উত্তরপ্রদেশে আবারও নৃশংস দলিত হত্যা
In Uttar Pradesh

উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজ জেলার গোরি মোহনগঞ্জ গ্ৰামে ২৪ নভেম্বর গভীর রাতে দলিত পরিবারের চার সদস্যের খুন হওয়ার পুলিশী তদন্ত কোন পথে এগোচ্ছে? উচ্চবর্ণের মূল অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তার কি কোনো যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে? যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন দলিত ও নারীদের নিরাপত্তা কতটা সুরক্ষিত করতে পেরেছে? দলিত হত্যাকাণ্ড এই প্রশ্নগুলোকে সামনে নিয়ে আসায় সেটির দিকে তাকানো যাক।

খুন হওয়া দলিত পরিবারটার চারজন সদস্যই ছিল — গৃহকর্তা ৫০ বছর বয়স্ক ফুলচন্দ্র সরোজ, তাঁর স্ত্রী ৪৫ বয়স্কা মীনা দেবী, ১৭ বছরের মেয়ে স্বপ্না এবং ১০ বছরের ছেলে শিব। চারজনই খুন হওয়ায় খবরটা জানাজানি হতে দু’দিন দেরি হল, দরজা ভেঙ্গে ঘাতকদের হিংস্রতার চিহ্ন বহন করা দেহগুলোকে দেখতে পাওয়া গেল। খুন হওয়া পরিবারের নিকটজনরা পাশে থাকা উচ্চবর্ণের ঠাকুর পরিবারের ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলেন — পুলিশ অভিযুক্তদের আটজনকে গ্ৰেপ্তার করল। পুলিশ তাদের বিবৃতিতে জানাল যে, নিহত চারজনের মধ্যে তিনজনকে একটা খোলা জায়গায় পাওয়া গেছে এবং ১৭ বছরের মেয়েটির দেহ পাওয়া গেছে একটা ঘরে। আরও জানাল, খুন করার আগে মেয়েটাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

কিন্তু হঠাৎই পুলিশী তদন্ত একটা বাঁক নিলো। পুলিশ দিনমজুরি খাটা পবন সরোজ নামে ১৯ বছরের এক দলিত যুবককে গ্ৰেপ্তার করল ২৮ নভেম্বর। খুনের রহস্য তারা ভেদ করে ফেলেছে বলে দাবি করে পুলিশ জানাল — গ্ৰেপ্তার হওয়া দলিত যুবক পবন সরোজ দলিত যুবতীকে প্রেম নিবেদন করেছিল। কিন্তু মেয়েটি তার প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় সে রুষ্ট হয়ে মেয়েটি সহ তার বাবা-মা-ভাইকে হত্যা করেছে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, পবন সরোজ নাকি হত্যার কথা স্বীকারও করেছে। কিন্তু একটা ছেলের পক্ষে কি চারজনকে খুন করা আদৌ সম্ভব? পুলিশ বলল, তারসঙ্গে অন্য যারা ছিল তাদের খোঁজ চলছে এবং তাদের ধরতে পুলিশের লোকজন নাকি পুনে গেছে। এছাড়া গ্ৰামের অন্য দুই দলিত যুবককেও তারা গ্ৰেপ্তার করল। পুলিশের বয়ান অনুযায়ী এটা দাঁড়ালো যে, হত্যাকাণ্ডের পাণ্ডা যে দলিত যুবক তার সহযোগীরা পালিয়ে গেলেও সে নির্ভয়ে গ্ৰামে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আর তাই তারা অনায়াসে তাকে ধরতে পারল। পুলিশ আরও জানাল, মেয়েটি নাবালিকা নয়, তার জন্ম ১৯৯৬ সালে এবং তার বয়স ২৫ বছর। সেজন্য হত্যাকাণ্ডে দায়ের হওয়া পকসো আইনের অভিযোগকে তারা তুলে নিল। যেহেতু গ্ৰেপ্তার হওয়া যুবকটিও দলিত, খুন হওয়া পরিবারটির মতো পাসি জাতের অন্তর্ভুক্ত, তাই হত্যাকাণ্ডে প্রযুক্ত দলিত নিপীড়ন নিরোধক আইনের অভিযোগকেও তুলে নেওয়া হল। এরপর প্রথম অভিযোগের ভিত্তিতে গ্ৰেপ্তার হওয়া ঠাকুর জাতের ৮ সদস্যকেও পুলিশ ছেড়ে দিল ৩০ নভেম্বর।

খুন হওয়া দলিত পরিবারের সঙ্গে উচ্চবর্ণের ঠাকুর পরিবারের কি জমিকেন্দ্রিক সংঘাতের কোনো ইতিহাস ছিল? প্রকাশিত সংবাদ জানাচ্ছে — দলিত পরিবার সরকারের কাছ থেকে একখণ্ড জমি পেয়েছিল, আর ঠাকুর পরিবারও সেই জমির মালিকানা দাবি করছিল। এই জমিকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দুই পরিবারের মধ্যে একটা সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল। দলিতদের চাষ করা ঐ জমির ফসল ঠাকুর পরিবারের গবাদি পশু খেয়ে নষ্ট করার অভিযোগ দলিত পরিবারের প্রৌঢ়া ঠাকুরদের ঘরে গিয়ে জানালে ঠাকুর পরিবারের লোকজন দলিতদের ঘরে ঢুকে হামলা চালায়। ওরা দলিতদের বলেছিল, “তোরা পাসিরা কি করে ঠাকুরদের বাড়িতে আসার সাহস দেখাস? কি করেই বা তোরা অভিযোগ জানাতে আসিস?” এই হামলার জন্য ৫ সেপ্টেম্বর স্থানীয় ফাফামাউ থানায় ঠাকুর পরিবারের ৭ সদস্যের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়। একই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে এবছরের ২১ সেপ্টেম্বর, ঠাকুরদের জনা ১০-১২ লোক দলিতদের ওপর হামলা চালায় এবং আবারও এফআইআর হয়। কিন্তু পুলিশ কি অভিযোগে যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যাশিত ব্যবস্থা নেয়? সংবাদে প্রকাশ, ঠাকুরদের কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পাওয়া দলিতদের অভিযোগে গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় ফাফামাউ থানার ইনচার্জ ও হেড কনস্টেবলকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এটাতো খুনের ঘটনার পর নিজেদের মুখ রক্ষায় পুলিশের মরিয়া পদক্ষেপ। কিন্তু এরথেকে দলিতরা নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে কতটা নিশ্চিত বোধ করতে পারেন? যে রাজ্য এবং যে জমানা দলিত বিদ্বেষ এবং উচ্চবর্ণের সামাজিক প্রতাপের বৈশিষ্ট্যে কলঙ্কিত, সেখানে প্রশাসনিক ন্যায় ও নিরপেক্ষতার প্রদর্শন কতটা প্রত্যাশিত হতে পারে? বিশেষভাবে ঠাকুর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের জাতের গরিমা যাদের দাপটকে বল্গাহীন করে তুলেছে?

