হিন্দুত্ববাদ, ভারতীয় জনতা পার্টি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও মিথ্যাচার-মিথ্যা ভাষণ একাকার হয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ-মোহন ভাগবত ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা যা বলেন তার অধিকাংশই অসত্য। গত কয়েকদিন ধরে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়, কোভিড নিয়ন্ত্রণ ও টিকাকরণে ইতিহাস সৃষ্টি নিয়ে একটানা কৌশলী মিথ্যাচার করে চলেছে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর অনুসারীরা। উত্তর প্রদেশের মন্ত্রী শ্রীমান উপেন্দ্র তেওয়ারি অবলীলাক্রমে বললেন, পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কেবলমাত্র দেশের ৫ শতাংশ মানুষকে কষ্ট দেয় বাকিদের কিছু হয় না। আরো বললেন, গত ৭ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে পেট্রল-ডিজেলের দাম তো দ্বিগুণ হয়নি। এই যে মন্ত্রী তেওয়ারি মশাই বললেন, আর উপস্থিত সাংবাদিকরা শুনলেন, কেউ জানতে চাইলেন না কোন পরিসংখ্যান বলছে যে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে? প্রকৃত সত্য হল, ২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০২০-২১, এই ৭ বছরে ২০১১-১২ সালের মূল্যে প্রকৃত মাথাপিছু জাতীয় আয় ৬৮,৫৭২ টাকা থেকে ২৬ শতাংশ বেড়ে ৮৬,৬৫৯ হয়েছে। এমনকি চলতি মূল্যে জাতীয় আয় ওই ৭ বছরে ৭৪,৯২০ টাকা থেকে ৭২ শতাংশ বেড়ে ১,২৮,৮২৯ টাকা হয়েছে। ২০১৪-র মে থেকে ২০২১-র অক্টোবর, এই ৮৯ মাসে সময়ে ডিজেলের দাম বেড়েছে ৮২ শতাংশ ও পেট্রলের দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশ। ওই সময়ে বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমেছে ৩০ শতাংশ। ফলে মন্ত্রী তেওয়ারি গলা তুলে মিথ্যে বললেন ও তারপরেই টুইটারে বা কু’এ বিজেপির দলবল অমিত বিক্রমে সেই ‘সত্য যা রচিব আমি’ প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
একদিকে যখন মাথাপিছু আয় ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তেওয়ারিজী মিথ্যে বলছেন, দেশের মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন, তখন মোদীজীও এসে পড়েছেন ভ্যাক্সিন সংক্রান্ত মিথ্যা ভাষণ নিয়ে। বলা হল যে, ভারত নিজের দেশজ টিকা নিয়ে টিকাকরণ করেছে। সত্য হল, এস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা সিরাম ইন্সটিটিউট পুনাতে উৎপাদন করেছে মাত্র। দেশে প্রদত্ত ৯০ শতাংশ টিকা ওই কোভিশিল্ড যা ইংল্যান্ডের এস্ট্রাজেনেকা কর্তৃক সৃষ্ট। কিন্তু তথাকথিত বিশ্ববরেণ্য মোদীজী অবলীলাক্রমে অসত্য বললেন। ভারতে সৃষ্ট যে টিকা নিয়ে মোদীজী ঢাক পিটিয়ে ছিলেন সেই কোভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে মাত্র ১০% ক্ষেত্রে। তাছাড়া কোভ্যাক্সিন এখনো পর্যন্ত (২৬ অক্টোবর) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের ছাড়পত্র পায়নি।
কেবল তাই নয় ১৩৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে দুটি ডোজ প্রয়োজনীয় টিকার সামগ্রিক ১০০ কোটি ডোজ দিয়েই মোদীজী ইতিহাস সৃষ্টির গল্প ফাঁদলেন। এটাতো অত্যন্ত স্বাভাবিক যে চিন ব্যতিরেকে কেবল ভারতেই ৫০ কোটির বেশি মানুষ থাকে যাদের ২টি ডোজ টিকা দিতে গেলে ১০০ কোটি টিকা লাগতে পারে। আর কোনো দেশে তো এত মানুষ থাকে না। সত্য হচ্ছে দেশের অর্ধেক মানুষ এখনো একটি ডোজ টিকাও পায়নি। ওদিকে চিনে ২২৫ কোটি টিকা দেওয়া হয়েছে ও দুটি ডোজ পেয়ে গেছে ১০৫ কোটি মানুষ। ভারতে সেই সংখ্যাদুটি যথাক্রমে ১০২ কোটি ও ৩০ কোটি।
