প্রতিবেদন
ক্ষমতার অলিন্দ্য থেকে ওঠা কিছু ভিন্ন সুর
Some different tunes

আজ পর্যন্ত মানবতার সামনে সবচেয়ে বড় সংকট হিসাবে আছড়ে পড়ে কোভিড১৯। এই অতিমারি সৃষ্ট নজিরবিহীন স্বাস্থ্য সংকট দুনিয়া জুড়ে প্রায় সমস্ত ধরনের আর্থিক কর্মকান্ডকে স্তব্ধ করে দেয়, ঘনিয়ে তোলে কল্পনাতীত আর্থিক বিপর্যয়। এই স্বাস্থ্য বিপর্যয় দুনিয়াব্যাপী যে অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনে তার সুদুরপ্রসারি প্রভাব পড়েছে কর্মক্ষেত্রে — লক্ষ কোটি শ্রমজীবী মানুষ রুটি রুজি হারিয়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন চরম আর্থিক দুর্দশার নিঃসীম অন্ধকারে। দুনিয়া জুড়ে এই অতিমারি মোকাবিলায় নানা পদ্ধতি প্রকরণের মধ্যে লকডাউন ছিল অন্যতম এক হাতিয়ার, আর মোদীর ঘোষিত লকডাউন ছিল পৃথিবীর মধ্যে নির্মমতম, কঠোরতম। লকডাউন-১ এর পর জনজীবনে তার বিপর্যয়কারী প্রভাব সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমীক্ষা প্রকাশ করে আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়। যা আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত। সেই রিপোর্ট অতিমারী বিপর্যস্ত নাগরিকদের রুটি রুজি আর্থিক সুরক্ষা দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একাধিক প্রস্তাব দেয়, যা মোদী সরকারের স্বভাবধর্ম ঔদ্ধত্য ও অনুভূতিহীন মনোভাবের দ্বারা প্রত্যাখাত হয়। এই প্রথম, সংসদের শ্রম সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটি এক পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করে, ‘ইম্প্যাক্ট অফ কোভিড১৯ অন রাইজিং আনএমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড লস অফ জবস্/লাইভলিহুড ইন অরগানাইজড অ্যান্ড আনঅরগানাইজড সেক্টরস্’। সংসদের দুই কক্ষ — লোকসভা ও রাজ্যসভায় এই রিপোর্ট পেশ করা হয় গত ৩ আগস্ট ২০২১। বলা যায়, এটাই প্রথম প্রকাশিত সরকারি ভাষ্য, আর সেকারণে এর গুরুত্ব আছে বৈকি। এতে প্রকাশিত হয়েছে লকডাউনের ফলে সাধারণ মানুষের অসীম যন্ত্রণা, দুঃখ দুর্দশার ধারাবিবরণী। রয়েছে আর্থিকভাবে বিধ্বস্ত গরিব মানুষদের ব্যাঙ্কে সরাসরি নগদ প্রদানের প্রস্তাব, এই পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা পদক্ষেপ সম্পর্কে মন্তব্য। কিছুটা প্রশংশা, কিছুটা সমালোচনা। তবে বেশ তথ্য সমৃদ্ধ এই রিপোর্ট জানিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের থেকে শুরু করে অন্যান্য অসংগঠিত শ্রমিকদের দুরাবস্থার কথা, মনরেগা প্রকল্পকে আরও প্রসারিত করা, শহুরে কর্মসংস্থানকে উৎসাহিত করা ইত্যাদি।

এই রিপোর্ট তৈরি করার প্রক্রিয়ায় স্ট্যান্ডিং কমিটি এআইসিসিটিইউ সহ ১২টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের কাছ থেকে লিখিত বক্তব্য নেওয়ার পাশাপাশি সাক্ষাতেও মতামত নেয়, সরাসরি বাণিজ্য ও বণিক সংস্থাগুলোর মতামতও সংগ্রহ করে।

