ডেউচা-পাঁচামি কয়লা খনি প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে রাজ্য সরকার এখন পর্যন্ত যেভাবে এগিয়েছে তা চরম অগণতান্ত্রিক ও আইনবিরুদ্ধ। জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের প্রশ্নে ২০১৩ সালের আইনকে অমান্য করা হচ্ছে। প্রকল্পের সামাজিক প্রভাব ও পরিবেশগত প্রভাব খতিয়ে দেখে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট সর্বসমক্ষে হাজির করা, প্রকল্প এলাকার মানুষকে অবহিত করে জনশুনানি করা এবং পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া আবশ্যক। এইসব প্রক্রিয়াকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাজ্য সরকার আগেভাগে ক্ষতিপূরণের একটা প্যাকেজ ঘোষণা করে দিয়েছে। এখন বীরভূম জেলা প্রশাসন স্থানীয় মানুষের উপর চাপ সৃষ্টি করে জমি অধিগ্রহণের সম্মতি আদায় করে নিতে চাইছে। স্থানীয় জনগণ এবং বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে, শুরু হয়ে গেছে পুলিশি দমন-নিপীড়ন। এই পরিস্থিতিতে সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
এই কয়লা খনি প্রকল্প নিয়ে আপত্তির আরও কারণ রয়েছে। এলাকার চার হাজারের উপর পরিবার উচ্ছেদ হবে, যাদের অধিকাংশই আদিবাসী-জনজাতি এবং সংখ্যালঘু। প্রকল্প এলাকার চারপাশের বহু গ্রাম, গঞ্জ ও শহরের আকাশ-বাতাস ও জনস্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হবে এবং সামাজিক জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠবে। দ্বারকা নদী এবং প্রকল্পের বহু দূর পর্যন্ত কৃষিক্ষেত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সর্বোপরি, নতুন করে আরও দুশো কোটি টন কয়লা পোড়ালে যে বিপুল কার্বন নিঃসরণ ঘটবে তা বিশ্ব উষ্ণায়নকে ত্বরান্বিত করবে। সুন্দরবন সহ দুই চব্বিশ পরগণা ও পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আগামী কয়েক দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে জলের তলায় তলিয়ে যাওয়ার বিপদসীমায় দাঁড়িয়ে আছে। জলবায়ু সঙ্কটের ধাক্কা ঘনঘন সমুদ্রঝড়ের মাধ্যমে আমরা খানিকটা প্রত্যক্ষ করতেও শুরু করেছি। কিন্তু রাজ্য সরকার এইসবের কোনো তোয়াক্কা করছে না।
পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু সঙ্কটের প্রেক্ষিতে আগামী ১০০ বছর কয়লার যোগান দেওয়ার জন্য আরেকটা নতুন কয়লা খনির আদপেও কি কোনো প্রয়োজন আছে? এতে বাড়তি কর্মসংস্থান কতই বা হবে এবং কিসের বিনিময়ে? বিশ্বজুড়ে যখন কয়লা এবং খনিজ তেলের বিকল্প হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে, ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই রাস্তায় হাঁটছে না কেন? এই সমস্ত প্রশ্নে রাজ্যজুড়ে গণবিতর্কের প্রয়োজন আছে।
দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙা অঞ্চলে বলপূর্বক জমি অধিগ্রহণ রুখতে, স্থানীয় মানুষের জমি-জীবন-জীবিকার অধিকার রক্ষার্থে এবং কয়লা চালিত বিদ্যুতের বিকল্প, পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের দাবিতে আগামী ৬ জানুয়ারি, বেলা ১২টায় সিউড়ি জেলাশাসক দপ্তরে বিক্ষোভ ও ডেপুটেশন কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের সকল প্রগতিশীল, গণতন্ত্রপ্রিয় শক্তি এবং ব্যক্তিদের এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সবান্ধবে শামিল হওয়ার আহ্বান জানাতে উদ্যোগী হয়েছেন নানা বিশিষ্টজন।
বিপর্যয়কর কয়লা খনি প্রশ্নে এলাকার সাধারণ মানুষের বিরোধিতা যত স্পষ্ট চেহারা নিচ্ছে ততই প্রকট হয়ে উঠছে পুলিশ ও শাসকদলের সন্ত্রাস। গত নভেম্বরে হরিণসিঙার বিক্ষোভের পর থেকে সংগঠকদের থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে ‘বোঝানো’ চলছিলই, তারপর গত ১৮ ডিসেম্বর দেওয়ানগঞ্জে বহু মানুষ সমবেত হয়ে খনির বিরোধিতা করার পরও সংগঠকদের তুলে নিয়ে গিয়ে সারাদিন আটক করে রাখা হয় এবং ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টে কেস দেওয়া হয়। গতকাল কিছু টিএমসি নেতা নিজস্ব দলবল ও পুলিশবাহিনী সাথে নিয়ে দেওয়ানগঞ্জে ঢোকার পর স্থানীয় মহিলারা খনির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে পুলিশ তাঁদের ওপর নির্মম লাঠিচার্জ করে। বেশ কয়েকজন মহিলা আহত হয়েছেন। পুলিশ এমনকি আহতদের সিউড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতেও বাধা দেয়। পাহাড়ের ঘুরপথে শেষ পর্যন্ত মল্লারপুর হাসপাতালে আহতদের নিয়ে যেতে সক্ষম হন গ্রামবাসীরা।
দেওয়ানগঞ্জের আদিবাসী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মহিলাদের ওপর এই সরকারি সন্ত্রাসকে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন “ডেউচা সিঙ্গুর হবে না”, কিন্তু গ্রামবাসীদের ওপর সন্ত্রাস চালিয়ে এলাকা জবরদখল করার একই অপচেষ্টা সামনে আসতে শুরু করেছে, সরকার সাবধান না হলে পরিণতিও একই হবে।
অবিলম্বে দেওয়ানগঞ্জের হামলাকারি টিএমসি নেতা ও পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সন্ত্রাস সম্পূর্ণ বন্ধ করে গ্রামবাসীদের নির্ভয়ে নিজেদের কথা বলতে দিতে হবে।
দেউচা-পাঁচামীতে সরকারি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গত ২৪ ডিসেম্বর কলকাতায় মৌলালি মোড়ে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়। গতকাল দেওয়ানগঞ্জে মহিলাদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনাকে তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানান রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার। আহতদের চিকিৎসা ও অবিলম্বে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থার দাবি তোলেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকটের প্রেক্ষাপটে দেউচা-পাঁচামি কয়লা খনি প্রকল্পের নীতিগত বিরোধিতা করে তিনি বলেন, সরকারি সংস্থা পরিবেশগত প্রভাব খতিয়ে দেখা তো দূরের কথা — সামাজিক প্রভাবও এখনও খতিয়ে দেখতে পারেনি। ২০১৩ সালের জমি আইনে গ্রামবাসীদের মতামতকে মান্যতা দেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয়েছিল তাকেও নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। আর এখন তো সরাসরি সন্ত্রাসের রাস্তা নিচ্ছে সরকার। তিনি রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে এই বিপর্যয়ের রাস্তা থেকে সরে আসার দাবি তোলেন এবং এই প্রশ্নে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন লড়াই গড়ে তুলবে বলে জানান।
এছাড়া বক্তব্য রাখেন পার্টির কলকাতা জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী, রাজ্য কমিটি সদস্য মলয় তেওয়ারি, মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদক ইন্দ্রানী দত্ত এবং ছাত্রনেতা সৌমেন্দু মিত্র। সকলেই দেওয়ানগঞ্জে সরকারি সন্ত্রাসকে ধিক্কার জানান এবং এই প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিরোধিতা করেন। দিনের কর্মসূচি থেকে দাবি ওঠে, এই প্রকল্পের সাথে ওই এলাকার মানুষের উচ্ছেদের প্রশ্ন জড়িত আছে কেবল তা নয়, সকলেরই সুস্থ-সবল ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িত আছে, পরিবেশগত স্থিতিশীলতার প্রশ্ন জড়িত আছে। সুতরাং এলাকার মানুষের কাছে এই সমস্ত দিক তুলে ধরার পর তাঁদের স্বাধীন মতামত নিতে হবে, সন্ত্রাস চালিয়ে নয়।
শিলিগুড়িতে প্রতিবাদ
দেওয়ানগঞ্জে আদিবাসী মহিলাদের উপর তৃণমূলী বাহিনীর হামলার বিরুদ্ধে ও দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও দেউচা-পাঁচামি প্রকল্প বাতিলের দাবিতে গত ২৩ ডিসেম্বর শিলিগুড়িতে হাসমি চকে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। নেতৃত্ব দেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ সহ মুক্তি সরকার, মোজাম্মেল হক, মীরা চতুর্বেদী, রঞ্জনা সরকার, প্রলয় চতুর্বদী প্রমুখ।
দেওয়ানগঞ্জে পুলিশী আক্রমণে আহতদের চিকিৎসা এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবিতে রাজ্যের অন্যান্য জায়গার সাথে শিলিগুড়ির শক্তিগড়ে জলপাইমোড় বাজারে বিক্ষোভ দেখানো হয়। বক্তব্য রাখেন পার্টির শক্তিগড় ব্রাঞ্চের পক্ষে শাশ্বতী সেনগুপ্ত, রুবী সেনগুপ্ত, রজত বর্মন, মন্টু রায়, ভাগ্য মন্ডল, সানিয়া মন্ডল, গঙ্গা রায় প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন পবিত্র সিংহ, মীরা চতুর্বেদী, মোজাম্মেল হক, শরৎ সিংহ প্রমুখ।
