এআইকেএসসিসি’র এক প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, ৩ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশে (লখিমপুর খেরী) নৃশংসভাবে কৃষক হত্যার বিরুদ্ধে এআইকেএসসিসি’র ডাকে ৪ অক্টোবর কলকাতায় মৌলালি মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশে সমন্বয় সমিতির সাথে সংযুক্ত বিভিন্ন কৃষক সংগঠন ছাড়াও আরও বহু সংগঠন যোগ দেয়। এছাড়াও পূর্ব বর্ধমান, নদীয়া, বাঁকুড়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, দার্জিলিং সহ বিভিন্ন জেলায় প্রায় একশ’টি জায়গায় অনুরূপ বিক্ষোভ সংগঠিত হয়।
মৌলালির বিক্ষোভসভা পরিচালনা করেন এআইকেএসসিসি’র রাজ্য সম্পাদক কার্তিক পাল। বক্তব্য রাখেন সর্বভারতীয় কৃষক নেতা হান্নান মোল্লা, অভীক সাহা, প্রদীপ সিংহ ঠাকুর, সুশান্ত ঝাঁ, স্বপন দেবনাথ, তুষার ঘোষ, তরুণ গাঙ্গুলী, মিহির পাল সহ সমন্বয় সমিতির অন্যান্য নেতারা। এছাড়া বন্দীমুক্তি কমিটির ছোটন দাস, নো-এনআরসি মুভমেন্টের অরূপ মজুমদার, আইসা’র অন্বেষা, এআইসিসিটিইউ’র বাসুদেব বোস, নেতাজী ভগৎ সিং সমিতির নৌসিন বাবা খান, এআইপিডব্লিউএ’র ইন্দ্রানী দত্ত, ইয়ং বেঙ্গলের অনির্বান তলাপাত্র, এআইআরডব্লিউএ’র শিখা সেন সহ আরও অনেকে। শেষে মোদী ও যোগী সরকারের কুশপুতুল পোড়ানো হয়।
বক্তারা বলেন, লখিমপুর খেরীতে যেভাবে মন্ত্রীর কনভয় কৃষকদের পিষে দিল তা পরিকল্পিত, কৃষক আন্দোলনকে হিংস্রতার পথে ঠেলে দিয়ে পিষ্ট করতে চায় সরকার। প্রতিবাদীদের জেলে পুরছে, সংখ্যালঘুদের হত্যা করে মৃতদেহের বুকের ওপর লাফাচ্ছে, কৃষকদের পিষে দিচ্ছে গাড়ির কনভয়ে — বিজেপি সরকারগুলো তাদের নৃশংস কদর্য ফ্যাসিস্ট চেহারা প্রকাশ করছে। কিন্তু এই অপশক্তির বিরুদ্ধে দেশের মানুষ আরও এককাট্টা হবে।
কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির অপসারণ ও তার পুত্র আশীষ মিশ্র টেনির বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করে গ্রেপ্তার ও সমগ্র ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করা হয়।
সভার শেষে কার্তিক পাল বলেন আগামী কয়েকদিন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয়স্তরে আন্দোলন চলবে। এরাজ্যে কৃষকদের দাবি নিয়ে আন্দোলন আরও জোরালো করা হবে।
নদীয়ার ধুবুলিয়ায় ধিক্কারসভা
৪ অক্টোবর ধুবুলিয়ায় আয়োজিত প্রতিবাদী কর্মসূচিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, উঃ প্রদেশে ঘাতকের নৃশংস হামলাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অন্নদাতারা আজ যে বার্তা তুলে ধরেছেন তা হলো হাজারো আক্রমণ সত্বেও চলমান কৃষক আন্দোলন কখনই মাঝপথে থেমে যেতে পারে না। কৃষি সংকটের চরিত্রই জন্ম দেবে কৃষকের প্রত্যাঘাত। কৃষক হত্যার মধ্য দিয়ে আসলে দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রকে হত্যা করছে বিজেপি। দেশের ব্যাপক মানুষ এই অপরাধ ক্ষমা করবে না। ক্ষমতার দম্ভের পতন হবেই।
