সম্পাদকীয়
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গৈরিক হানা! নামতে হবে গণপ্রতিরোধে
Gairik Hana

বিশ্বভারতীর পর খড়গপুর আইআইটি, তারপর শিবপুর আইআইইএসটি। এবিভিপি-বিজেপি-আরএসএস-এর সুপরিকল্পিত ত্রিশূল হানা চলছেই। তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কেন্দ্রের মোদী সরকারের প্রভাব খাটানোর প্রতাপ রয়েছে। সেই জোরে গৈরিকায়নের শক্তিগুলো এতো খোলাখুলি বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, দুঃসাহস দেখাতে পারছে। কারো আর বুঝতে বাকি নেই যে বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য মশাই হলেন কেন্দ্রের উদ্দেশ্য হাসিলের এক পরিকল্পিত বিনিয়োগ, নিজের মুখোশ তিনি নিজেও খুলেছেন নির্লজ্জের মতন, আর তা বিজেপিও বুঝিয়ে দিয়েছে তাঁর সপক্ষে ন্যক্কারজনকভাবে সাফাই গেয়ে। উপাচার্যের নিয়োগ পরিকল্পনার পিছনে বিজেপির লক্ষ্য ছিল রাজ্যের গত বিধানসভা নির্বাচন, রাজ্যপালকে নিয়ে ছক কষার মতোই। যদি এক ঢিলে দুই পাখী মারা সম্ভব হয় সেই চেষ্টায়। একদিকে উদার মানবতাপ্রবাহের বিশ্বভারতীর জঘন্য গেরুয়াকরণ ঘটানো, অন্যদিকে বঙ্গ সমাজের বর্ণহিন্দু শিক্ষিত অংশের ভেতর থেকে বিজেপির জন্য প্রশ্নাতীত আনুগত্যের বর্গ তৈরি করা। যারা হয়ে উঠতে পারেন বিজেপির ভাষায় তার বিশেষ ‘সামাজিক প্রচারক ও বিস্তারক’, যাদের ভাঙিয়ে নতুন ভোটবাজার বানানো যাবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এসেছিলেন সফরের উদ্দেশ্য হাসিলের বার্তা দিতে, কিন্তু অমিত শাহকে এনে ‘কুলশীল’দের কোনও অংশকেই মোহের ফাঁদে ধরা সম্ভব নয়, হয়নি। অগত্যা উপাচার্য-বিজেপি মিলে শলা করে রাজ্যসভার এক বিজেপি সাংসদকে এনে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির আসর জমাতে। সঙ্গতে রাখা হয় এবিভিপি-কে। কিন্তু বাধ সাধে নাছোড় বাম-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের বিভিন্ন অংশ, পাশে দাঁড়ায় সুশীল সমাজের নানা অংশ। চলে লাগাতার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। যার ফলে পিছু হঠতে হয় উপাচার্য ও তাঁর পারিষদবর্গকে, তাঁর নিয়োগ কর্তাদেরও। ইতিমধ্যে বিধানসভা নির্বাচনী সাধ পূরণ হয়নি, তবে হতোদ্যম না হয়ে পুনরুত্থানের চেষ্টায় বিজেপি মরীয়া। তারই অঙ্গ হিসাবে ঝাঁপাচ্ছে খড়গপুরে, শিবপুরে।

খড়গপুর আইআইটি-তে শুরু হয়েছে এক নয়া কার্যক্রম। প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করা ও অপবিজ্ঞান প্রচার করার শয়তানি। ক্রিয়াশীল গেরুয়াপন্থীরা বেশ তৎপর। কার্যকলাপ চালানো হচ্ছে নানা গালভরা গুরুগম্ভীর বিষয় নামাঙ্কনের বহিরঙ্গে। ‘সেন্টার অব এক্সসেলেন্স ফর ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’! ‘রিকভারি অব দ্য ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’! এইসব নিয়ে বানানো হয়েছে ২০২২-এর ক্যালেন্ডার। আসলে অপচেষ্টা চলছে মদতের জোর খাটিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চার এক প্রখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রকে অসত্য, বিকৃতি, অপবিজ্ঞান প্রচারের আখড়া বানানোর। তবে এই অভিলাষ অচিরেই সম্মুখীন হচ্ছে সংবেদনশীল-সচেতন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের। গড়ে উঠেছে রুখে দেওয়ার প্রাথমিক উদ্যোগ — ছাত্র-অশিক্ষক-অধ্যাপকদের “সংহতি মঞ্চ”। মঞ্চ পাল্টা নিরবচ্ছিন্ন প্রচার চালাচ্ছে, জনমত গড়ে তুলছে, কর্তৃপক্ষের উপরেও অবিরাম চাপ রাখছে, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির উদ্দেশ্য প্রণোদিত ‘নলেজ সিস্টেম’ ইত্যাদি বন্ধ করে দেওয়ার দাবিতে। তাদের লড়াই সাহায্য সমর্থন পেতে শুরু করেছে ক্যাম্পাসের বাইরেও।

শিবপুর আইআইইএসটি-তে সম্প্রতি সংঘটিত হতে দেখা গেল সংঘী সংস্কৃতির আরেক নতুন মহড়া। প্রথম বর্ষে অন্তর্ভুক্তির ভার্চুয়াল কর্মশালা চালানোর সময় শোনানো হয় হিন্দুত্বের মাহাত্ম্য প্রচারের বক্তৃতাবাজি! শুধু তাই নয়, চরম ঔদ্ধত্য দেখালেন প্রতিষ্ঠানের ‘চীফ ওয়ার্ডেন’, প্রদর্শন করলেন তাঁর এবিভিপি রাজ্য সভাপতি পদের পরিচয়পত্রটিও। নিহিত উদ্দেশ্য সেই একই — গেরুয়াকরণ তথা বিদ্বেষ-বিভাজনের ধংসাত্মক প্রয়াস চালানো। সব দেখেও কর্তৃপক্ষ রয়েছে নিষ্ক্রিয় উদাসীন অবস্থায়। শিবপুরের আইআইইএসটি-কে যদি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বাঁচাতে হয় তবে এখনই শুরু করতে হবে সংগঠিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ।

পশ্চিমবাংলায় বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর প্রচলন রয়েছে বহু দশক যাবত। যদিও এই চলতি পরম্পরা কোনও সাম্প্রদায়িক দূষণ এখনও ছড়ানোর কারণ হয়নি। কিন্তু সেদিকে গড়ায়নি বলে যে রীতি চলে আসছে তা নিয়ে নতুন চেতনায় কোনও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে না তা নয়। এপ্রশ্ন ওঠানো যেতেই পারে আরও বহু কারণে। ইতিমধ্যে বিজেপি হিড়িক তুলতে শুরু করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পুজো আবশ্যিক করা ও গীতা পাঠ চালু করার; তাছাড়া ভগবৎগীতাকে ‘জাতীয় ধর্মগ্রন্থ’ করার দাবি তুলেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এই সবকিছুই চলছে আরএসএস এবং বিজেপির যুগল যোজনায়।

এইসব দূষণ ও সংক্রমণ থেকে নাগরিক সমাজ ও সভ্যতাকে রক্ষা করতে হবে, তার জন্য নামতে হবে বিরুদ্ধতার পথে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-46