চতুষ্পার্শ্বে শুধু যন্ত্রণার জলছবি! প্রকৃতি রুষ্টা হইয়াছেন। গাঙ্গেয় উপত্যকায় অবস্থিতি এবং সমুদ্র সমীপবর্তী হওয়ায় বঙ্গভূমির উপর কোপ কিঞ্চিৎ বেশি।
কয়েকটি জেলায় ঘরবাড়ি চাষের জমি ফসল গবাদিপশু সকলই প্রবল জলস্রোতে ভাসিয়া গিয়াছে। কতজনের সলিল সমাধি হইয়াছে কে জানে! আশ্বিন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। আকাশ এখনও বিরহিনী কন্যার মতো সাশ্রুনয়না। কোথায় সেই স্বর্ণাভ উজ্জ্বল রৌদ্রে ভাসমান বর্ষণক্ষান্ত মেঘের ডিঙ্গা! কোথায় বা সরলা বালিকার মতো শেফালি-প্রভাত, কোথায় বা কাশের হাসি! শারদ প্রকৃতির সেই সবুজ-হিল্লোলিত গৌরবস্মিত ছবি জলবায়ু পরিবর্তনের দাপটে শুধু সাহিত্যের পাতায় বুঝি থাকিয়া যাইবে।
প্রকৃতির রুদ্ররোষের মাঝেই দিনকতক পূর্বে প্রভাতী দৈনিকের পাতায় এক ছবি নজর কাড়িয়াছিল। ক্যানিং-২ ব্লকের সারেঙ্গাবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতের সিংহেশ্বর সাবস্টেশন। ব্যাগ কারখানার কারিগর এক নবীন যুবা নিজামুদ্দিন হাঁড়িমধ্যে সদ্যোজাত সন্তানকে ভাসাইয়া প্রায় কোমর জল ঠেলিয়া আশা দিদিদের নিকট চলিয়াছেন সন্তানদের পোলিও খাওয়াইতে। বড়টি ছিল পশ্চাদবর্তী সঙ্গীর স্কন্ধে। আশাদিদি ও এএনএম-রা সকাল হইতে সাপ জোঁকের সানন্দ বিচরণের মধ্যে প্রায় বুকসমান জলরাশি ঠেলিয়া ঠেলিয়া, কোথাও ভেলা ভাসাইয়া বাড়ি বাড়ি হাঁকিয়া ফিরিতেছিলেন। শুনা যায় স্বাস্থ্য অধিকর্তা দিদিদের কর্তব্যপরায়ণতায় মুগ্ধ হইয়া প্রশংসার বান ডাকিয়াছেন। (যদিও প্রশংসা নহে, তাহাদের দরকার সামাজিক সুরক্ষা, ন্যায্য বেতন, শ্রমিকের মর্যাদা।) সে যাহা হউক, আম জনতার পোলিও-সচেতনতা আর প্রকল্পকর্মীদের শিশু-স্বাস্থ্য ও পুষ্টির প্রতি প্রতিনিয়ত সতর্ক দৃষ্টি-উভয়ই অত্যন্ত স্বস্তির বিষয়।
কিন্তু এই ছবিটি ধূসর হইয়া গেল সাম্প্রতিক প্রায় প্রত্যহের এক উদ্বেগবার্তায়। উত্তরবঙ্গে এক অজানা জ্বরে আক্রান্ত হইয়া প্রতিদিন সদ্যোজাত হইতে ১০ বছরের বালক বালিকারা ব্যাপক সংখ্যায় হাসপাতালে ভর্তি হইতেছে। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ, রায়গঞ্জ ও মালদহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুবিভাগ কার্যত দিশাহারা। শিলিগুড়ি, খড়িবাড়ি, ইসলামপুর, জলপাইগুড়ি, ফালাকাটা, চোপড়া অর্থাৎ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল হইতে তাহারা জ্বর তো বটেই, অন্যান্য উপসর্গ লইয়াও আসিতেছে। এবং অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হইল দিনকয়েক ধরিয়া প্রতিদিন তাহাদের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। কেহ জ্বর ও