প্রতিবেদন
ভীমা কোরেগাঁও মামলায় সমস্ত আটক অভিযুক্তকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে
Bhima Koregaon

ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত সুধা ভরদ্বাজের জেল থেকে জামিনে মুক্তির পিছনে আদালতের যে ইতিবাচক ভূমিকা আছে তা অনস্বীকার্য। বম্বে হাইকোর্ট ১ ডিসেম্বর তাঁর জামিন মঞ্জুর করার পর, আদালতের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এবং জামিন মঞ্জুরিতে স্থগিতাদেশ চেয়ে এনআইএ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ইউ ইউ ললিত, এস এ ভাট ও বেলা টি ত্রিবেদীর বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, “বম্বে হাইকোর্টের নির্দেশে হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন নেই।” মাঝখানে কয়েক বছর, বিশেষভাবে জহুর আহমেদ শাহ ওয়াতালি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এ এম খানউইলকার ও অজয় রাস্তোগির বেঞ্চের রায়ের পর ইউএপিএ আইনে অভিযুক্তদের জন্য জামিনের দরজায় বলতে গেলে তালাই লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই তালা খুলতে সর্বোচ্চ আদালত একান্ত অনিচ্ছুক বলেই মনে হয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালত যেন জানান দিচ্ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছায় তাল মেলানোতেই তার আগ্ৰহ। সম্প্রতি কয়েকটা মামলায় ইউএপিএ’তে অভিযুক্তদের নিম্ন আদালতের জামিন মঞ্জুর এবং সুপ্রিম কোর্টে সেই রায়গুলোর বিরুদ্ধে আপত্তি জানানো হলে নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্তে সর্বোচ্চ আদালতের সম্মতি প্রদান আদালতের ভাবমূর্তি পরিবর্তনের কিছুটা ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এরপরও মাথাচাড়া দিচ্ছে এই প্রশ্নটা যে — সংবিধানের জিম্মাদার হিসাবে, মানবাধিকারের রক্ষকরূপে সর্বোচ্চ আদালতের আত্মঘোষণায় এত শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে কেন? ভীমা কোরেগাঁও মামলায় সুধা ভরদ্বাজ জামিন পেলে অন্য অভিযুক্তদের কারারুদ্ধ থাকতে হবে কেন? প্রকরণগত ত্রুটিই কি জামিন মঞ্জুরের ক্ষেত্রে একমাত্র অন্তরায় বলে বিবেচিত হবে? গ্ৰেপ্তারির পিছনে সরকারের দুরভিসন্ধি রয়েছে কিনা, তাও জামিন না পাওয়ার পিছনে বিচার্য হবেনা কেন?

জেলে তিনবছরেরও বেশি আটক থাকার পর সুধা ভরদ্বাজ মুক্তি পেলেন। তবে, জামিন এসেছে অনেক প্রতিকূল শর্তের ভিত্তিতে। এনআইএ তাঁর জামিনের সঙ্গে ১৬টা কঠোর শর্ত জুড়েছে, তারমধ্যে রয়েছে — তাঁকে মুম্বইয়ে থাকতে হবে, শহরের বাইরে যেতে গেলে আদালতের অনুমতি লাগবে, তাঁর বাড়ি হরিয়ানা এবং কর্মস্থল ছত্তিশগড় হলেও তিনি সেখানে যেতে পারবেন না, মামলা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে বা কোথাও লিখতে পারবেন না, এই মামলায় অভিযুক্ত অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না, প্রভৃতি। তাঁর মুক্তির ক্ষেত্রে আদালতের কাছে নির্ধারক হয়েছে ‘ডিফল্ট বেল’এর আবেদন। চার্জশিট পেশের যে সময়সীমা আইনে বলা আছে, সেই সময়ের মধ্যে চার্জশিট দাখিল না হলে ‘ডিফল্ট বেল’ মঞ্জুরির বিধান আইনে রয়েছে। সুধা গ্ৰেপ্তার হয়েছিলেন ২০১৮ সালের আগস্টে, তাঁর ক্ষেত্রে প্রথম চার্জশিট দাখিল হয়েছিল ২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, আর জেলে তাঁর আটককাল ৯০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি ‘ডিফল্ট বেল’এর আবেদন করেছিলেন ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর। চার্জশিট দাখিল হওয়ার আগে যেহেতু তাঁর ‘ডিফল্ট বেল’এর আবেদন পেশ হয়েছিল, তাঁর জামিন মঞ্জুরিতে আদালত তাই স্বচ্ছন্দ বোধ করেছে। আর অন্য অভিযুক্তদের কারো ক্ষেত্রে ‘ডিফল্ট বেল’এর আবেদন যেহেতু চার্জশিট পেশ হওয়ার পর হয়েছে বা কারো-কারো ক্ষেত্রে গ্ৰেপ্তারির পিছনে অন্যায্যতাকেই জামিন মঞ্জুরির ভিত্তি করা হয়েছে, তাঁদের জামিনের আবেদন তাই বহুবার নাকচ হয়ে বন্দীদশাই তাঁদের ভবিতব্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু জামিনের আবেদনের শুনানিতে মামলার অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বিবেচিত হবে না কেন? ইউএপিএ’তে সমস্ত অভিযুক্তদের জামিনের আবেদন কেন জহুর আহমেদ শাহ ওয়াতালি মামলার রায়ে ছায়াচ্ছন্ন হয়ে থাকবে?

