ইতিহাসের বড় বড় প্রশ্নগুলি রাস্তার গণআন্দোলনেই ফয়সালা হয়। কমরেড বিনোদ মিশ্রের এই কথা আমাদের অভিজ্ঞতায় আরো একবার সত্য প্রমাণিত হল। কোভিড মহামারীর সুযোগ নিয়ে মোদী সরকার কৃষি ব্যবস্থাকে বড় বড় প্রাইভেট কোম্পানির হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল সংসদে জালিয়াতি করে কৃষি আইন চাপিয়ে দিয়ে। কিন্তু পাঞ্জাবের কৃষকেরা মহামারীর মাঝেও এমন এক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে সমর্থ হন যা দেশজুড়ে কৃষকদের উজ্জীবিত করে। সমস্ত অপপ্রচার ও নিষ্ঠুর আক্রমণ মোকাবিলা করে শেষ পর্যন্ত দাম্ভিক মোদী সরকারকে আইনগুলি প্রত্যাহার করতে বাধ্য করে নতুন ইতিহাস রচনা করল এ আন্দোলন। কৃষক আন্দোলনকে এভাবে এক শক্তিশালী ফ্যাসিবাদ-বিরোধী প্রতিরোধের দুর্গে বিকশিত হতে দেখলে কমরেড বিনোদ মিশ্র সবচেয়ে খুশী হতেন।
মোদী সরকার কৃষক আন্দোলনের অন্তর্নিহিত শক্তি বোঝে। স্পষ্টতই, কর্পোরেট আগ্রাসনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার শক্তি কৃষক আন্দোলনের আছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে নিহিত বিস্ফোরক শক্তিকে সর্বত্র ওরা যেভাবে কাজে লাগায় তাকেও কৃষক আন্দোলন অকেজো করে দিতে পারে। আর নিজেদের অধিকার রক্ষায় আন্দোলনরত সব অংশের মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে দিতে পারে। উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিশেষ গুরুত্ববাহী বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে আইন তিনটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হলেও কৃষক আন্দোলনের সাথে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে ফয়সালায় পৌঁছনোর প্রক্রিয়াকে মোদী সরকার তাই অস্বীকার করে চলেছে। কৃষক আন্দোলনের কাছে সরকারের নতিস্বীকারকে দেখাতে চাইছে সরকারের উদারতা বা মহানুভবতা হিসেবে। নতুন কৃষি আইন প্রত্যাহারের যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বার্ষিকীতে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতেই সরকার কৃষকদের এক ছোট অংশের বিরোধিতাকেও মেনে নিল। কিন্তু এই দাম্ভিক ও কপট প্রচার তাদের পরাজয় ও হতাশাকে লুকিয়ে রাখতে পারবেনা।
লখিমপুর খেরিতে প্রতিবাদরত কৃষকদের ওপর হিংস্র আক্রমণের উস্কানিদাতা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে বরখাস্ত করা, আন্দোলনে অংশ নেওয়া সমস্ত কৃষক ও অন্যান্য কর্মীদের ওপর থেকে সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করা এবং সমস্ত কৃষকের সমস্ত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন করা সহ বাকি সব মৌলিক দাবিতে দৃঢ় থাকাটা অবশ্যই সঠিক পদক্ষেপ। পাঞ্জাব হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকেরা এতদিন তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের লড়াইটা সামনের সারিতে থেকে সাফল্যের সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছে, এবারে আগামী পর্যায়ের লড়াইটা এগিয়ে নিয়ে যেতে অন্য রাজ্যের কৃষকদের, বিশেষত যেসব রাজ্যে ফসলের সরকারি ক্রয় খুব কম এবং কৃষকেরা এমএসপি’র থেকে অনেক কম দরে ফসল বিক্রয় করতে বাধ্য হন সেরকম রাজ্যগুলির কৃষকদের, বৃহত্তর ভূমিকা রাখার সময়। কৃষকের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিতে অস্বীকার করা হচ্ছে, অধিকাংশ শ্রমিককে কঠোর শ্রমের ন্যূনতম মজুরিটাও দেওয়া হচ্ছেনা, অথচ কোম্পানিগুলোকে খুচরো ক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান হারে সর্বোচ্চ মূল্য আদায় করার খোলাখুলি ছাড় দিয়ে রাখা হয়েছে। কৃষক আর শ্রমিককে মিনিমাম বা ন্যূনতম মূল্য দিতেও এত আপত্তি, অথচ কোম্পানি মালিকদের জন্য যত বেশি সম্ভব আদায় করে চড়া মুনাফার গ্যারান্টি। এমএসপি’র লড়াইকে তাই জীবনধারণের উপযুক্ত মজুরির লড়াই ও মূল্যবৃদ্ধি রোধ করার লড়াইয়ের সাথে যুক্ত করতে হবে।
আমাদের এ’কথাও বুঝে নিতে হবে যে এই আন্দোলন সফল হয়েছে মাসের পর মাস ধরে সংগঠিতভাবে, নিবিড় ও সুব্যবস্থিতভাবে লক্ষ লক্ষ কৃষককে সামিল করানোর মধ্যে দিয়ে। কৃষক আন্দোলনের বিজয়ের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হওয়া অনুপ্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে এখন ব্যাপক বিস্তৃত সংগঠন নির্মাণে এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক সমাবেশে মনোনিবেশ করতে হবে। কৃষি আইন প্রত্যাহারের এক সপ্তাহের মধ্যে, ভারতের সংবিধান গ্রহণ দিবস ২৬ নভেম্বর দিনটিকেই নরেন্দ্র মোদী বেছে নিলেন সংবিধানের মূলভাব নস্যাৎ করার কাজে। সংবিধানকে ভয় পেয়ে, বিশেষত সংবিধানের পূর্বঘোষণায় ঊর্ধ্বে তুলে ধরা মৌলিক অধিকারের যে অঙ্গীকারগুলি, যেগুলি অধিকার রক্ষার জনপ্রিয় আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে সেগুলোর ভয়ে, প্রধানমন্ত্রী সংবিধানকে উল্টে দিতে চাইলেন অধিকারকে কর্তব্যের অধীনস্থ বানিয়ে। স্মরণে রাখা দরকার যে জরুরি অবস্থা জারি করার সময়কালেই সংবিধান সংশোধন করে নাগরিকের কর্তব্যকর্মগুলি সংবিধানে ঢোকানো হয়েছিল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও অঙ্গীকারের ওপর আক্রমণ মোদী সরকার যত তীব্র করবে আমাদের তত কৃষক আন্দোলনের বিজয় থেকে বিভিন্নভাবে অনুপ্রেরণা নিয়ে চলতে হবে ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। কৃষক আন্দোলন নিজে অনুপ্রাণিত হয়েছিল সমান নাগরিকত্বের অভূতপূর্ব আন্দোলন এবং মুসলমান মহিলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীছাত্রদের শক্তিতে ভর করে গড়ে ওঠা শাহীনবাগ মডেলের বীরত্বপূর্ণ উত্থান থেকে।
২০২১ ছিল ভারতীয় জনতার জন্য এক নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের বছর। রাষ্ট্র দেশবাসীর প্রাণ রক্ষা করার দায়দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে নৃশংস নিপীড়ন আর নিষ্ঠুর জনবিরোধী নীতি চাপিয়ে দিতে এবং সরকারি সম্পদ বেচে দিতেই ব্যস্ত থেকেছে। কিন্তু তবু এই বছরটা আমরা শেষ করছি বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জনগণের বিজয় অর্জনের এক চমৎকার দৃষ্টান্তের সাক্ষী হয়ে। নতুন বছরটা শুরু হবে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড, গোয়া ও মণিপুরের বিশেষ গুরুত্ববাহী বিধানসভা নির্বাচনগুলির মধ্যে দিয়ে। আসুন আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি আর সাধ্যকে সমাবেশিত করে এই নির্বাচনগুলিকে শক্তিশালী গণআন্দোলনের রূপ দিই ফ্যাসিবাদী শক্তিকে আরেকটা ধাক্কা দিতে।
আজ আমরা কমরেড বিনোদ মিশ্রের অকাল প্রয়াণের ২৩তম বার্ষিকী পালন করছি। মতাদর্শগত দৃঢ়তা ও সাংগঠনিক শক্তির সাথে জনগণের সাহসী উদ্যোগ ও উত্থানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে সিপিআই(এমএল)-কে এক শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁর জীবনভর সংগ্রাম আমাদের অবশ্যই স্মরণ করতে হবে। পার্টিকে শক্তিশালী করাই জনতার বিজয়ী উত্থানের মূল চাবিকাঠি। ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মাঝেও আমরা পার্টির প্রসার ঘটানো ও সর্বাত্মক উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণের প্রভূত সম্ভাবনা আজ চারদিকে দেখতে পাচ্ছি। সময়কে শক্ত মুঠোয় ধরে আসুন আমরা ২০২২কে আরও আন্তরিক উদ্যম ও বৃহত্তর বিজয়ের বছরে উন্নীত করি।
- কেন্দ্রীয় কমিটি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন
উত্তরপ্রদেশের 'সিট' (বিশেষ তদন্তকারী দল) অনুসন্ধান চালিয়ে অবশেষে আদালতকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আসলে কী ঘটেছিল! লখিমপুর-খেরীতে যা সংঘটিত হয়েছিল সেটা পূর্ব পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র অনুসারেই। গত তেসরা অক্টোবর সেখানে জমায়েত ছিল পণ করা সংগ্রামী কৃষকদের। মুখ্যত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার ও ফসলের দামে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে। রয়েছে আরও কিছু শ্রেণীগত ও গণতান্ত্রিক দাবিও। ওই জমায়েত বানচাল করতেই ভীড় জনতার ওপর গাড়ি চালিয়ে দেওয়া হয়। তাতে চাপা পড়ে মারা যান এক সাংবাদিক সহ চার কৃষক। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জমায়েতের কৃষক জনতা, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা, দেশজুড়ে গণতান্ত্রিক শক্তি ও বিবেকবান মহল। প্রত্যক্ষদর্শীদের দৌলতে জ্বলন্ত দাবি ওঠে, ওই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলে আশিস মিশ্র ও তার খুনে মাফিয়া দলবলই, অতএব তাদের গ্রেপ্তার করে, বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। এরা সব বিজেপির। একইসঙ্গে জোর দাবি ওঠে, কেন্দ্রের মন্ত্রর থেকে অজয় মিশ্রের অবিলম্বে পদত্যাগ চাই, নয়ত বরখাস্ত। আশিসকে ‘নির্দোষ’ দাবি করতে অজয় অজেয় হওয়ার প্রচুর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই কসরত কোনও ফল দেয়নি। বিপরীতে, দাবি আদায়ে নাছোড় জনতার প্রশ্নাঘাত যোগী-মোদী সরকারকে হ্যাঁচকা টান দেয়। প্রথম কদিন বহু বাহানা দেখানোর পর যোগী সরকার বাধ্য হয় কিছুটা স্বর নামাতে, দাবিগুচ্ছের একাংশ মেনে নিতে। যোগীর পুলিশ অগত্যা বাধ্য হয় অভিযুক্ত মোট তেরজন সমেত আশিসকে গ্রেপ্তার করে বিচারাধীন হেফাজতে ঢোকাতে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত লাগু করা হয়েছিল অনেক লঘু অভিযোগ। ঘটনা ঘটে গেছে নাকি নিতান্তই অসাবধানতাবশত! মামলায় প্রথমে যুক্ত করা হয়েছিল ফৌজদারী আইনের অপেক্ষাকৃত কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ ধারা। অন্যদিকে ‘শ্রীঘরে’ স্থান হওয়া তেরজনের একজনকে দিয়ে পাল্টা এফ আই করা হয় কৃষকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু চাতুরি করে পার পাওয়া যায়নি। ইতিমধ্যে মামলা গড়ায় রাজ্যের আদালত ছাড়িয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দেয় বিশেষ তদন্তের। সেই মোতাবেক যোগী সরকার বাধ্য হয় ‘সিট’ গঠন করতে। কারণ, রয়েছে উপর্যূপরি চাপ — ন্যায়বিচারের দাবিতে কৃষক জনতার মায় বৃহত্তর গণপরিসরের আর উত্তরপ্রদেশে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের। উভয় চাপের মুখে মুখ্যমন্ত্রী যোগী প্রথমে গররাজি হলেও অগত্যা পদক্ষেপ করেন ‘সিট’-তদন্তের। সেখানেও শয়তানি ছিল পেটোয়া অফিসারদের নিয়ে দল গঠনের, তদন্ত রিপোর্টে যাতে বিজেপির অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভেস্তে দেওয়া যায়। তবে সেই অভিলাষ বানচাল হয়ে যায় সুপ্রীম কোর্টের হস্তক্ষেপে।সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের দেওয়া শর্তে তদন্ত দল ফের ঢেলে সাজানো হয়। উত্তরপ্রদেশ ক্যাডারের হলেও ওই রাজ্যের বাসিন্দা নয় এমন অফিসারদের নিয়ে তদন্ত দল তৈরি হয়। তার ফলে তদন্ত রিপোর্টে অন্তত এই সার সত্য বেরিয়ে এসেছে যে, ভয়ঙ্করভাবে হতাহত সংঘটিত করা হয়েছিল পরিকল্পনা করেই। আর, মামলায় নতুন করে জোড়া হয় ফৌজদারী আইনের কিছু গুরুতর ধারা। তবে তদন্ত রিপোর্ট উদঘাটিত করেছে এক শিলাখন্ডকে মাত্র, এখনও বাকি রয়েছে গোপন ছক কষার মধ্যে আরও কী মাথাচক্র কাজ করেছে তার সনাক্তকরণ।