বিশ্বভারতীর পর খড়গপুর আইআইটি, তারপর শিবপুর আইআইইএসটি। এবিভিপি-বিজেপি-আরএসএস-এর সুপরিকল্পিত ত্রিশূল হানা চলছেই। তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কেন্দ্রের মোদী সরকারের প্রভাব খাটানোর প্রতাপ রয়েছে। সেই জোরে গৈরিকায়নের শক্তিগুলো এতো খোলাখুলি বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, দুঃসাহস দেখাতে পারছে। কারো আর বুঝতে বাকি নেই যে বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য মশাই হলেন কেন্দ্রের উদ্দেশ্য হাসিলের এক পরিকল্পিত বিনিয়োগ, নিজের মুখোশ তিনি নিজেও খুলেছেন নির্লজ্জের মতন, আর তা বিজেপিও বুঝিয়ে দিয়েছে তাঁর সপক্ষে ন্যক্কারজনকভাবে সাফাই গেয়ে। উপাচার্যের নিয়োগ পরিকল্পনার পিছনে বিজেপির লক্ষ্য ছিল রাজ্যের গত বিধানসভা নির্বাচন, রাজ্যপালকে নিয়ে ছক কষার মতোই। যদি এক ঢিলে দুই পাখী মারা সম্ভব হয় সেই চেষ্টায়। একদিকে উদার মানবতাপ্রবাহের বিশ্বভারতীর জঘন্য গেরুয়াকরণ ঘটানো, অন্যদিকে বঙ্গ সমাজের বর্ণহিন্দু শিক্ষিত অংশের ভেতর থেকে বিজেপির জন্য প্রশ্নাতীত আনুগত্যের বর্গ তৈরি করা। যারা হয়ে উঠতে পারেন বিজেপির ভাষায় তার বিশেষ ‘সামাজিক প্রচারক ও বিস্তারক’, যাদের ভাঙিয়ে নতুন ভোটবাজার বানানো যাবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এসেছিলেন সফরের উদ্দেশ্য হাসিলের বার্তা দিতে, কিন্তু অমিত শাহকে এনে ‘কুলশীল’দের কোনও অংশকেই মোহের ফাঁদে ধরা সম্ভব নয়, হয়নি। অগত্যা উপাচার্য-বিজেপি মিলে শলা করে রাজ্যসভার এক বিজেপি সাংসদকে এনে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির আসর জমাতে। সঙ্গতে রাখা হয় এবিভিপি-কে। কিন্তু বাধ সাধে নাছোড় বাম-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের বিভিন্ন অংশ, পাশে দাঁড়ায় সুশীল সমাজের নানা অংশ। চলে লাগাতার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। যার ফলে পিছু হঠতে হয় উপাচার্য ও তাঁর পারিষদবর্গকে, তাঁর নিয়োগ কর্তাদেরও। ইতিমধ্যে বিধানসভা নির্বাচনী সাধ পূরণ হয়নি, তবে হতোদ্যম না হয়ে পুনরুত্থানের চেষ্টায় বিজেপি মরীয়া। তারই অঙ্গ হিসাবে ঝাঁপাচ্ছে খড়গপুরে, শিবপুরে।
খড়গপুর আইআইটি-তে শুরু হয়েছে এক নয়া কার্যক্রম। প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করা ও অপবিজ্ঞান প্রচার করার শয়তানি। ক্রিয়াশীল গেরুয়াপন্থীরা বেশ তৎপর। কার্যকলাপ চালানো হচ্ছে নানা গালভরা গুরুগম্ভীর বিষয় নামাঙ্কনের বহিরঙ্গে। ‘সেন্টার অব এক্সসেলেন্স ফর ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’! ‘রিকভারি অব দ্য ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’! এইসব নিয়ে বানানো হয়েছে ২০২২-এর ক্যালেন্ডার। আসলে অপচেষ্টা চলছে মদতের জোর খাটিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চার এক প্রখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রকে অসত্য, বিকৃতি, অপবিজ্ঞান প্রচারের আখড়া বানানোর। তবে এই অভিলাষ অচিরেই সম্মুখীন হচ্ছে সংবেদনশীল-সচেতন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের। গড়ে উঠেছে রুখে দেওয়ার প্রাথমিক উদ্যোগ — ছাত্র-অশিক্ষক-অধ্যাপকদের “সংহতি মঞ্চ”। মঞ্চ পাল্টা নিরবচ্ছিন্ন প্রচার চালাচ্ছে, জনমত গড়ে তুলছে, কর্তৃপক্ষের উপরেও অবিরাম চাপ রাখছে, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির উদ্দেশ্য প্রণোদিত ‘নলেজ সিস্টেম’ ইত্যাদি বন্ধ করে দেওয়ার দাবিতে। তাদের লড়াই সাহায্য সমর্থন পেতে শুরু করেছে ক্যাম্পাসের বাইরেও।
শিবপুর আইআইইএসটি-তে সম্প্রতি সংঘটিত হতে দেখা গেল সংঘী সংস্কৃতির আরেক নতুন মহড়া। প্রথম বর্ষে অন্তর্ভুক্তির ভার্চুয়াল কর্মশালা চালানোর সময় শোনানো হয় হিন্দুত্বের মাহাত্ম্য প্রচারের বক্তৃতাবাজি! শুধু তাই নয়, চরম ঔদ্ধত্য দেখালেন প্রতিষ্ঠানের ‘চীফ ওয়ার্ডেন’, প্রদর্শন করলেন তাঁর এবিভিপি রাজ্য সভাপতি পদের পরিচয়পত্রটিও। নিহিত উদ্দেশ্য সেই একই — গেরুয়াকরণ তথা বিদ্বেষ-বিভাজনের ধংসাত্মক প্রয়াস চালানো। সব দেখেও কর্তৃপক্ষ রয়েছে নিষ্ক্রিয় উদাসীন অবস্থায়। শিবপুরের আইআইইএসটি-কে যদি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বাঁচাতে হয় তবে এখনই শুরু করতে হবে সংগঠিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ।
পশ্চিমবাংলায় বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর প্রচলন রয়েছে বহু দশক যাবত। যদিও এই চলতি পরম্পরা কোনও সাম্প্রদায়িক দূষণ এখনও ছড়ানোর কারণ হয়নি। কিন্তু সেদিকে গড়ায়নি বলে যে রীতি চলে আসছে তা নিয়ে নতুন চেতনায় কোনও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে না তা নয়। এপ্রশ্ন ওঠানো যেতেই পারে আরও বহু কারণে। ইতিমধ্যে বিজেপি হিড়িক তুলতে শুরু করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পুজো আবশ্যিক করা ও গীতা পাঠ চালু করার; তাছাড়া ভগবৎগীতাকে ‘জাতীয় ধর্মগ্রন্থ’ করার দাবি তুলেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এই সবকিছুই চলছে আরএসএস এবং বিজেপির যুগল যোজনায়।
এইসব দূষণ ও সংক্রমণ থেকে নাগরিক সমাজ ও সভ্যতাকে রক্ষা করতে হবে, তার জন্য নামতে হবে বিরুদ্ধতার পথে।
লোকসভায় নির্বাচন আইন (সংশোধনী) বিল ২০২১’র পাশ করানোটা ভারতের গণতন্ত্রের ধ্বংস সাধনের লক্ষ্যে এক বিপজ্জনক পদক্ষেপ। এই প্রস্তাবিত সংশোধনীটি ভোটাধিকারের সাথে আধার যাচাইয়ের সংযুক্তির পক্ষে। অনেকজন বিরোধী সাংসদের দাবি ছিল এই বিলটিকে একটি সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানোর, যে কমিটি এর প্রয়োগ সম্পর্কে পর্যালোচনা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারতো। কিন্তু বিরোধীদের এই দাবিকে ধামাচাপা দিয়ে অন্যান্য অনেক জনবিরোধী আইনের মতোই এই বিলটাকেও লোকসভায় ধ্বনি ভোটে পাশ করিয়ে যাবতীয় আপত্তিকে উড়িয়ে দেওয়া হল।
২০১৭-তে ঐতিহাসিক সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ে বলা হয় যে গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার — ভারত সরকার এই আধার সংযোগের পক্ষে দাঁড়িয়ে সেই অধিকারকেই নাকচ করে দিচ্ছে। ২০১৮-তে শীর্ষ আদালত আধারের সাংবিধানিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরে এবং এর ব্যবহারকে কেবল রাষ্ট্রচালিত কল্যাণমূলক কর্মসূচির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ করে। ভোটার আইডি’র সঙ্গে আধার সংযোগের লক্ষ্যে ভোটার তালিকা সংশোধন ও যাচাইয়ের উপর ২০১৫-তে শীর্ষ আদালতেরই জারি করা একটি স্থগিতাদেশের কথাও আদালত ২০১৮-তে তুলে ধরে। ঐবছরেই তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশিকা লঙ্ঘন করে ভোটার পরিচয়পত্রের সঙ্গে আধার সংযোগ করায় — ফলে অন্ততপক্ষে ৫৫ লক্ষ ভোটারের নাম যথেচ্ছভাবে ভোটার তালিকা থেকে মুছে যায়।
ইতিমধ্যেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আধার সংযোগের ফলে গণবণ্টন ও কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের সুযোগসুবিধা থেকে গণহারে প্রচুর দরিদ্র ও অভাবী মানুষ বাদ পড়ে গিয়েছেন যার পরিণতিতে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা অবধি ঘটেছে। আধার সংযোগ তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে বিপুল সংখ্যক ভোটারকে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। উপরন্তু এটাও স্পষ্ট যে এই আধার ভোটার পরিচয়ের সাথে মোবাইল ফোন ও তার মারফত সোশ্যাল মিডিয়ারও সংযোগ করবে যা অনিবার্যভাবেই ভোটারের সামাজিক অবস্থান ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সহ অন্যান্য বিষয়কে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েই তার প্রোফাইল তৈরিতে সাহায্য করবে। এরফলে ভোটার তালিকায় শাসকের পছন্দ-অপছন্দ অনুসারে কারচুপির বা নাম মুছে ফেলার অবকাশও তৈরি হবে। এই পদক্ষেপ সমস্ত ভোটারকে শাসকদলের দয়াদাক্ষিণ্য বা ক্ষমাপ্রার্থী করে তোলার দিকেই এগোবে যেহেতু শাসকদলের হাতে আধার মারফত কল্যাণমূলক প্রকল্প ও ভোটাধিকার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ থাকবে।
আধার সংযোগ বিষয়টি নাকি ‘ঐচ্ছিক’ — এতকিছুর পরেও সরকারের এই দাবিটা কার্যত বিভ্রান্তিকর। ভোটদানের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণ এটাকে তো বাধ্যতামূলকই করে তুলবে, যেভাবে সামাজিক প্রকল্পের সঙ্গে এর সংযুক্তিকরণ শেষবিচারে বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধার নাকি তথ্যভিত্তিকে ‘পরিশোধন’ করে — এই দাবিটাও অবান্তর কারণ যেহেতু আধার ডেটাবেসের মধ্যেই মনুষ্যসৃষ্ট বহু ত্রুটি এমনকি ভুয়ো তথ্যের প্রমাণ রয়েছে, যা ভোটার তালিকায় থাকা অসঙ্গতির থেকেও বেশি।
আধার নাগরিকত্বের কোনো প্রামাণ্য নথি নয়। তাই ভোটদানের সঙ্গে এর সংযুক্তিকরণ গণতন্ত্রের জন্য একটা বড় ধাক্কা। সুতরাং গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরার লক্ষ্যে এই দাঁত, নখ বের করা পদক্ষেপকে যেকোনো মূল্যে আটকাতেই হবে। আধার বাতিল করার দাবি তুলুন! ভোটদানের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণের উদ্যোগকে মুখের উপর নাকচ করে দিন!