এই বার্তা তুলে ধরে ধিক্কার সভার পর ৩৪নং জাতীয় সড়ক অবরোধ করে দাহ করা হলো উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কুশপুতুল। শ্লোগানে শ্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠলো গোটা ধুবুলিয়া বাজার। খুনী মন্ত্রী অজয় মিশ্র ও তার ছেলে আশীষ মিশ্রকে গ্রেপ্তার করে খুনের মামলা দায়ের করতে হবে,কঠোর শাস্তি দিতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী যোগীকে বরখাস্ত করতে হবে। তিন কৃষি আইন বাতিল করতে হবে। কৃষক হত্যাকারী মোদী-যোগী হঠাও দেশ বাঁচাও,গণতন্ত্র বাঁচাও। এই কর্মসূচি এলাকার ব্যাপক মানুষের দৃস্টি আকর্ষণ করে। বহু মানুষ সহমর্মিতা জানায়।
ধিক্কারসভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ সহ সন্তু ভট্টাচার্য, ঠান্ডু সেখ, গিয়াসউদ্দিন সেখ, আরওয়াইএ জেলা দায়িত্বশীল অমিত মন্ডল, রাজ্য সম্পাদক রণজয় সেনগুপ্ত। ছিলেন আনসারুল হক, ইসলাম ঢাকি প্রমূখ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
হুগলীর বৈঁচিতে মিছিল ও সভা
৫ অক্টোবর বৈঁচিতে সিপিআই(এমএল) অফিসের সামনে থেকে বামপন্থীদের সংযুক্ত মিছিল সমগ্র বাজার এলাকা পরিক্রমা করে। মিছিল থেকে আওয়াজ ওঠে : উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরীতে বিজেপির গুন্ডাদের হামলায় নিহত বীর কৃষকদের জানাই লাল সেলাম।শহিদ লাভপ্রীত,দলজিৎ,নক্ষত্র ও গুরবিন্দার সিং লাল সেলাম।কেন্দ্রীয় উপ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অজয় মিশ্রের পুত্র কৃষক হত্যাকারী আশিস মিশ্রকে গ্রেপ্তার করতে হবে। হত্যাকাণ্ডের নৈতিক দায় স্বীকার করে অজয় মিশ্র ও যোগী আদিত্যনাথকে ইস্তফা দিতে হবে।
জিটি রোড চৌমাথায় বিক্ষোভসভায় বক্তব্য রাখেন খেতমজুর ইউনিয়নের সুশান্ত চ্যাটার্জি, সারা ভারত কৃষক সভার সুনীল ক্ষেত্রপাল, ডিওয়াইএফের ঊজ্জ্বল ঘোষ এবং আয়ারলার হুগলী জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন বাগ। কিষাণ মহাসভার মুকুল কুমার সভা সঞ্চালন করেন।
দক্ষিণ ২৪ পরগণার বজবজে প্রতিবাদ
৪ অক্টোবর বজবজে জেলা অফিসের সামনে, গ্রামাঞ্চলে এবং ৫ অক্টোবর বাখরাহাটের বুড়িরপোল নতুন রাস্তা মোড়ে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের প্রতিবাদী কর্মসূচি আয়োজিত হয়।জেলা অফিসের সামনে কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন সম্পাদক কিশোর সরকার, উপস্থিত ছিলেন দেবাশীষ মিত্র, লক্ষীকান্ত অধিকারী, যুবনেতা সেখ সাবির সহ আরো অনেকে।বজবজ গ্রামাঞ্চলে কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন গ্রামীণ লোকাল সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ দত্ত, উপস্থিত ছিলেন জেলা নেত্রী দেবযানী গোস্বামী, শ্যামসুন্দর গোস্বামী, ছাত্র নেতা দীপ মালিক, অনিন্দিতা মালিক সহ আরো অনেকে। বাখরাহাটে বক্তব্য রাখেন কৃষক নেতা দিলীপ পাল, উপস্থিত ছিলেন লোকাল সম্পাদক নিখিলেশ পাল, নেত্রী পূর্ণিমা হালদার, শাহালম সেখ সহ আরো অনেকে।
হাওড়ার বালীতে বিক্ষোভসভা