এবার অভিযুক্ত খুনীদেরকে বাঁচাবে! যোগী সরকার কি বলবে, কি করবে? কথায় আছে, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। এবার খুনী-পুত্রের মন্ত্রী-পিতা কি জবাব দেবেন? তাঁর মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের দাবির কি হবে? তিনি কি পদত্যাগ করবেন? মন্ত্রী অজয়ের ওপর থেকে প্রধানমন্ত্রীর অভয়দানের হাত কি সরবে? বেকারির দূর্দশায়, হিন্দুত্ব-জাতিবাদী-বর্ণবাদী ও লিঙ্গগত উৎপীড়নে সারা ভারতে সবচেয়ে কুখ্যাতি কুড়িয়েছে যোগী রাজত্ব। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্ট আরও কী বলছে? গত তিন বছরে কুখ্যাত ইউএপিএ-তে উত্তরপ্রদেশে যত গ্রেপ্তার হয়েছে তার সত্তর শতাংশ ত্রিশ বছরের নিচের। এ তথ্যতে-রাত্তির আগে লোকসভায় জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অনুজ মন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই, তবে আগ বাড়িয়ে নয়, প্রশ্নোত্তরের ঠ্যালায়। এসব হল একটা যুব প্রজন্মকে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা লাগিয়ে দিয়ে কারাবন্দী করে রাখার অপচেষ্টা, এক নারকীয় রাজত্বকে প্রতিবাদবিহীন করে তোলার নজীর। লখিমপুর-খেরীর হত্যালীলা ঘটেছে শাসনের এই চূড়ান্ত অমানবিক হাওয়াতেই। স্বভাবতই প্রসঙ্গত যে দাবিসব উঠেছে, আন্দোলনের যে গুরুত্ব রয়েছে তা জারী রাখতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে লখিমপুর-খেরীর খুনি আর নেপথ্যে থাকা মুনিদের রেহাই দেওয়া চলবে না।
সেনার বিশেষ সশস্ত্র বাহিনী নাগাল্যাণ্ডের মন জেলার ওটিং গ্রামে খনি শ্রমিকদের গণহত্যা সংগঠিত করেছে। এ এক হীন অপরাধ। সেনা যেভাবে এই গণহত্যাকে ‘এনকাউন্টার’ বলে সাজাতে চেয়েছে তাতে অপরাধ আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও আর্মি অফিসাররা “ভুল করে হয়ে গেছে” বলে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। কিন্তু উত্তর-পূর্বের বিজেপি সদস্য ও তাদের জোটসঙ্গীদের কাছে পর্যন্ত এই ব্যাখ্যা মোটেই গ্রহণযোগ্য হয়নি।
সশস্ত্র বাহিনী দাবি করেছে যে তাঁরা ট্রাকভর্তি নাগরিকদের (কাজ থেকে ফেরা খনি শ্রমিক) ওপর গুলি চালিয়ে ঘটনাস্থলেই ৬ জনকে মেরে ফেলেছেন কারণ সেনার কাছে “গুপ্তচর বিভাগের বিশ্বস্ত খবর” ছিল জঙ্গীদের যাতায়াত বিষয়ে। কিন্তু সেনার দেওয়া এই অজুহাত নানা কারণেই মেনে নেওয়া যায় না।
প্রথমত, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এক ব্যস্ত রাস্তার ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় পুলিশকে অপারেশনে যুক্ত না করে সেনা প্রথাবদ্ধ নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। অধিকন্ত, ট্রাকের আরোহীদের দিক থেকে কোনোরকম আক্রমণের চিহ্নমাত্র না দেখেও এবং তাঁদের প্রতি কোনোরকম সতর্কতামূলক ঘোষণা জারি না করেই সেনা গুলি চালিয়েছে, আরোহীদের প্রকৃত পরিচিতি যাচাই করে নেওয়া তো অনেক দূরের কথা। যদি ওই ট্রাকে বাস্তবতই জঙ্গিরা থাকত তবুও এই অপারেশন মানবাধিকার উল্লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হত।
যখন স্থানীয় নাগরিকেরা এই হত্যার খবর পেয়ে খোঁজখবর নিতে আসেন তখন তাঁরা সশস্ত্র বাহিনীকে ‘এনকাউন্টার’ সাজানোর কাজে ব্যস্ত হিসেবে দেখতে পান। খুব স্বাভাবিকভাবেই গ্রামবাসীরা ক্রুদ্ধ হয়ে স্থানীয় সেনা দপ্তরে প্রতিবাদ দেখাতে শুরু করেন। সেনা এখানে আবার প্রতিবাদরত নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়, ৭ জনকে হত্যা করে। খবরে প্রকাশ, এরপর ওই সশস্ত্র বাহিনী পালাতে শুরু করে এবং পালানোর সময় এমনকি রাস্তার ধারের খনিশ্রমিক বসতির দিকে গুলি ছুঁড়তে যায়। সব মিলিয়ে সেনার অতর্কিত হামলা ও তার পরবর্তী ঘটনাক্রমে মোট ১৫ জন নাগরিকের প্রাণ গেছে। আরও অনেকে মারাত্মক জখম।
এই ঘটনা কোনও ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে অথবা কাশ্মীর ও বস্তার সহ অন্যান্য সংঘর্ষের এলাকায় সাজানো এনকাউন্টারে নাগরিকদের হত্যা করা খুবই সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আফস্পা)’র উৎস ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে দমন করার লক্ষ্যে ব্রিটিশের চালু করা ‘সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স’এর মধ্যে। লজ্জার কথা হল এই ঔপনিবেশিক উৎসের আইনটি ১৯৫৮ সাল থেকে ভারতীয় আইন হিসেবে উত্তর-পূর্ব ভারতে লাগু আছে।
খুন, অত্যাচার এমনকি ধর্ষণের অপরাধেও বিচার থেকে ছাড় পাওয়ার বিশেষ রক্ষাকবচ সশস্ত্র বাহিনীকে দেয় আফস্পা। সেই কারণেই, ওটিং গণহত্যার বিষয়ে নাগাল্যাণ্ড পুলিশের পক্ষ থেকে স্পেশাল ফোর্সের বিরুদ্ধে এফআইআর করা সত্ত্বেও শাস্তির লক্ষ্যে পুলিশ এগোতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত না কেন্দ্রীয় সরকার অনুমতি দিচ্ছে। আর, এই অনুমতি প্রায় কখনই দেওয়া হয় না। এমনকি ২০০৪ সালে মণিপুরের থাংজাম মনোরমাকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্তে আসাম রাইফেলসের জওয়ানেরা দোষী সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত অফরাধীরা শাস্তি না পেয়ে বহাল তবিয়তে আছে আফস্পার কারণে।
নাগরিকদের ওপর সেনার নিষ্ঠুর নিপীড়নের মুখ্য হাতিয়ার এই ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’এর বিরুদ্ধে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন যাবত প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। আসাম রাইফেলসের সদর দপ্তরের সামনে মনিপুরের মহিলারা শরীরের সমস্ত পোশাক ত্যাগ করে “ইণ্ডিয়ান আর্মি রেপ আস” (ভারতীয় সেনা এসো আমাদের ধর্ষণ করো) লেখা ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই প্রতিবাদ আফস্পা খারিজ করার এক জোরালো আবেদন হিসেবে আজও জনমানসে উজ্জ্বল। কিন্তু বিভিন্ন রঙের একের পর এক সরকার আফস্পা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে গেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চল, কাশ্মীর ও বস্তার সহ অন্যত্র নাগরিকদের ওপর অপরাধের ক্ষেত্রে সেনা ও আধাসেনাকে দায়বদ্ধ করতে অস্বীকার করে গেছে সরকারগুলো। গত দু’দশকে কেবলমাত্র মনিপুরে ভূয়ো সংঘর্ষের প্রায় ১,৫০০ মামলা সুপ্রিম কোর্টে পড়ে আছে সুবিচারের অপেক্ষায়।
সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা সাজানো সংঘর্ষ ও ধর্ষণের বিষয়ে মানবাধিকার কর্মীরা প্রশ্ন তুললে বিজেপি তাঁদের ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’ বলে দেগে দেয় এবং রাজদ্রোহ আইন দিয়ে তাঁদের ভয় দেখায়। কাশ্মীরের মানবাধিকার রক্ষার অগ্রণী যোদ্ধা জেকেসিএস’র খুররম পারভেজকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হল মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে অগণতান্ত্রিক ইউএপিএ আইনে। জেকেসিএস কাশ্মীর উপত্যকায় মানবাধিকারের জোরালো ওকালতি করে থাকে এবং এখন ওটিং’এ যেরকম হল ঠিক সেরকম ‘সংঘর্ষ’ হিসেবে সাজানো বহু গণহত্যা ও অন্যান্য লঙ্ঘনের অনুপুঙ্খ তথ্য সংকলনের কাজ করে থাকে।
এখন এমনকি নাগাল্যাণ্ড ও মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীরা — উভয়েই বিজেপি’র জোটসঙ্গী — আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন, আর ‘মন’ জেলার বিজেপি নেতা অভিযোগ করেছেন যে সেনা তাঁকে লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করেছে এবং ভূয়ো সংঘর্ষ সাজিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে সুবিচার নিশ্চিত করতে হলে আফস্পা প্রত্যাহার করার পাশাপাশি সমগ্র অঞ্চলের বে-সামরিকীকরণ ও বিগত সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সেনাকে দায়বদ্ধ করাটা একান্ত জরুরি। অতীতে উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলির যেসব ক্ষেত্রে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সেসব তদন্তও পরিহাসে পর্যবসিত হয়েছে এবং অপরাধীরা কোনও শাস্তি ছাড়াই পার পেয়ে গেছে।
উপরন্ত, ওটিং মামলা সহ সশস্ত্র বাহিনীর অন্যান্য অপরাধের বিচার অবশ্যই অসামরিক আদালতে প্রকাশ্যে হওয়া দরকার। এবং সমস্ত চলমান সশস্ত্র সংঘর্ষের পদ্ধতিকে অবশ্যই মানবিকতাপন্থী ও মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন এবং সাংবিধানিক মান্যতার সাথে সাজুয্যপূর্ণ হতে হবে।
সামরিক সমাধানের বিরুদ্ধে সারা দেশের উঠে দাঁড়ানোর এবং সেনাবাহিনীর কাছে দায়বদ্ধতা দাবি করার এখনই উপযুক্ত সময়। সারা দেশকে অবশ্যই উঠে দাঁড়াতে হবে আফস্পাকে এক চূড়ান্ত ধাক্কা দেওয়ার লক্ষ্যে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন করার এই সময়টাই আফস্পার মতো ঔপনিবেশিক শাসনধারার আইন থেকে মুক্ত হওয়ার সময়, সংঘর্ষের এলাকায় সবরকম হেফাজত-হিংসার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর দায়বদ্ধতা ও মানুষের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করার সময় এখন।
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৭ ডিসেম্বর ২০২১)
সাড়ে তিন দশকের ‘বামপন্থী’ শাসনের পরে পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ কীভাবে দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতাকে অনায়াসে মেনে নিতে পারল তা ৭০ বছরের ‘কমিউনিস্ট’ শাসনের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পুতিনের মতো স্বৈরতন্ত্রীকে রাশিয়ার জনগণের মেনে নেওয়ার কারণের থেকে কম কিছু গবেষণার বিষয় নয়। বামফ্রন্ট তথা সিপিআই(এম)-র চরম শত্রু বা সমালোচকও এমনটা বলতে পারবেনা যে ‘বামপন্থী’ বামফ্রন্টীয় মন্ত্রী, নেতারা তুমুল দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। এমনটাও বলা যাবে না যে নেতারা অতীব সাম্প্রদায়িক ছিলেন। তাহলে সরকার থেকে সরে যাওয়ার ১০ বছরের মধ্যে (বা তারও অনেক আগে থেকে) এত সহজে কীভাবে সরকারের ব্যবস্থাপনায় রন্ধ্রে এত দুর্নীতি প্রকট হয়ে উঠছে।
ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিনিয়ত একের পর এক দুর্নীতির খবর সামনে আসছে, যার সূত্রপাত সারদা-রোজভ্যালি-আইকোর-এমপিএস প্রভৃতি ‘চিটফাণ্ড’ নিয়ে হাজার কোটি টাকা তছরূপের কাহিনী সামনে আসার মধ্য দিয়ে। বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রী-শান্ত্রীরা গ্রেফতার হল, কেউ আবার বিজেপি বনে গিয়ে ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। বিধায়ক-সাংসদ-মন্ত্রীদের সাথে সাংবাদিকদের হাজতবাসও হল। তবে ৮ বছর বাদেও সেই দুর্নীতির রহস্য পুরোপুরি উদঘাটন হল না, শাস্তি হলনা অপরাধীদের। টাকা ফেরত পেলেন না হতভাগ্য আমানতকারীরা। তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী বা নেতারা যাই বলুন না কেন সারদা-রোজভ্যালির দুর্নীতি তছরূপ, ডেলোতে মিটিং এসব বাস্তব। যেমন ছবির মতো পরিস্কার ভিডিও ছবিতে মুকুল-সুব্রত-শোভন-ফিরহাদ-সৌগত-শুভেন্দু’দের নারদ কেলেঙ্কারিতে টাকা নেওয়া। ৫ বছর বাদেও কোনো শাস্তি নেই। এমনভাবে সরকারগুলি, কেন্দ্রে ও রাজ্যে চলছে এবং চলেছে যে, নেতাদের বিধায়ক মন্ত্রীদের উৎকোচ নেওয়া মোটামুটি আইনসিদ্ধ হয়ে গেছে, কেবল বিধানসভা বা সংসদে এব্যাপারে একটা আইন প্রণয়নে বাকি আছে মাত্র।