- সিপিআই (এম-এল) কেন্দ্রীয় কমিটি
ধানকাটার মরশুমের মধ্যপর্বে উপর্যুপরি বৃষ্টিপাতে যে অভূতপূর্ব বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তারফলে চাষিরা অনেকেই পাকা ধান খামারে তুলতে পারেননি এবং আলু চাষের অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে। বহু কষ্ট করে চাষিরা যে জমিতে আলু বসিয়েছিলেন সে সবই সম্পূর্ণত নষ্ট হয়ে গেছে। হুগলী ও পূর্ব বর্ধমানে আলুই হল প্রধান অর্থকরী ফসল। যেকোনও মূল্যে কৃষকদের এই ফসলের আবাদ করতেই হবে। নতুন করে আবার কীভাবে চাষ করা যাবে সেই চিন্তায় ঋণগ্রস্ত চাষিদের রাতের ঘুম চলে গেছে। কৃষকদের এই মহাদুর্দিনে, কৃষিঋণ মকুবের দাবিতে সারা ভারত কিষাণ মহাসভার পান্ডুয়া ব্লক কমিটি গত ২৬ ডিসেম্বর বৈঁচিতে এক গণকনভেনশন সংগঠিত করে। কনভেনশনে উত্থাপিত প্রস্তাবনায় বলা হয়, “সমবায় সমিতি বা ব্যাঙ্ক কর্তৃক প্রদত্ত সমস্ত কৃষিঋণ যদি মকুব করা হয় তাহলে এই ভয়াবহ সঙ্কট থেকে কৃষকরা, কিছুটা হলেও, রেহাই পেতে পারেন। বলা বাহুল্য, কৃষকদের এক বড় অংশই ভাগচাষি বা ঠিকাচাষি। নিজস্ব কোনও জমি না থাকায় সরকারি/প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ থেকে তাঁরা বঞ্চিত। সে কারণে তাঁদের ক্ষতিপূরণে সরকারকে নগদ অর্থ সাহায্যে উদ্যোগী হতে হবে। এরই সাথে সাথে অভাবি বিক্রি রোধের জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সরকারকে সহজ ও মসৃণ পদ্ধতিতে ধান সংগ্রহ করতে হবে।” কনভেনশনের প্রস্তাবে সরকারের নিকট সুনির্দিষ্ট দাবি জানানো হয়।
১) অবিলম্বে সমস্ত কৃষিঋণ মকুব করতে হবে। নিজস্ব জমি নেই এমন গরিব চাষি — যারা ঠিকা বা অন্য প্রথায় চাষ করেছেন তাদেরও (শস্যহানির জন্য) আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে হবে।
২) বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত আলু ও ধান সহ সমস্ত ফসলের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩) ন্যায্যমূল্যে সার ও বীজ সরবরাহে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৪) প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে সরকারি উদ্যোগে, কমপক্ষে একটি করে ধান সংগ্রহের স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে এবং সরকারি উদ্যোগে ধান সংগ্রহে হয়রানিমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।
কনভেনশনের মূল প্রস্তাবের সমর্থনে বক্তব্য রাখার সময় বক্তারা প্রত্যেকেই দিল্লীর ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে আনেন এবং বলেন, এরাজ্যেও কৃষক সমস্যার প্রতি নির্বিকার যে রাজ্য সরকার তার বিরুদ্ধেও ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়পণ সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন আয়ারলা’র হুগলী জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন বাগ, কিষাণ মহাসভার (এআইকেএম) রাজ্য যুগ্ম-সম্পাদক তপন বটব্যাল, সারা ভারত কিষাণ সভার পান্ডুয়া ব্লক সভাপতি গোপাল হেমরম ও সঞ্জীব ব্যানার্জী এবং খেতমজুর ইউনিয়নের সুভাষ ক্ষেত্রপাল।
কনভেনশনের মূল প্রস্তাবের পাশাপাশি অপর এক প্রস্তাবে দেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্পে পরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নকে লঙ্ঘন করে ও ২০১৩’র সংশ্লিষ্ট আইনকে পাশ কাটিয়ে, গ্রামবাসীদের সম্মতি ছাড়াই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে দেওয়ানগঞ্জে প্রতিবাদী মহিলাদের ওপর পুলিশী বর্বরতার নিন্দা জানানো হয় এবং প্রকল্প এলাকার সংগ্রামী জনগণের ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি সহমর্মীতা জ্ঞাপন করা হয়। ভালো সংখ্যক কৃষক ও কৃষিজীবী মানুষের উপস্থিতিতে এই কনভেনশনের শুরুতে ‘হরাল আদিবাসী গাঁওতা’র শিল্পীদের পরিবেশিত লোকনৃত্য কনভেনশনকে আকর্ষণীয় করে তোলে। এছাড়া গণসংস্কৃতি পরিষদের ‘সংযোগ সাংস্কৃতিক সংস্থা’র শিল্পীদের গণসঙ্গীত ছিল কনভেনশনের সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই। সবশেষে কনভেনশন মঞ্চ থেকে, মূল দাবিগুলির সপক্ষে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে নতুন বছরের শুরুতে ডিএম ডেপুটেশনের কর্মসূচি ঘোষিত হয়।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও গত প্রায় দু’বছর যাবত করোনা অতিমারির কারণে গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়ে সাংঘাতিক অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত। এরমধ্যে নিম্নচাপের কারণে অসময়ের বৃষ্টিতে রাজ্যের কয়েকটি জেলার বেশ কিছু ব্লকের সাথে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট ১নং ব্লকের ৭টি পঞ্চায়েত এলাকায়ও আমন ধান ও রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় কৃষকরা চরম আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে, তারমধ্যে অনেকেই ঋণগ্রস্ত। কৃষকদের অধিকাংশই ক্ষুদ্র, ভাগ ও লিজ চাষি। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে কৃষকের সবচেয়ে বেশি ফসলের ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নে এখনও পর্যন্ত সরকার নীরব।
এই সময়ে সরকারের কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার প্রশ্নেও দেখা যায়, ভাগ ও লিজ সহ প্রকৃত যারা চাষ করেছেন, সেই কৃষকরা ধান বিক্রি করতে পারছেন না, ফড়ে-দালালরা ধান বিক্রি করছে। কৃষকরা সরকারের কাছে ধান বিক্রির সুযোগ না পেয়ে বাধ্য হচ্ছেন ফড়ে-দালালদের কাছে কুইন্টাল প্রতি ১,২০০/১,৩০০ টাকায় বিক্রি করতে এবং ফড়ে-দালালরা সেই ধান সরকারের কাছে বিক্রি করছে সরকারি দর ১,৯৬০ টাকায়। সরকার নির্ধারিত মূল্য পাওয়ার প্রশ্নে কৃষকদের সর্বনাশ, ফড়েদের পৌষমাস! এই ‘খেলা চলছে’ শাসকদল তৃণমূলের কলকাঠিতে।
এমতাবস্থায়, গত ২২ ডিসেম্বর বসিরহাট ১নং ব্লকের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের কাছে গণডেপুটেশন দেওয়া হয় সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির বসিরহাট আঞ্চলিক কমিটির পক্ষ থেকে। ঐদিন বসিরহাট টাউন হলের মাঠ থেকে কৃষক-ক্ষেতমজুররা লাঙ্গল-কোদাল-মই সহ মিছিল করে ইটিন্ডা রোড ধরে বসিরহাট ১নং ব্লক অফিস চত্বরে পৌঁছান। সেখানে কৃষক, ক্ষেতমজুর সহ গ্রামীণ মানুষের দাবির সমর্থনে সভা হয়। বক্তব্য রাখেন সারা ভারত কিষাণ মহাসভার রাজ্যনেতা দিলীপ পাল ও সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির পক্ষে নির্মল ঘোষ। সভা পরিচালনা ও গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের বাবুনি মজুমদার।
সভা চলাকালীন সময়ে মোঃ রবিউল মোল্লা, নূর ইসলাম মোল্লা ও দেবব্রত বিশ্বাস এই তিনজনের প্রতিনিধি দল দাবিগুলি নিয়ে সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক’এর সাথে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন। সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক সদর্থক ভূমিকা রাখার আশ্বাস দেন।
দাবিপত্রে উল্লেখ করা হয়,
১) ভাগচাষি ও লিজচাষি সহ সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আলু চাষে বিঘাপিছু ২০ হাজার টাকা এবং ধান ও অন্য রবিশস্যের জন্য বিঘাপিছু ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
২) গ্রামে গ্রামে সরকারকে ক্যাম্প করে ভাগচাষি ও লিজচাষি সহ সমস্ত কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে।
৩) রাসায়নিক সার, বীজ ও কীটনাশক সরকারকে ভাগচাষি ও লিজচাষি সহ সমস্ত কৃষককে বিনামূল্যে ও সঠিক সময়ে সরবরাহ এবং কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে।
৪) গরিব, ভাগচাষি ও লিজচাষিদের সমস্ত সরকারি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৫) সমস্ত কৃষিজীবীদের কিষাণ কেডিট কার্ড দিতে হবে।
৬) ১০০ দিনের কাজ অবিলম্বে ব্লকজুড়ে শুরু করতে হবে এবং মজুরি ৭ দিনের মধ্যে দিতে হবে।
৭) মহাত্মা গান্ধী জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনে ২০০ দিন কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি দিতে হবে।
৮) বার্ধক্যভাতা ও বিধবাভাতা কমপক্ষে ৩,০০০ হাজার টাকা করতে হবে।
ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত সুধা ভরদ্বাজের জেল থেকে জামিনে মুক্তির পিছনে আদালতের যে ইতিবাচক ভূমিকা আছে তা অনস্বীকার্য। বম্বে হাইকোর্ট ১ ডিসেম্বর তাঁর জামিন মঞ্জুর করার পর, আদালতের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এবং জামিন মঞ্জুরিতে স্থগিতাদেশ চেয়ে এনআইএ সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ইউ ইউ ললিত, এস এ ভাট ও বেলা টি ত্রিবেদীর বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, “বম্বে হাইকোর্টের নির্দেশে হস্তক্ষেপের কোনো প্রয়োজন নেই।” মাঝখানে কয়েক বছর, বিশেষভাবে জহুর আহমেদ শাহ ওয়াতালি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এ এম খানউইলকার ও অজয় রাস্তোগির বেঞ্চের রায়ের পর ইউএপিএ আইনে অভিযুক্তদের জন্য জামিনের দরজায় বলতে গেলে তালাই লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই তালা খুলতে সর্বোচ্চ আদালত একান্ত অনিচ্ছুক বলেই মনে হয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালত যেন জানান দিচ্ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছায় তাল মেলানোতেই তার আগ্ৰহ। সম্প্রতি কয়েকটা মামলায় ইউএপিএ’তে অভিযুক্তদের নিম্ন আদালতের জামিন মঞ্জুর এবং সুপ্রিম কোর্টে সেই রায়গুলোর বিরুদ্ধে আপত্তি জানানো হলে নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্তে সর্বোচ্চ আদালতের সম্মতি প্রদান আদালতের ভাবমূর্তি পরিবর্তনের কিছুটা ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এরপরও মাথাচাড়া দিচ্ছে এই প্রশ্নটা যে — সংবিধানের জিম্মাদার হিসাবে, মানবাধিকারের রক্ষকরূপে সর্বোচ্চ আদালতের আত্মঘোষণায় এত শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে কেন? ভীমা কোরেগাঁও মামলায় সুধা ভরদ্বাজ জামিন পেলে অন্য অভিযুক্তদের কারারুদ্ধ থাকতে হবে কেন? প্রকরণগত ত্রুটিই কি জামিন মঞ্জুরের ক্ষেত্রে একমাত্র অন্তরায় বলে বিবেচিত হবে? গ্ৰেপ্তারির পিছনে সরকারের দুরভিসন্ধি রয়েছে কিনা, তাও জামিন না পাওয়ার পিছনে বিচার্য হবেনা কেন?
জেলে তিনবছরেরও বেশি আটক থাকার পর সুধা ভরদ্বাজ মুক্তি পেলেন। তবে, জামিন এসেছে অনেক প্রতিকূল শর্তের ভিত্তিতে। এনআইএ তাঁর জামিনের সঙ্গে ১৬টা কঠোর শর্ত জুড়েছে, তারমধ্যে রয়েছে — তাঁকে মুম্বইয়ে থাকতে হবে, শহরের বাইরে যেতে গেলে আদালতের অনুমতি লাগবে, তাঁর বাড়ি হরিয়ানা এবং কর্মস্থল ছত্তিশগড় হলেও তিনি সেখানে যেতে পারবেন না, মামলা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে বা কোথাও লিখতে পারবেন না, এই মামলায় অভিযুক্ত অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না, প্রভৃতি। তাঁর মুক্তির ক্ষেত্রে আদালতের কাছে নির্ধারক হয়েছে ‘ডিফল্ট বেল’এর আবেদন। চার্জশিট পেশের যে সময়সীমা আইনে বলা আছে, সেই সময়ের মধ্যে চার্জশিট দাখিল না হলে ‘ডিফল্ট বেল’ মঞ্জুরির বিধান আইনে রয়েছে। সুধা গ্ৰেপ্তার হয়েছিলেন ২০১৮ সালের আগস্টে, তাঁর ক্ষেত্রে প্রথম চার্জশিট দাখিল হয়েছিল ২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, আর জেলে তাঁর আটককাল ৯০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি ‘ডিফল্ট বেল’এর আবেদন করেছিলেন ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর। চার্জশিট দাখিল হওয়ার আগে যেহেতু তাঁর ‘ডিফল্ট বেল’এর আবেদন পেশ হয়েছিল, তাঁর জামিন মঞ্জুরিতে আদালত তাই স্বচ্ছন্দ বোধ করেছে। আর অন্য অভিযুক্তদের কারো ক্ষেত্রে ‘ডিফল্ট বেল’এর আবেদন যেহেতু চার্জশিট পেশ হওয়ার পর হয়েছে বা কারো-কারো ক্ষেত্রে গ্ৰেপ্তারির পিছনে অন্যায্যতাকেই জামিন মঞ্জুরির ভিত্তি করা হয়েছে, তাঁদের জামিনের আবেদন তাই বহুবার নাকচ হয়ে বন্দীদশাই তাঁদের ভবিতব্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু জামিনের আবেদনের শুনানিতে মামলার অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বিবেচিত হবে না কেন? ইউএপিএ’তে সমস্ত অভিযুক্তদের জামিনের আবেদন কেন জহুর আহমেদ শাহ ওয়াতালি মামলার রায়ে ছায়াচ্ছন্ন হয়ে থাকবে?
