প্রতিবেদন
নাগাল্যান্ড বিধানসভার প্রস্তাবে আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি
Demand for withdrawal of AFSPA

নাগাল্যান্ডের ‘মন’ জেলার ‘ওটিং’ গ্ৰামে ৪ ও ৫ ডিসেম্বর প্যারা কম্যাণ্ডোদের হাতে ১৪ জন শ্রমিক ও গ্ৰামবাসীর হত্যা এবং ৩৫ জনের আহত হওয়ার ঘটনা শুধু নাগাল্যান্ড নয়, সমগ্ৰ উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই সেনাদের নিপীড়ন ক্ষমতার বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছিল। এরসাথেই উঠেছিল নাগাল্যান্ড সহ গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকেই সেনা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আফস্পা) প্রত্যাহারের দাবি। কেননা, আফস্পা আছে বলেই সেনারা নিপীড়ন চালাতে পারে। নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেফিউ রিও এবং মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা আফস্পা প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণের দাবিতেই গলা মেলান। প্রত্যাহারের দাবি এতটা জোরালো হয়েছে যে রাজ্য সরকারের পক্ষেও তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। সেই দাবির পক্ষে প্রস্তাব গ্ৰহণ করতে নাগাল্যান্ড বিধানসভার একদিনের বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হল ২০ ডিসেম্বর। অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত প্রস্তাবে নাগাল্যান্ড এবং সমগ্ৰ উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “নাগাল্যান্ড বিধানসভা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই দাবি জানাচ্ছে যে, ভারত সরকারকে উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে, এবং বিশেষভাবে নাগাল্যান্ড থেকে, আফস্পা প্রত্যাহার করে নিতে হবে, যাতে নাগাদের রাজনৈতিক ইস্যুটির শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে চলমান প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করে তোলা যায়।” প্রস্তাবের বয়ান থেকে স্পষ্ট, নাগা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে পৌঁছানোর লক্ষ্যে, এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের পথে আফস্পা এক প্রতিবন্ধক হয়েই থাকছে। সেনাবাহিনী অবলীলায় নিরীহ নিরপরাধ নাগরিকদের হত্যাকাণ্ড সংঘটনের ক্ষমতা পায় আফস্পা থেকে, যে আইন সন্দেহভাজন যে কোনো ব্যক্তির ওপরই তল্লাশি চালানো, তাকে গ্ৰেপ্তারের এবং এমনকি জনগণের ওপর গুলি চালানোর ক্ষমতা সেনাদের দিয়েছে। এবং সেনাদের আরও দিয়েছে, ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত করা ক্রিয়াকলাপের জন্য শাস্তি থেকে অব্যাহতির বিধান। এই ধরনের দানবীয় আইনের মধ্যে অনিবার্যভাবেই নিহিত থাকে নাগরিকদের নিপীড়নভোগের অশেষ সম্ভাবনা। সেদিনের বিশেষ অধিবেশনে নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেফিউ রিও তুলে ধরেন আফস্পা চালিত সেনাদের হাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণের পৈশাচিক পীড়ন ভোগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে, “নাগাল্যান্ড এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য অংশে, বিশেষভাবে মনিপুরে ও আসামে তাদের অভিযান চালানোর সময় সেনাবাহিনীর হাতে আফস্পার বিধানগুলির ভুল ব্যবহার বা অপব্যবহারের অনেক ঘটনা ঘটেছে। জনগণের মতামতকে প্রতিফলিত করা এবং তাদের আকাঙ্খাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্তব্য পালনে আমরা বাধ্য এবং দায়িত্বপরায়ণ।” মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় নেফিউ রিওকে সেনাদের দৌরাত্ম্যের বিবরণ যে রেখেঢেকে দিতে হচ্ছে তা বুঝতে পারা কারুর পক্ষেই কঠিন নয়।