খুন হওয়া দলিত ব্যক্তির দাদা এবং গ্ৰেপ্তার হওয়া দলিত পরিবারগুলোর সদস্যরা পুলিশের তদন্তকে কি চোখে দেখছেন? নিহত ফুলচন্দ্র সরোজের দাদা বলেছেন, “আমার ভাই, তার স্ত্রী এবং তাদের দুই সন্তানকে প্রত্যাখ্যাত কোনো প্রেমিক খুন করেনি। উচ্চবর্ণের ঠাকুর পরিবারের সুপরিচিত কিছু সদস্যই ওদের খুন করেছে। কিন্তু পুলিশ আমার কথায় কান দিচ্ছে না। …” তিনি আরও জানান, “আমার ভাইঝির সঙ্গে ছেলেটার কোনো বিবাদ থাকলে সে আমার ভাইঝিকে খুন করত, অন্য তিনজনকে খুন করবে কেন?” নিহত ও ধর্ষিতা মেয়েটি ২৫ বছর বয়স্ক কলেজ পাশ করা গ্ৰ্যাজুয়েট বলে পুলিশ যে দাবি করছে, তাকে খণ্ডন করে তিনি বলেন, তাঁর ভাইঝি অপ্রাপ্ত বয়স্কাই ছিল। গ্ৰেপ্তার হওয়া দলিত যুবকের দিদি তার ভাইয়ের মেয়েটির পিছু নেওয়ার পুলিশের অভিযোগকে অস্বীকার করে বলেছেন, হত্যার ঘটনা ঘটার সময় সে বাড়িতেই ছিল। গ্ৰেপ্তার হওয়া অন্য দুই দলিত যুবকের পরিবারের সদস্যরা থানার বাইরে বিক্ষোভ দেখিয়ে তাদের মুক্তির দাবি জানায়।

দলিতদের খুনের এই ঘটনা উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছে। সিপিআই(এমএল) পুলিশের তদন্তকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তদন্তকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা হচ্ছে এবং অভিযুক্তরা সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের লোকজন হওয়ায় তাদের আড়াল করা এবং অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়ার সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। দলিত পরিবারের সদস্যদের খুনের প্রতিবাদে সিপিআই(এমএল) ২ ডিসেম্বর রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদ দিবস পালন করে। লক্ষ্ণৌ, গাজিপুর, রায়বেরিলি, বেনারস, আজমগড়, মির্জাপুর, কানপুর ও অন্যান্য জেলায় প্রতিবাদ সংগঠিত হয় এবং রাজ্যপাল আনন্দিবেন প্যাটেলের কাছে একটা দাবিপত্র পেশ করা হয়। ঐ দাবিপত্রে আর্জি জানানো হয় — দলিত পরিবারের খুনের ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে; অপরাধীদের গ্ৰেপ্তার করে শাস্তি দিতে হবে; স্থানীয় থানার যে পুলিশ অফিসারেরা অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে; খুন হওয়া দলিত পরিবারকে আর্থিক সহায়তা এবং একজনকে সরকারি চাকরি দিতে হবে এবং নারী ও দলিতদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে হবে।

এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অনেকেই উন্নাও ও হাথরস কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি দেখতে পেয়েছেন। উন্নাও, হাথরস এবং প্রয়াগরাজের তিনটে ঘটনাতেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে দলিত বালিকা, দুটি ক্ষেত্রে ধর্ষিতারা মারা গেছে এবং তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও হিংসার বলি হয়েছে। নিপীড়করা সবক্ষেত্রেই ছিল উচ্চবর্ণের লোকজন, এবং হাথরস ও প্রয়াগরাজ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে যুক্ত বলে ঠাকুর সম্প্রদায়ের লোকজন অভিযুক্ত হয়েছে। তিনটে ক্ষেত্রেই দোষীদের অপরাধকে ধামাচাপা দিয়ে তাদের রক্ষার চেষ্টার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে উঠেছে এবং নিপীড়তদের হুমকি দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহারের পথেও তারা সক্রিয় হয়েছে। এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডগুলো প্রমাণ করেছে যে, যোগী জমানায় দলিত এবং নারীদের নিরাপত্তা ভয়ংকরভাবে অরক্ষিত, ন্যায়বিচার এক দুর্লভ বস্তু এবং চরম পদক্ষেপ নিয়ে দুর্বৃত্তদের শায়েস্তা করার যোগী আদিত্যনাথের দাবি এক প্রহসন বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-44