ভীমা কোরেগাঁওয়ের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি, যেদিন উচ্চবর্ণ পেশোয়াদের বিরুদ্ধে জয়ের দ্বিশত বার্ষিকীর উদযাপনে দলিতরা সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদীরা এই সমাবেশকে সুনজরে দেখেনি এবং উগ্ৰ হিন্দুত্ববাদী মিলিন্দ একবোটে ও সম্ভাজি ভিদের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। এই দুই হিন্দুত্ববাদী পাণ্ডার বিরুদ্ধে এফআইআর হলেও পুনে পুলিশ (মহারাষ্ট্রে তখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন ফড়নবিশ সরকার) একবোটেকে গ্ৰেপ্তার করে দু’দিন পর ছেড়ে দেয় আর সম্ভাজি ভিদের গায়ে হাতই দেয় না। তবে, পুলিশ দ্রুতই তাদের তদন্তে মোড় ঘোরালো এবং অভিযোগ করল যে মানবাধিকার আন্দোলনের আইনজীবীরাই জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে ভীমা কোরেগাঁওয়ের সংঘর্ষকে উস্কিয়ে তুলেছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৮’র জুন থেকে কয়েকমাসের মধ্যে পুলিশ ১৬ জনকে গ্ৰেপ্তার করল। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগকে জোরদার করতে এদের সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগের কথা ওঠানো হল। আরও বলা হল, এরা সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত এবং এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্রেও শামিল।

All the arrested accused released immediately

এই অভিযোগগুলোর সপক্ষে পুলিশ তাদের চার্জশিটে যে সাক্ষ্যপ্রমাণ তুলে ধরেছে সেগুলো তারা অভিযুক্তদের ল্যাপটপ আর মোবাইল ফোন থেকে সংগ্রহ করেছে বলে দাবি করে। এখন আমরা জানি, ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও’র তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার এবং নেটওয়্যার দিয়ে অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক ও সমাজ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভীমা কোরেগাঁওয়ের মামলায় অভিযুক্তদের ল্যাপটপ এবং ফোনেও জাল সাক্ষ্যপ্রমাণ ঢোকানো হয়েছিল। মাত্র কদিন আগে, গত ১৮ ডিসেম্বরের দ্য টেলিগ্ৰাফ পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়েছে — ভীমা কোরেগাঁও মামলায় দুই অভিযুক্ত রোনা উইলসন এবং সুরেন্দ্র গ্যাডলিং-এর কম্পিউটার হ্যাক করে তাতে জাল করে বানানো অপরাধের প্রমাণ ঢোকানো হয়েছিল বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেনসিক ফার্ম আর্সেনাল কনসাল্টিং আগেই জানিয়েছিল। এখন আবার আর্সেনাল কনসাল্টিং জানিয়েছে — যে রিপোর্টটা দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে — রোনা উইলসনের মোবাইল ফোনেও পেগাসাস স্পাইওয়্যার হানা দিয়ে তাতে ষড়যন্ত্রমূলক অনেকগুলো মেসেজ ঢুকিয়েছে। এই সংবাদ প্রকাশের পর মানবাধিকার সংগঠন পিইউসিএল বলেছে, “আর্সেনালের কাছ থেকে পাওয়া চারটে রিপোর্টকে একসঙ্গে বিচার করলে দেখা যায়, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণের কোনো ভিত্তিই নেই। সমস্ত অভিযুক্তকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। আমরা আশা করি, বিচার বিভাগ এই বিষয়টা অনুধাবন করবে যে, ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যপ্রমাণকে জাল করা ও তাতে কারচুপি করা যায় এবং আর্সেনালের কাছ থেকে পাওয়া ফরেনসিক তদন্তমূলক রিপোর্টের মতো রিপোর্টগুলোর গুরুত্বকে বিচারের জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণের নয়া নীতি ও সে সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের প্রয়োজন।”