৫ অক্টোবর মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়। শুরুতে চলমান কৃষক আন্দোলনে নিহত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে নিরবতা পালন করা হয়। অত্যাচারী মোদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন দীপক চক্রবর্তী, পার্থ সারথি মিত্র, বাবলু গুহ। ২০২০ কৃষি আইন এবং মোদী, যোগীর কুশপুতুল পোড়ানো হয়। দাবি তোলা হয় অবিলম্বে কৃষক বিরোধী মানুষ বিরোধী কৃষি বিল বাতিল করতে হবে, মন্ত্রী অজয় মিশ্রর পুত্র আশিষ মিশ্রর কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে। এলাকার সর্বস্তরের মানুষকে বন্যা কবলিতদের পাশে থাকার আহ্বান জানানো হয়। সভার সঞ্চালক মাধব মুখার্জি সকল শ্রেণীর মানুকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
রাজ্যের তিনটি বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল বিশাল বিশাল ব্যবধানে পুনর্বিজয়ী হল। প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপির প্রত্যাশায় আবার ছাই পড়ল। বিশেষ করে ভবানীপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচন নিয়ে নানা কারণে কিছুটা হলেও বাজারে জল্পনা ছড়িয়েছিল। প্রথমত, বিজেপির আই টি সেল প্রচারে নামিয়েছিল ‘নন্দীগ্রামে তৃণমূলনেত্রীর পরাজয়ের ভূত’কে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী কেন্দ্রটি কিছুটা কম-বেশি পঞ্চাশ পঞ্চাশ মিশ্র এলাকার। ৪৪-৪৫ শতাংশ অবাঙালী ভোটার। তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় এজেন্সীর জিজ্ঞাসাবাদের জেরে তৃণমূলকে মানসিক চাপে রাখার কৌশল ছিল। চতুর্থত, তৃণমূল নিয়েছিল অতি সাবধানী মনোভাব থেকে অতি সক্রিয় অবস্থান। আরও হয়ত কিছু উপসর্গ ছিল। তবে বিজেপি'র হেভিওয়েট প্রার্থীও ছিল না, আর দলের প্রচারে দিল্লী থেকে চূড়ামনি দুজনও আসার কার্যকারিতা খুঁজে পাননি। লক্ষ্য ছিল বিগত তৃণমূলের বিধায়কের প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় এবার যদি ব্যবধান কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু বাজিতে ব্যর্থই থাকতে হল। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে এই বিধানসভা ক্ষেত্রে বিজেপি ১৮৫ ভোটে হলেও এগিয়ে গিয়েছিল, কোন রসদে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল তাও পরে যথেষ্ট উন্মোচিত চর্চিত হয়েছিল। কিন্তু এবার সবচেয়ে মিশ্র প্রবণ দুটি ওয়ার্ড সহ সমস্ত ওয়ার্ডেই বিজেপি পরাজিত হয়েছে। বাঙালী অংশে তো নয়ই, এমনকি অবাঙালী হিসাব কষেও গুজরাটি, মাড়ওয়াড়ি, বিহারি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবী ভোটারদের কোনও অংশের মধ্যে মেরুকরণ ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। পাঁচ মাস আগে যেখানে বিজেপির ভোট ছিল যথাক্রমে ৪৪,৭৮৬ ও ৩৫.১ শতাংশ, এবার নেমে এসেছে ২৬,৪২৮ ও ২২.২ শতাংশে। শ্যামাপ্রসাদ থেকে মোদী – কোনও ভাবমূর্তি ভাঙানো প্রচার দাগ কাটতে পারেনি। বরং ধাক্কা খেয়েছে বিদ্বেষ-বিভাজন-সাম্প্রদায়িকতা, মিথ্যাচারের রাজনীতি; ব্যাপক বেকারি ঘনিয়ে নিয়ে আসা ও কর্পোরেট ভজা অর্থনীতি।