শ্বাসকষ্ট, কেহ জন্মকালে অত্যন্ত কম ওজন, কেহ জন্মের আগে-পরে অক্সিজেনের অভাবে, কেহ হইপারটেনসিভ এনসেফ্যালোপ্যাথি, কেহ হৃদরোগ ইত্যাদির কারণে মারা যাইতেছে। বর্ধমান ও বীরভূমেও শিশুদের এই জ্বর হানা দিয়াছে। শিশুর জন্মকালে ওজন কম হয় কেন? নিশ্চয়ই গর্ভধারণকালে মায়ের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর আহার জুটে নাই। এবং সেই সমস্যা ব্যক্তিগত স্তরে নাই, একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সমস্যা হইয়া উঠিয়াছে। কোভিড কালে গর্ভবতী মা ও শিশুর পরিচর্যা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হইয়াছে, সন্দেহ নাই। বিশেষজ্ঞরাই সঠিক কারণ নির্ণয় করিতে পারিবেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ইহা লইয়া স্বাস্থ্য প্রশাসনে বা নাগরিক পরিসরে কোন উচ্চ-বাচ্য নাই! কেন? তাহারা গরিবের সন্তান বলিয়া? উহারা তো এমনিই অনাহার, অপুষ্টি, রোগভোগ, সাপের কামড়ে, বজ্রাঘাতে মারা যাইবে! উহাদের জন্য অশ্রুপাতের আবশ্যকতা নাই ! ব্যাপারটা কি ইহাই? এই মৃত্যুস্রোত আজ পর্যন্ত অব্যাহত।
অতিবর্ষণে শহর ও শহরতলিতেও মৃত্যুর খতিয়ান বেদনাদায়ক যে মৃত্যু হয়তো অনিবার্য ছিল না। কলিকাতার আহিরীটোলা স্ট্রিটে জীর্ণ দ্বিতল বাড়ি অতিবর্ষণে ভাঙিয়া পড়িয়া প্রাণ কাড়িয়াছে এক শিশু ও প্রৌঢ়ার। আড়াই বৎসরের শিশু যাহার দিনকয় পরে নূতন জামাটি, সস্তায় ক্রীত বাহারী চটিটি পরিয়া হাতে বেলুন বা চরকি লইয়া পূজামণ্ডপে হাসিয়া খেলিয়া ছুটিয়া বেড়াইবার কথা ছিল, কাহার, কাহাদের অপরাধে তাহার সরল হাসিমুখটি চিরদিনের জন্য হারাইয়া গেল? কলিকাতায় নাকি ৩০০০টি বিপজ্জনক বাড়ি আছে যাহার ১০০টি এখনই ভাঙিয়া ফেলা উচিত। কিন্তু পুরসভা শুধু নোটিশ ঝুলাইয়া ক্ষান্ত কেন? কেন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক বাড়িগুলি ভাঙা যাইতেছে না? জটিলতা নাই তাহা নহে। প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িগুলি শরিকী সমস্যা ও বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া সংঘাতে জর্জরিত। অত্যন্ত অল্প ভাড়ায় তিন প্রজন্মের বসবাস। অনেকে রেন্ট কন্ট্রোলে ভাড়া জমা দেন। অনেক মালিকানা মামলা কন্টকিত। তথাপি সেগুলি ভাঙার দায় এড়ানো যায় না। গতকাল কলুটোলা স্ট্রিটে এইরূপ এক জীর্ণ বাড়িতে বিধ্বংসী আগুন লাগে। ইহাও আরেক বিপর্যয়। নামমাত্র ভাড়ার জন্য এইখানে যত গুদাম ঘর। তাহাতে বিবিধ দাহ্য পদার্থ মজুত থাকে। বৈদ্যুতিক তারের জটিল জটাজাল। সংকীর্ণ গলি। অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণের অপ্রতুল পরিকাঠামোর সুযোগ গ্রহণও হয়তো সে কারণে সম্ভব হয় না। কলুটোলার ঘটনায় অন্তত দশজন ফায়ার ফাইটার জখম হইয়াছেন।