ওদিকে গরু পাচার, কয়লা পাচারের মতো কোটি টাকার দুর্নীতিতেও জড়িয়ে পড়ছে তৃণমূল নেতার নাম, এমনকি দলের সেকেণ্ড-ইন-কম্যাণ্ডের নামও এসে পড়ছে। কয়লা পাচারের অন্যতম প্রধান খলনায়ক বিনয় মিশ্র যুব তৃণমূলের সম্পাদক ছিলেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠও এবং তিনি ফেরার। ফলে কয়লা পাচারের দুর্নীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের সংযোগ আছে বলাই যায়। এর পাশাপাশি মেট্রো ডেয়ারিকে জলের দরে কেভেন্টার গোষ্ঠির কাছে বেচে দেওয়াটিও একই রকম দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। নাহলে কেনই বা সরকার যে পরিমাণ শেয়ার (৪৭ শতাংশ) বিক্রি করে মাত্র ৮৫ কোটি টাকা পেল, শেয়ার কেনার পরেই তার এক-তৃতীয়া়ংশের কম (১৫ শতাংশ) বিক্রি করে ১৩৫ কোটি টাকা পেল কেভেন্টার! ফলে ওই হিসেবে সরকার ৩৪০ কোটি টাকা কম দামে শেয়ার বিক্রি করেছে।
দুর্নীতির প্রশ্নে সবথেকে বেশি সামনে এসেছে বিদ্যালয়ের চাকরি। বিদ্যালয়ের শিক্ষক, গ্রুপ ডি, গ্রুপ সি সর্বস্তরেই নিয়োগের ক্ষেত্রে, এমনকি বদলির ক্ষেত্রে যে অবাধ বেনিয়ম আসছে ধারাবাহিকভাবে তা সারা রাজ্যের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের নৈতিকতাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, এবং রাজ্যের শাসক দলের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির চূড়ায় সোনার কলস স্থাপন করছে। এসএসসি’র নিয়োগের অনিয়ম, প্যানেলের উপরের দিকে থাকা প্রার্থীকে টপকে শেষের দিকে থাকা প্রার্থীকে নিয়োগ করা এসব বারবার ধরা পড়েছে। এমনিতেই নিয়োগ পদ্ধতিকে এতটাই বেনিয়মের ধাঁধায় জড়িয়ে ফেলা হয়েছে যে, এসএসসি’র কোনোবারের নিয়োগই আদালতে না গিয়ে শেষ হয়নি। অতি সম্প্রতি বিদ্যালয়গুলিতে গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বেনিয়মের কথা সামনে এসেছে। উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতি শিক্ষাকর্মীদের নিযুক্তিতে অনিয়মের তদন্ত করার ভার সিবিআই’এর উপর ন্যস্ত করেছিলেন। যদিও ওই আদালতের ডিভিসন বেঞ্চ সে রায়কে পাল্টে তদন্তের ভার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির তত্ত্বাবধানে করার আদেশ দিয়েছেন। তবে প্যানেল পাল্টে বা বাতিল হওয়া প্যানেল থেকে যে নিয়োগ হয়েছে তা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। কীভাবে কেন এবং কারা তা কোন উৎকোচের বিনিময়ে করল সেটাই রহস্য ও তা উদঘাটন প্রধান বিবেচ্য। প্রতিদিন শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মী নিয়োগ নিয়ে উচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। এসএসসি’র শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম তথা দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্যানেলভুক্ত চাকরিপ্রার্থীরা ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী-শিক্ষামন্ত্রীরা বিবিধ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ও তা ভাঙছেন। ওদিকে আন্দোলনরত ছাত্রদের গ্রেফতার করে মামলা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওইসব আন্দোলনকে গোড়াতেই ধ্বংস করার জন্য করোনার জুজু ও তদুদ্ভুত ডিজ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইন তো আছেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করা ওই আইনে অপরাধ, নিয়োগে ও বদলিতে দুর্নীতি জায়েস্।
কেবল স্কুল সার্ভিস কমিশনেই বা বিদ্যালয়ে চাকরির ক্ষেত্রেই দুর্নীতির বা অনিয়মের দেখা মিলেছে তাই নয়, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষাতেও তেমন অভিযোগ উঠেছে, এমনকি ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তেমনটাই অভিযোগ। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত ক্লার্কশিপ পরীক্ষার ফল ঘোষণার পরে তাকে প্রত্যাহার করে নতুন করে প্রকাশ করাও হয়েছে, কমিশনের চেয়ারম্যানকে অপসারণের পরে। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীপদে কর্মী নিয়োগ প্রায় বন্ধ, উপরন্তু যেটুকু হয় তাতেও ভুরি ভুরি বেনিয়ম বুঝিয়ে দিচ্ছে যে চাকরি পেতে কোনো না কোনো অর্থ লেনদেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া, সিভিক ভলান্টিয়ার বা অন্যান্য অস্থায়ী, কন্ট্রাকচুয়াল কর্মী নিয়োগের কোনো রীতি পদ্ধিতিই নেই, ফলে সেগুলি সরকারি দলের নেতাদের সোনার খনি।
ইমারতি দ্রব্যের সরবরাহে সিন্ডিকেটের কথাতো সকলেরই জানা। এমনটা নয় যে তা কেবল তৃণমূল শাসনেই ঘটেছে। সারাদেশ জুড়েই ইমারতি দ্রব্যের যোগানদার ও বিল্ডিং কন্ট্রাক্ট এবং প্রোমোটিং-এর ব্যবসা প্রায় মাফিয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যে রাজ্যে যারা ক্ষমতায় আসীন তারাই তার রস আস্বাদন করে থাকে। বামফ্রন্ট আমলেও এলাকার দুলাল, লক্ষ্মণদাদারা ছিল। কিন্তু তৃণমূল শাসনে পুরসভার কাউন্সিলরারা ফুলে ফেঁপে রসালো হয়ে উঠেছে। কাউন্সিলরদের বেতন মাসিক ১০ হাজার টাকা। সেই জনপ্রতিনিধিরা কীভাবে বৈভবশালী হয়ে ওঠেন তা অবশ্যই আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদ সংক্রান্ত তদন্তের উপজীব্য হয়ে উঠতে পারে। এলাকায় প্রোমোটারদের থেকে বর্গফুটপিছু অর্থ, নিজের তাঁবে থাকা বিল্ডিং মেটেরিয়াল যোগানদারের কাছ থেকে মাল নিতে বাধ্য করা, নিজের ওয়ার্ডের রাস্তা, ফুটপাথ সংক্রান্ত পুরসভার কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে কাটমানি নেওয়া এসবই নিয়মসিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। কেউ যদি সেটা না নেন তিনি ব্যতিক্রম যা নিয়মকে প্রতিষ্ঠিত করতেই সাহায্য করে।
এইসব কারণে এককথায় বললে অত্যুক্তি হবেনা, তৃণমূল আমলে দুর্নীতি সর্বত্র এক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- অমিত দাশগুপ্ত
স্বাধীনতা লাভের এক দশক পরই নাগা পার্বত্য অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ দমনে ১৯৫৮ সালে চালু হয় সেনা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন বা আফস্পা। এই আইন জঙ্গি কার্যকলাপ দমনে তল্লাশি, গ্ৰেপ্তারি ও গুলি চালানোর যথেচ্ছ ক্ষমতা সেনাদের দিয়েছে। চালু হওয়ার ছ-দশক পরও বিভিন্ন রাজ্যে ঐ আইনের সচলতায় কোনো ছেদ নেই। এই ছ-দশকেরও বেশি সময়কালে আফস্পার ইতিহাস দেশের নাগরিকদের রক্ত ঝড়ানোর ইতিহাস — এই আইন সেনাদের শাস্তিহীনতার সুরক্ষা দেওয়ায় তারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে এবং কাশ্মীরে সৃষ্টি করে চলে নির্মম নিপীড়নের নিরবচ্ছিন্ন আখ্যান। ফলে আফস্পা-লাঞ্ছিত রাজ্যগুলো থেকে বারবারই উঠেছে আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি। সেনাদের নৃশংস আচরণে নিযুক্ত তদন্ত কমিটি এবং মানবাধিকার রক্ষার সংস্থাগুলোও আফস্পা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছে। গত ৪ ডিসেম্বর নাগাল্যান্ডের মন জেলার ওটিং গ্ৰামে সেনাদের হাতে ঘরে ফেরা শ্রমিক ও প্রতিবাদী গ্ৰামবাসীদের হত্যা (ঐ ঘটনায় নিহতের মোট সংখ্যা ১৭) এবং আরও বহু সংখ্যককে গুরুতর রূপে আহত করার পর আফস্পা বাতিলের দাবি আরও একবার উঠল জোরালো ভাবে। উত্তর-পূর্বের সব রাজ্যেই বিজেপি এখন শরিকদের নিয়ে ক্ষমতাসীন, সেই শরিকরাও এখন আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে সোচ্চার, একই দাবি তুলেছেন নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী এনপিএফ নেতা নিফিউ রিও এবং মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী এনপিপি নেতা কনরাড সাংমা। মিজোরাম থেকেও প্রত্যাহারের দাবি শোনা গেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আট ছাত্র সংগঠনের যৌথ সংস্থা ‘নেসো’ ৯ ডিসেম্বর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটা রাজ্য রাজধানীতে মন জেলার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করে এবং আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। সেনাদের দৌরাত্ম্যে সবচেয়ে উৎপীড়িত রাজ্যগুলোর অন্যতম মনিপুরের “উইমেন গান সারভাইভারস নেটওয়ার্ক”-এর নেত্রী বীণালক্ষ্মী নেপ্রামের অভিজ্ঞতায় সেনাদের কার্যধারা এই রকম — “বিনা বিচারে, বিনা প্ররোচনায় বছরের পর বছর সামরিক বাহিনী সাধারণ মানুষকে হত্যা করে চলেছে। আজ পর্যন্ত কারো শাস্তি হয়নি। মানুষ মারার অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে তাদের।” যে আফস্পা সেনাদের এমন নারকীয় নৃশংসতার অধিকারী করেছে, গণতন্ত্রে আদৌ তার ঠাঁই হতে পারে না।
আফস্পা প্রথমে নাগা অধ্যুষিত অঞ্চলে চালু হলেও পরে, ১৯৭২ সালে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমস্ত রাজ্যেই তা বলবৎ হয়। এই রাজ্যগুলো হল — আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশ। বর্তমানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে আফস্পা বহাল রয়েছে আসাম, নাগাল্যান্ড, মনিপুর (ইম্ফল পৌর অঞ্চল বাদে) এবং অরুণাচল প্রদেশের তিনটে জেলা ও আটটা থানা অঞ্চলে। এরপর জম্মু ও কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যকলাপ দমনে রাজ্যপাল করে পাঠানো হয় জগমোহনকে এবং সেই সময়ই, ১৯৯০ সালে ঐ রাজ্যে আফস্পা চালু হয়। তারপর থেকেই জম্মু ও কাশ্মীর কার্যত সেনা শাসনের অধীন হয় যা আজও চলছে। এবং বর্তমানে রাজ্যের মর্যাদা হারানো জম্মু ও কাশ্মীর সেনা কার্যকলাপের চরমতম বর্বরতা ভোগ করছে। মাঝে খালিস্তানি আন্দোলন দমনে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত পাঞ্জাবও আফস্পার জোরে সেনা বর্বরতা ভোগ করে। তবে, সেনা বাহিনীর পৈশাচিকতা অব্যাহতভাবে চলার পাশাপাশি আফস্পা-বিরোধী প্রতিবাদ এবং তার প্রত্যাহারের দাবিও লাগাতার ভাবেই উঠতে থাকে।
২০০০ সালের ৫ নভেম্বর চোখের সামনে সেনাদের হাতে ১০ জন নিরীহ নিরপরাধ নাগরিকের নৃশংস হত্যা দেখে মনিপুরের ইরম চানু শর্মিলা আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন এবং তাঁর সেই লড়াই চলে টানা ১৬ বছর। সেনাদের হাতে মনিপুরেরই মনোরমা থাংজামের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে ১২ জন মহিলা ২০০৪ সালের ১৫ জুলাই নগ্ন দেহে আসাম রাইফেলস-এর সদর দপ্তর কাংলা ফোর্টের সামনে অভিনব ও সাহসী প্রতিবাদ সংগঠিত করেন। মনিপুরের জনগণের এই শক্তিশালী আন্দোলনের পরিণতিতে কেন্দ্রীয় সরকার আফস্পার পুনর্বিবেচনার জন্য জীবন রেড্ডি কমিটি তৈরি করে যা আফস্পা বাতিলের পক্ষে মত দেয়। বীরাপ্পা মইলির নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনও আফস্পা বাতিলের পক্ষে রায় দেয়।
ঔপন্যাসিক মির্জা ওয়াহিদ ২০১১ সালে তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, “মাত্র এক ধরনের সন্ত্রাসই আছে যা কাশ্মীরের যুবকদের মা-বাবার হৃদয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বওয়াতে পারে — সেটা হল উর্দিধারীদের সন্ত্রাস।” সেনা বাহিনীর এই সন্ত্রাসের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে কাশ্মীরের সর্বত্র — ভুয়ো সংঘর্ষে হাজার-হাজার যুবকের হত্যার মধ্যে, স্বীকৃত নয় এমন অচিহ্নিত কবরগুলোয় অগুণতি যুবকের শায়িত থাকার মধ্যে, হেফাজত থেকে বিপুল সংখ্যক যুবকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আখ্যানে, ধর্ষণের কতশত ঘটনার মধ্যে। জঙ্গি হামলার বাস্তবতা সত্ত্বেও দেশের অসামরিক নাগরিকদের ওপর নামানো এই লাগামহীন সন্ত্রাসের কোনো ন্যায্যতা থাকতে পারে না এবং গণতন্ত্রও তাকে অনুমোদন করে না। রাজ্যের জনগণ এবং দেশের কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিকরা সঙ্গত ভাবেই সীমাহীন নিপীড়ন চালানোয় সেনাদের সক্ষম করে তোলা আফস্পাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তার বিলোপ সুনিশ্চিত করার দাবি উঠিয়েছেন।