ভীমা কোরেগাঁওয়ের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি, যেদিন উচ্চবর্ণ পেশোয়াদের বিরুদ্ধে জয়ের দ্বিশত বার্ষিকীর উদযাপনে দলিতরা সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। হিন্দুত্ববাদীরা এই সমাবেশকে সুনজরে দেখেনি এবং উগ্ৰ হিন্দুত্ববাদী মিলিন্দ একবোটে ও সম্ভাজি ভিদের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। এই দুই হিন্দুত্ববাদী পাণ্ডার বিরুদ্ধে এফআইআর হলেও পুনে পুলিশ (মহারাষ্ট্রে তখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন ফড়নবিশ সরকার) একবোটেকে গ্ৰেপ্তার করে দু’দিন পর ছেড়ে দেয় আর সম্ভাজি ভিদের গায়ে হাতই দেয় না। তবে, পুলিশ দ্রুতই তাদের তদন্তে মোড় ঘোরালো এবং অভিযোগ করল যে মানবাধিকার আন্দোলনের আইনজীবীরাই জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে ভীমা কোরেগাঁওয়ের সংঘর্ষকে উস্কিয়ে তুলেছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৮’র জুন থেকে কয়েকমাসের মধ্যে পুলিশ ১৬ জনকে গ্ৰেপ্তার করল। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগকে জোরদার করতে এদের সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগের কথা ওঠানো হল। আরও বলা হল, এরা সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত এবং এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্রেও শামিল।
এই অভিযোগগুলোর সপক্ষে পুলিশ তাদের চার্জশিটে যে সাক্ষ্যপ্রমাণ তুলে ধরেছে সেগুলো তারা অভিযুক্তদের ল্যাপটপ আর মোবাইল ফোন থেকে সংগ্রহ করেছে বলে দাবি করে। এখন আমরা জানি, ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও’র তৈরি পেগাসাস স্পাইওয়্যার এবং নেটওয়্যার দিয়ে অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক ও সমাজ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভীমা কোরেগাঁওয়ের মামলায় অভিযুক্তদের ল্যাপটপ এবং ফোনেও জাল সাক্ষ্যপ্রমাণ ঢোকানো হয়েছিল। মাত্র কদিন আগে, গত ১৮ ডিসেম্বরের দ্য টেলিগ্ৰাফ পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়েছে — ভীমা কোরেগাঁও মামলায় দুই অভিযুক্ত রোনা উইলসন এবং সুরেন্দ্র গ্যাডলিং-এর কম্পিউটার হ্যাক করে তাতে জাল করে বানানো অপরাধের প্রমাণ ঢোকানো হয়েছিল বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেনসিক ফার্ম আর্সেনাল কনসাল্টিং আগেই জানিয়েছিল। এখন আবার আর্সেনাল কনসাল্টিং জানিয়েছে — যে রিপোর্টটা দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে — রোনা উইলসনের মোবাইল ফোনেও পেগাসাস স্পাইওয়্যার হানা দিয়ে তাতে ষড়যন্ত্রমূলক অনেকগুলো মেসেজ ঢুকিয়েছে। এই সংবাদ প্রকাশের পর মানবাধিকার সংগঠন পিইউসিএল বলেছে, “আর্সেনালের কাছ থেকে পাওয়া চারটে রিপোর্টকে একসঙ্গে বিচার করলে দেখা যায়, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণের কোনো ভিত্তিই নেই। সমস্ত অভিযুক্তকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। আমরা আশা করি, বিচার বিভাগ এই বিষয়টা অনুধাবন করবে যে, ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যপ্রমাণকে জাল করা ও তাতে কারচুপি করা যায় এবং আর্সেনালের কাছ থেকে পাওয়া ফরেনসিক তদন্তমূলক রিপোর্টের মতো রিপোর্টগুলোর গুরুত্বকে বিচারের জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণের নয়া নীতি ও সে সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের প্রয়োজন।”
ল্যাপটপ থেকে পাওয়া আরও যে সাক্ষ্যপ্রমাণের উল্লেখ পুলিশ করেছে তারা হল কিছু চিঠি, যেগুলোতে নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার পরিকল্পনা, এম-৪ রাইফেল ও চারলক্ষ গোলাগুলি জোগাড়ের কথা রয়েছে। চিঠিগুলো কিন্তু হাতে লেখা নয়, সেগুলো টাইপ করা এবং তাতে কারুর স্বাক্ষর নেই।
এই সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয় এবং এমন সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মামলা যে কমজোরি হবে তা অনিবার্য। অভিযুক্তদের তিনবছরের বেশি সময় ধরে আটক রাখা এবং প্রথম চার্জশিট পেশ হয়ে তিনবছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারল না এবং এখনো কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা গেল না, সেটাও অভিযোগ ও মামলার দুর্বলতা এবং সরকারের দুরভিপ্রায়ের দিকেই ইঙ্গিত করে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের গ্ৰেপ্তারির পিছনে বিনাবিচারে আটক রাখার দুরভিসন্ধিই যে কাজ করেছে তার সপক্ষে অন্য একটা দৃষ্টান্তও রয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় তদন্ত প্রথমে করছিল পুনে পুলিশ, তখন মহারাষ্ট্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার। কিন্তু মহারাষ্ট্রে বিজেপি ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়ে শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্ৰেস জোট রাজ্যে ক্ষমতায় এলে নতুন সরকার ভীমা কোরেগাঁওয়ের হিংসার ঘটনার তদন্তে একটা বিশেষ তদন্তকারী দল গঠনের কথা বলে। বিজেপি এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, তাদের অভিপ্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। তদন্তকে নিজেদের কাঙ্খিত ধারায় চালিয়ে যেতে তদন্তের দায়িত্বভার পুনে পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে তুলে দেয় এনআইএ’র হাতে। এই মামলায় যারা অভিযুক্ত তারা সবাই মানবাধিকার ও সমাজ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত, সরকারের বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় সংকোচহীন।
সরকারের সমালোচকদের মোদী সরকার বৈরী বলেই জ্ঞান করে এবং তাদের মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সর্বশক্তির প্রয়োগ ঘটায়। ছাত্র আন্দোলনের তিন কর্মী দেবাঙ্গনা কলিতা, নাতাশা নারওয়াল এবং আসিফ ইকবাল তানহার জামিন মঞ্জুর করতে গিয়ে দিল্লী হাইকোর্ট তাদের রায়ে যা বলেছিল তা বর্তমান প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য — “মনে হচ্ছে যে, বিরোধিতা দমনে ব্যাকুল হয়ে উঠে রাষ্ট্রের মানসিকতায় সংবিধান স্বীকৃত প্রতিবাদের অধিকার এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মধ্যে ভেদরেখা কিছুটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এই মানসিকতা গতি পেলে তা হবে গণতন্ত্রের পক্ষে এক বেদনাদায়ক দিন।” ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের ক্ষেত্রেও সরকার তার সমালোচকদের সন্ত্রাসবাদী প্রতিপন্ন করতেই সচেষ্ট হয়েছে।
এই ধরনের কণ্ঠস্বরগুলোকে দমন করতে এবং তাদের সক্রিয়তায় লাগাম পরাতে কারান্তরীণ করে রাখার কৌশল সরকারের কাছে এক সুবিধাজনক উপায় হতে পারে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় গ্ৰেপ্তার হওয়া ১৬ জনের মধ্যে ফাদার স্ট্যানস্বামী মারা গেছেন এবং ভারভারা রাও ও সুধা ভরদ্বাজ জামিন পেয়েছেন। ন্যায়বিচার বাকি ১৩ জনেরও অবিলম্বে মুক্তির দাবি করে। এদের মুক্তির জন্য ওয়াতালি মামলার পুনর্বিবেচনার দরকার হলে সুপ্রিম কোর্টকে তা করতে হবে। সরকারের বিষ নজরে পড়া ব্যক্তিদের দীর্ঘকাল ধরে বিনাবিচারে আটক গণতন্ত্রের লজ্জা, মানবাধিকারের অবমাননা।
- জয়দীপ মিত্র
নাগাল্যান্ডের ‘মন’ জেলার ‘ওটিং’ গ্ৰামে ৪ ও ৫ ডিসেম্বর প্যারা কম্যাণ্ডোদের হাতে ১৪ জন শ্রমিক ও গ্ৰামবাসীর হত্যা এবং ৩৫ জনের আহত হওয়ার ঘটনা শুধু নাগাল্যান্ড নয়, সমগ্ৰ উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই সেনাদের নিপীড়ন ক্ষমতার বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছিল। এরসাথেই উঠেছিল নাগাল্যান্ড সহ গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকেই সেনা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আফস্পা) প্রত্যাহারের দাবি। কেননা, আফস্পা আছে বলেই সেনারা নিপীড়ন চালাতে পারে। নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেফিউ রিও এবং মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা আফস্পা প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণের দাবিতেই গলা মেলান। প্রত্যাহারের দাবি এতটা জোরালো হয়েছে যে রাজ্য সরকারের পক্ষেও তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। সেই দাবির পক্ষে প্রস্তাব গ্ৰহণ করতে নাগাল্যান্ড বিধানসভার একদিনের বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হল ২০ ডিসেম্বর। অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত প্রস্তাবে নাগাল্যান্ড এবং সমগ্ৰ উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “নাগাল্যান্ড বিধানসভা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই দাবি জানাচ্ছে যে, ভারত সরকারকে উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে, এবং বিশেষভাবে নাগাল্যান্ড থেকে, আফস্পা প্রত্যাহার করে নিতে হবে, যাতে নাগাদের রাজনৈতিক ইস্যুটির শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে চলমান প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করে তোলা যায়।” প্রস্তাবের বয়ান থেকে স্পষ্ট, নাগা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে পৌঁছানোর লক্ষ্যে, এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের পথে আফস্পা এক প্রতিবন্ধক হয়েই থাকছে। সেনাবাহিনী অবলীলায় নিরীহ নিরপরাধ নাগরিকদের হত্যাকাণ্ড সংঘটনের ক্ষমতা পায় আফস্পা থেকে, যে আইন সন্দেহভাজন যে কোনো ব্যক্তির ওপরই তল্লাশি চালানো, তাকে গ্ৰেপ্তারের এবং এমনকি জনগণের ওপর গুলি চালানোর ক্ষমতা সেনাদের দিয়েছে। এবং সেনাদের আরও দিয়েছে, ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত করা ক্রিয়াকলাপের জন্য শাস্তি থেকে অব্যাহতির বিধান। এই ধরনের দানবীয় আইনের মধ্যে অনিবার্যভাবেই নিহিত থাকে নাগরিকদের নিপীড়নভোগের অশেষ সম্ভাবনা। সেদিনের বিশেষ অধিবেশনে নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেফিউ রিও তুলে ধরেন আফস্পা চালিত সেনাদের হাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণের পৈশাচিক পীড়ন ভোগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে, “নাগাল্যান্ড এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য অংশে, বিশেষভাবে মনিপুরে ও আসামে তাদের অভিযান চালানোর সময় সেনাবাহিনীর হাতে আফস্পার বিধানগুলির ভুল ব্যবহার বা অপব্যবহারের অনেক ঘটনা ঘটেছে। জনগণের মতামতকে প্রতিফলিত করা এবং তাদের আকাঙ্খাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্তব্য পালনে আমরা বাধ্য এবং দায়িত্বপরায়ণ।” মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় নেফিউ রিওকে সেনাদের দৌরাত্ম্যের বিবরণ যে রেখেঢেকে দিতে হচ্ছে তা বুঝতে পারা কারুর পক্ষেই কঠিন নয়।
গৃহীত প্রস্তাবে আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি ছাড়াও উল্লেখিত হয়েছে যে, গণহত্যার দায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ক্ষমা চাইতে হবে। প্রস্তাবে গুরুত্বের সঙ্গে আরও স্থান পেয়েছে ন্যায়বিচার লাভকে সুনিশ্চিত করার দাবি। বলা হয়েছে, যারা এই পৈশাচিক গণহত্যা সংঘটিত করেছে এবং গণহত্যার জন্য যারা দায়ী, তাদের ওপর দেশের আইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, যাতে ন্যায়বিচারের বঞ্চনাকে প্রতিহত করা যায়। নাগা সমস্যার দ্রুত ও সম্মানজনক সমাধানসূত্র বার করার আকাঙ্খা ব্যক্ত করে প্রস্তাব আরও উল্লেখ করেছে, “এই সভা, অতএব, ভারত-নাগা আলোচনায় জড়িত সমস্ত আলোচক দলগুলোর কাছে আরও একবার আবেদন জানাচ্ছে, দ্রুত সম্মানজনক ও সর্বস্বার্থরক্ষার সমাধানে পৌঁছে আলোচনা প্রক্রিয়াকে যুক্তিসম্মত পরিণতি দেওয়া হোক।” প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ায় এটা লক্ষণীয় যে, রাজ্য বিধানসভার ১২ জন বিজেপি বিধায়ককেও প্রস্তাবের সমর্থনে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে।
আফস্পা আইনের ৩নং ধারায় আছে, কোনো এলাকায় এই আইন প্রয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারকে সেই এলাকা ‘উপদ্রুত’ বলে ঘোষণা করতে হবে, যে ঘোষণার বলে আইন ৬ মাস বহাল থাকবে। নাগাল্যান্ডকে ‘উপদ্রুত’ ঘোষণা করে কেন্দ্র সরকার শেষবারের মতো বিজ্ঞপ্তি জারি করে ২০২১ সালের ৩০ জুন, তার সময়সীমা শেষ হবে ২৯ ডিসেম্বর। তবে, আফস্পা প্রত্যাহারের জন্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবল দাবি উঠলেও এবং নাগাল্যান্ড বিধানসভায় প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাশ হলেও নাগাল্যান্ড এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে আফস্পা প্রত্যাহার এখনই সম্পন্ন হচ্ছেনা।
নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নেফিও রিও, উপ-মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই প্যাটন এবং এনপিএফএল দলের নেতা টি আর জেলিয়াং তাঁদের স্বাক্ষর করা এক প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছেন — সেনা কম্যাণ্ডোদের সংঘটিত গণহত্যা এবং আফস্পা প্রত্যাহারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেতাদের দিল্লীতে এক বৈঠকে ডাকেন। অমিত শাহর বাড়িতে ২৩ ডিসেম্বর সেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নাগাল্যান্ডের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি বিবেচনা করতে কেন্দ্র পাঁচ সদস্যের এক কমিটি গঠন করবে। কমিটির শীর্ষে থাকবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উত্তর-পূর্ব বিষয়ক স্বরাষ্ট্রসচিব, এবং অন্যান্য সদস্যরা হবেন নাগাল্যান্ডের মুখ্যসচিব, নাগাল্যান্ডের ডিজিপি, আসাম রাইফেলস ও সিআরপি’র কর্তাব্যক্তিরা। কমিটি ৪৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবে এবং তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই বিবেচিত হবে নাগাল্যান্ড থেকে আফস্পা প্রত্যাহৃত হবে কিনা। সমগ্ৰ উত্তর-পূর্বাঞ্চল নয়, শুধুই নাগাল্যান্ড থেকে, কেননা, কমিটিকে শুধু নাগাল্যান্ডের পরিস্থিতিই বিচার করতে বলা হয়েছে।
তবে, উত্তর-পূর্বের আফস্পা ও সেনা বিরোধী রোষকে আপাতত প্রশমিত করতে এবং আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিকে ধামাচাপা দিতে একটা কৌশলও হতে পারে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত। কমিটির রিপোর্টের বিষয়বস্তু যাই হোক, কোথাও আফস্পাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না। এই আইন ১৯৫৮ সালে সর্বপ্রথম চালু হয় নাগাল্যান্ডেই, এবং তারপর থেকে এই আইনের বলে সেনারা যথেচ্ছ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে শুধু নাগাল্যান্ড বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই নয়, পাঞ্জাবে এবং কাশ্মীরেও রচনা করে গেছে এবং এখনও করে চলেছে পৈশাচিক পীড়নের ছেদহীন আখ্যান, রক্ত ঝড়ানোর নিরবচ্ছিন্ন বৃত্তান্ত। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের যথার্থ দাবি তাই হল — শুধু নাগাল্যান্ড থেকেই নয়, সারা দেশ থেকেই আফস্পাকে অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
গত ২৬ আগস্ট, কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক দেশের অসংগঠিত শ্রমিকদের নথিভুক্ত করতে ই-শ্রম ওয়েব পোর্টালের উদ্বোধন করে। আনুমানিক ৭০৪ কোটি টাকার বিনিময়ে গড়ে উঠেছে এই ওয়েব পোর্টাল। দেশের মধ্যে এটি হল অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য এযাবত প্রথম কেন্দ্রীভূত ডেটাবেস বা তথ্যভান্ডার যাকে সংযুক্ত করা হয়েছে আধার’এর সঙ্গে। ১৬ থেকে ৫৯ বছরের যে কোনও অসংগঠিত শ্রমিক, যারা পিএফ/ইএসআইসি বা সরকারি তহবিলভুক্ত জাতীয় পেনশন স্কিম বা এনপিএস’এর আওতায় নেই, তাঁরাই এই পোর্টালে নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন। নথিভুক্ত শ্রমিকদের দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা স্থায়ীভাবে অঙ্গহানি হলে এককালীন তাঁর নিকটাত্মীয় পাবেন দু’লক্ষ টাকা আর আংশিক অঙ্গহানি হলে পাবেন একলক্ষ টাকা। নথিভুক্ত শ্রমিকরা পাবেন ১২ ডিজিটের এক ইউনিক পরিচয় কার্ড, আর ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারগুলো যদি কোন ধরনের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করে তবে তাঁরা তার সুযোগ পেতে পারেন। যেহেতু, চারটি শ্রমকোডের মধ্যে অন্যতম সামাজিক সুরক্ষা কোড দেশের সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা চালু করেনি, তাই বোঝাই যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য যেটুকু ‘সামাজিক সুরক্ষার’ প্রকল্পগুলো আছে, তা বিলুপ্ত করে সবটাই আনা হবে একই ছাতার তলায়। সামাজিক সুরক্ষার এই খুড়োর কল দেখিয়ে আগামীদিনে আরও কত শ্রমিক নিজের নাম নথিভুক্ত করেন, সেটাই দেখার। শ্রম মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ই-শ্রম পোর্টালটি ২৬ আগস্ট উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০.০৬ কোটিরও বেশি অসংগঠিত শ্রমিক নিজেদের নাম এখানে নথিভুক্ত করেছেন। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব বলেছেন, এটা নাকি আগামীদিনে অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনতে ‘গেম চেঞ্জার’এর ভূমিকা পালন করবে এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপকদের নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করতে প্রভূত সাহায্য করবে।
বিগত ১৩ সপ্তাহ ধরে যে চারটি রাজ্যের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি নিজেদের নথিভুক্তি করিয়েছেন, সেই রাজ্যগুলি হল — পশ্চিমবাংলা (২.১৭ কোটির বেশি), উত্তরপ্রদেশ (১.৯৫ কোটি), উড়িষ্যা (১.২২ কোটি) এবং বিহার (১.০৮ কোটি)। একই সময়কালে সমগ্র নথিভুক্তির মধ্যে পুরুষ ও মহিলাদের সংখ্যা যথাক্রমে ৫২ শতাংশ ও ৪৮.৬ শতাংশ। নথিভূক্ত শ্রমিকদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই হলেন তরুণ — ১৮ থেকে ৪০’র মধ্যে — আর, এরাই হলেন প্রায় ৬৩ শতাংশ। তারপরই রয়েছেন ৪০ থকে ৫০ বছর বয়সের শ্রমিকেরা, যারা হলেন সমগ্রের ২১.৫ শতাংশ।
দেখা যাচ্ছে, সমগ্র নথিভুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে পশ্চিমবাংলা থেকেই প্রায় এক চতুর্থাংশ নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করিয়েছেন। আর, উল্লিখিত চারটি রাজ্য বাদে, অন্যান্য রাজ্য থেকে গোটা শ্রমশক্তির দুই শতাংশেরও কম নথিভুক্ত হয়েছে। অনেক শ্রম বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আধার কার্ডের সাথে নিজেদের মোবাইল ফোনের বাধ্যতামূলক সংযুক্তির শর্ত না থাকলে, আর ই-শ্রম পোর্টালে নাম তোলার প্রক্রিয়া-পদ্ধতি প্রকরণ অনেক সহজ সরল হলে এই সময়সীমার মধ্যে আরও অনেক বেশি শ্রমিক নিজেদের নাম নথিভুক্ত করাতেন।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে আসছে শ্রম মন্ত্রকের ওয়েবসাইট থেকে। দেখা যাচ্ছে, ২৫ নভেম্বরের মধ্যে নথিভুক্ত শ্রমিকদের প্রায় ৫৩ শতাংশই হলেন কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত। এরপর রয়েছে উৎপাদন শিল্প (১৩ শতাংশ) এবং নির্মাণ (১২ শতাংশ)। বোঝাই যাচ্ছে, ভারতে এখনও বৃহত্তম নিয়োগকর্তা কৃষি ক্ষেত্র — যে ক্ষেত্রটি সবচেয়ে বঞ্চিত, উপেক্ষিত। শিল্পবিকাশ বা উন্নয়নের গালভরা স্লোগানের আড়ালে কেন্দ্রীয় সরকার যাদের দিয়ে যাচ্ছে বিপুল ভর্তুকি (ইন্সেন্টিভের নামে), কিন্তু কর্মসংস্থানে যারা পিছিয়ে রয়েছে অনেকটা। যাক সে কথা।
কোভিড অতিমারির প্রথম হানায়, মোদী সরকার অতর্কিতে দেশব্যাপী নির্দয় লকডাউন ঘোষণা করার পর গোটা দেশ এমনকি বিশ্ব দেখল পরিযায়ী শ্রমিকদের নিদারুণ যন্ত্রণা ও ট্রাজেডি। কাতারে কাতারে পরিযায়ী শ্রমিক রাতারাতি রুটি- রুজি ও মাথার উপর একচিলতে ছাদ খুইয়ে কিভাবে হয়ে গেলেন নেই-রাজ্যের বাসিন্দা তা আমরা বসে বসে শুধু দেখলাম। সংখ্যায় এরা কত, তার হিসাব তখন দিতে পারল না কোনও সরকার — না রাজ্য, না কেন্দ্র। দিল্লী সরকার তো শীর্ষ আদালতে জানিয়েই দিল যে তাদের খাতায় কারুর নাম বা সংখ্যা নেই। অথচ, তখনও দেশে লাগু ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কেন্দ্রীয় আইন ‘ইন্টার স্টেট মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কমেন অ্যাক্ট, ১৯৭৯’। যেখানে কোন সংস্থায় বা কোন ঠিকাদারের অধীনে কতজন পরিযায়ী শ্রমিক কোথায় কর্মরত, তার হিসাব রাখাটা সেই আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক ছিল। এই পরিঘটনার উপর দাঁড়িয়ে, ২০২১’র জুন মাসে সুপ্রিমকোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয়, পরিযায়ী শ্রমিকদের এক জাতীয় তথ্যভান্ডার তৈরি করতে। এই নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নানা টালবাহানা করায় শীর্ষ আদালতের কাছে তীব্র ভৎর্সনার মুখে পড়ে অবশেষে এই ই-শ্রম পোর্টাল দিনের আলো দেখল। কিন্তু পরিহাস এটাই, ৭ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২.২৫ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক নিজেদের নাম নথিভুক্ত করিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য, আনুমানিক ৪০ কোটি অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের এই পোর্টালে নথিভুক্ত করাবে। কিন্তু, ইতিমধ্যেই যে সমস্ত তথ্য উঠে এল, তার শবব্যবচ্ছেদ করলে নির্মম ও কঠোর বাস্তবের ধূসর ছবি ফুটে ওঠে। দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১০ কোটি নথিভুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে ৯৪.৫ শতাংশের মাসিক আয় দশ হাজার টাকারও নীচে। এক শতাংশের মাসিক আয় ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে, আর ০.৫ শতাংশের আয় ১৮ হাজার থেকে ২১ হাজারের মধ্যে। পাশাপাশি আরেকটি তথ্য উঠে এল — ৭০ শতাংশেরও বেশি অসংগঠিত শ্রমিকরা হলেন তপসিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া বর্গ থেকে আগত। অর্থাৎ, শেষোক্ত এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক স্তরটি সমস্ত মাপকাঠি থেকে বঞ্চিত, প্রান্তসীমায় নিক্ষিপ্ত। আর্থিক, সামাজিক ও মর্যাদার দিক থেকে। কিন্তু এই বিপুল অংশটি তো দেশের জিডিপি’তে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে চলেছে। সেই ২০০৮ সালেই অর্জুন সেনগুপ্ত নেতৃত্বাধীন গড়ে ওঠা ‘ন্যাশনাল কমিশন ফর এন্টারপ্রাইজেস ইন দ্য আনঅর্গনাইজড সেক্টর’ (আজ পর্যন্ত যে সমীক্ষাটি সবচেয়ে তথ্যমূলক গবেষণাধর্মী ও আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত) রিপোর্টে জানান যে এই ইনফর্মাল ক্ষেত্রটি দেশের জিডিপিতে ৫০-৫৫ শতাংশ অবদান রাখে। এরাই গোটা শ্রমশক্তির ৯২ শতাংশ! দেশের শাসকবর্গ যখন ৭৫ বছরের স্বাধীনতাকে বিপুল উদ্যমে উদযাপন করছে, তখন তারা আমাদের ভুলিয়ে দিতে চাইছেন যে সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত, অগণন, অগোচরে থাকা নামহীন, অবয়বহীন ইনফর্মাল শ্রমিকরাই জাতীয় আয়ে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে চলেছেন। ভারতের বিপুল সংখ্যাধিক্য কর্মক্ষম এই তরুণ জনসংখ্যার যৎসামান্য আয় যথেষ্ট মাত্রায় বৃদ্ধি করতে না পারলে যে দেশের অর্থনীতির এই ঝিমুনি কাটবে না, তা রাষ্ট্রক্ষমতার অলিন্দে থাকা নীতিকারেরা কোনদিনই স্বীকার করলেন না। এদিকে, আইএলও তার প্রতিটি পলিসি ঘোষণায় স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে এই বার্তা নিরন্তর দিয়ে যাচ্ছে।
দিন কয়েক আগে, বিপরীত দুটো চিত্র দেখা গেল।
৪ঠা ডিসেম্বরে, একটি প্রথম সারির ইংরাজি সংবাদপত্র কর্তৃক আয়োজিত এক আলোচনাসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেন, কোভিড অতিমারির ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে ভারতের অর্থনীতি নাকি গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততার সাথে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে মোদী সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের দৌলতে।
আর, ৫ ডিসেম্বর, গুজরাতের আমেদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের এক অনলাইন সমাবেশে নোবেল জয়ী অর্থশাস্ত্রী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “দেশের অর্থনীতি বিধ্বস্ত। ভয়ংকর কষ্টে আছেন দেশবাসী। করোনা আঘাত হানার আগে দেশের অর্থনীতি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, এখন তার থেকেও তা নীচে গড়িয়ে পড়েছে।”
১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার কর্পোরেট কর কেন্দ্রীয় সরকার মকুব করলেও শিল্পের মড়া গাঙে বান এলো না। উপরন্তু, সেই একই আলোচনাসভায় (ইংরেজি দৈনিকের) অর্থমন্ত্রী কর্পোরেটদের উদ্দেশ্যে বললেন, সহজে ব্যবসা-বাণিজ্য করার শর্ত, শিথিল কর্পোরেট কর কাঠামো ও আইন মানার বোঝা থেকে ক্রমে সরে এসেই দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।
যে নির্মম বাস্তবের মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো ই-শ্রম পোর্টালের তথ্যভান্ডার, আগামীতে অনিচ্ছাকৃতভাবে যা আরও অনেক কিছু উদ্ঘাটিত করবে, তার উপর দাঁড়িয়ে সরকার — সে রাজ্যই হোক বা কেন্দ্রীয় — নতুন করে রচনা করবে কি নীতিমালা?
