অতিধনী ‘দেশপ্রেমিক’দের ধনের প্রতি উগ্র লোভ মেটার নয়। তার সঙ্গে যদি সংগত করতে থাকে রাজনীতির ‘মহান’ নেতারা। ৫ বছর আগে ফাঁস হয়েছিল পানামা পেপারস। নাম ছিল কোটিপতি বানানোর মালিক বিখ্যাত অভিনেতার, ছিল দেশের ‘বরেণ্য’ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের। আরো অনেকের। কালো টাকা উদ্ধারে ‘কৃতসংকল্প’ প্রধান সেবক কী করেছেন তাদের? কেউ ভারতকে ‘স্বচ্ছ’ করার বিজ্ঞাপনে নিয়োজিত হয়েছেন তো কেউ সংসদ আলো করে রেখেছেন। ওদিকে কালো টাকা উদ্ধারের নাম করে গরিবকে আরো গরিব করেছেন প্রধান সেবক। ৫ বছর বাদে আবার ফাঁস হচ্ছে অতিধনী কিছু মানুষের কীর্তিকলাপ। প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ দলিল দস্তাবেজ ফাঁস হয়েছে। নাম এসে পড়েছে বহু ‘গুণীজনের’, দেশবিদেশের। যথাবিহিত এদেশের খ্যাতনামারাও রয়েছেন তালিকায়। এত কাগজ এত নাম যে নামকরণ হয়েছে ‘প্যান্ডোরা পেপারস’। কথিত আছে, অতিলোভী একজন প্যান্ডোরার বাক্স খুলেই বের করেছিল পৃথিবীর যত খারাপ বিষয়, পাপ, লোভ, ভয়, হতাশা ইত্যাদি। এবারের প্যান্ডোরার বাক্সও সন্ধান দিচ্ছে সেইসব পাপীদের।
প্যান্ডোরার বাক্স থেকে বেরিয়ে পড়েছে রাশি রাশি দলিল দস্তাবেজ, পাওয়া যাচ্ছে দেশবিদেশের সকল ‘দেশপ্রেমিক’ ধনী শিল্পপতি, গায়ক, খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদদের অর্থলগ্নির আইনি-বেআইনি-অতি আইনি তথ্যসমূহ। সবে গত রবিবার থেকে এসম্পর্কে জানাজানি হতে শুরু করেছে। ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা, ‘বিবিসি’ ও ভারতের ‘দ্য ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ সমেত বিশ্বের ১৫০ টি প্রচার মাধ্যম সংস্থা নিয়ে গঠিত অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন (দ্য ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) দাবি করেছে তাদের হাতে প্রায় ১২০ লক্ষ গোপন দস্তাবেজ এসেছে যাতে বিশ্বের বহু অতি ধনীর গোপন আর্থিক লেনদেনের তথ্য রয়েছে। দেশবিদেশের তাবড় সব মানুষজনের সাগরপাড়ে বিনিয়োগের যে সমস্ত কাহিনী শোনা যাচ্ছে তাতে নাম শোনা যাচ্ছে এদেশের ক্রিকেট মহানায়ক শচীন তেন্দুলকার, শিল্পপতি অনিল আম্বানি, শিল্পপতি কিরণ শ মজুমদারের স্বামী জন শ-র । নাম রয়েছে পপ সঙ্গীত শিল্পী সাকিরা, নাম করা মডেল ক্লদিয়া শিফার প্রভৃতির। যদিও তেন্ডুলকার বা শাকিরা কিংবা শিফারের উকিলরা বলেছেন যে তাঁদের বিনিয়োগ আইন মেনেই হয়েছে। সাগরপাড়ে আর্থিক লেনদেনে জড়িত রাজনীতিবিদদের বিশ্বজোড়া পরিসংখ্যানের নিরিখে সংখ্যার দিক দিয়ে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে ভারত ও সপ্তম স্থানে পাকিস্তান।
