কৃষকবিরোধী আইন তিনটি প্রণয়নের সময় যেমন অসৎ ও অগণতান্ত্রিক কায়দা নিয়েছিল মোদী সরকার, প্রত্যাহারও করল ততটাই অসৎ অগণতান্ত্রিকভাবে। আলোচনার দাবি অগ্রাহ্য করে সংসদে ধ্বনি ভোটে পাস করা হয়েছিল আইন তিনটি, প্রত্যাহারের সময়ও কোনও রকম আলোচনা করতে দেওয়া হল না। এই স্বৈরাচারী কায়দা মোদী সরকারের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে।
আইন প্রত্যাহার করতে হল কেন তার কারণ হাজির করতে গিয়ে মোদী সরকারকে অবশ্য বেশ সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে হয়েছে। সরকার একই কথা আওড়ে চলেছে। বলছে যে, আইনগুলিতে কোনও দোষ ছিল না, আর কৃষকদের একটি ক্ষুদ্র অংশই সরকারের কথা বুঝতে ও আইনগুলি সমর্থন করতে অস্বীকার করেছে। সরকার দাবি করছে যে আইনগুলি খুব ভালো হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যাহার করে নিতে হচ্ছে মূলত তিনটি কারণে: কারণ সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছে; কারণ কোভিড১৯ সংকটকালে কৃষকেরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে প্রচুর ফসল ফলিয়েছে; এবং, কারণ হল ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তীতে — আজাদী কা অমৃত মহোৎসবে — মহানুভবতার সাথে সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলা সরকারের অবশ্যকর্তব্য।
তিনটি কারণই মিথ্যাচার মনে হতে বাধ্য। সুপ্রিম কোর্ট ২০২১-এর জানুয়ারি মাসেই স্থগিতাদেশ দিয়েছিল। তখনই কেন মোদীঐ সরকার আইনগুলি প্রত্যাহার করেনি? করলে তো কৃষকদের এই চরম হয়রানি হত না, ৭০০ কৃষকের প্রাণ বাঁচত। যে সরকার বছরভর কৃষকদের শাস্তি দিতে আর বদনাম করতে ব্যস্ত ছিল সেই সরকারই এখন কৃষকদের পরিশ্রমের কথা বলে পিঠ চাপড়ে পুরস্কার দেওয়ার ভণিতা করছে! আর শেষত, কাকে বোকা বানানোর খোয়াব দেখছে সরকার? ভারতের একটা শিশুও তো জানে যে ৭৫ বছরের স্বাধীনতা উপলক্ষে মহানুভবতা দেখাতে নয়, দাম্ভিক মোদীকে আইনগুলি প্রত্যাহার করতে হয়েছে ইউপি ও অন্য দুই রাজ্যে আসন্ন নির্বাচনে কৃষকের হাতে নিশ্চিত পরাজয় আটকানোর মরিয়া প্রচেষ্টা হিসেবে। বরাবরের মতো মোদীর এই পদক্ষেপও ক্ষমতার লোভ থেকেই, কৃষকের ভালো করার আকাঙ্খা থেকে নয়।
আমাদের একথাও স্মরণে রাখতে হবে যে কৃষকেরা প্রথম থেকেই যার বিরোধ করছিল সেই ক্ষতিকর আইনগুলি সরকার প্রত্যাহার করে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু উৎপাদন খরচের ওপর ৫০% লাভের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করার আইন প্রণয়নের যে দাবি কৃষকেরা লাগাতার তুলে এসেছে তাকে সরকার এখনও স্বীকারই করেনি। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কিনে নিয়ন্ত্রিত মূল্যের রেশন দোকানে দেশের জনগণের জন্য সরবরাহ করুক।
কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, আর অন্যদিকে ভোক্তাদের তা কিনতে হচ্ছে চরম মূল্য দিয়ে বাজার থেকে। খাদ্যসামগ্রীর দাম হুহু করে বেড়ে চলেছে; এই সরকারেরই বিমুদ্রাকরণ, লকডাউন ও কর্মনাশের ফলে ইতিমধ্যে ধুঁকতে থাকা গরিব জনতা এই মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় চরম বিধ্বস্ত। খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়েই খাদ্যসামগ্রীর ওপর কর্পোরেট থাবার বিরুদ্ধে লড়ছে
সারা দেশের কাছ থেকে উষ্ণ অভিনন্দন প্রাপ্য কৃষকদের — শুধুমাত্র খাদ্য উৎপাদনের জন্য নয় বরং আমাদের গণতন্ত্রের মাটিতে আর দেশের জনতার অন্তরে নতুন আশার যে বীজ তাঁরা বপন করলেন তার জন্য। কৃষক আন্দোলন ভারতের উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের প্রকৃত অন্তরাত্মাকে এমনভাবে জাগ্রত করেছে যা বিজেপির সংগঠিত “আজাদী কা অমৃত মহোৎসব”-এর পক্ষে করা সম্ভব নয়, কারণ ব্রিটিশ কোম্পানিরাজের সেবা আর স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল যারা তাদেরই মতাদর্শগত আনুগত্যে চলে বিজেপি এবং সেই একই ধারায় ওরা দেশের কৃষক ও খাদ্য উৎপাদন সহ সমস্ত কিছুকে বর্তমানকালের কোম্পানিরাজের হাতে তুলে দিচ্ছে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৩০ নভেম্বর সংখ্যা)