আইএলও’র রিপোর্ট, ‘কোভিড১৯ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ার্ক’কে উল্লেখ করে সংসদীয় কমিটি জানাচ্ছে এটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘনিয়ে ওঠা ১৯৩০’র বিরাট মন্দার পর সবচেয়ে মারাত্বক আর্থিক সংকট, যা দুনিয়াব্যাপী ২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের কাজ কেড়ে নিয়েছে। যা আর কোনদিন ফিরে আসবেনা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ইনফর্মাল সেক্টরের সাথে যুক্ত পৃথিবীর দরিদ্রতম অগণন শ্রমজীবী মানুষ। আর, আইএলও’র রিপোর্ট (যা এই কমিটি উল্লেখ করেছে) অনুযায়ী ৪০ কোটি ইনফর্মাল শ্রমিক চরম দারিদ্রের কবলে পড়বে।

শ্রম সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট জানিয়েছে, সংগঠিত ক্ষেত্রেও ব্যাপক মাত্রায় কর্মচ্যুতি হয়েছে। সিএমআইই’র তথ্য উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, ২০২০তে সংগঠিত ক্ষেত্রের অর্ধেক শ্রমশক্তি ফর্মাল থেকে ইনফর্মাল ক্ষেত্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, আয়ের ক্ষেত্রে বিরাট মাত্রায় সংকোচন হওয়ায় উৎকট বৈষম্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, কাজ হারানো ও মজুরি হ্রাস পাওয়ায় জাতীয় ন্যূনতম মজুরির নিচে নতুন করে প্রবেশ করেছে ২৩০ কোটি মানুষ। এই হিসাব আগে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় উঠে আসে। এবার বলা যায়, তাতে পড়ল সরকারি শিলমোহর। জুন ২০২০’র পর অর্থনীতি আবার মুখ তুলেছে বলে কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি কার্যত খারিজ করে কমিটির রিপোর্ট জানাচ্ছে যে লকডাউন ও বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার পর আর্থিক কর্মকান্ড আবার শুরু হলেও আর্থিক পুনরুজ্জীবন থমকেই থাকে। ২০২০’র ডিসেম্বরে প্রায় ২০ শতাংশ শ্রমিক কাজ হারানোর পর তা আর ফিরে পাননি, আর সবচেয়ে চিন্তাজনক বিষয় হল, ওই সময়কালে (২০২০’র ডিসেম্বর) পরিবার পিছু প্রকৃত আয় প্রাক অতিমারির সাপেক্ষে কমে যায় ১২ শতাংশ হারে! কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ সন্দেহাতীত ভাবে প্রথমটির তুলনায় আরও অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক থাকলেও সেই সময়কার কোন সমীক্ষা এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। তবে নানা সূত্র ও প্রামান্য তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে দ্বিতীয় পর্বে ইনফর্মাল সেক্টরে আঘাত আরও অনেক বেশি মারাত্মক ছিল। দারিদ্র সীমার অনেক নিচে নতুন করে আরও অসংখ্য মানুষ নিক্ষিপ্ত হন, কাজ খোয়ানো মানুষের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।

কমিটির রিপোর্ট কর্মহীনতা সংক্রান্ত সিএমআইই’র যে তথ্য উল্লেখ করেছে তা ২০২০’র এপ্রিল-জুন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু তার পরের চিত্র পাওয়া যায় প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী অধ্যাপক কৌশিক বসুর লেখায়। তিনি উক্ত সংস্থার ২ সেপ্টেম্বরের রিপোর্ট তুলে দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র আগস্ট মাসে ১৫ লক্ষ মানুষ কাজ হারায়, আর কর্মহীনতার হার জুলাই মাসে ছিল ৬.৯৫ শতাংশ, যা মাত্র একমাসে, আগস্টে লাফ দিয়ে বেড়ে হয়েছে ৮.৩২ শতাংশ! এটা স্পষ্ট, আরো গভীর সংকট দেশের অর্থনীতিকে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে।