শুরুতে উল্লিখিত আফস্পা প্রত্যাহারের জোরালো দাবি ছাড়াও নিরীহ, নিরপরাধ শ্রমিক ও গ্ৰামবাসীদের হত্যায় আরও কিছু প্রতিক্রিয়া আমাদের নজরে এসেছে। এগুলোর একটা হল নাগা জনগণের মানবাধিকার আন্দোলন নামক সংস্থার একটা বিবৃতি। কোহিমা থেকে ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিবৃতিতে সেনাদের হাতে নাগা জনগণের ভোগ করা নৃশংসতার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকেই দায়ী করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ভারতীয় সংসদ প্রদত্ত দানবীয় ও পৈশাচিক অব্যাহতির অধিকারে সজ্জিত হয়ে ভারত সরকার তার সুবিধামতো যে কোনো সময়ে ও স্থানে অসামরিক ও সাধারণ জনগণকে হত্যা করে চলেছে।… অসামরিক জনগণের ওপর চালানো সন্ত্রাস ও যুদ্ধর ভারতীয় রাষ্ট্রের শাসনকে আবারও জাহির করা হল যখন সবচেয়ে ভালোভাবে প্রশিক্ষিত সেনারা কর্মস্থল থেকে ট্রাকে করে বাড়ি ফেরা দীনহীন মানুষদের নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করল।… ওটিং গ্ৰামের যে নিরপরাধ জনগণ সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে জীবিকা উপার্জনে নিয়োজিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো অপরাধ করেননি, তাদের ছিন্নভিন্ন করার উদ্দেশ্যে নিজেদের যুদ্ধ লড়ার কুকুরগুলোকে লেলিয়ে দেওয়ার জন্য তার দানবীয় ও ফ্যাসিস্ত আইনগুলো সহ ভারত সরকারকেই আমরা দায়ী করছি।…” ঐ বিবৃতিতে নাগা জনগণের শান্তিকামিতাকে তুলে ধরা হয়েছে এবং পৃথিবীর কোনো শক্তিই নাগা স্পিরিটকে অবদমিত করতে পারবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
আফস্পা বিলোপের দাবি উঠেছে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিশ্বের নজরদারি সংস্থার দিক থেকেও। নিউ ইয়র্কে সদর দপ্তর চালানো এনজিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর দক্ষিণ এশিয়ার ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, “সেনাদের হাতে ১৪ জন মানুষের ভয়াবহ হত্যার তদন্ত করার যে অঙ্গীকার ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী করেছে তা নিষ্ফলাই হবে যদি না যারা দায়ী তাদের বিচার করা হয়। সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন যতদিন জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা থেকে সেনাদের সুরক্ষা যুগিয়ে যাবে, ততদিন এই ধরনের নৃশংসতা ঘটতে থাকবে।” আফস্পায় সংঘটিত অপরাধের বিচার করতে গেলে অপরাধীদের বিচারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতির প্রয়োজন এবং “যারা দোষী” তাদের বিচারের অনুমতি কেন্দ্রীয় সরকার দেবে কি না তা অমিত শাহ খোলসা করে বলেননি। আফস্পা বাতিলের দাবি সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে থেকে আফস্পা দীর্ঘদিন ধরে সেনাদের আড়াল করে এসেছে এবং ক্ষতিগ্ৰস্ত পরিবারগুলোকে ন্যায় বিচার লাভ থেকে বঞ্চিত করেছে। নাগাল্যান্ডের হত্যাকাণ্ডে এক নিরপেক্ষ অসামরিক তদন্ত যাতে হয় তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে এবং আরও অনেক জীবন রক্ষার জন্য আফস্পাকে অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।”
উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও কাশ্মীর উভয় স্থানেই বিদ্রোহ বলুন, অভ্যুত্থান বলুন বা গণ বিক্ষোভ বলুন, সবের মধ্যেই কিছু যদি নিহিত থেকে থাকে তবে তা হল আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খা। ভারতীয় রাষ্ট্র এই আকাঙ্খাকে বৈর জ্ঞান করে রাজনৈতিক বিষয়টার সামরিক সমাধানে প্রয়াসী হয়েছে। সেনা, তাদের বন্দুক ও বেয়নেটের ওপর ভর করে ভারতীয় রাষ্ট্র দেশের জনগণের এক বড় অংশের অন্তর্নিহিত ও ন্যায্য আকাঙ্খার দমনের পথকেই আরাধ্য করলেও ছয় দশক ধরে অনুসরণ করা সেই পথ শুধু গণতন্ত্র-বিরোধীই নয়, তা অকার্যকরী বলেও প্রতিপন্ন হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মদন বি লকুর ও উদয় উমেশ ললিত ২০০৮ সালের ৮ জুলাই তাঁদের এক রায়ে বলেন, “স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসাটা কখনই দীর্ঘকাল ধরে, স্থায়ীভাবে বা অনির্দিষ্টকাল ব্যাপী সেনাবাহিনী নিযুক্ত করার আবরণ হতে পারে না (বিশেষভাবে সামাজিক শৃঙ্খলা অথবা আইন শৃঙ্খলার উদ্দেশ্যে), কেননা, তা আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই উপহাস করবে।…” অতএব, অসামরিক অঞ্চল থেকে সেনাদের প্রত্যাহার করে নিয়ে এবং অবিলম্বে আফস্পাকে বিদায় জানিয়ে সংশ্লিষ্ট জনগণের সঙ্গে আলোচনায় বসার সময় সমুপস্থিত। সমস্যার সমাধানে আন্তরিক হতে হলে এই পদক্ষেপই হবে একমাত্র অভিপ্রেত পথ।
- জয়দীপ মিত্র
প্রায় দু'মাস হতে চলল রাজ্যের নিয়োগ দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মপ্রার্থীরা সুবিচারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। কলকাতায় গান্ধী মূর্তির পাদদেশে যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের ব্যানারে ধর্ণা আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা ও সমর্থন জানানোর জন্য গত ১৩ ডিসেম্বর সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার এক প্রতিনিধিবৃন্দ ধর্ণা স্থলে যান। এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন অমল হালদার, কার্তিক পাল, অভীক সাহা, সমীর পতিতুন্ড, হরিপদ বিশ্বাস ও মিহির পাল।
অবস্থান স্থলে সবকিছু জেনেশুনে কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয় — নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীতে শিক্ষক কর্মপ্রার্থীরা নিয়োগে অসঙ্গতির কারণে বঞ্চিত হয়ে অবস্থান আন্দোলন চালাচ্ছেন। দেশের কৃষক সংগঠন ও গণ আন্দোলনের কর্মী হিসাবে তাদের আমন্ত্রণে অবস্থান স্থলে গিয়ে জানা গেল সামগ্রিক অভিযোগের কথা। মেরিট প্যানেলে অনেক পেছনে থাকা অনেকে নিয়োগপত্র পেয়েছেন, অথচ প্রথমদিকে থাকা অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন। একইসাথে মেরিট প্যানেলে নাম না থাকা অজস্র ক্যান্ডিডেটকে শিক্ষক-শিক্ষিকা হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছে। এইসমস্ত বহু তথ্য কর্মপ্রার্থীরা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ২০১৯ সালে কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে আপনার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা না হওয়ায় বাধ্য হয়ে কর্মপ্রার্থীরা আবেদন জানাতে অবস্থান আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ চাকরি না পেয়ে এক বড় অংশের যুবক-যুবতী হতাশার দিকে যাচ্ছেন। তাদের এই পথে নামা আসলে রুটি-রুজির প্রশ্নের সাথে যুক্ত এক গণ আন্দোলন। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার পশ্চিমবঙ্গ শাখার পক্ষ থেকে আমরা আপনার কাছে আবেদন করছি — বঞ্চিত শিক্ষক-শিক্ষিকা কর্মপ্রার্থীদের অভিযোগ শুনুন এবং আপনার প্রতিশ্রুতি মাফিক এদের চাকরি সুনিশ্চিত করুন। প্রয়োজনে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করে গণতান্ত্রিক সমাধানসূত্র বের করার জন্য আমরা আলোচনা করতেও প্রস্তুত। বেকার যুবক-যুবতীদের এই আন্দোলন ও দাবিকে আপনি সহানুভূতির সাথে দেখবেন, আমরা এই আবেদন জানাচ্ছি।
মুখ্যমন্ত্রী গত কৃষ্ণনগর প্রশাসনিক বৈঠক ও বিভিন্ন বক্তব্যে বলে যাচ্ছেন তিনি ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পের অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছেন এবং ক্ষেত মজুরদের ও অনুদানের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্ত বাস্তব হল ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পে এক একর এর বেশি জমি আছে তারাই একমাত্র এক কিস্তিতে ৫০০০ টাকা অনুদান পেয়েছেন, যদি ঠিক মতো জমির কাগজ পত্র জমা দিতে পেরেছেন। আর একবার ৫০০০ টাকা পেয়ে বছরে ১০হাজার পাওয়া যাবে বলা হচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে অন্যান্য অনেক প্রকল্পের মতো কিছুদিন পর বন্ধ করে দিয়ে নির্বাচনের প্রচারের জন্য নতুন নতুন প্রকল্পের আওয়াজ শোনা যেতে পারে। আর এক একরের কম জমি আছে এমন কৃষকরা জমির কাগজ পত্র জমা দিয়ে আবেদন করলে তাকে এক কিস্তিতে ২০০০ টাকা দেওয়া হচ্ছে। আর এক কিস্তিতে ২০০০ টাকা দিয়ে মোট বছরে ৪০০০ টাকা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তার মানে জমির কাগজপত্র না থাকলে জমি চাষ করলেও কৃষক বন্ধু প্রকল্পের সুযোগ পাবেন না।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের যারা নিজেরাই জমিতে হাত লাগিয়ে উৎপাদন করেন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠই এক একরের কম জমির মালিক। এই কৃষকরা ঐবছরে ৪০০০ টাকার বেশি পাবেন না অর্থাৎ এক একরের এক শতক কম হলেই ৪ হাজার আর এক শতক বেশি হলেই ১০হাজার টাকা এটাও অসামঞ্জস্য। আবার জমি চাষ না করে জমির মালিক হয়ে অনেক সময় শুধু কাগজের মালিক হয়েই অনুদানের টাকা পেয়ে যাচ্ছে। আর ব্যাপক সংখ্যক অনথিভুক্ত ভাগচাষি, লিজ-চাষি ও পাট্টাহীন গরিব কৃষক এই প্রকল্পের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই সমস্ত গরিব কৃষকরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ, শস্য বিমা এবং কৃষক বন্ধু প্রকল্প বা কৃষক সন্মান যোজনা সমস্ত ধরনের সরকারী প্রকল্পের সুযোগ থেকেই বঞ্চিত। অথচ এই সব কৃষকদের চাষ করতে যেহেতু নিজের কৃষি উপকরণ থাকে না তাই সেচ থেকে সব কিছুই অন্য থেকে বেশি মূল্যে ভাড়া নিতে হয়। কালোবাজারি মূল্যে সার কিনতে হয়। জমির লিজ খাজনা দিতে হয়। পায় না সরকারী সহায়ক মূল্যের সুযোগ। অথচ এদের উপরই কৃষি-উৎপাদন অনেকটাই নির্ভরশীল। এরাই ক্ষেতমজুর দের বড় অংশ। নিজের শ্রমই এদের পুঁজি। এদের জন্য সরকারি বরাদ্দ ১০০ দিনের৷ কাজ, তাও ঠিক মতো কাজ দেওয়া হয় না। কাজ দিলে মজুরি কম দেওয়া হয়। আবার দুর্নীতিও চলছে। এই সব পরিবারের যুবকদের কাজের অভাবে প্রতিনিয়ত কাজের সন্ধানে বাইরে যেতে হয়। এই স্তরের মানুষের সমস্যা বেশি। এই স্তরের মানুষকে সরকারি প্রকল্পের সুযোগ পাওয়ার ব্যবস্থা না হতে করে মুখ্যমন্ত্রী কাদের ক্ষেতমজুর বলছেন জানি না সাধারণভাবে যাদের ক্ষেতমজুর বলা হয় তাদের কিভাবে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হবে সেই ব্যাপারে সরকারের কোনও সার্কুলার নেই। তাই এই শ্রেণীর দাবির আন্দোলনকে শক্তিশালী করাই আজকের সময়ের দাবি।
- সজল পাল
মাইক্রোফিনান্স কোম্পানীর ঋণ মকুব, বিদ্যুৎ বিল বকেয়ার জন্য বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি দাবি নিয়ে পাঞ্জাবের কৃষিমজুরদের সংগঠন ‘সানঝা মোর্চা’ ১২ ডিসেম্বর চার ঘণ্টার জন্য রেল অবরোধ করেন আম্বালা ডিভিশনের ভাতিন্দা, বারনালা এবং সাংরুর অঞ্চলে ও ফিরোজপুর ডিভিশনে। মোট ১৭টি ট্রেন চলাচল ব্যহত হয়। যে নয়টি অঞ্চলে সংগঠিতভাবে রেলরোকো হয় সেগুলি হল, অমৃতসর, মানসা, যেথুকি এবং ভাতিন্দার পাথরালা, ফরিদকোটের গলিওয়ালা, বারনালার তপা, মগার অজিতওয়াল, লুধিয়ানার জাগরাঁও নির্বাচনক্ষেত্রের চৌকিমান, জলন্ধরের ফিল্লাউর অঞ্চলে। রেল পরিষেবা পুরোপুরি ব্যহত হয় মালওয়া অঞ্চলে, অমৃতসর এবং ফিল্লাউরের রেলরোকোর জন্য দিল্লী রুটের ট্রেন, লুধিয়ানা-ফিরোজপুরের লাইন এবং ভাতিন্দা-গঙ্গানগর লাইনে।