খেপে খেপে অতিবর্ষণের মধ্যে আরেক বিপর্যয়-বিদ্যুৎ স্পষ্ট হইয়া মৃত্যু। সম্প্রতি নজিরবিহীনভাবে শহর ও শহরতলিতে তো বটেই, গোটা রাজ্য জুড়িয়া বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হইয়া কতগুলি প্রাণ একসঙ্গে চলিয়া গেল যাহার মধ্য কয়েকটি শিশু ও নাবালকও রহিয়াছে। এখানেও অনেকক্ষেত্রেই সেই একই সমস্যা। জীর্ণ বাড়ি বা আবাসনের জীর্ণতর ওয়্যারিং। ইহাদের মধ্যে সরকারি আবাসনও আছে। শুধুমাত্র কলিকাতা, দমদম, সল্ট লেকেই এবং পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের অধীনে ৭২টি সরকারি আবাসন আছে যাহার মধ্য ২৫টির এই মুহূর্তে সংস্কার প্রয়োজন। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর প্রাণের ঝুঁকি নিয়া বসবাস। সরকারের হেলদোল আছে?
জমা জল, বিদ্যুতের ছেঁড়া তার, জীর্ণ প্রকোষ্ঠে অভাবী সংসারের রুগ্ন শিশুর কান্না — এসব তো ছিলোই। আছে। থাকিবে। যতদিন নাগরিক-অধিকার উন্নত পুর পরিষেবার দাবিতে উচ্চকণ্ঠ না হইতেছে। প্রশাসন শহরের অভিজাত অঞ্চলের পরিষেবা লইয়া ব্যতিব্যস্ত। ঝাঁ চকচকে রাস্তা, বহুতল বিপণি, ফ্লাইওভার, দ্রুত ও পরিবেশ বান্ধব যান-এসব শহর উপহার পাইতেছে। কিন্তু এই কোভিড বিধ্বস্ত অর্থনীতির অনিবার্যতায় অনেকেরই কাজে যাওয়া-আসায় গণপরিবহনের ভাড়া গোণার সামর্থ্য নাই। তাহারা সাইকেল-সওয়ার হইয়া দীর্ঘ দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিতেছেন। বাধ্য হইয়া। তাহাদের জন্য একটি নিরাপদ নিরুপদ্রব পথ যে বড় দরকার!
কিন্তু এসবের মাঝে ফ্যাতাড়ু পুলকিত বঙ্গ নারীদের গতিচাঞ্চল্য দেখিয়া। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধাভোগী হওয়ার জন্য অধিকার সচেতন মহিলারা কী না করিতেছেন! ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খোলা হইতে ব্যক্তিগত নথিপত্র সংগ্রহ করা, গুছাইয়া সযত্নে রাখা, মোবাইল ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া-খুব দ্রুত এসব ঘটিতেছে!
ফ্যাতাড়ু নিশ্চিন্ত-বঙ্গবাসী অশুভ শক্তিকে চিহ্নিত করিয়া তাহাদের আবারও প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন! করিবেন!
ফ্যাতাড়ু আশান্বিত — বঙ্গবাসী অজেয়, পরাক্রান্ত — রাইফেল মণ্ডল ও তাহার সঙ্গীরাই তাহার প্রমাণ দিয়াছেন। জলস্রোতে আন্দোলিত কাঁটাগাছের মগডালে চাপিয়া কাঁটাক্ষত শরীরের যন্ত্রণায় দৃকপাত না করিয়া, পাঁচনি দিয়া পায়ের গোড়ায় বিষাক্ত সাপ তাড়াইয়াও নিকষ আঁধারে উদ্ধারকারীর আলোকবিন্দুর প্রতি তীক্ষ্ম নজর রাখিয়াছেন! এই দুর্জয় মনোবল বাঙালীর সম্বল!