কমিটির রিপোর্টে অনেকগুলো দিক আলোচিত হয়েছে। দীর্ঘ রিপোর্টে মূল মূল কিছু বিষয় ও তার সুপারিশ সম্পর্কে আমরা এখানে দৃষ্টিপাত করবো।

কর্মহীনতা

সংসদীয় কমিটির এই রিপোর্ট স্পষ্ট ভাবেই তুলে ধরেছে যে কোভিডের আগে থেকেই দেশে কর্মহীনতা উত্তুঙ্গে ছিল, আর অতিমারি সেই মরার উপরই নামিয়ে আনলো খাঁড়ার ঘা। মোদী সরকার যা কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না। তারা এইভাবেই দেখায় যেন সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, হঠাৎ কোভিড এসে সাজানো বাগানটাকে লন্ডভন্ড করে দিল। কমিটির রিপোর্ট সেই মান্যতা দিল না। রিপোর্ট আরও একবার জোরের সাথে ঘোষণা করল যে, দেশের ৯০ শতাংশ শ্রমিকই হলেন ইনফর্মাল, ৪৬ কোটি ৫ লক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে ৪ কোটি ১৯ লক্ষ ইনফর্মাল ক্ষেত্রভুক্ত! বিপুল এই বাহিনীর কাজের মরশুমি চরিত্র, শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে অস্পষ্টতা, এই কারণগুলোই এদের দুর্দশা আরও বেশি ডেকে আনে। গভীর উদ্বেগের সঙ্গে রিপোর্ট লিখেছে, এই বিরাট সংখ্যক মানুষের কর্মহীনতা, ক্রমে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা বেকারত্ব, তীব্র ঋণগ্রস্থতা, পরিবারের সদস্যদের অপুষ্টি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত এই করুণ অবস্থা দেশের অর্থনীতির উপর দীর্ঘ এক ছায়া বিস্তার করে আগামী দিনে অপরিসীম ক্ষতি ডেকে আনবে যা আর মেরামত করা যাবে না। গোটা এই ক্ষেত্রকে সংগঠিত চেহারা দেওয়া (বলাই বাহুল্য, এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ), উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, তাঁদের বর্তমান জীবন যাপনের চারপাশের অবস্থাকে আরও উন্নত ও মজবুত করা, আকর্ষণীয় রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচের চারপাশে নিয়ে আসা, নতুন নতুন উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা — এই সমস্ত সুপারিশ করেছে কমিটি। সর্বোপরি, কোভিড অতিমারীতে বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত বিপুল ইনফর্মাল শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি নগদ অর্থ পাঠানোর জোরালো সুপারিশ করা হয়েছে।

সাবেক ক্ষেত্রগুলোতে আরও অনেক বেশি সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’কে মজবুত করতে স্থানীয় স্তর থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেক্টরে নতুন নতুন প্রযুক্তি এনে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবার প্রস্তাব ও রাখা হয়েছে। অন্যান্য ইনফর্মাল শ্রমিকদের মতো, এই অতিমারি মারাত্মকভাবে আঘাত নামিয়েছে মহিলা-অল্পবয়সী তরুণ ও স্বনিযুক্ত পেশার মানুষদের উপর। অসংগঠিত ক্ষেত্রের পাশাপাশি কোভিড যে সংগঠিত ক্ষেত্রকেও মোক্ষম আঘাত দিয়েছে, তা কমিটির রিপোর্ট উল্লেখ করেছে।

আরেকটা নজরকাড়া সুপারিশ করেছে এই কমিটি। এযাবৎ অনুসৃত আর্থিক বৃদ্ধির গতিপথকে আমূল বদলে কর্মসংস্থানমুখী শ্রমনিবিড় শিল্প গঠনের কথা বলা হয়েছে, যে শিল্প অনিয়মিত অসংগঠিত শ্রমশক্তি মারফত পরিচালিত হবেনা, বরং তা হবে অনেক সংগঠিত চরিত্র সম্পন্ন, শ্রমশক্তিকে আরও দক্ষতা সম্পন্ন করতে যেখানে গড়ে তুলতে হবে নানা ধরনের ইউনিট। ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে মেরামত ও আধুনিক করতে বিশেষ আর্থিক বরাদ্দ এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবাকে আইনী বাধ্যতা দিতে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