পাঞ্জাব ক্ষেতমজদুর ইউনিয়ন (পিকেএমইউ)-এর সভাপতি জোরা সিং নাসরালি ১২ ডিসেম্বর বলেন, ক্ষেতমজদুরদের কিছু বকেয়া দাবি নিয়ে ‘রেল রোকো’ হবে। পাঞ্জাবের কৃষকদের সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন ‘বিকেইউ (উগ্রহান)’ এই কর্মসূচিকে সমর্থন করে। বিকেইউ (উগ্রহান)-এর সহসভাপতি সিংগারা সিং মান বলেন, “অনেক কৃষক ও কৃষিমজদুর আগের রাত্রে দিল্লী বর্ডার থেকে ফিরেছেন এবং আজ তারা রেল-লাইনে প্রতিবাদ করছেন, আমিও গতরাত্রে ফিরেছি।” পিকেএমইউ’র সম্পাদক লছমন সিং সেওয়াওয়ালা, যিনি আগের রাত্রে টিকরি বর্ডার থেকে ফিরেছেন, তিনি বলেন, “২৩ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রী চরণজিৎ সিং চান্নি’র সাথে সানঝা মোর্চার মিটিং হয়। দাবি নিয়ে তিনি পাকাপাকি কোনও সমাধান দেননি, কিন্তু তাও আমরা কিছুদিন অপেক্ষা করলাম।”
মজদুররা গ্রামে পাঁচ-মারলা প্লটের জমি (বাড়ি করার জন্য) বন্টন, বকেয়া বিদ্যুৎ বিল মকুব এবং কৃষিকাজের জন্য পঞ্চায়েতী জমির ভূয়ো নিলাম বন্ধ করার দাবি করেন।
“পঞ্চায়েতী জমির এক-তৃতীয়াংশ দলিতদের জন্য সংরক্ষিত থাকা সত্বেও দলিত পরিবারদের চাষের অধিকারকে খর্ব করে বৃহৎ জমি মালিকেরা ভূয়ো দাবিদার দেখিয়ে তা আত্মসাৎ করছে। গুরদাসপুরের একটি ভূয়ো নিলামের কেসকে নিদর্শন হিসাবে দেখানো সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী তা বাতিল করেননি”, বলেন ইউনিয়ন নেতা তারসেম পিটার।
- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১২ ডিসেম্বর ২০২১
মোদী সরকারের স্বপ্নের প্রকল্প ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’। এই প্রকল্পকে হাতিয়ার করেই সারাদেশের শিশুকন্যাদের সার্বিক বিকাশের অঙ্গীকার করেছে মোদী সরকার। সেই প্রকল্পের প্রচার ও বিজ্ঞাপনে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, সংসদে পেশ করা প্রতিবেদনে এমনই চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করল কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি সংসদীয় কমিটি। এই সংসদীয় কমিটির প্রধান আবার বিজেপি’রই সাংসদ হিনা গাভিট।
লোকসভায় পেশ করা মহিলাদের ক্ষমতায়ন বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ এই তিন বছরে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে ৪৪৬ কোটি ৭২ লক্ষ টাকা। সেই অর্থের ৭৮.৯১ শতাংশ অর্থাৎ ৩৫২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়েছে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনে। এই বিশাল অঙ্কের টাকা বিজ্ঞাপনে খরচ না-করে দেশের শিশু কন্যাদের উন্নয়নে খরচ করা প্রয়োজন ছিল, সাফ জানিয়ে দিয়েছে সংসদীয় কমিটি।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্পের প্রচারের গুরুত্ব বুঝতে পারছে কমিটি। একই সঙ্গে কমিটি মনে করে যে, প্রকল্পের মূল লক্ষ্যের সঙ্গে প্রচারের খরচের ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, বাংলায় মেয়েদের স্কুলছুট আটকাতে ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৩ সালে যে কন্যাশ্রী প্রকল্পের সূচনা করেছেন, তা সমাদৃত হয়েছে আন্তর্জাতিক স্তরেও। বাজেটও কেন্দ্রের তুলনায় অনেক বেশি রাজ্যের এই প্রকল্পের। মমতা বরাবরই বলে এসেছেন যে, কেন্দ্রের ‘বেটি বাঁচাও’ প্রকল্পের চেয়ে তাঁর কন্যাশ্রী কাজের ক্ষেত্রে অনেক বেশি উপযোগী। সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট যেন মমতার ওই দাবিতেই সিলমোহর দিল।
সংসদীয় কমিটির এই রিপোর্ট নিয়ে তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার বলেন, “প্রকৃত সত্য জনমানসে তুলে ধরার জন্য আমি কমিটির চেয়ারপার্সন হিনা গাভিটকে ধন্যবাদ জানাই। আশা করি, এই রিপোর্ট দেখার পরে মোদী সরকার বিজ্ঞাপনখাতে খরচ কমিয়ে প্রকল্প সম্পর্কিত আসল কাজের জন্য বেশি করে টাকা খরচ করবে।”
২০১৫ সালে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্পের সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল কন্যা ভ্রূণহত্যা বন্ধ করা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা এবং কন্যা শিক্ষায় উৎসাহ জোগানো। এই প্রকল্পের সার্থকতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিজেপি সাংসদ হিনা গাভিটের নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটি তার রিপোর্টে জানিয়েছে, গত ৬ বছর ধরে এই প্রকল্প নিয়ে জাতীয়স্তরে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। এবার শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে প্রকল্পের মূল বিষয়গুলিতে নজর দিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। এই কমিটির দাবি, প্রকল্পের প্রচার ও বিজ্ঞাপনের পিছনে অর্থ ব্যয় করা নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে।
পাশাপাশি, দেশের শিশুমৃত্যুর হার নিয়ে রাজ্যভিত্তিক একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে এই কমিটির তরফে। ৫ বছরের নীচে শিশুদের মৃত্যুর হারে শীর্ষে রয়েছে বিজেপি শাসিত রাজ্য মধ্যপ্রদেশ। বিজেপি’র বহুচর্চিত ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার শাসিত মধ্যপ্রদেশে ৫ বছরের নীচে শিশুমত্যুর হার ৫৬ শতাংশ। এরমধ্যে ছেলে শিশুমৃত্যুর হার ৫৮ শতাংশ এবং শিশুকন্যার মৃত্যুর হার ৫৩ শতাংশ। দ্বিতীয়স্থানে রয়েছে যোগীর রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। দেশের বৃহত্তম এই রাজ্যে ৫ বছরের নীচে শিশুমৃত্যুর হার ৪৭ শতাংশ, তারমধ্যে শিশুকন্যার মৃত্যুর হার ৪৮ শতাংশ বলে কমিটির রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। ডাবল ইঞ্জিনের সরকার শাসিত রাজ্য অসমে মোট শিশুমৃত্যুর হার ৪৭ শতাংশ হলেও, সেখানে শিশুকন্যার মৃত্যুর হার ৫১ শতাংশ। সর্বভারতীয় স্তরে নানাবিধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং আইন প্রণয়ন করার পরেও দেশে ছেলে ও মেয়ে শিশুদের অনুপাত যথেষ্ট কম বলে দাবি করেছে মহিলা ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।
- এই সময়, ১১ ডিসেম্বর ২০২১
আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিল আনার পক্ষপাতী নরেন্দ্র মোদী সরকার। এর মূল লক্ষ্য জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো। সরকারের এই পরিকল্পনাকে ভোটের ময়দানে মেরুকরণের কাজে লাগানোর কথা ভাবছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
১১টি রাজ্য এবং তিনটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের উপরে করা জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। তাতে উল্লেখ, গত চারবছরে দেশে ক্রমশ কমে এসেছে জন্মহার। ২০১৫-১৬ সালে জাতীয় জন্মহার ছিল ২.২। কিন্তু দুই পর্বে নেওয়া সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা (২০১৯-২১) জানিয়েছে, সেই হার বর্তমানে নেমে এসেছে ২.০-তে। জন্মহার কমলেও, শিশুপুত্রের পরিবর্তে অনেকটাই বেড়েছে শিশুকন্যার জন্মও। দ্বিতীয় পর্বের সমীক্ষায় যে ১৪টি রাজ্য ছিল তাতে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ ছিলনা। সমীক্ষাটি করা হয়েছে দেশের ৭০৭টি জেলায়।
আজ সমীক্ষার যে দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই জন্মহার ২.০ বা তার নীচে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহারের মতো রাজ্যগুলি ছাড়া জন্মহার বেশি হল মণিপুর ও মেঘালয়ে। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের ব্যাখ্যা, ভারত হল প্রথম দেশ যারা বিশ্বে প্রথম পরিবার পরিকল্পনার উপরে জোর দিয়েছিল। দীর্ঘ সময় পরে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কাঙ্খিত ফল পাওয়া গিয়েছে। এখন এই সংখ্যাকেই আগামী দিনে ধরে রাখতে হবে। সমীক্ষা জানিয়েছে, গত চারবছরে আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রকের ব্যবহার ৫৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৭ শতাংশ হয়েছে।
আদমশুমারি ২০১১’র সময়ে দেশে প্রতি হাজার শিশুপুত্র জন্মানোর নিরিখে শিশুকন্যা জন্মানোর সংখ্যা কমে প্রায় সাড়ে ন’শোর নীচে চলে এসেছিল। ২০১৫-১৬ সার্ভেতে এই সংখ্যাটা ছিল ১,০০০ জন শিশুপুত্র পিছু শিশুকন্যা জন্মানোর সংখ্যা ৯৯১ জন। কিন্তু এবারের সমীক্ষা জানিয়েছে, গত চারবছরে শিশুকন্যা জন্মানোর সংখ্যাতেও উল্লেখজনক বৃদ্ধি হয়েছে। নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি হাজার জন শিশুপুত্রের অনুপাতে ১,০২০ জন শিশুকন্যা জন্মাচ্ছে এদেশে। এছাড়া পরবর্তী সময়ে কম বয়সে বিয়ে ও ১৫-১৯ বছরের মধ্যে মেয়েদের মা হয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা ছিল, কিছুটা হলেও ছেদ পড়েছে তাতেও। কমেছে ঘরে জন্মানো শিশুর সংখ্যা। তুলনায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র-হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রসবের সংখ্যা প্রায় আট শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৮৮.৬ শতাংশে। দেশের ৭৮ শতাংশ মায়েরা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকে ‘কেয়ার’ পান। আগে এই হার ছিল ৬৫ শতাংশের কম। তবে রক্তল্পতা আজও সমস্যা হিসেবে রয়েই গিয়েছে। একেবারে জন্মের সময় থেকে। সমীক্ষা বলছে, ৫ থেকে ৫৯ মাস শিশুদের ক্ষেত্রে আগে যেখানে ৫৮ শতাংশ শিশু রক্তাল্পতায় ভুগত, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ শতাংশ। যা তাদের পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করেছে। ১৫-৪৯ বছর বয়সি নারীদের ক্ষেত্রে রক্তল্পতার সমস্যা ৫৩ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ শতাংশে।
- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ নভেম্বর ২০২১
১২ ডিসেম্বর নৈহাটির গরুরফাঁড়িতে অনুষ্ঠিত হল ‘প্রকৃতি-পরিবেশ ভাবনা জমায়েত’। এনআইএসসি, হালিসহর বিজ্ঞান পরিষদ, অগ্নিবীণা সহ বিভিন্ন বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং অঞ্চলের নাগরিকদের মিলিত উদ্যোগে জমায়েতস্থল মুখর হয়ে উঠে। কথা-কবিতা-গান-স্লাইড প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে উঠে আসে প্রকৃতি-পরিবেশের অবধারিত বিপর্যয়ের ধারাবিবরণীর বিরুদ্ধে জীবনের জয়গান। সভা থেকে কৃষক-আদিবাসী উচ্ছেদকারী ও পরিবেশ ধ্বংসকারী দেউচা-পাঁচামী কয়লাখনির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। অঙ্গীকার করা হয় ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন এনআইএসসি-র পক্ষ থেকে বঙ্কিম দত্ত।
উত্তর ২৪ পরগণার কাঁকিনাড়া জুট মিলে গত ১ ডিসেম্বর এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম’এর উদ্যোগে পিএফ অন্তর্ভুক্তির দাবিতে ‘এ শিফট’এর মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট সকাল ৬টা থেকে একঘণ্টা কাজ বন্ধ করে দেয়। মিল কর্তৃপক্ষ জানান তারা এই বিষয়ে মালিককে অবহিত করবেন। এদিকে লেবার অফিসার টালবাহানা করতে থাকেন এবং জানান মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের এ শিফটে পিএফ নম্বর দেওয়ার দরকার নেই। এরফলে শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থকে। বাধ্য হয়ে মিল মালিক বিসিএমএফ নেতৃত্বের সাথে আলোচনায় বসেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেখানে যেখানে প্রয়োজন নম্বর দেওয়া হবে। এই আন্দোলন বিসিএমএফ’এর নেতৃত্বে আংশিক জয় হয়েছে। আপাতত এ শিফট ডিপার্টমেন্টের শ্রমিকদের মধ্যে ১৫ জনকে নম্বর দেওয়া হবে। ইতিপূর্বেই পুজোর আগে মিলের সমস্ত ইউনিয়নের উদ্যোগে, জিরো নম্বরের শ্রমিকদের পিএফ নম্বর করার জন্য ২০০ জন শ্রমিক লেবার অফিসে ডেপুটেশন দেয়। কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে তারা দ্রুত নম্বর দেওয়া শুরু করবে। কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ এই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে থাকে।