ল্যাপটপ থেকে পাওয়া আরও যে সাক্ষ্যপ্রমাণের উল্লেখ পুলিশ করেছে তারা হল কিছু চিঠি, যেগুলোতে নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার পরিকল্পনা, এম-৪ রাইফেল ও চারলক্ষ গোলাগুলি জোগাড়ের কথা রয়েছে। চিঠিগুলো কিন্তু হাতে লেখা নয়, সেগুলো টাইপ করা এবং তাতে কারুর স্বাক্ষর নেই।

এই সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয় এবং এমন সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মামলা যে কমজোরি হবে তা অনিবার্য। অভিযুক্তদের তিনবছরের বেশি সময় ধরে আটক রাখা এবং প্রথম চার্জশিট পেশ হয়ে তিনবছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারল না এবং এখনো কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা গেল না, সেটাও অভিযোগ ও মামলার দুর্বলতা এবং সরকারের দুরভিপ্রায়ের দিকেই ইঙ্গিত করে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের গ্ৰেপ্তারির পিছনে বিনাবিচারে আটক রাখার দুরভিসন্ধিই যে কাজ করেছে তার সপক্ষে অন্য একটা দৃষ্টান্তও রয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় তদন্ত প্রথমে করছিল পুনে পুলিশ, তখন মহারাষ্ট্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার। কিন্তু মহারাষ্ট্রে বিজেপি ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়ে শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্ৰেস জোট রাজ্যে ক্ষমতায় এলে নতুন সরকার ভীমা কোরেগাঁওয়ের হিংসার ঘটনার তদন্তে একটা বিশেষ তদন্তকারী দল গঠনের কথা বলে। বিজেপি এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, তাদের অভিপ্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। তদন্তকে নিজেদের কাঙ্খিত ধারায় চালিয়ে যেতে তদন্তের দায়িত্বভার পুনে পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে তুলে দেয় এনআইএ’র হাতে। এই মামলায় যারা অভিযুক্ত তারা সবাই মানবাধিকার ও সমাজ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত, সরকারের বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় সংকোচহীন।

 Bhima Koregaon case

সরকারের সমালোচকদের মোদী সরকার বৈরী বলেই জ্ঞান করে এবং তাদের মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সর্বশক্তির প্রয়োগ ঘটায়। ছাত্র আন্দোলনের তিন কর্মী দেবাঙ্গনা কলিতা, নাতাশা নারওয়াল এবং আসিফ ইকবাল তানহার জামিন মঞ্জুর করতে গিয়ে দিল্লী হাইকোর্ট তাদের রায়ে যা বলেছিল তা বর্তমান প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য — “মনে হচ্ছে যে, বিরোধিতা দমনে ব্যাকুল হয়ে উঠে রাষ্ট্রের মানসিকতায় সংবিধান স্বীকৃত প্রতিবাদের অধিকার এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মধ্যে ভেদরেখা কিছুটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এই মানসিকতা গতি পেলে তা হবে গণতন্ত্রের পক্ষে এক বেদনাদায়ক দিন।” ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেও সরকার তার সমালোচকদের সন্ত্রাসবাদী প্রতিপন্ন করতেই সচেষ্ট হয়েছে।

এই ধরনের কণ্ঠস্বরগুলোকে দমন করতে এবং তাদের সক্রিয়তায় লাগাম পরাতে কারান্তরীণ করে রাখার কৌশল সরকারের কাছে এক সুবিধাজনক উপায় হতে পারে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় গ্ৰেপ্তার হওয়া ১৬ জনের মধ্যে ফাদার স্ট্যানস্বামী মারা গেছেন এবং ভারভারা রাও ও সুধা ভরদ্বাজ জামিন পেয়েছেন। ন্যায়বিচার বাকি ১৩ জনেরও অবিলম্বে মুক্তির দাবি করে। এদের মুক্তির জন্য ওয়াতালি মামলার পুনর্বিবেচনার দরকার হলে সুপ্রিম কোর্টকে তা করতে হবে। সরকারের বিষ নজরে পড়া ব্যক্তিদের দীর্ঘকাল ধরে বিনাবিচারে আটক গণতন্ত্রের লজ্জা, মানবাধিকারের অবমাননা।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-28
সংখ্যা-46