পক্ষান্তরে, ‘ভবানীপুরের খেলা শেষ হবে ভারত জয়ে’ প্রচারে মাতোয়ারা তৃণমূল। নেত্রী এবার জিতেছেন প্রায় ৫৯,০০০ ভোটে, ২০১১-র চেয়ে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি ব্যবধানে। পেয়েছেন মোট প্রদত্ত ৫৭ শতাংশ ভোটের ৭১.৯০ শতাংশ। যাই হোক, ২০২১-এর বঙ্গভূমি থেকে শুরু করে ২০২২-এ উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, যেখানেই যা নির্বাচন হবে তার রণনীতি ও রণকৌশলগত বর্শামুখ থাকতে হবে ২০২৪-এ মোদী পতনের লক্ষ্যে, এ নিয়ে কোনও দ্বিধা থাকলে চলবে না। মানুষের আন্দোলনও চালিয়ে যেতে হবে নিরন্তর।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলার বিধানসভা নির্বাচন-উপনির্বাচনের ফলাফল অবশ্যই ইতিবাচক।
স্বৈর তৃণমূলকে ফ্যাসিস্ত বিজেপির সমতুল করে দেখা মুর্খামী। পক্ষান্তরে, আরও কিছু আশু গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সংস্কার ও গণদাবি সহ তৃণমূলের দুর্নীতি, দলতন্ত্র, সন্ত্রাস, ও মমতা সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে বহু লড়াই চলছে, আন্দোলন গড়ে তোলার গুরুত্ব রয়েছে, যা ঠিক এখনও তত কার্যকরি ও জনপ্রিয় রূপে নির্মাণ হয়ে উঠতে পারছে না। তৃণমূলের জনমন আকর্ষণের জোর তার চালু করা কিছু স্বল্পমেয়াদী একগুচ্ছ জনপ্রিয়তাবাদী সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুলোধোনার ঊর্দ্ধে। বরং তার ওপর চাপ আছে একপ্রস্থ, সেইসব ইস্যুতে সংগ্রাম-সমাবেশ গড়ে তোলা দরকার। কৃষিপণ্যের দেড়গুন ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চয়তা আইন, কৃষকের থেকে সরাসরি ফসল সংগ্রহ বৃদ্ধি, মনরেগা প্রকল্পের কর্মসংস্থান ও মজুরি বৃদ্ধি, মোদী সরকারের লেবার কোড প্রচলন না করা ও বন্ধ কলকারখানা খোলার নিশ্চয়তা বিধান, অবিলম্বে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা এবং শিক্ষান্তে কর্মসংস্থান, মহানগর-জেলাসদর-ব্লকস্তর থেকে গ্রামস্তরে স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামো, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থাগ্রহণ ইত্যাদি সহ বিরোধী কর্মসূচিকে পুলিশী-প্রশাসনিক হামলা করে-মামলা চাপিয়ে দমন করার ইস্যুতে বহু আন্দোলন করার আছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ ও তীব্র রাজনৈতিক সংগ্রাম ও গণসংগ্রামের ভারসাম্যের মেলবন্ধন করে এগিয়ে চলাই আজকের সময়ের মূল দাবি।
বর্তমান সময়ে মবলিঞ্চিং ভারতে বিচার-বহির্ভূত হত্যার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ হিসেবে সামনে এসেছে। আসামের দরং জেলার ঢোলপুর গ্রাম থেকে আসা ভিডিও চলচ্চিত্র আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে রাস্তার মব আর রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেকার ঝাপসা হয়ে আসা পার্থক্যরেখাটা সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেলে হিংসার চেহারা কতটা অকল্পনীয় হিমশীতল ও মানবতা বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীই রাস্তার মবে পরিণত হল এবং একজন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে তার প্রাণহীন দেহটিকে উল্লাসমঞ্চ বানানো হল, পুলিশের ফটোগ্রাফার তার ওপরে লাফিয়ে পদাঘাত করে উৎসব করল।