বিসিএমএফ নতুন করে উদ্যোগ নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। ফলে তৃণমূল থেকে শুরু করে অন্য ইউনিয়নের শ্রমিকরা কাঁকিনাড়া জুট মিলের বিসিএমএফ নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ করে, বৃহত্তর আন্দোলন করার দাবি ব্যক্ত করেন।
আন্দোলন শুরুর পর্বে কয়েক দফায় পোস্টারিং করা হয়। গত একমাস পূর্বে মিল কর্তৃপক্ষ, প্রথমে স্পিনিং ও পরে ড্রয়িং মেশিনম্যান সহ বেশ কিছু সংখ্যক শ্রমিকদের পিএফ নম্বর দেওয়া শুরু করে। এই মূহুর্তে সিদ্ধান্ত হয়েছে ১০০ জনের মতো শ্রমিককে নম্বর দেবে। সবাই জানেন কাঁকিনাড়া মিল দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক গুণ্ডামির পীঠস্থান হয়ে আছে। শাসকশ্রেণীর ইউনিয়ন ছাড়া, প্রতিকূলতার মধ্যেও বিসিএমএফ ইউনিয়ন অফিস শ্রমিকরা নিয়মিত খোলেন। ইউনিয়ন সম্পাদক কৃষ্ণা বেহরার অবসরের পর উজ্জ্বল বেহরাকে নতুন সম্পাদক করে ইউনিয়নের কাজ শুরু হয়েছে। নতুন ও পূর্বতন সম্পাদকের সমন্বয়ে ইউনিয়ন নতুন করে উদ্যোগ নিচ্ছে।
কাঁকিনাড়া জুট মিলে বিসিএমএফ যে প্রচারগুলো চালাচ্ছে,
১) অবিলম্বে শ্রমিকদের বকেয়া গ্র্যাচুইটি দিতে হবে।
২) ২০১৯ ও ২০২০ সালের চুক্তি অনুযায়ী গ্র্যাচুইটির বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে।
৩) মিলে কর্মরত সব শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করতে হবে।
৪) শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি ও অন্যান্য ছুটিতে কর্মরত শ্রমিকদের নির্ধারিত মজুরি থেকে বেশি মজুরি দিতে হবে। ইউনিয়ন নেতৃত্ব এবং শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনের পথে পা বাড়িয়েছেন।
- নারায়ণ দে
১৪ ডিসেম্বর কল্যাণী মেইন ষ্টেশনের সম্মুখে বিকেল চারটের সময় ‘সেভ পাবলিক সেক্টর’ ব্যানারে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ রুখতে আগামী ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বরের ধর্মঘট সফল করতে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যবস্থা, অর্থাৎ দেশের সরকারি ব্যঙ্ক ব্যবস্থাকে কেন্দ্রের মোদী সরকার বেপরোয়াভাবে দ্রুত বেসরকারিকরণের পথে নিয়ে যাচ্ছে।কেন্দ্রের বর্তমান বিজেপি সরকার এবং তার আগের কংগ্রেসের মনমোহন সিং-এর সরকারের সাথে দেশ-বিদেশের বড় বড় পুঁজিপতি গোষ্ঠী ও উচ্চশ্রেণীর ধনী ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের এক অশুভ বোঝাপড়ার ফলাফল হিসাবে আজ ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের বিপদের মুখে পড়েছে। এই বোঝাপড়ার মধ্যে শক্তিশালী কর্পোরেট ও ব্যক্তিদেরকে গত ২০০৮-০৯ থেকে ২০২০-২১-এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের বিভিন্ন সরকারি ব্যঙ্কগুলি থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ ৪৮ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে পুরোপুরি দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শিল্পপতিরা এই বিপুল টাকা ফেরত দেয়নি। এই অনাদায়ী ঋণের ভারে সরকারি ব্যঙ্কগুলো ধুঁকছে। বক্তারা বলেন, বিজেপি সরকার শীতকালীন অধিবেশনে পেশ করতে চলেছে ‘ব্যঙ্ক আইন (সংশোধনী) বিল, ২০২১’, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ অহমিকায় এই কালা বিল পাস করতে চায়।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যে, আগামী কিছুদিনের মধ্যেই ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যঙ্ক ও সেন্ট্রাল ব্যঙ্ক অব ইন্ডিয়া বিজাতীয়করণ করা হবে। এর ফলে ব্যঙ্কে রাখা সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের টাকা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। এতদিন দেশের সাধারণ মানুষেরা সরকারি ব্যঙ্ক ব্যবস্থার সুবাদে তাদের নিরাপদে রাখা কষ্টের টাকা, ব্যঙ্কের স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া, সহজে লেনদেন ইত্যাদির সুযোগ পেতেন। কোটি কোটি মানুষের খুচরো ব্যবসা, অন্নদাতা কৃষকদের সহজে ঋণ পাওয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় হয়ে আসছিল। তার উচ্ছেদ ঘটিয়ে দেশের সরকারি ব্যঙ্কগুলোকে আদানি, আম্বানিদের মতো বড়ো বড়ো দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত করছে। বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক রাজনৈতিক দল বিজেপি ও তার সরকারের যোগসাজশে বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজিপতিদের কাছে দেশকে অর্থনৈতিক পরাধীনতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্তকে রুখতে আমাদের এই মুহূর্তে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে দিকে দিকে নাগরিক জোট, গণজোট গড়ে তোলা দরকার।
সভায় বক্তব্য রাখেন দেবজ্যোতি মজুমদার (অবসরপ্রাপ্ত ব্যঙ্ককর্মী), সন্তোষ সেন (পরিবেশ কর্মী), বিবর্তন ভট্টাচার্য (পরিবেশ কর্মী), রবি সেন (অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী), শুভাশীষ গাঙ্গুলী (অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী), শম্ভু ব্যানার্জি (এআইসিসিটিইউ)। সভা সঞ্চালনায় অনুপম পাল (অবসরপ্রাপ্ত ব্যঙ্ককর্মী)। ব্যঙ্ক বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে আগামী ১৬-১৭ ডিসেম্বর সর্বাত্মক ব্যঙ্ক ধর্মঘট সফল করতে সর্বস্তরের নাগরিকদের সহযোগিতার সোচ্চার আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ হয়। এছাড়াও সর্বাত্মক ব্যঙ্ক ধর্মঘট সফল করার আহ্বান সহ বারাসাত-মধ্যমগ্রামে প্রচার সংগঠিত করা হয়। অংশগ্রহণে ছিলেন গণপ্রতিরোধ মঞ্চ (বারাসত), ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামী মঞ্চ (বারাসাত), বন্দীমুক্তি কমিটি (উত্তর চব্বিশ পরগণা), আইসা এবং এআইপিএফ-এর সংগ্রামী সাথীরা।
উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজ জেলার গোরি মোহনগঞ্জ গ্ৰামে ২৪ নভেম্বর গভীর রাতে দলিত পরিবারের চার সদস্যের খুন হওয়ার পুলিশী তদন্ত কোন পথে এগোচ্ছে? উচ্চবর্ণের মূল অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তার কি কোনো যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে? যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন দলিত ও নারীদের নিরাপত্তা কতটা সুরক্ষিত করতে পেরেছে? দলিত হত্যাকাণ্ড এই প্রশ্নগুলোকে সামনে নিয়ে আসায় সেটির দিকে তাকানো যাক।
খুন হওয়া দলিত পরিবারটার চারজন সদস্যই ছিল — গৃহকর্তা ৫০ বছর বয়স্ক ফুলচন্দ্র সরোজ, তাঁর স্ত্রী ৪৫ বয়স্কা মীনা দেবী, ১৭ বছরের মেয়ে স্বপ্না এবং ১০ বছরের ছেলে শিব। চারজনই খুন হওয়ায় খবরটা জানাজানি হতে দু’দিন দেরি হল, দরজা ভেঙ্গে ঘাতকদের হিংস্রতার চিহ্ন বহন করা দেহগুলোকে দেখতে পাওয়া গেল। খুন হওয়া পরিবারের নিকটজনরা পাশে থাকা উচ্চবর্ণের ঠাকুর পরিবারের ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলেন — পুলিশ অভিযুক্তদের আটজনকে গ্ৰেপ্তার করল। পুলিশ তাদের বিবৃতিতে জানাল যে, নিহত চারজনের মধ্যে তিনজনকে একটা খোলা জায়গায় পাওয়া গেছে এবং ১৭ বছরের মেয়েটির দেহ পাওয়া গেছে একটা ঘরে। আরও জানাল, খুন করার আগে মেয়েটাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
কিন্তু হঠাৎই পুলিশী তদন্ত একটা বাঁক নিলো। পুলিশ দিনমজুরি খাটা পবন সরোজ নামে ১৯ বছরের এক দলিত যুবককে গ্ৰেপ্তার করল ২৮ নভেম্বর। খুনের রহস্য তারা ভেদ করে ফেলেছে বলে দাবি করে পুলিশ জানাল — গ্ৰেপ্তার হওয়া দলিত যুবক পবন সরোজ দলিত যুবতীকে প্রেম নিবেদন করেছিল। কিন্তু মেয়েটি তার প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় সে রুষ্ট হয়ে মেয়েটি সহ তার বাবা-মা-ভাইকে হত্যা করেছে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, পবন সরোজ নাকি হত্যার কথা স্বীকারও করেছে। কিন্তু একটা ছেলের পক্ষে কি চারজনকে খুন করা আদৌ সম্ভব? পুলিশ বলল, তারসঙ্গে অন্য যারা ছিল তাদের খোঁজ চলছে এবং তাদের ধরতে পুলিশের লোকজন নাকি পুনে গেছে। এছাড়া গ্ৰামের অন্য দুই দলিত যুবককেও তারা গ্ৰেপ্তার করল। পুলিশের বয়ান অনুযায়ী এটা দাঁড়ালো যে, হত্যাকাণ্ডের পাণ্ডা যে দলিত যুবক তার সহযোগীরা পালিয়ে গেলেও সে নির্ভয়ে গ্ৰামে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আর তাই তারা অনায়াসে তাকে ধরতে পারল। পুলিশ আরও জানাল, মেয়েটি নাবালিকা নয়, তার জন্ম ১৯৯৬ সালে এবং তার বয়স ২৫ বছর। সেজন্য হত্যাকাণ্ডে দায়ের হওয়া পকসো আইনের অভিযোগকে তারা তুলে নিল। যেহেতু গ্ৰেপ্তার হওয়া যুবকটিও দলিত, খুন হওয়া পরিবারটির মতো পাসি জাতের অন্তর্ভুক্ত, তাই হত্যাকাণ্ডে প্রযুক্ত দলিত নিপীড়ন নিরোধক আইনের অভিযোগকেও তুলে নেওয়া হল। এরপর প্রথম অভিযোগের ভিত্তিতে গ্ৰেপ্তার হওয়া ঠাকুর জাতের ৮ সদস্যকেও পুলিশ ছেড়ে দিল ৩০ নভেম্বর।
খুন হওয়া দলিত পরিবারের সঙ্গে উচ্চবর্ণের ঠাকুর পরিবারের কি জমিকেন্দ্রিক সংঘাতের কোনো ইতিহাস ছিল? প্রকাশিত সংবাদ জানাচ্ছে — দলিত পরিবার সরকারের কাছ থেকে একখণ্ড জমি পেয়েছিল, আর ঠাকুর পরিবারও সেই জমির মালিকানা দাবি করছিল। এই জমিকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দুই পরিবারের মধ্যে একটা সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল। দলিতদের চাষ করা ঐ জমির ফসল ঠাকুর পরিবারের গবাদি পশু খেয়ে নষ্ট করার অভিযোগ দলিত পরিবারের প্রৌঢ়া ঠাকুরদের ঘরে গিয়ে জানালে ঠাকুর পরিবারের লোকজন দলিতদের ঘরে ঢুকে হামলা চালায়। ওরা দলিতদের বলেছিল, “তোরা পাসিরা কি করে ঠাকুরদের বাড়িতে আসার সাহস দেখাস? কি করেই বা তোরা অভিযোগ জানাতে আসিস?” এই হামলার জন্য ৫ সেপ্টেম্বর স্থানীয় ফাফামাউ থানায় ঠাকুর পরিবারের ৭ সদস্যের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়। একই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে এবছরের ২১ সেপ্টেম্বর, ঠাকুরদের জনা ১০-১২ লোক দলিতদের ওপর হামলা চালায় এবং আবারও এফআইআর হয়। কিন্তু পুলিশ কি অভিযোগে যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যাশিত ব্যবস্থা নেয়? সংবাদে প্রকাশ, ঠাকুরদের কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পাওয়া দলিতদের অভিযোগে গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় ফাফামাউ থানার ইনচার্জ ও হেড কনস্টেবলকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এটাতো খুনের ঘটনার পর নিজেদের মুখ রক্ষায় পুলিশের মরিয়া পদক্ষেপ। কিন্তু এরথেকে দলিতরা নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে কতটা নিশ্চিত বোধ করতে পারেন? যে রাজ্য এবং যে জমানা দলিত বিদ্বেষ এবং উচ্চবর্ণের সামাজিক প্রতাপের বৈশিষ্ট্যে কলঙ্কিত, সেখানে প্রশাসনিক ন্যায় ও নিরপেক্ষতার প্রদর্শন কতটা প্রত্যাশিত হতে পারে? বিশেষভাবে ঠাকুর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের জাতের গরিমা যাদের দাপটকে বল্গাহীন করে তুলেছে?