- অতনু চক্রবর্তী
“আদিবাসীও কী এক হী নারা,
জল জঙ্গল জমিন হ্যায় হমারা”
সব আদিবাসীদের একই শ্লোগান, জল জঙ্গল জমি আমাদেরই।
এই শ্লোগান তুলে গুজরাটের বলসাড জেলার কাপরালা ও ধর্মপুর তালুকায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বে গ্রামপঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এই নির্বাচনে প্রতি পদক্ষেপে ‘মা-লে’ বিজেপি-বজরং দল এবং কোনো কোনো জায়গায় কংগ্রেসী গুন্ডাদের বাধা ও হুমকির দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করেছে।
সাহসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকায় আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার ও অন্যান্য প্রশ্নে ‘ভাকপা মালে’ দ্বারা সঞ্চালিত সংগ্রামের তথ্য জনতার সামনে তুলে ধরে। যেখানে বিজেপি বা কংগ্রেস আদিবাসীদের ভোট নেওয়ার জন্য মদ, পয়সা আর পেশীশক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে, সেখানে মালে নেতৃত্ব নিঃসম্বল হয়েও শুধুমাত্র রাজনৈতিক সমাবেশকরণের মাধ্যমে নির্বাচনী সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
দুই তালুকার আলাদা আলাদা পঞ্চায়েতের ১২টি পঞ্চায়েত পদে প্রার্থী দাঁড় করানো হয়, যারমধ্যে ৯টি আসনে মালে প্রার্থীরা বিজয়ী হন।
বিজয়ী জনপ্রতিনিধিরা হলেন
গুলাবভাই যমনাভাই মোর (টেরি চিখলি),
সুনীলভাই ধাবলুভাই তুমরা (টেরি চিখলি),
সঙ্গীতাবেন মহেন্দ্রাভাই আরাজ (মহিলা) (ঘনবেরি),
সতীশভাই ধকলভাই চৌধুরী (ঘনবেরি),
কসমভাই ভাবুভাই লাখন (মোটি পলসন),
কিষানভাই সন্তুভাই দরবারে (তুকবাড়া),
মাহদুভাই সাকাভাই ঘাটাল (চেপা),
রাশিবেন কিষানভাই ভুম্বা (মহিলা) (সারওয়ার তাঁতি)।
ওপরের সবাই কাপরালা তালুকার অন্তর্গত।
বাবুভাই নানকিয়াভাই যাদব (বাঘবল), তালুকা-ধর্মপুর।
দীর্ঘদিন পর চিলিতে ক্ষমতায় ফিরলেন বামপন্থীরা। সত্তর দশক থেকে অধিকাংশ সময়ে চিলিতে বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী সরকারের শাসন চলেছে। সেই দিক থেকে এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং বাম জোট প্রার্থীর জয়ের ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। এই তাৎপর্য ভালোভাবে বুঝতে আমাদের একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে।
সেটা ছিল ১৯৭৩ সাল। চিলিতে তখন রাষ্ট্রপতির আসনে জনপ্রিয় বামপন্থী নেতা সালভাদর আলেন্দে। কিউবায় এক দশকের বেশি হয়ে গেছে ফিদেল কাস্ত্রোর সরকারের স্থায়িত্ব। নিকারাগুয়া সহ লাতিন আমেরিকার নানা দেশে চলছে বিপ্লবীদের লড়াই। দুনিয়া জুড়ে রয়েছে ঠান্ডাযুদ্ধের আবহ। নানা দেশে সোভিয়েত আনুগত্যের ভূত দেখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অপছন্দের সরকারগুলিকে ছলে বলে কৌশলে সরিয়ে দিতে মরীয়া সিআইএ’র গোয়েন্দা বিভাগ। এর পেছনে তারা ব্যয় করছিল কোটি কোটি ডলার। চিলিতেও তাই করল তারা। এক ‘মিলিটারি ক্যু’র মাধ্যমে আলেন্দেকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসায় পিনোচেতকে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত চলে চিলিতে পিনোচেতের স্বৈরশাসন। বদলে ফেলা হয় সংবিধান। মিলটন ফ্রিডম্যানের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দিয়ে তৈরি করা হয় চিলির নয়া আর্থিক নীতির নকশা। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের জায়গাগুলোকে ধ্বংস করে নয়া উদারনীতিমালাকে বরণ করে নেওয়া হয়।
১৯৯০-এ পিনোচেত জমানার অবসানের পর কেটে গেছে আরো তিরিশ বছর। এক কোটি নব্বই লক্ষ মানুষের দেশ চিলিতে সেই জমানার রেশ মুছে যায়নি। সংবিধানে কিছু কিছু বদল এসেছে, কিন্তু মূল কাঠামোটা তেমন বদলায়নি। আর্থিক নীতিমালাও পিনোচেত জমানার থেকে তেমন কিছু সরে আসেনি। দেশজুড়ে চূড়ান্ত বৈষম্য সেখানে।
এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিল চিলির বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে মুখোমুখি লড়াই। দক্ষিণপন্থী প্রার্থী ছিলেন হোসে আন্তোনিও কাস্ত। তাঁর দাদা মিগুয়েল ছিলেন পিনোচেতের অন্যতম সহযোগী আর বাবা ছিলেন জার্মান নাৎসি দলের সদস্য। কাস্ত তাঁর নির্বাচনী প্রচারে পিনোচেত জমানার উদারনৈতিক নীতিমালার পক্ষেই ওকালতি করেন। কাস্ত’র সমর্থনে ছিল ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ফ্রন্ট, ক্রিশ্চিয়ান কনজারভেটিভ পার্টি।
বামপন্থী জোটের প্রার্থী ছিলেন ৩৫ বছরের তরুণ প্রাক্তন ছাত্রনেতা গ্যাব্রিয়েল বোরিক। এই বাম জোটের শরিক ছিল চিলির কমিউনিস্ট পার্টিও। এছাড়া এর অন্যান্য শরিকদের মধ্যে ছিল সোশ্যাল কনভারজেন্স, সোশ্যাল গ্রিন রিজিওনালিস্ট ফেডারেশান, ডেমোক্রেটিক রিভোলিউশন, হিউম্যানিস্ট অ্যাকশান প্রমুখ দল। বোরিক তাঁর প্রচারে নিওলিবারাল অর্থনীতির বিরুদ্ধে প্রচার করেন এবং অতি ধনীদের ওপর বেশি করে কর বসানোর কথা বলেন। নির্বাচনের ফল বেরনোর পর দেখা গেল কাস্ত পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ ভোট। আর বারো শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে তাঁকে পরাস্ত করেছেন বোরিক।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তীব্র অসাম্যর অবসানের আশায় বোরিককে তাঁরা ভোট দিয়েছে — এরকম প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমের তরফে নেওয়া সাক্ষাৎকারগুলিতে। পেনশন প্রকল্প বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষাও তাঁরা ব্যক্ত করেছেন।
চিলির সংবিধান ও নিওলিবারাল নীতিমালাকে কতটা বদলাতে পারবে বাম শাসনের এই অধ্যায় তা আগামীদিনে দেখা যাবে। তবে রাষ্ট্রপতি পদে বিজয়ী হবার পরেই যে কটি দৃঢ় মত বোরিক প্রকাশ করেছেন, তাতে চিলিতে বড় ধরনের রদবদলের সম্ভাবনা প্রবল। পরিবেশ ধ্বংস করে খনি প্রকল্পর বিরুদ্ধে বোরিক বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছেন। চিলি গোটা বিশ্বে তামার সবচেয়ে বড় উৎপাদক এবং নতুন করে ২৫০ কোটি ডলারের খনি প্রকল্প সেখানে চালু করার কথাবার্তা চলছে। এর বিরুদ্ধে বোরিকের দৃঢ় অবস্থান বুঝিয়ে দেয় প্রচলিত উন্নয়ন মডেলকে প্রশ্ন করা, পরিবেশচেতনা ও সমতার আদর্শ তাঁর জমানাকে ঘিরে থাকবে।
চিলিতে খনি বিরোধী এইসমস্ত কথাবার্তা যখন চলছে, তখন বীরভূমে দেউচা-পাঁচামী কয়লাখনি প্রকল্প নিয়ে বিক্ষোভ ও সংশয় ক্রমশ দানা বাঁধছে। কেন কয়লাখনি ও তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশ ও সভ্যতার সঙ্কট তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে নানা জায়গায়। চিলিতে বাম বিজয়ের বার্তা এদেশের সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে যেমন উৎসাহ জোগাবে, তেমনি বিজয়ী রাষ্ট্রপতির খনি বিরোধী দৃঢ় অবস্থান নির্দিষ্টভাবে শক্তি দেবে দেউচা-পাঁচামী খনি প্রকল্পর বিরোধীদের।
- সৌভিক ঘোষাল
রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে গেল পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি
খুচরো বাজারের পাশাপাশি পণ্যের নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধির সাক্ষী হল দেশের পাইকারি বাজারও। প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, অক্টোবরে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার ১২.৫৪ শতাংশ থাকলেও নভেম্বরে তা বেড়ে ১৪.২৩ শতাংশে পৌঁছেছে। ১৬ বছরের মধ্যে যা নতুন রেকর্ড।
সবজি-সহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, ভোজ্যতেলের পাশাপাশি শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত নানা কাঁচামালের পাইকারি মূল্যও অনেকটাই বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে ওই সরকারি পরিসংখ্যানে। কেন্দ্রীয় শিল্প এবং বাণিজ্য মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘মূলত খনিজ তেল, মৌলিক ধাতু, অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস, রাসায়নিক পণ্য এবং খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়েছে।’’
অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে, কেন্দ্র আরও আগে পেট্রল-ডিজেলে উৎপাদন শুল্ক কমালে হয়তো মূল্যবৃদ্ধি এত চড়তনা। তাঁদের আশঙ্কা এবার শিল্পক্ষেত্রের মূল্যবৃদ্ধির আঁচ পড়বে সাধারণ ক্রেতাদের উপর। তবে অর্থনীতিবিদদের আর এক অংশের মতে পাইকারি বাজারে এই মূল্যবৃদ্ধি আদতে চাহিদা বাড়ার লক্ষণ। আর এই চাহিদা বৃদ্ধি কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে আর্থিক বৃদ্ধির ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত।
সোমবার প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যানে জানানো হয়, খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার অক্টোবরে ছিল ৪.৪৮ শতাংশের কাছাকাছি। নভেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৪.৯১ শতাংশ। সবজি-সহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির কথাও মেনে নেওয়া হয়েছে ওই রিপোর্টে।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তলানিতে যোগীর উত্তরপ্রদেশ
স্বাস্থ্যে প্রথম কেরল, ফেল করল উত্তরপ্রদেশ। ভারত সরকারের নীতি আয়োগের ২০১৯-২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নয়নে একেবারের প্রথম হিসেবে উঠে এসেছে কেরলের নাম। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উন্নত রাজ্য হিসাবে এরপরেই স্থান করে নিয়েছে তামিলনাড়ু। তারপরেই তেলঙ্গানার উল্লেখ। বড় রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উত্তরপ্রদেশের, এমনই জানিয়েছে নীতি আয়োগের রিপোর্ট।
কী ভাবে স্বাস্থ্যে সেরা রাজ্যকে বেছে নেয় নীতি আয়োগ?