কোভিডকালে, কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত ক্ষেত্রে কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী অল্প কিছু সংখ্যক কর্মীর চাকরিতে ছেদ, অনিয়মিত বেতন, বা বেতন না পাওয়ার অভিযোগ থাকলেও বেশিরভাগ বা সর্বত্রই তার সমাধানের রিপোর্ট পাওয়া গেছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত ক্ষেত্রগুলোতে এ প্রশ্নে রেকর্ড মোটেই ভালো নয় বলে জানাচ্ছে কমিটি। এপ্রিল ২০২০ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত পর্যায়ে কর্মীদের কাছ থেকে বহু অভিযোগ পাওয়া গেলেও সেগুলোর সমাধান হয়নি। এব্যাপারে যে রাজ্য সরকারগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে, সেগুলো হল মহারাষ্ট্র, দিল্লী, হরিয়ানা, কর্ণাটক, পশ্চিমবাংলা ও উত্তরাখন্ড।

নির্মাণ শ্রমিক

কোভিডের প্রথম ঢেউ’র সময়, কমিটির কাছে পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন রাজ্য নির্মাণ শ্রমিকদের সরাসরি নগদ অর্থ প্রদান করেছে। কমিটি জানাচ্ছে, আনুমানিক ৫,৬১৮ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে ১ কোটি ৮২ লক্ষ ৪৪ হাজার ২৭৮ নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নির্মাণ শ্রমিকরা নাকি টাকা পেয়েছেন পশ্চিমবাংলায় —২১ লক্ষ ৯৮ হাজার ৩৪৯ জন। পশ্চিমবাংলা, অন্ধ্র প্রদেশ, ওড়িশা, উত্তর প্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও বিহার — এই সাতটি রাজ্য ছাড়া আর কোনও রাজ্যই এমনকি দ্বিতীয় কোভিডের বিধ্বংসী ছোবলের সময়ে ও নির্মাণ শ্রমিকদের নিজস্ব কল্যাণ তহবিলের থেকে অর্থ প্রদান করেনি।

কমিটি সুপারিশ করেছে, আরও ব্যাপক সংখ্যায় ও মাত্রায় নতুন নতুন নির্মাণ শ্রমিকদের নথিভুক্ত করতে হবে, পুরানো সমস্ত শ্রমিকদের নাম নবীকৃত করতে হবে, নথিভুক্তির প্রক্রিয়া আরও সহজ সরল ও শ্রমিকদের বোধগম্য করতে হবে যাতে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে পারেন।

অন্যান্য অসংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ও নির্মাণ শ্রমিকদের অভিজ্ঞতার আলোকে অনুরূপ সেস তহবিল গঠন করার প্রস্তাব কমিটি দিয়েছে।

পরিযায়ী শ্রমিক

কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, লকডাউনের প্রথম ধাক্কায় বিভিন্ন রাজ্য থেকে নিজভূমে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা ১ কোটি ১৪ লক্ষ ৩০ হাজার ৯৬৮। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিভিন্ন রাজ্য থেকে পাঠানো তথ্য থেকেই কমিটি ওই রিপোর্ট দিয়েছে। আর, দ্বিতীয় কোভিডের ঢেউ’র সময় ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যাটি হল ৫ লক্ষ ১৫ হাজার ৩৬৩। উল্লিখিত রিপোর্টে এরাজ্যের সরকার যে তথ্য দিয়েছে তা হল, প্রথম লকডাউনের সময় ফিরে আসা শ্রমিকদের সংখ্যা হল ১৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৬৯৩। উত্তর প্রদেশ (৩২ লক্ষ ৪৯ হাজার ৬৩৮) ও বিহারের (১৫ লক্ষ ৬১২ হাজার) পরই এরাজ্যের স্থান। বুঝতে অসুবিধে হয় না, গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার মোদীর দাবির বিপরীতে মমতার রাজ্যে কৃষিতে তিনগুণ আয় বৃদ্ধির গালগপ্পো নিছক অন্তঃসারশূন্য আরেকটি ভাওতা মাত্র। পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যাই তা প্রমাণ করে।