খুন হওয়া দলিত ব্যক্তির দাদা এবং গ্ৰেপ্তার হওয়া দলিত পরিবারগুলোর সদস্যরা পুলিশের তদন্তকে কি চোখে দেখছেন? নিহত ফুলচন্দ্র সরোজের দাদা বলেছেন, “আমার ভাই, তার স্ত্রী এবং তাদের দুই সন্তানকে প্রত্যাখ্যাত কোনো প্রেমিক খুন করেনি। উচ্চবর্ণের ঠাকুর পরিবারের সুপরিচিত কিছু সদস্যই ওদের খুন করেছে। কিন্তু পুলিশ আমার কথায় কান দিচ্ছে না। …” তিনি আরও জানান, “আমার ভাইঝির সঙ্গে ছেলেটার কোনো বিবাদ থাকলে সে আমার ভাইঝিকে খুন করত, অন্য তিনজনকে খুন করবে কেন?” নিহত ও ধর্ষিতা মেয়েটি ২৫ বছর বয়স্ক কলেজ পাশ করা গ্ৰ্যাজুয়েট বলে পুলিশ যে দাবি করছে, তাকে খণ্ডন করে তিনি বলেন, তাঁর ভাইঝি অপ্রাপ্ত বয়স্কাই ছিল। গ্ৰেপ্তার হওয়া দলিত যুবকের দিদি তার ভাইয়ের মেয়েটির পিছু নেওয়ার পুলিশের অভিযোগকে অস্বীকার করে বলেছেন, হত্যার ঘটনা ঘটার সময় সে বাড়িতেই ছিল। গ্ৰেপ্তার হওয়া অন্য দুই দলিত যুবকের পরিবারের সদস্যরা থানার বাইরে বিক্ষোভ দেখিয়ে তাদের মুক্তির দাবি জানায়।
দলিতদের খুনের এই ঘটনা উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছে। সিপিআই(এমএল) পুলিশের তদন্তকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তদন্তকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা হচ্ছে এবং অভিযুক্তরা সুবিধাভোগী সম্প্রদায়ের লোকজন হওয়ায় তাদের আড়াল করা এবং অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়ার সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। দলিত পরিবারের সদস্যদের খুনের প্রতিবাদে সিপিআই(এমএল) ২ ডিসেম্বর রাজ্যব্যাপী প্রতিবাদ দিবস পালন করে। লক্ষ্ণৌ, গাজিপুর, রায়বেরিলি, বেনারস, আজমগড়, মির্জাপুর, কানপুর ও অন্যান্য জেলায় প্রতিবাদ সংগঠিত হয় এবং রাজ্যপাল আনন্দিবেন প্যাটেলের কাছে একটা দাবিপত্র পেশ করা হয়। ঐ দাবিপত্রে আর্জি জানানো হয় — দলিত পরিবারের খুনের ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে; অপরাধীদের গ্ৰেপ্তার করে শাস্তি দিতে হবে; স্থানীয় থানার যে পুলিশ অফিসারেরা অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে; খুন হওয়া দলিত পরিবারকে আর্থিক সহায়তা এবং একজনকে সরকারি চাকরি দিতে হবে এবং নারী ও দলিতদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে হবে।
এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অনেকেই উন্নাও ও হাথরস কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি দেখতে পেয়েছেন। উন্নাও, হাথরস এবং প্রয়াগরাজের তিনটে ঘটনাতেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে দলিত বালিকা, দুটি ক্ষেত্রে ধর্ষিতারা মারা গেছে এবং তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও হিংসার বলি হয়েছে। নিপীড়করা সবক্ষেত্রেই ছিল উচ্চবর্ণের লোকজন, এবং হাথরস ও প্রয়াগরাজ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে যুক্ত বলে ঠাকুর সম্প্রদায়ের লোকজন অভিযুক্ত হয়েছে। তিনটে ক্ষেত্রেই দোষীদের অপরাধকে ধামাচাপা দিয়ে তাদের রক্ষার চেষ্টার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে উঠেছে এবং নিপীড়তদের হুমকি দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহারের পথেও তারা সক্রিয় হয়েছে। এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডগুলো প্রমাণ করেছে যে, যোগী জমানায় দলিত এবং নারীদের নিরাপত্তা ভয়ংকরভাবে অরক্ষিত, ন্যায়বিচার এক দুর্লভ বস্তু এবং চরম পদক্ষেপ নিয়ে দুর্বৃত্তদের শায়েস্তা করার যোগী আদিত্যনাথের দাবি এক প্রহসন বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে।
নিখুঁত চিত্রনাট্য! অপূর্ব অভিনয়! শুধু ‘'তদ্গত'’ অবস্থায় ক্যামেরার দিকে বার কয়েক ভুল করে তাকিয়ে ফেলা।
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। হচ্ছে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাষ্ট্রের’ স্বপ্নের ফেরিওলা নয়া ফ্যাসিবাদী সেই নেতা-অভিনেতার কথা। আজ কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের নব কলেবরের ৩৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রথম পর্যায়ের নির্মাণের উদ্বোধন করতে গিয়ে কীভাবে তিনি গঙ্গায় ডুব দিলেন, পূজার্চনা-আরতি করলেন, কী ভাবে গঙ্গাবক্ষে সুসজ্জিত বিলাসবহুল ক্রুজে বসে বিপুল অর্থব্যয়ে আয়োজিত ‘শিব দীপাবলির’ অপূর্ব আলোকমালায় উদ্ভাসিত নগরীর সৌন্দর্য অবলোকন করলেন, কীভাবে হিন্দুত্বের রাজসিক প্রচারে গোটা একটি দিন কাটালেন (আরও একটি দিন কাটাবেন ভোট প্রচারে) — গোদী মিডিয়ার দিনভর সবিস্তার গদগদ বর্ণনায় দেশবাসী তা জেনেছেন। শুনেছেন জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে কীভাবে সাম্প্রদায়িক বিষোদগার করে বিশ্বনাথ মন্দিরের তথা দেশের এক ‘নয়া ইতিহাসের শুরুয়াত’ নিয়ে তিনি প্রায় বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কী বলেছেন। জনতার কাছে চেয়ে ছেন-স্বচ্ছতা, সৃজনশীলতা আর আত্মনির্ভর ভারত গড়ার প্রচেষ্টা (সত্যিই কি চেয়েছেন? এই শব্দবন্ধগুলো তো মোদী জমানায় ক্রমবিলীয়মান!)। কিন্তু গোটা নগর ছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় ঘেরা। মাছিটি গলার জো ছিল না। কোটি কোটি টাকার এই রাজসূয় যজ্ঞস্থলে আমজনতার প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। বিশাল বিশাল জায়েন্ট স্ক্রিনে অবশ্য দেখার ব্যবস্থা ছিল। মোদী গর্বভরে বলেছেন তামাম দুনিয়া এক নয়া ইতিহাস শুরুর সাক্ষী রইলো।
হ্যাঁ সাক্ষী থাকলো বৈ কি — আরও একবার — ধর্মনিরপেক্ষ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের এক রাষ্ট্রপ্রধান কী নির্লজ্জ দম্ভে, স্পর্ধায় সংবিধানকে দু’পায়ে মাড়িয়ে গেলেন, একটা ক্রমবর্ধমান অসাম্যের দেশে এক রাজ্যের ভোটপ্রচারে সরকারি কোষাগারের টাকা অর্থাৎ আম জনতার টাকা কীভাবে জলের মতো অপচয়িত হল! সাক্ষী থাকলো — আরও একবার — হাজার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করে আরএসএস-বিজেপি তথা মোদীর নিজেকে ‘নতুন ইতিহাসস্রষ্টা’ দাবি করার অপরিসীম মূঢ়তা ও অর্বাচীনত্বের!
কাশী বা বারাণসী পৃথিবীর প্রাচীনতম নগরগুলির একটি যাকে একসময় বলা হত দেশের ‘আধ্যাত্মিকতা ও সংস্কৃতির রাজধানী’। প্রাচীন বাণিজ্য নগরীও বটে — এখানকার রেশম ও মসলিন, হাতির দাঁতের কারুকার্য জগদ্বিখ্যাত। বহু গায়ক, বাদক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিভিন্ন ধর্মের প্রচারকদের জন্ম, কর্ম বা বাসে, সুপ্রাচীন বিদেশি জ্ঞানপিপাসু পর্যটকদের পদপাতে ধন্য এই নগর। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অপূর্ব মেলবন্ধনের এই নগরের অন্যতম আকর্ষণ বিশ্বনাথ মন্দির সহ আরও বেশ কিছু মন্দির, যার জন্য একে ‘মন্দির নগরী’ও বলা হয়। হিন্দুদের বিশ্বাস ‘শিবভূমি’ পবিত্র এই জনপদে নাকি ‘মোক্ষলাভ’ হয়! তা তিনি কোন ‘মোক্ষ’ লাভের জন্য এখানে এসেছিলেন?
গত ২০১৯ এর ৫ আগস্ট অযোধ্যার বিতর্কিত স্থলে রাম মন্দিরের শিলান্যাস করে তিনি অবলীলায় বলেছিলেন সেই দিনটি নাকি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস’! এবার হিন্দুদের ধর্মীয় আবেগের কেন্দ্রভূমি কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির-চত্বরের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে তিনি দাবি করলেন ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির (পড়ুন আরএসএস-এর মতাদর্শ ও সংস্কৃতির) ‘এক নতুন ইতিহাসের’ সূচনা হল! অর্থাৎ হিন্দু তীর্থপর্যটন ভূমির দখলদারি গেল হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-এর হাতে! তৈরি হল তাদের পরিকল্পিত ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ আরেকটি সোপান! আগে মন্দির চত্বর ছিল ৩০০০ বর্গফুট জুড়ে। এখন প্রস্তাবিত মন্দির কমপ্লেক্সের আয়তন পাঁচ লক্ষ বর্গফুট যার প্রথম পর্যায়ের নির্মাণের উদ্বোধন করলেন তিনি হিন্দুত্বের ‘পোস্টার বয়’ যোগী আদিত্যনাথকে পাশে নিয়ে। এই সম্প্রসারণে যে কত বাড়ি ও দোকান ভাঙা পড়েছে, কত মানুষ উৎখাত হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। প্রাচীন জ্ঞানবাপী মসজিদকে কোণঠাসা করে উঠেছে নবনির্মাণের সুউচ্চ প্রাচীর। এটা তাদের পরিকল্পিত উদ্যোগেরই অংশ।
কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে এই ‘উদ্বোধন’ কেন? তার উত্তর কাশীবাসী এক পাঁচ বছরের শিশুও দিয়ে দেবে। ভোট বড় বালাই! উত্তর প্রদেশের বিধানসভা ভোটের সমীক্ষা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয় বিজেপি’র পক্ষে। কেন? কৃষক আন্দোলন! যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে হাতিয়ার করে গত নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল, কৃষক আন্দোলন তার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে। বিজেপিরই ভুল চালে (কৃষক আন্দোলনে হামলা চালানো) পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষক, যারা তখনও আন্দোলনে যোগদানে দ্বিধান্বিত ছিল, তারাও এসে আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালো। আর মুজাফ্ফর নগরের কৃষক মহাপঞ্চায়েতে ধ্বনি উঠল-হর হর মহাদেব, আল্লাহ্ আকবর! কৃষকদের অদম্য জেদ, অনন্য লড়াকু চেতনা সঞ্চারিত হল মহাপঞ্চায়েতে আগত সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মনে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে তারা ফিরলেন। আর কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের হাজারো অত্যাচার আক্রমণ কুৎসিত গালিগালাজ, দেশদ্রোহিতার জঘন্য মিথ্যা অপবাদ, শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় প্রকৃতির রুদ্ররোষ, কোভিড-এর আতঙ্ক-সবকিছুর মধ্যে তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে অনড় কৃষক সত্যাগ্রহ আজ বিশ্ব রাজনীতির চর্চার বিষয় হয়ে বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত অন্নদাতাদের অনন্য দৃঢ়তা, দুর্জয় প্রতিরোধের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের হার মানা ও কৃষি আইন বাতিল করা — আম জনতার আত্মবিশ্বাসকে তুঙ্গে নিয়ে গেছে আর বিজেপি তথা মোদী সরকারের দম্ভ আর স্পর্ধাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করেছে।
এই পরিস্থিতিতে ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্যে বিজেপি-কে কড়া হিন্দুত্বের তাস খেলতেই হবে শেষ ভরসা হিসেবে। আহত হিন্দুত্বের প্রতিনিধি মোদী নেমে পড়লেন হিন্দু ভাবাবেগকে উস্কে তুলতে। এই ঠাণ্ডায় ডুব দিলেন গঙ্গায়। ষোড়শোপচারে রাজসিক আড়ম্বরে পুজো করলেন বিগ্রহের! কিন্তু দেশের মানুষকে কি এত সহজেই ধোঁকা দিতে পারবেন-এই সংকীর্ণ, চূড়ান্ত স্বার্থান্বেষী, আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে! নিছক অভিনয় দিয়ে! ভারতীয় সংস্কৃতি বহুত্ববাদের সংস্কৃতি। ‘দখলের’ মানসিকতা নিয়ে, বিদ্বেষের সওয়ার হয়ে কি তার পৃথিবীব্যাপ্ত ঐতিহ্য মুছে দেওয়া যাবে? মনে তো হয় না!
ভারতবর্ষের মানুষ মনে রেখেছে — যে মোদী নিজের সংসদীয় ক্ষেত্র বারাণসীতে হিন্দুত্বের প্রচারে গোটা একটা দিন কাটিয়ে দিলেন তিনি লখিমপুর খেরিতে তারই মন্ত্রীসভার সদস্যের প্ররোচনায় গাড়িতে পিষ্ট কৃষকদের সাথী ও পরিবারকে সমবেদনা জানাতে যাওয়া দূরে থাক (তখন তিনি লখনউয়ে ছিলেন) বার্তা পাঠাতে একটি সেকেন্ডও ব্যয় করেননি। কৃষক আন্দোলনের সাতশো শহীদের প্রতি শোক জানিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি! সব মানুষ মনে রেখেছে!
হ্যাঁ কৃষক আন্দোলনের ‘মহড়ার’ শিক্ষা ও প্রেরণা (কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েতের কথা ধার করে) এতটাই সংক্রামক যে তা ভারতের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে গেছে। তাই উত্তর পূর্ব কোণের নাগাল্যান্ডের ওটিং গ্রামের শোক সন্তপ্ত মানুষ অন্ত্যেষ্টির জন্য সরকারের দেওয়া প্রায় কুড়ি লাখ টাকা মুখের ওপর ফেরত দিতে পারেন ‘আফস্পা’ প্রত্যাহারের দাবিতে! যে আফস্পা অযথা প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল কাজ শেষে ঘরে ফেরার পথে ১৪ জন খনি শ্রমিকের। তাই ‘হিন্দুত্বে’ চিঁড়ে ভিজবে না — এটা নিশ্চিত! মানুষ সব মনে রেখেছে!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
গত ২৪ নভেম্বর জাতীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও নীতি-আয়োগের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত হল পঞ্চম জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষা (এনএফএইচএস) ২০২০-২১ সালের রিপোর্ট। এই রিপোর্টে জনসংখ্যা, প্রজনন ও শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার কল্যাণের মত সূচকের উপর সংগৃহীত তথ্যকে সামনে রেখে উল্লিখিত সরকারি মন্ত্রণালয়গুলি দাবি করছে যে ইউএন নির্দেশিত সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ওরফে এসডিজি-র লক্ষ্যে ভারত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত জুড়ে মোট ৭০৭টি জেলা স্তরে ৭,২৪,১১৫ জন মহিলা ও ১,০১,৮৩৯ জন পুরুষের সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে এই রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। মোট ১৩১টি সূচকের উপর বিভিন্ন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
২০২১ সালে প্রকাশিত জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মহিলাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের নিরিখে ১৫৬টি দেশের মধ্যে ভারত ১৪০ তম স্থানে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে খারাপ ফল করা তিনটি দেশের মধ্যে একটি ভারত। বাকী দুটি পাকিস্তান ও আফগানিস্থান। বিশ্ব অর্থনৈতিক মঞ্চের পরিচালিত রিপোর্টের স্বাস্থ্য বিষয়ক সূচক অনুযায়ী ভারতের র্যাংক ১৫৬টি দেশের মধ্যে ১৫৫ স্থানে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, মহামারী চলাকালীন ভারতের মেয়েদের কাজে অংশগ্রহণের হার সংকটজনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ১৫ জন মহিলা বাইরে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। মেয়েদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্বাধীকারের বিষয়ে সংগঠিত সমীক্ষা, গবেষণাগুলি থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বিজেপি চালিত কেন্দ্রীয় সরকারকে দেশের ভিতরে ও বাইরে চাপে ফেলে দেয়। কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের নারীদের ক্ষমতায়ন, স্বায়ত্ব ও গতিশীলতার প্রমাণ হিসাবে পঞ্চম এনএফএইচএস সমীক্ষা রিপোর্টের নির্দিষ্ট কিছু পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি-আকর্ষণ করতে চাইছে।
এই রিপোর্ট দাবি করছে যে, মেয়েদের সন্তান প্রসবের হার আগের থেকে কমেছে। অর্থাৎ সন্তান-ধারণের ভার থেকে মেয়েরা মুক্ত হচ্ছেন। ৭০ শতাংশের বেশি মহিলার ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। অর্থাৎ মেয়েদের অর্থনৈতিক সচেতনতা গড়ে উঠছে। প্রসূতি মায়েরা আগের থেকে অনেক বেশি সংখায় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা পরিষেবা নিতে যাচ্ছেন এবং অস্ত্রোপচার করে সন্তান জন্ম দেওয়ার হার বেড়েছে আগের থেকে। হন। সিজারিয়ানের অস্বাভাবিক সংখ্যাবৃদ্ধি বা ব্যাংক-একাউন্ট ব্যবহারকারী মহিলাদের ভাবমূর্তি দিয়েও কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের মেয়েদের দুর্দশার আসল ছবিকে চাপা দিতে পারছে কী?