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সেরার তালিকায় স্থান পেতে হলে মোট ২৪টি সূচকের পরীক্ষা হয় বিভিন্ন বিভাগে। তারমধ্যে রয়েছে চিকিৎসা পরবর্তী ফলাফল, প্রশাসনিক দক্ষতা, তথ্য এবং মূল চিকিৎসা পদ্ধতি। এইসব সূচক থেকে জেনে নেওয়া হয় কোনও রাজ্যের সদ্যোজাত মৃত্যুর হার, পাঁচ বছরের নীচে শিশু মৃত্যুর হার, জন্মকালীন লিঙ্গ অনুপাত, প্রসূতি মৃত্যুর হার এবং পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতার হার সম্পর্কে।
প্রশাসনিক সূচকের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, তথ্যভাণ্ডার-সহ অন্য বিষয়গুলি খতিয়ে দেখা হয়। পাশাপাশি প্রাথমিক ও মহকুমা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য কর্মীদের দক্ষতা এবং উপস্থিতিকেও মান্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে খতিয়ে দেখা হয়।
এর পাশাপাশি রিপোর্টের চতুর্থ সংস্করণে একটি বিশেষ সূচকের উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি প্রসূতি মৃত্যুর হার সংক্রান্ত। বলা হয়েছে, খতিয়ে দেখা হবে প্রসূতি মৃত্যুর হারের সঙ্গে আনুপাতিক হিসাবে মিলিয়ে দেখা হবে সেই সব অন্তঃসত্ত্বাদের সংখ্যা যাঁরা প্রসবের আগে অন্তত চারবার বা তার বেশি চিকিৎসকের পরামর্শ পেয়েছন।
নীতি আয়োগের এই বিশেষ রিপোর্টকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। বড় রাজ্য, ছোট রাজ্য এবং কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। ছোট রাজ্যগুলির মধ্যে মিজোরাম স্বাস্থ্য পরিষেবায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা রাজ্য। অন্যদিকে শেষতম রাজ্য হিসেবে উঠে এসেছে নাগাল্যান্ডের নাম।
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে সবথেকে উপরে রয়েছে চণ্ডীগড়। এরপর রয়েছে দাদরা ও নগর হাভেলি। পুদুচেরির স্থান সবচেয়ে নীচে।
পশ্চিমবঙ্গের স্থান সার্বিক ভাবে ১১ নম্বরে।
উত্তরপ্রদেশের স্থান নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে চাপান উতোর। ২০২২ বিধানসভা নির্বাচনে পাখির চোখ উত্তরপ্রদেশে। সেখানে উন্নয়নের প্রচার চলছে জোরদার। কিন্তু ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে ৬৩ শিশুর মৃত্যু-সহ একাধিক ঘটনায় উত্তরপ্রদেশের বদনাম হয়েছে বলেই মনে করছে সংশ্লীষ্ট মহল। এদিকে এই গোরক্ষপুরে এআইআইএমএস নিয়ে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবু নীতি আয়োগের রিপোর্টে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল সবচেয়ে খারাপ যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য উত্তরপ্রদেশে।
- এই সময়, ২৮ ডিসেম্বর ২০২১
১৮ ডিসেম্বর, ২০২১। চেন্নাইতে নিজের বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, তিনবার যৌনহেনস্থার শিকার হয়ে আত্মহত্যার রূঢ় পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে মেয়েটি। রেখে গেছে একটি সুইসাইড নোট। তাতে স্পষ্ট ক’রে লেখা, “মাতৃগর্ভ আর কবরেই শুধু মেয়েরা নিরাপদ। … যৌনহেনস্থা বন্ধ হোক। প্রত্যেক মা-বাবা ছেলেকে শেখান, মেয়েদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়!” – এই জবানবন্দী আসলে বাস্তব থেকে উঠে আসা সমস্ত মেয়ের কথা; যারা নিত্যদিন নানাভাবে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে দাঁড়িয়ে নির্যাতনের শিকার হয়। মহিলাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা যেন এ’দেশে সোনার পাথর বাটি! চেন্নাইয়ের ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভারতে লিঙ্গ বৈষম্য, মহিলাদের বিরুদ্ধে সামাজিক কু-প্রথা, যৌননিগ্রহের ঘটনা নিরন্তর ঘটছে। আর যদি নির্যাতিতা দেহ-মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে দু’কদম এগিয়ে এসে তার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, তখন তার আশেপাশে চলতে থাকে ভিক্টিম ব্লেমিং, ভিক্টিম শেমিং ইত্যাদি, প্রভৃতি।
এবার আসা যাক কিছু দ্বিচারিতার প্রশ্নে। দ্বিচারিতা কারা করছে, কেন করছে, কীভাবে করছে? আসুন জেনে নিই।
সম্প্রতি মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করা হয়েছে। ক্যাবিনেটে পাশ হয়েছে অনুমোদন। পুরুষের ক্ষেত্রেও বিয়ের ন্যূনতম বয়স ২১। সুতরাং, এভাবেই জেন্ডার ইকুয়ালিটি অর্থাৎ নারী-পুরুষের সমানাধিকারকে স্পষ্ট করতে চাইছে রাষ্ট্র তথা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। কিন্তু প্রশ্ন উঠে আসে, এভাবে আদৌ কি কেবলমাত্র বিয়ের বয়স সমান করে সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার বহাল রাখা সম্ভব? লকডাউনে অভাবের দরুন বহু পরিবারে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পড়াশোনা ছেড়ে মেয়েরা সংসার গড়তে এগিয়ে গেছে। এই স্কুলছুট মেয়েদের দায় কার? ভারতে নাগরিকদের ভোটাধিকার দেওয়া হয় ১৮ বছর বয়স থেকে। তাহলে ধরে নেওয়াই যায়, দেশের ছেলে-মেয়ে উভয়েরই ১৮ বছর বয়সের মধ্যে সমস্তরকম মানসিক বিকাশ ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক। নিয়মানুযায়ী, একজন সাবালক এবং একজন সাবালিকা নিজেদের ইচ্ছে ও পরস্পরের সম্মতিতে ১৮ বছর বয়সেই বিয়ে করতে পারে। আর সেই কারণে তাদের পুলিশী হেনস্থা করা রাষ্ট্রের কাজ হতে পারেনা। অর্থাৎ, নতুন আইন ভিত্তিহীন। আপাদমস্তক যুক্তিহীনতায় মোড়া এক-একটা আইন বিজেপি সরকার পাশ করিয়ে চলেছে। উপর-উপর ভারতীয় সমাজকে প্রগতিশীল দেখানোর চেষ্টা বিজেপি জারি রেখেছে।
২০১৫ সালে মহা সমারোহে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লিঙ্গবৈষম্যের সমস্যা সমাধান ও কন্যাভ্রূণ হত্যার হার কমাতে এই প্রকল্পের সূচনা হয়। ঢাকবাদ্যি পিটিয়ে প্রকল্পের প্রচার করে কেন্দ্রীয় সরকার। সংসদে পেশ হওয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায় দিনে দিনে এই প্রকল্পের প্রচারের জন্য বরাদ্দ অর্থ বাড়তে থাকে। বিজ্ঞাপনের খাতে খরচ হয়েছে প্রায় ৭৮.৯১ শতাংশ টাকা। এরপরেও বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশে পাঁচ বছরের নীচে শিশুকন্যার মৃত্যুর হার ৫৩ শতাংশ, যোগীরাজ্য উত্তরপ্রদেশে ৪৮ শতাংশ এবং অসমে ৫১ শতাংশ। শুধু তাই নয়, গোটা দেশে মহিলাদের নিরাপত্তার বেহাল দশা। এনসিআরবি-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে ভারতে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ৭৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। একই বছরে মোট ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ২৮ হাজার ৪৬টি। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের রেকর্ড হয়েছে ৩৭ লাখ ১ হাজার ৫০৩টি।
২০১৮ সালে জম্মু কাশ্মীরের কাঠুয়ায় গণধর্ষণের শিকার হয় আট বছরের নাবালিকা আসিফা বানু। এর আগে ইতিহাসে আমরা ধর্ষকের সপক্ষে মিছিল বের করতে দেখিনি। বিজেপি কাঠুয়ায় ধর্ষকের সপক্ষে ভারতের জাতীয় পতাকা হাতে মিছিল করেছে। উত্তরাঞ্চলে ধর্ষণ মামলার শুনানির জন্য আদালতে যাওয়ার সময় ২৩ বছরের মেয়েকে জলজ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ধর্ষিত হয়েছিল। ভারতের রাজধানী দিল্লীতে নির্ভয়ার ঘটনার পরেও একাধিক ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা নিত্য তিনশো দিনের খবর। দিল্লীতে নয় বছরের দলিত মেয়েকে শ্মশানঘাটে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারা হয়। উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে বিজেপির নেতা কুলদীপ সিং ১৭ বছর বয়সী একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে দলিত তরুণীর ওপর চরম যৌন অত্যাচার চালায় চারজন উচ্চ বর্ণের যুবক। এরপর তার জিভ কেটে নেওয়া হয় যাতে সে নিজের বয়ানটুকু না দিতে পারে! সবশেষে পুলিশের সহায়তায় নির্যাতিতার পরিবারকে না জানিয়ে মেয়েটির মরদেহ পেট্রোল ঢেলে রাতারাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়৷ প্রশাসনের সাহায্যে প্রমাণ লোপাটের বড়সড় দৃষ্টান্ত বোধহয় এই ঘটনা। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে দলিত নারী সম্পর্কে বলেছিলেন, “দলিত নারী ধর্ষণ করা পাপ নয়, কারণ তার শরীর অপবিত্র হলেও যোনি অপবিত্র নয়।” বলাবাহুল্য, এদের হাতে দেশটা তুলে দিলে মহিলাদের অবস্থাটা যেমন হওয়ার, তেমনটাই হয়েছে।
দলিত ও আদিবাসী মহিলাদের ওপর ভারতে নিপীড়নের হার অনেক বেশি। গ্রামের এধরণের ঘটনা অতখানি সামনে আসেনা। হাথরাসের ঘটনায় মিডিয়া হস্তক্ষেপ করতে চাইলে বহু সাংবাদিকদের ওপর মিথ্যে মামলা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও গুজরাত দাঙ্গা, মুজাফফর নগর দাঙ্গায় বহু মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়, তাদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে দীর্ঘ দিন ধরে যৌন অত্যাচার চালানো হয়।
চেন্নাইয়ের ঘটনা খুব বেশি ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। একুশ শতকে ভারতবর্ষে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মহিলাদের সমাজে অগ্রগতির বদলে মহিলাদের নিয়ন্ত্রণের দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। নারীর মর্যাদা, নিরাপত্তা ও স্বাধীকারের প্রশ্নই হোক, কিংবা সমাজ থেকে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণের প্রশ্নই হোক–এই সবকিছুকেই বারংবার গুরত্ব না দিয়ে রাষ্ট্রের কিছু নিয়মনীতি কাগজে-কলমে দেশের সমস্ত মহিলাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর ফলাফল মিলছে পরিসংখ্যানে।
নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার তালিকায় এ’দেশে নাম ফুরোনোর সময় আসেনি। সুতরাং, গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার এটাই সঠিক সময়। চেন্নাইয়ের নির্যাতিতার মতো জম্মু, উন্নাও, হাথরাসের মেয়েদের আর্তনাদ শুনতে হবে। যারা শুনবে না, তাদের জোর করে শোনাতে হবে। এতগুলো মেয়ের গোঙানির শব্দ স্পষ্টভাবে কানে বাজবে। তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হবে সেই আওয়াজ। যুগ যুগ ধরে নেমে আসা সমস্ত অত্যাচারের বদলা নেবে আগল ভেঙে বেরিয়ে আসা মেয়ের দল। নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায় থাকবে। শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদে সামিল হবে নতুন মুখ, নতুন আলো, নতুন দিশা। এই কঠিন সময় পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা আরও কঠিন। তবে লড়াইটা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যেতে হবে। শেষদিন অবধি। শেষ রক্তবিন্দু অবধি। আমরা হারি না, হারতে পারি না।
- ত্রিয়াশা লাহিড়ী
অনাদিকাল হতে তুমি নির্যাতিত, অসহায়
শান্ত প্রকৃতির মতোই সহজ সরল।
তাই সমাজের সকল আবর্জনা —
তোমার বুকেই এসে জড়ো হয়,
তোমার চলার পথকে করে ব্যাহত।
আর কতদিন এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবে?