তৃতীয়ত, মোদীজী বললেন, তাঁরা দেশের সমস্ত মানুষকে বিনে পয়সায় টিকা দিয়েছেন। আদতেই তা হয়নি। বহু মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে টাকা দিয়ে টিকা নিয়েছে। কেবল তাই নয়, মোদী সরকার ঘোষণা করেছিল যে, ৪৫ বছরের উপরের নাগরিকদের বিনে পয়সায় টিকা দেওয়ার বন্দোবস্ত থাকলেও (তাঁরা ইচ্ছে করলে বেসরকারি হাসপাতালে মূল্য দিয়েও নিতে পারে) ৪৫ বছরের নিচে থাকা নাগরিকদের মূল্য দিয়েই টিকা নিতে হবে বা রাজ্য সরকার ভারত বায়োটেক বা সিরাম ইন্সটিটিউট বা অন্য কোন বিদেশি সংস্থার থেকে কিনে তা রাজ্যের নাগরিকদের বিনামূল্যে দিতে পারে। পরে সুপ্রিম কোর্টের চাপেই মোদী সরকার বিনামূল্যে টিকাকরণের বন্দোবস্ত সবার জন্য রাখতে বাধ্য হয়েছে। যদিও তারসঙ্গে অর্থ ব্যয় করেও বেসরকারি হাসপাতালে টিকার বন্দোবস্ত রাখা হয়েছিল।
ব্লুমবার্গ ট্রাকারের বিশ্বব্যাপী কোভিড টিকাকরণের হিসেব অনুযায়ী ভারতে টিকা পেতে যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে ৫১ শতাংশ অন্তত একটি টিকা পেয়েছে এবং ২২ শতাংশ দুটি টিকা পেয়েছে। ফলে দুটির মধ্যে অনুপাত দাঁড়িয়েছে ২.৪, বিশ্বে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে চিনের ৮২ শতাংশ মানুষ অন্তত একটি ও ৭৬ শতাংশ দুটি টিকা পেয়েছে, ফলে অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১.১। আমেরিকায় তা ১.১৫, যেখানে ৬৬ শতাংশ পেয়েছে অন্তত একটি ও ৫৭ শতাংশ দুটি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ৬৯ শতাংশ অন্তত একটি ও ৬৬ শতাংশ দুটি টিকা পেয়েছে: ফলে অনুপাতটির মান ১.০৪। ভারতে ১৮ বছরের উর্ধে থাকা (সাবালক) মানুষের সংখ্যা ৯৪ কোটি। ফলে সেই সব মানুষকে টিকা দিতে লাগবে ১৮৮ কোটি টিকা। অর্থাৎ আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে টিকাকরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গেলে দৈনিক ১.৫ কোটি টিকা দিতে হবে। যেখানে ২২ অক্টোবর শেষ হওয়া সপ্তাহে গড় দৈনিক টিকাকরণের সংখ্যা ছিল ৫০ লক্ষের মত। এই গতিতে চললে সমস্ত সাবালককে দুটি ডোজ দিতে আরো ৬ মাস লেগে যাবে। লক্ষনীয় যে, কেবল নিজেদের ঢাক পেটাতে নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে ১৭ সেপ্টেম্বর ২.৫ কোটি টিকা দেওয়া হয়েছিল। যে হারে টিকা আর কোনদিন দেওয়া হয়নি। স্বতঃই এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, সত্যিই ওইদিন ২.৫ কোটি টিকা দেওয়া হয়েছিল কি? আর যদি তা দেওয়াই হয়, তাহলে কেন অন্যান্য দিনে তা দেওয়া হচ্ছে না?
সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ একটি সরকার মিথ্যা প্রচারের সাফল্যের উপর ভরসা করে দেশের মানুষকে বোকা বানাচ্ছে ও ক্রমাগত বেকারি, গরিবি, ক্ষুধা, গণতন্ত্রহীনতা সব বাড়িয়ে চলেছে। নিচের তালিকা দেখলে তা বোঝা যায়।
আর গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির অবস্থানে অবনমন ২০১৪ সালে ২৭তম থেকে ২০২০-তে ৫৩তম।
- অমিত দাশগুপ্ত