আই সি আই জে-র বক্তব্য অনুযায়ী ওই সমস্ত গোপন দস্তাবেজ জর্ডানের রাজা, কেনিয়া, ইকুয়েডোর ও ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার প্রভৃতির সাগরপাড়ের আর্থিক লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করছে। এছাড়াও রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিনের সাগরদের ও রাশিয়া, আমেরিকা, তুরস্ক ও অন্যান্য দেশের ১৩০ জন অর্বুদপতির (বিলিয়নেয়ার) নামও রয়েছে। আইসিআইজে-র মতে তাদের বিশ্বজোড়া অনুসন্ধান দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে সারা বিশ্বে আইনের শাসনকে দোমড়ানো মোচরানো ও ভাঙা চলছে সম্পদশালী দেশগুলির দ্বারা সৃষ্ট এক আর্থিক গোপনীয়তার মাধ্যমে। ওই সমস্ত গোপন দস্তাবেজ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের ১৪টা সাগপাড়ের পরিষেবা সংস্থার থেকে পাওয়া গেছে যেগুলি আর্থিক লেনদেন গোপনে রাখতে চায় এমন সব মক্কেলদের জন্য সাগরপাড়ে খোলস (শেল) কোম্পানি সৃষ্টি করে। আইসিআইজে-র অনুসন্ধান দেখিয়ে দিচ্ছে যে বিশ্ব রাজনীতিতে গোপন অর্থলগ্নি কীভাবে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে, যার ফলে সরকার ও বিশ্ব প্রতিষ্ঠানসমূহ সাগরপাড়ের আর্থিক অপব্যবহার রুখতে কিছুই করতে পারেনি।
২০১৬ সালের পানামা পেপার কান্ডের পরে ধনী ভারতীয়দের অনেকেই তাদের সাগরপাড়ের সম্পত্তি ও বিনিয়োগের নতুন বন্দোবস্ত করেছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা গুচ্ছের সাগরপাড়ের ট্রাস্ট তৈরি করেছে যাতে ব্যাঙ্ক বা অন্য ঋণদাতাদের পক্ষে তাদের সম্পত্তি ছোঁয়া সম্ভব না হয়। বিভিন্ন অর্থনৈতিক অপরাধে অভিযুক্তরা বিভিন্ন করমুক্ত দ্বীপে জাল বিছিয়ে রেখেছে।
প্যান্ডোরা পেপারের তথ্য অনুযায়ী ভারতীয় ব্যাঙ্কে হাজার হাজার কোটি টাকার খাতকরা তাদের সম্পত্তির এক বৃহৎ পরিমাণ সাগরপাড়ের কোম্পানিতে সরিয়ে দিয়েছে। একজন বর্তমানে জেলে থাকা অর্থনৈতিক অপরাধী একটি বোম্বার্ডিয়ার চ্যালেঞ্জার বিমান কিনেছে একটি সাগরপাড়ের সংস্তার মাধ্যমে। বহু সংস্তার প্রোমোটাররা তাদের ব্যবসায় ঋণ শোধে অপারগ হলে যাতে তাদের সম্পত্তিকে না ছোয়া যায় তাই সাগরপাড়ের ট্রাস্টে তা গচ্ছিত রেখেছে। এছাড়া রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যাক্তিরা রয়েছে। ভারতের সেরকম লোকেদের মধ্যে প্রাক্তন সাংসদরা আছে, আছে সরকারি কর্তাব্যক্তিরা। ফাঁস হয়ে যাওয়া দস্তাবেজ এমনটাও দেখাচ্ছে যে যাদের কাজ ছিল সাগরপাড়ের এই অর্থলগ্নির লেনদেনকে বন্ধ করার তারাও ওই ধরনের লুকোনো কোম্পানি বা ট্রাস্টে সম্পত্তি সরিয়েছে। যেমন, রাজস্ব বিভাগের প্রাক্তন কর্তা, একজন প্রাক্তন আয়কর কমিশনার, একজন প্রাক্তন সেনা কর্তা, একজন আইন বিভাগের কর্তা।
- অমিত দাশগুপ্ত