আর কত অবিচার মুখ বুজে কেবলই সয়ে যাবে?
শুনতে কি পাও না? ভিটে ছাড়া কত মানুষের হাহাকার —
প্রকৃতির বুক থেকে, টেনে ছুঁড়ে ফেলা শিশুর আর্তনাদ —
সেই কত কাল হতে কত ‘ঠুড়গা প্রকল্প’, কত ‘দেউচা পাঁচামী’
তোমার স্বজনদের করলো ঘরছাড়া —
তোমার ভাইকে করলো ভিটেছাড়া।
তবু তুমি নিশ্চুপ!
মায়ের চোখের জলও কি তোমায় বিগলিত করে না?
তুমি কি পারো না সুনামির মতো ঠেউ তুলে
প্রতিবাদে মুখর হতে?
তুমি কি পারো না ঝর্ণার মতো সবেগে ধেয়ে এসে
কঠিন শিলাকে চূর্ণ করতে?
চেয়ে দেখ — নিথর হয়ে যাওয়া তোমার মায়ের থমথমে মুখ,
তোমার বোন আজ মজুরি গিরি করে,
দমকা ঝড়ে পরিশ্রান্ত তোমার পিতা —
ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিন গোনে।
না আর না, অনেক হয়েছে
সময় এসেছে এবার উঠুক ডাক —
কোটি কোটি করাঘাত দ্বারে তুলুক আওয়াজ।
প্রলয় ঝড়ে ছিটকে পড়ুক সকল সন্ধিপত্র —
কোলাহলে কেঁপে উঠুক সমগ্র আকাশ।
বিদ্রোহের এই বাণীতেই ধৌত হোক সকল পাপ
ধরণী উঠুক খিলখিলিয়ে হেসে,
নতুন প্রভাতের আলোয় চকচক করে উঠুক
মায়ের সুন্দর মিষ্টি মুখচ্ছবি।
- পাপিয়া মাণ্ডী
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের হাওড়া জেলা কমিটির পক্ষ থেকে গত ২৫ ডিসেম্বর এক প্রেস বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে,
বিগত দিনে ঐতিহ্যবাহী বালি পুরসভাকে বালির নাগরিকদের জনমতকে অগ্রাহ্য করে, স্বাধীকার ধ্বংস করে হাওড়া পুরনিগমের অন্তর্ভুক্ত করে তৃণমূল সরকার।
সিপিআই(এমএল) এই পদক্ষেপকে প্রথম থেকেই বিরোধিতা করেছে এবং বালির মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনে সামিল থেকেছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও নির্বাচন না করে পুর অধিকার ও নাগরিক পরিষেবাকে কার্যত বিপর্যস্ত করে তোলা হয়েছে। জনমতের চাপে সাম্প্রতিককালে বালি পুরসভা পৃথকীকরণের সিদ্ধান্ত রাজ্য মন্ত্রীসভা এবং বিধানসভায় পাশ হলেও রাজ্যপাল এখনো এই বিলে সই করেননি।
হাইকোর্টে রাজ্যের এটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন রাজ্যপাল সই করে দিয়েছেন, তাই আর নির্বাচনে বাধা রইলো না। ২০২২-এর ২২ জানুয়ারি হাওড়া পুরনিগম এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি বালি পুরসভার নির্বাচন হতে আর বাধা নেই। তারপরেই বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে সাক্ষাতের পরে রাজ্যপাল ট্যুইট করে জানান তিনি এখনো সই করেননি, বিলটি তার বিবেচনাধীন!
এই টানাপোড়েনে ভুক্তভোগী হচ্ছেন হাওড়া ও বালি এলাকার সাধারণ মানুষ। বিজেপি নেতার সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই রাজ্যপালের এই ট্যুইট যথেষ্ট সন্দেহজনক। তিনি এতোদিন ধরে কী বিবেচনা করছেন তা তিনি স্পষ্ট করুন। তার ভূমিকা সন্দেহজনক শুধু নয়, যথেষ্ট নিন্দনীয়।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন দাবি করছে অবিলম্বে হাওড়া পুরনিগম এবং বালি পুরসভাকে পৃথক করার সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন করতে হবে এবং দ্রুত এই দুই পুরসভার নির্বাচন করতে হবে। ‘বিবেচনা’ করার নামে নাগরিক অধিকারকে খর্ব করার এই চক্রান্তকে আমরা ধিক্কার জানাই।
২৪ ডিসেম্বর বালী-দূর্গাপুরে, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন হাওড়া জেলা কমিটি ও পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ রাজ্য কমিটির উদ্যোগে, কমরেড অমিতাভ দে (ফুচকন)-র স্মরণসভা হয়। মাল্যদান ও নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। বাবলু গুহ, মাধব মুখার্জী ও নিলাশিস বসুর সভাপতিত্বে বক্তব্য, গান, কবিতার মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শোকবার্তা পাঠ করেন পার্টির হাওড়া সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত। বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, বর্ধমান জেলা সম্পাদক সলিল দত্ত, হুগলী জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার, রাজ্য কমিটির সদস্য বাসুদেব বসু, বালী-বেলুড় লোকাল কমিটির সদস্য রঘুপতি গাঙ্গুলী; পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সম্পাদক নীতীশ রায়, থিয়েটার লিবার্টির প্রদীপ সরকার, এপিডিআর বালীর পক্ষে অরুণ পাল, সেবা সদন সমিতির অচ্যুত সেনগুপ্ত, স্বজনের পক্ষে পার্থসারথী মিত্র, বালী গ্রমাঞ্চল সাংস্কৃতিক সমন্বয় কমিটির তন্ময় কুশারী; অমিতাভ দের নিজের ভাই অরুনাভ দে। সঙ্গীত পরিবেশন করেন ইঙ্গিত সাংস্কৃতিক সংস্থার চঞ্চল ভট্টাচার্য, গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সদস্য বাবুনী মজুমদার ও নীতীশ রায় এবং সংযোগ সংস্থা। কবিতা পাঠ করেন মোহন মান্না, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংস্থার অমিতাভ ব্যানার্জী, গণ সংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সদস্যা শোভনা নাথ। অনুষ্ঠানে দেওচা পাঁচামীতে মহিলাদের উপর পুলিশ ও টিএমসির হামলার বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
কমরেড বীরেন রায় প্রয়াত
২৭ ডিসেম্বর ভোর আনুমানিক ৩টের সময় জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের ১নং গৌড়গ্রামের দীর্ঘদিনের লড়াকু নেতা কমরেড বীরেন রায় প্রয়াত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। পার্টি সদস্য বীরেন রায় ময়নাগুড়ি লোকাল কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ৭০ দশকে পার্টির গোপন অবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিলেন। গ্রামে সংঘর্ষের সময় তিনি আধা-সামরিক বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছিলেন। শেষদিকে অসুস্থ থাকলেও তাঁর বাড়িতে সমস্ত মিটিং হোত। বাড়ি ছিল সবার আশ্রয়স্থল। ময়নাগুড়িতে ফ্যাসিবাদী বিজেপি’র বিরুদ্ধে লালঝান্ডা হাতে নিয়ে বীরেনদা সমস্ত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। তাঁর প্রয়াণ হওয়ার আগেরদিন পার্টির ময়নাগুড়ি লোকাল সম্মেলন ছিল। পরদিন গ্রামের সমস্ত মানুষ ও পার্টি নেতৃবৃন্দ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে শোকযাত্রায় সামিল হন।
কমরেড বীরেন রায় লাল সেলাম।
কমরেড কণা সরকার প্রয়াত
গত ২৪ ডিসেম্বর বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেত্রী কমরেড কণা সরকার পুর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের জৌগ্রামে নিজের বাসভবনে ভোররাতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বয়স জনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন মহিলা আন্দোলন ও সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির জন্মলগ্ন থেকেই কণা সরকার যুক্ত ছিলেন। তিনি আয়ারলার জাতীয় কাউন্সিল সদস্য ছিলেন, দীর্ঘদিন রাজ্য কমিটির সদস্যা ছিলেন। তাছাড়া পার্টির জামালপুর লোকাল কমিটির সম্পাদক হিসেবে সংগঠকের ভুমিকা পালন করতেন। গরিব মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে এলাকায় সব সময়ই সক্রিয় ভুমিকা পালন করতেন। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর স্বামী রেলের কর্মী ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলে রেলের চাকরি পায়। জৌগ্রাম রেলস্টেশন সংলগ্ন রেল কোয়ার্টারের পাশে একটা ঘর করে একাই থাকতেন। সেই ঘরটি ছিল পার্টির অফিসের মতো। পার্টির লোকেদের প্রায় সময়ই যাতায়াত ছিল এবং জেলা কমিটির মিটিং ও গণসংগঠনের মিটিং হত। কমরেডের জীবন থেকে বিপ্লবীদের শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছুই আছে। পার্টির জেলা কমিটির পক্ষ থেকে কমরেডের মৃত্যুতে গভীর শোক জ্ঞাপন করা হয়েছে। এই কমরেডের বিপ্লবী কর্মকান্ড ও আদর্শ থেকে শিক্ষা নিয়ে পার্টি ও জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য আহবান রাখছে।
কমরেড কণা সরকার লাল সেলাম। কমরেডের স্মৃতি অবিনশ্বর হোক।