আসামের হিমন্ত বিশ্বশর্মা সরকারের কাছে ঢোলপুরের এই নৃশংস হিংস্রতা নিছক কৃষি প্রকল্পের জন্য সরকারি জমি থেকে ‘জবর দখলকারী’ সরানোর এক নিত্যনৈমিত্তিক কাজ মাত্র। এই জমি চর এলাকা নামে পরিচিত, যে এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের প্রায়শই এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় সরে যেতে হয় বছরের পর বছর বন্যার কারণে। আর, যাদের ‘জবর দখলকারি’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে তাঁরা হলেন সেইসব পরিবার যাঁরা দশকের পর দশক ধরে এই বন্যাবিধ্বস্ত এলাকার জমিতে ফসল ফলিয়ে আসছেন, যাঁরা সেই অত্যন্ত প্রতিকুল প্রকৃতিতে দীর্ঘ জীবন-সংগ্রামের মাধ্যমে কৃষিকার্যে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছেন। ঘটনা হল, খুন হওয়া মানুষ দুটির নাম — মইনুল হক ও শেখ ফরিদ — এনআরসি তালিকায় আছে এবং ১৩ বছর বয়সী ফরিদের পকেটে ছিল সদ্য পাওয়া তার আধার কার্ডটি।
এই মানুষেরা কেবলমাত্র এটুকুই চেয়েছিলেন যে, উচ্ছেদের আগে যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থাটুকু অন্তত করুক সরকার। ভিটে ও জমি থেকে উচ্ছেদ করতে হলে সরকারের কাছ থেকে পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত পাওয়া যে কোনও মানুষের মৌলিক আইনি অধিকার। এমনকি গৌহাটি হাইকোর্টও মহামারীর এই সময়ে এই উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করতে বলেছিল সরকারকে। একথা স্পষ্ট যে সরকারই আসলে আইন ভেঙ্গেছে। তারপরও সরকার এখন এক তীব্র অপপ্রচার ও নিপীড়ন অভিযান চালাচ্ছে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে বলে প্রচার চালিয়ে ঢোলপুরের নৃশংসতা আড়াল করতে চাইছে, আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে ওই মানুষগুলোকে আরও সন্ত্রাসের শিকার বানাচ্ছে। ভীমা কোরেগাঁও/এলগার পরিষদ ও দিল্লী দাঙ্গার কুখ্যাত মামলাগুলির মতই ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আমদানি করা হচ্ছে জঘন্য অপরাধীদের বাঁচাতে আর অপরাধের শিকার ও তাদের পাশে দাঁড়ানো সকলকে নিগ্রহ করতে।
এনআরসি’র প্রক্রিয়া চলার সময় ওদের শব্দ ছিল অনুপ্রবেশকারী। জনসাধারণকে বলা হয়েছিল যে একবার এনআরসি হয়ে গেলে যাদের নাম তালিকায় উঠে যাবে তাদের আর চিন্তার কোনও কারণ থাকবে না, তারা অনুপ্রবেশকারীর তকমা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে, এনআরসি’র ছাঁকনি দিয়ে আসা আসামের সব নাগরিকদের মধ্যে এক নতুন সামাজিক সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি হবে। অভিজ্ঞতা এখন দেখাচ্ছে যে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া প্রায় বিশ লক্ষ মানুষের মধ্যেকার অধিকাংশ নারী, পুরুষ ও শিশুর আদতে অন্য কোথাও থেকে আসার কোনও ইতিহাস নাই, এটুকুই বলা যায় যে তাদের ডকুমেন্টগুলো এনআরসি’র পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। এঁরা আসলে আসামের ডকুমেন্ট বিহীন মানুষ। কিন্তু ঢোলপুরে হিংস্রতা দেখিয়ে দিল যে এনআরসি’র পরও মানুষ নিরাপদ হয়নি। এনআরসি’র পরীক্ষায় পাস করার পর তাঁদের এখন নতুন পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে। এখন আবার গোলপোস্ট সরিয়ে দিয়ে তথাকথিত ‘জবর দখলকারিদের’ উচ্ছেদ করতে নেমে পড়েছে সরকার।
সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে জবরদখলকারিদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করে আসামের আদিবাসীদের মধ্যে সেই জমি বিতরণ করবে। কিন্তু ‘অভিবাসী জবর দখলকারী’ ও ‘আদিবাসী’র মধ্যে এই পার্থক্যকরণও আসলে মানুষের মধ্যে বিভাজন ও বিদ্বেষের ধোঁয়াজাল তৈরির চেষ্টা মাত্র। আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে তথাকথিত আদিবাসী মানুষেরা একইরকম নির্মম উচ্ছেদের শিকার, তা সে সরকারি অভিযানের মাধ্যমে হোক বা বন্যায়। জনসাধারণকে জবরদখলকারী বলে দেগে দেওয়া আর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়াই কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা সাম্প্রতিক ভারতের নির্মম বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। কোথাও করা হচ্ছে শিল্পায়ন ও উন্নয়নের নামে, বৃহৎ জলাধার বা বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের নামে, কোথাও শহরের সৌন্দর্যায়ন বা রাস্তা চওড়া করার নামে।
যখন ‘জবর দখলকারীদের’ পরিচয় হয় নিশানা বানানো কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ — ধর্মীয়, ভাষিক বা জাতিগত সংখ্যালঘু — তখন উচ্ছেদ অভিযানের নৃশংসতা অমানবিক মাত্রা নেয়, যেমনটা আসামের স্তম্ভিত করা ভিডিওটিতে দেখা গেল। ভারত ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ডকুমেন্টবিহীন নাগরিকদের ‘উঁইপোকা’ বলেছিলেন। এরকম নিধন অভিযান চালানোর উস্কানিই তিনি দিচ্ছিলেন তাঁর শ্রোতাদের। অমিত শাহের কুখ্যাত ‘ক্রনলজি’র না-বলা ভবিষ্যৎ এটাই ছিল, এটাই ছিল এনআরসি-এনপিআর-সিএএ’র বহিষ্কার অনুশীলনের প্রকৃত সঞ্চারপথ।
আসামের সরকার দরং হিংসার তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। হিমন্ত বিশ্বশর্মা মুখ্যমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন বাস্তবে কোনও সদর্থক ও নিরপেক্ষ তদন্ত আদৌ সম্ভব নয়। দরং-এর এসপি মুখ্যমন্ত্রীর নিজের ভাই। এবং মুখ্যমন্ত্রী তো উচ্ছেদ অভিযান প্রসঙ্গে নিজের খুশী প্রকাশ করেছেন। তদন্তের মাধ্যমে কোনও সত্য তুলে এনে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা সবার আগে জরুরি এবং তারপর হাইকোর্টের একজন কর্মরত বিচারকের তত্ত্বাবধানে বিচারবিভাগীয় তদন্ত চালানো জরুরি। যারা ভারতের গণতন্ত্র, বৈচিত্র্য ও সাংবিধানিক আইনি শাসন রক্ষা করতে চান তাদের সকলের জন্য এক চূড়ান্ত সতর্কবাণী হোক এই দরং ভিডিওটি। জবরদখলকারিদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করার নামে আরও সন্ত্রাস চালাতে দেওয়া যাবেনা আসাম সরকারকে। সমস্ত রকম উচ্ছেদ অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং দরং-এর সমস্ত ভিক্টিম ও উচ্ছিন্ন মানুষের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে — মানবতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সংঘটিত কদর্য অপরাধের প্রেক্ষিতে ন্যূনতম এইটুকু অন্তত আসামের পাওয়া উচিত, ন্যূনতম এটুকু অন্তত ভারতবাসী দাবি করতে পারে।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১)