গৃহীত প্রস্তাবে আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি ছাড়াও উল্লেখিত হয়েছে যে, গণহত্যার দায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ক্ষমা চাইতে হবে। প্রস্তাবে গুরুত্বের সঙ্গে আরও স্থান পেয়েছে ন্যায়বিচার লাভকে সুনিশ্চিত করার দাবি। বলা হয়েছে, যারা এই পৈশাচিক গণহত্যা সংঘটিত করেছে এবং গণহত্যার জন্য যারা দায়ী, তাদের ওপর দেশের আইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, যাতে ন্যায়বিচারের বঞ্চনাকে প্রতিহত করা যায়। নাগা সমস্যার দ্রুত ও সম্মানজনক সমাধানসূত্র বার করার আকাঙ্খা ব্যক্ত করে প্রস্তাব আরও উল্লেখ করেছে, “এই সভা, অতএব, ভারত-নাগা আলোচনায় জড়িত সমস্ত আলোচক দলগুলোর কাছে আরও একবার আবেদন জানাচ্ছে, দ্রুত সম্মানজনক ও সর্বস্বার্থরক্ষার সমাধানে পৌঁছে আলোচনা প্রক্রিয়াকে যুক্তিসম্মত পরিণতি দেওয়া হোক।” প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ায় এটা লক্ষণীয় যে, রাজ্য বিধানসভার ১২ জন বিজেপি বিধায়ককেও প্রস্তাবের সমর্থনে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে।

withdrawal of AFSPA

আফস্পা আইনের ৩নং ধারায় আছে, কোনো এলাকায় এই আইন প্রয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারকে সেই এলাকা ‘উপদ্রুত’ বলে ঘোষণা করতে হবে, যে ঘোষণার বলে আইন ৬ মাস বহাল থাকবে। নাগাল্যান্ডকে ‘উপদ্রুত’ ঘোষণা করে কেন্দ্র সরকার শেষবারের মতো বিজ্ঞপ্তি জারি করে ২০২১ সালের ৩০ জুন, তার সময়সীমা শেষ হবে ২৯ ডিসেম্বর। তবে, আফস্পা প্রত্যাহারের জন্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবল দাবি উঠলেও এবং নাগাল্যান্ড বিধানসভায় প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাশ হলেও নাগাল্যান্ড এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে আফস্পা প্রত্যাহার এখনই সম্পন্ন হচ্ছেনা।

নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেফিও রিও, উপ-মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই প্যাটন এবং এনপিএফএল দলের নেতা টি আর জেলিয়াং তাঁদের স্বাক্ষর করা এক প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছেন — সেনা কম্যাণ্ডোদের সংঘটিত গণহত্যা এবং আফস্পা প্রত্যাহারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেতাদের দিল্লীতে এক বৈঠকে ডাকেন। অমিত শাহর বাড়িতে ২৩ ডিসেম্বর সেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নাগাল্যান্ডের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি বিবেচনা করতে কেন্দ্র পাঁচ সদস্যের এক কমিটি গঠন করবে। কমিটির শীর্ষে থাকবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উত্তর-পূর্ব বিষয়ক স্বরাষ্ট্রসচিব, এবং অন্যান্য সদস্যরা হবেন নাগাল্যান্ডের মুখ্যসচিব, নাগাল্যান্ডের ডিজিপি, আসাম রাইফেলস ও সিআরপি’র কর্তাব্যক্তিরা। কমিটি ৪৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবে এবং তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই বিবেচিত হবে নাগাল্যান্ড থেকে আফস্পা প্রত্যাহৃত হবে কিনা। সমগ্ৰ উত্তর-পূর্বাঞ্চল নয়, শুধুই নাগাল্যান্ড থেকে, কেননা, কমিটিকে শুধু নাগাল্যান্ডের পরিস্থিতিই বিচার করতে বলা হয়েছে।

তবে, উত্তর-পূর্বের আফস্পা ও সেনা বিরোধী রোষকে আপাতত প্রশমিত করতে এবং আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিকে ধামাচাপা দিতে একটা কৌশলও হতে পারে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত। কমিটির রিপোর্টের বিষয়বস্তু যাই হোক, কোথাও আফস্পাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না। এই আইন ১৯৫৮ সালে সর্বপ্রথম চালু হয় নাগাল্যান্ডেই, এবং তারপর থেকে এই আইনের বলে সেনারা যথেচ্ছ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে শুধু নাগাল্যান্ড বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই নয়, পাঞ্জাবে এবং কাশ্মীরেও রচনা করে গেছে এবং এখনও করে চলেছে পৈশাচিক পীড়নের ছেদহীন আখ্যান, রক্ত ঝড়ানোর নিরবচ্ছিন্ন বৃত্তান্ত। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের যথার্থ দাবি তাই হল — শুধু নাগাল্যান্ড থেকেই নয়, সারা দেশ থেকেই আফস্পাকে অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-46