আলোচ্য রিপোর্ট বলছে, এই বর্ধিত সিজারিয়ান অস্ত্রোপাচারের ৪৭ শতাংশ লক্ষ্য করা গেছে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রে। অন্যদিকে সরকারি স্বাস্থ্য-কেন্দ্রে ১৪ শতাংশ সন্তান প্রসবে অস্ত্রোপচার ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে, পরিবার-পিছু সন্তানের সংখ্যা কমলেও, পরিবার প্ল্যানিং-এ পুরুষের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবেই কম। মেয়েদের মধ্যেই কন্ট্রাসেপ্টিভ বা নিরোধের ব্যবহার বেড়েছে। এখনো বেশিরভাগ পুরুষ নিরোধ ব্যবহারে অনিচ্ছুক। এখনো গড়ে ৫৮ থেকে ৬৭ শতাংশ শিশু, ৫৩ থেকে ৫৭ শতাংশ মহিলা ও ২২ থেকে ২৫ শতাংশ পুরুষ রক্তাল্পতার শিকার। ব্যাংক-একাউন্ট মহিলাদের নামে তৈরি হলেও বেশিরভাগ পরিবারের পুরুষদের হাতেই থাকছে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের রাশ।
এনএফএইচএস-৫ রিপোর্টের প্রথম দফার তথ্য থেকে জানা গিয়েছিল ১৮-৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে ৩০ শতাংশের বেশি মেয়েরা গৃহ-হিংসার শিকার। মহামারীতে গৃহ-হিংসার মাত্রা বেড়েছে। পরিবারের অবাধ্য হওয়া, বাচ্চার যত্নে ঘাটতি, ‘স্বামী’র অনুমতি ছাড়া ঘরের বাইরে পা রাখা, যৌনতায় রাজি না হওয়া, মনপসন্দ রান্না না করতে পারা, স্বামীর মনে সন্দেহ তৈরি করা — মূলত এই কারণ গুলির উপর ভিত্তি করে পুরুষদের পাশাপাশি ৫২ শতাংশ মহিলারা গৃহ-হিংসাকে ন্যায্য মনে করেন। দেখা গেছে, মেয়েদের গায়ে সবচেয়ে বেশি হাত ওঠে পরিবারের কাজ না করতে পারা ও পরিবারের অবাধ্যতার জন্য।
সম্প্রতি জাতীয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দশম শ্রেণীর পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে — আজকের যুগের মহিলারা পরিবারে পুরুষের কর্ত্বত্ব মেনে নিয়ে, ঘরের কাজে সময় দিয়ে পরিবারের নিয়ম ও গতানুগতিকতা ভাঙ্গছেন বলেই বাচ্চা ও গৃহ-কর্মীদের আয়ত্বে রাখা কঠিন হয়ে উঠেছে। নারীবাদ বিবাহিত মেয়েদের স্বায়ত্তের ইচ্ছাকে জাগিয়ে তুলেছে বলেই পরিবারের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ছে। প্রবল প্রতিবাদের মুখে পড়ে এই প্রবন্ধ সংক্রান্ত প্রশ্ন বাতিল করার কথা ঘোষণা করলেও, প্রশ্নপত্র তৈরি করা, মূল্যায়ন ও অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা শিক্ষক ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। মনে রাখতে হবে সবটাই হয়েছে জাতীয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নজরদারিতে। অর্থাৎ, মনুবাদী বিজেপির প্রত্যক্ষ্য প্ররোচনায় বিদ্যালয় স্তর থেকেই পাঠ চলছে পরিবারবাদের, যেখানে সমাজের ক্ষুদ্রতম ইউনিট হিসাবে পরিবারের শাসন চালাবে পুরুষ, নারী, শিশু ও গৃহ-কর্মীরা থাকবেন পুরুষের অধীনে। সাম্প্রতিক লোকসভা মহিলা উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকার বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও প্রকল্পে অনুমোদিত ৪৪৭ কোটির টাকার প্রায় ৮০ শতাংশ টাকা ব্যয় করেছে বিজ্ঞাপনী প্রচারে। অন্যদিকে, সরকারি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, কলেজ, ইউনিভার্সিটি থেকে লিঙ্গ-সচেতনতা বিষয়ক পাঠ্যক্রমগুলির (যেমন মানবী-বিদ্যা, জেন্ডার স্টাডিস) তহবিল ও শিক্ষার্থী আসন কমিয়ে নারীবাদ চর্চা বা লিঙ্গ-সংবেদনশীল জ্ঞান তৈরির পরিসরগুলিকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বদলে, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিসহ অন্যান্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে গৃহ-কর্মের উপর পাঠ্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
বর্তমানে ভারতে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বায়ত্তের সংকটের সাথে মোকাবিলা করতে হলে লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজন। কিন্তু ভারতের মসনদে বসে থাকা ফ্যাসিবাদের তল্পিবাহকদের স্বার্থ নারী-মুক্তির পরিপন্থী। সমাজের পিছিয়ে পড়া, অসংবেদনশীল মানসিকতাকে হাওয়া দিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে ফ্যাসিবাদ। নারীর সমানাধিকারের লক্ষ্যে, ভারতকে নতুন দিশায় এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে ঘরের ভিতরে ও বাইরে ফ্যাসিবাদ ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব হওয়া জরুরি।
- সম্প্রীতি মুখার্জী
সম্প্রতি চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে কেন্দ্রীয় কমিটির এক প্লেনামের আয়োজন করে। এই প্লেনাম যেমন কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে, তেমনি আগামী বছরের পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি নিয়েও সেখানে আলাপ আলোচনা হয়।
এই প্লেনাম আয়োজনের সময় গোটা বিশ্বের মতো চীনের অর্থনীতিও কোভিড পরিস্থিতির সঙ্কটকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। গত দু’দশক ধরে চীনে আর্থিক বৃদ্ধি বার্ষিক আট শতাংশের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু কোভিডের সময় এই বৃদ্ধি থমকে যায় এবং সাম্প্রতিক সময়ে এই বৃদ্ধিহার পাঁচ শতাংশের কাছে ঘোরাফেরা করছে। বিশেষ সঙ্কটে পড়ে সম্পত্তির বাজার। চীনের সম্পত্তি ব্যবসার সবচেয়ে বড় কোম্পানি এভারগ্রেনেড প্রায় দেউলিয়া হয়ে যায়। চীনে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছুটা কমলেও ধনী দরিদ্রের মধ্যেকার ব্যবধান এখনো প্রবল। চীনের কমিউনিস্ট সরকার এর মোকাবিলায় শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার অন্যতম একচেটিয়া পুঁজির ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ চাপানো। আলিবাবা বা টেনসেন্ট-এর মতো কোম্পানীগুলি তাদের একচেটিয়া আধিপত্য কিছুটা হারাতে বাধ্য হয়েছে। সবার বিকাশের যে লক্ষ্যমাত্রা সামনে রাখা হয়েছে, তা এরমধ্যে দিয়ে খানিকটা প্রকাশিত হয়েছে।
এই প্লেনাম শি জিনপিং-এর নেতৃত্বকে আরো সুদৃঢ় করেছে। কেন্দ্রীয় কমিটির ৩৭০ সদস্যের সকলেই এই প্লেনামে উপস্থিত ছিলেন। আগামী পার্টি কংগ্রেসে মাও-এর মতোই তিনিও যে তৃতীয়বারের জন্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব হতে যাচ্ছেন — তাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বস্তুতপক্ষে ২০১৮ সালেই পার্টি সংবিধানে রদবদল করে সত্তর দশক থেকে বলবৎ থাকা সর্বোচ্চ দু’বারের জন্য পার্টি প্রধান হবার নিয়মটি সরিয়ে দেওয়া হয়।
এই প্লেনাম শি জিনপিংকে মাও সে তুং ও দেং শিয়াও পিং-এর উচ্চতায় অভিষিক্ত করল। ১৯৪৫ সালে মাও এবং ১৯৮১ সালে দেং তৎকালীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, শি জিনপিং এই প্লেনামের মাধ্যমে সেই উচ্চতাই স্পর্শ করলেন। ১৯৪৫’র আগে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মাও-এর নেতৃত্ব এই অবস্থায় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং জাপ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ে তাঁর রণকৌশল নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়। ১৯৪৯ সালের চীন বিপ্লব হয় তাঁরই নেতৃত্বে।
বিপ্লবোত্তর চীন সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড-এর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়ে বেশ কিছু সঙ্কটের সামনে পড়েছিল। মাও পরবর্তী সেই সময়ে আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটে ভুগতে থাকা চীনকে সঙ্কটমুক্তির পথ দেখায় দেং শিয়াও পিং-এর নেতৃত্ব। ১৯৮১ সালেই চীনের অর্থনীতিকে বিদেশি পুঁজির জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, শুরু হয় পুঁজিবাদী পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও। শি জিনপিং, মাও এবং দেং-এর সমতুল্য মর্যাদায় অভিষিক্ত হলেন এই ধরনের কোনও বড় মাপের সঙ্কট মোকাবিলার কারণে নয়, বিগত নয় বছরে তাঁর নেতৃত্বে চীনের নানা মাত্রিক বিকাশ এবং ২০৪৯ সালে চীন বিপ্লবের শতবর্ষের সময় পর্যন্ত চীনের প্রগতির পথে চলার রূপরেখা নির্ধারণের জন্য। শি জিনপিং-এর সাফল্যের মূল্যায়ন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির প্লেনাম জানিয়েছে যে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে শি সাফল্যের সঙ্গে সামলেছেন, সঙ্কটকে সুযোগে পরিণত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনুগতদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’এ যেভাবে ভারত ছাড়া এশিয়ার অধিকাংশ দেশকে চীন সামিল করতে পেরেছে, তাকে শি জিনপিং-এর বিশেষ কৃতিত্ত্ব বলেই প্লেনাম মনে করেছে। এই উদ্যোগকে লাতিন আমেরিকাতেও ছড়িয়ে দেওয়ার ভাবনা এই প্লেনামে ব্যক্ত হয়েছে।
চীন যে কোভিড১৯’র বিপর্যয়কে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তার প্রতীকী বার্তা হিসেবেই হয়ত এই প্লেনামে উপস্থিত সদস্যদের কেউই মাস্ক ব্যবহার করেননি। বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন কোভিড১৯ আর সেখানে আতঙ্ক হিসেবে নেই। এই প্লেনাম স্পষ্ট করে দিয়েছে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে বিশ্বের পয়লা নম্বর আধিপত্যবাদী শক্তি হয়ে ওঠার কোনও ইচ্ছা পোষণ করে না, তবে চীনা সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার কথাও একইসঙ্গে এই প্লেনাম থেকে বলা হয়েছে। তাইওয়ান সমস্যার সমাধান করে চীনকে ঐক্যবদ্ধ করার ভাবনাও এখানে ব্যক্ত হয়েছে।
- সৌভিক ঘোষাল
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী, দেশব্রতী পত্রিকার দীর্ঘদিনের গ্রাহক প্রতিমা ভট্টাচার্য গত ১ ডিসেম্বর পার্টির রাজ্য দপ্তরে সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য’র সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে ১ লক্ষ টাকার একটি চেক এবং নিজের রচিত বেশ কিছু বই সাধারণ সম্পাদকের হাতে তুলে দেন। তাঁর প্রয়াত স্বামী পীযুষ আচার্য অসম রাজ্যে আইপিএফ’এর নেতা ও পার্টির সদস্য ছিলেন। সাক্ষাৎকারের সময় উপস্থিত ছিলেন পার্টির পলিটবুরোর সদস্য কার্তিক পাল, নিত্যানন্দ ঘোষ, ধীরেশ গোস্বামী এবং অতনু চক্রবর্তী।
‘ধর্ম নয়, জাত নয়, আমরা মানব সন্তান’ শিরোনামে ১২ ডিসেম্বর মধ্যমগ্রামে সংঘটিত হল এক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। চতুর্দিকে যেভাবে জাতপাতের বিভাজন, ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষ আর অপবিজ্ঞানের ছায়া, তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় এক ঘরোয়া পরিবেশের অনুষ্ঠানে গণশিল্পী বাবুনীর গান সবার মনকে নাড়িয়ে দিল। ডাঃ দেবাশীষ মুখার্জি তাঁর সুগঠিত আলোচনায় জোড় দিলেন আধুনিক বিজ্ঞান এবং জ্ঞান চর্চায়। পরিবেশিত হল কবিতার কোলাজ এবং শ্রুতি নাটক ‘দেবী নই নারী’ এবং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রেকর্ড’। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন বাচীক শিল্পী শোভনা নাথ।