প্রথম লকডাউনের পর পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নেমে আসা হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা, অশেষ লাঞ্চনা ও বর্ণনাতীত কষ্ট নেমে আসার পরেও কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবলেশহীন মনোভাবকে তীব্র সমালোচনা করেছে কমিটি।

মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প

কাজ হারা ডুবন্ত মানুষের একমাত্র সহায় হিসাবে এই প্রকল্পটি যেন পরিত্রাতার ভূমিকা নিয়ে লকডাউন পরবর্তী দুঃসময়ে আবির্ভূত হয়। যে প্রকল্পটিকে নিয়ে মোদী একসময়ে তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গ করেন। এই প্রকল্পটিকে আরও সম্প্রসারিত করা, বিপুল অর্থ বরাদ্দ, পরিবার পিছু কাজ বরাদ্দ না করে পরিবারের সদস্য পিছু কাজ দেওয়া, ন্যূনতম ২০০ দিনের কাজ ও কাজের শেষে সাথে সাথে মজুরি প্রদান এবং সমস্ত মনরেগা শ্রমিকদের বাধ্যতামূলকভাবে স্বাস্থ্যবিমার অধীনে নিয়ে আসতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে কমিটি। এই ধরনের সুপারিশ করেন বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রী জয়তী ঘোষ, আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়।

এরই পাশাপাশি শহুরে গরিবদের এই দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কমিটি একাধিক প্রকল্প চালু করতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখে। শুধু আর্থিক বিষয় নয়, শহুরে গরিবদের আশ্রয়, বাসস্থান, সু-চিকিৎসার পাশাপাশি তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ তৈরি করতে, নগদ অর্থ প্রদানের ও সুপারিশ করা হয়েছে। মূল অভিঘাত থেকেছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবার।

হকার

প্রধানমন্ত্রী স্বনিধি প্রকল্পের অধীনে হকারদের কার্যকরী মূলধন জোগাতে ৫০ লক্ষ হকারদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার এক প্রকল্প ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার। এই প্রকল্পের অধীনে সমস্ত হকাররা পাবেন ১০ হাজার টাকার ঋণ। কমিটি জানাচ্ছে, এখন পর্যন্ত ওই প্রকল্পের সুবিধা নিতে ৪২.৪৫ লক্ষ আবেদন পত্র জমা পড়লেও মাত্র ২৫.০৩ লক্ষ আবেদনপত্র মঞ্জুর হয়েছে, ২,১৩০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে ২১.৫৭ লক্ষ উপভোক্তাকে, ২৮ জুন ২০২১ পর্যন্ত। এর থেকেই প্রমাণিত, কেন্দ্রীয় সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’গুলোর আসল পরিণাম।

শ্রমজীবী মহিলা

বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত, ভারতীয় শ্রম বাজারে মহিলা শ্রমিকদের স্থান হচ্ছিল না। যাঁদের কোনোক্রমে জায়গা হয়েছে, তাঁরাও মজুরির প্রশ্নে পুরুষদের তুলনায় বিরাট ফারাক নিয়ে মুখবুজে কাজ করে যাচ্ছেন। আইএলও’র সমীক্ষা দেখাচ্ছে, জেন্ডার ওয়েজ গ্যাপে ভারত সবচেয়ে এগিয়ে।

