১৯৮১ সালে দেং তৎকালীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, শি জিনপিং এই প্লেনামের মাধ্যমে সেই উচ্চতাই স্পর্শ করলেন। ১৯৪৫’র আগে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মাও-এর নেতৃত্ব এই অবস্থায় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং জাপ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ে তাঁর রণকৌশল নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়। ১৯৪৯ সালের চীন বিপ্লব হয় তাঁরই নেতৃত্বে।
বিপ্লবোত্তর চীন সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড-এর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়ে বেশ কিছু সঙ্কটের সামনে পড়েছিল। মাও পরবর্তী সেই সময়ে আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটে ভুগতে থাকা চীনকে সঙ্কটমুক্তির পথ দেখায় দেং শিয়াও পিং-এর নেতৃত্ব। ১৯৮১ সালেই চীনের অর্থনীতিকে বিদেশি পুঁজির জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, শুরু হয় পুঁজিবাদী পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও। শি জিনপিং, মাও এবং দেং-এর সমতুল্য মর্যাদায় অভিষিক্ত হলেন এই ধরনের কোনও বড় মাপের সঙ্কট মোকাবিলার কারণে নয়, বিগত নয় বছরে তাঁর নেতৃত্বে চীনের নানা মাত্রিক বিকাশ এবং ২০৪৯ সালে চীন বিপ্লবের শতবর্ষের সময় পর্যন্ত চীনের প্রগতির পথে চলার রূপরেখা নির্ধারণের জন্য। শি জিনপিং-এর সাফল্যের মূল্যায়ন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির প্লেনাম জানিয়েছে যে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে শি সাফল্যের সঙ্গে সামলেছেন, সঙ্কটকে সুযোগে পরিণত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনুগতদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’এ যেভাবে ভারত ছাড়া এশিয়ার অধিকাংশ দেশকে চীন সামিল করতে পেরেছে, তাকে শি জিনপিং-এর বিশেষ কৃতিত্ত্ব বলেই প্লেনাম মনে করেছে। এই উদ্যোগকে লাতিন আমেরিকাতেও ছড়িয়ে দেওয়ার ভাবনা এই প্লেনামে ব্যক্ত হয়েছে।
চীন যে কোভিড১৯’র বিপর্যয়কে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তার প্রতীকী বার্তা হিসেবেই হয়ত এই প্লেনামে উপস্থিত সদস্যদের কেউই মাস্ক ব্যবহার করেননি। বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন কোভিড১৯ আর সেখানে আতঙ্ক হিসেবে নেই। এই প্লেনাম স্পষ্ট করে দিয়েছে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে বিশ্বের পয়লা নম্বর আধিপত্যবাদী শক্তি হয়ে ওঠার কোনও ইচ্ছা পোষণ করে না, তবে চীনা সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার কথাও একইসঙ্গে এই প্লেনাম থেকে বলা হয়েছে। তাইওয়ান সমস্যার সমাধান করে চীনকে ঐক্যবদ্ধ করার ভাবনাও এখানে ব্যক্ত হয়েছে।
- সৌভিক ঘোষাল