অতিমারির সুদুরপ্রসারি সর্বব্যাপী আঘাত মহিলাদের আরও বেশি করে ছিটকে দিয়েছে কাজের বাজার থেকে। যেগুলো পড়ে আছে, তা ভীষণ ধরণের শ্রমসাধ্যই শুধু নয়, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মহিলা শ্রমিকদের প্রশ্নে কমিটির রিপোর্ট খুবই দায়সারা। মূল সমস্যার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। যে অসংখ্য শ্রমজীবী আশা কর্মীরা কোভিড যোদ্ধা হিসাবে মুখবুজে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে গেলেন গোটা কোভিড১৯’এ, তাঁদের সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষার কোনও সুপারিশ এই কমিটির তরফ থেকে দেখা গেলনা। এ প্রশ্নে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশগুলো খুবই উল্লেখযোগ্য। স্কিম কর্মীদের অস্তিত্বই যেন কমিটি বেমালুম চেপে গেছে। আর, শ্রমজীবী মহিলাদের সামাজিক সুরক্ষার মতো কিছু মামুলি কথাবার্তা কিছুটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে উল্লেখিত হয়েছে।

এই কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জানতে চায়, কোভিডে কতজন শ্রমিকের প্রাণহানি হয়েছে। দেখা গেল, এ প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কোনও তথ্য নেই। তারা শুধু এটা জানিয়েছে ইএসআই একটা প্রকল্প চালু করে। কোভিডে মৃত শ্রমিক ইএসআই ভুক্ত হলে তাঁর উপর নির্ভরশীল পরিবার সেই প্রকল্প অনুযায়ী কিছু আর্থিক সাহায্য পাবেন। আর, ২৫ জুন ২০২১ পর্যন্ত মৃত পরিবারগুলোর তরফ থেকে ওই প্রকল্পের জন্য মাত্র ৪১৭ আবেদন বা ক্লেইম জমা পড়েছে। বলাই বাহুল্য, ভারতে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক আজও ইএসআই’র বহু যোজন দূরে অবস্থান করছে। তাই তাঁদের খবর রাখার কোন প্রতিষ্ঠান আজও এই দেশে গড়ে ওঠেনি। এদিকে, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রক জানিয়েছে, ৭ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত তাদের দপ্তরের হিসাবে দেশে মোট ৪ লক্ষ ৪ হাজার ২১১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে কোভিডের কারণে। মোদী সরকারের এটা হল আরেকটা ডাহা মিথ্যাচার!

যেখানে মোদী সরকার শ্রমকোডের মাধ্যমে হরণ করে নিতে চাইছে এযাবত শ্রমিকদের পিএফ-ইএসআই’র মতো সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচগুলো, সেখানে এই কমিটি কিছুটা ভিন্ন কথা শুনিয়েছে। এই দুটো সংস্থা যেন তাদের লিখিত নির্দেশিকা বা প্রকল্পের নিগড়ে বন্দী না থেকে এই গভীর দুঃসময়ে মানব কেন্দ্রীক, সহানুভূতি সম্পন্ন মনোভাব নিয়ে ব্যাপকতম দরিদ্র পীড়িত লাঞ্ছিত শ্রমজীবী মানুষের পাশে কিভাবে দাঁড়াতে পারে, তারজন্য উদ্ভাবনী উপায় বার করার পরামর্শ দিয়েছে।

বেশ কিছু প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশংসা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে উভয় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রচ্ছন্ন ও তীর্যক সমালোচনা রয়েছে এই রিপোর্টে। তবে এটা কবুল করা দরকার, এই প্রথম আমলা নির্ভর বদ্ধ ঘরে বসে প্রতিবেদন তৈরি করার পরিবর্তে সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন সহ বহুপক্ষীয় আলাপ আলোচনা, মত বিনিময় ও গ্রহণ করার এক ইতিবাচক মনোভাব দেখা গেছে গোটা এই প্রক্রিয়ায়, মোদী জমানায় যা সত্যিই বিরল।

ক্ষমতার অলিন্দ্য থেকে উঠে আসা কিছু ভিন্ন ধরনের সুর বোধহয় শোনা গেল এই প্রথম।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-28
সংখ্যা-36