সংযুক্ত কিষান মোর্চার মূল দাবি এখনো পূরণ হয়নি। অবিলম্বে আশীষ মিশ্র টেনি ও তার সহযোগীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে বলে মোর্চা দাবি জানিয়েছে। দাবি জানিয়েছে হরিয়ানা মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টরকে অবিলম্বে বরখাস্ত করতে হবে। সংযুক্ত কিষান মোর্চা শীঘ্রই দাবি আদায়ের কর্মসূচি ঘোষণা করবে এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। গুরনাম সিং চাডুনিকে গ্রেপ্তার করে আটকে রাখার নিন্দা জানাচ্ছে এসকেএম। ইউপি সরকারের আচরণ অগণতান্ত্রিক এবং কর্তৃত্ববাদী। এটা স্পষ্ট যে লখিমপুর খেরী হত্যাকাণ্ডের সত্য বিশ্ববাসীর সামনে উদ্ঘাটিত হয়ে যাওয়ার ভয় পেয়ে উত্তর প্রদেশের যোগী সরকার নিজেদের বাঁচাতে চাইছে।
গতকাল নয়াদিল্লির ইউপি ভবনের বাইরে আয়োজিত একটি বিক্ষোভ শেষ হওয়ার পর মন্দির মার্গ থানার দিল্লি পুলিশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছিল। রাজস্থানে হনুমানগড়ে কালেক্টরেট অফিসে ধান সংগ্রহের জন্য বিক্ষোভকারী কৃষকদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে পুলিশ কৃষকদের তাড়া করছে এবং নির্বিচারে লাঠিচার্জ করছে। এসকেএম প্রতিবাদী কৃষকদের উপর পুলিশের এই হিংসার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। জানা গেছে, কয়েকজন কৃষক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কৃষকদের আন্দোলনকে রাজনৈতিক লাভের জন্য ব্যবহার না করে কৃষিপণ্য কিনে, মূল্য সহায়তা করে, দুর্যোগে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মৌলিক অধিকার দিয়ে, কৃষকদের প্রতি তাদের সমর্থন ও সহানুভূতি দেখাতে বিভিন্ন রাজ্য সরকারগুলির কাছে আবেদন জানাচ্ছে এসকেএম। কৃষকদের দাবি, রাজস্থান সরকারকে ধান সংগ্রহ শুরু করতে হবে এবং সেচের জল সরবরাহের অভাবে ফসল যাতে ধ্বংস না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। হিমাচল প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলিতে কৃষক আন্দোলন আরও বেগবান ও তীব্র হচ্ছে এবং লখিমপুর খেরী হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ প্রকাশের জন্য অসংখ্য স্থান থেকে স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভ থেকে এই ছবি পরিস্কার।বহু জায়গায় বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।
গান্ধী জয়ন্তীতে চম্পারণে শুরু হওয়া লোকনীতি সত্যাগ্রহ যাত্রা চতুর্থ দিনে প্রবেশ করেছে। আজ সকালে খোরামপুর (গোপালগঞ্জ জেলা) থেকে রওনা হওয়ার পর, যাত্রাটি বিকেলে মঙ্গলপুর বাজারে পৌঁছায়। এখানেও, এটি স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে। কিষান জনজাগরণ পদযাত্রা আজ রাতের তরুণ এবং প্রবীণ কৃষকদের মধ্যে সিওয়ান জেলার মাদারপুরে পৌঁছাবে। যাত্রার প্রতিটি দিন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে একটি করে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করা হচ্ছে। তরুণ এবং প্রবীণ কৃষক উভয় পক্ষ থেকেই আজকের প্রশ্ন করা হচ্ছে – সরকার কখন কৃষকদের জন্য একটি এমএসপি গ্যারান্টি আইন প্রণয়ন করবে? পদযাত্রা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে অবিলম্বে বরখাস্ত এবং তার ছেলে আশীষ মিশ্রকে গ্রেফতারের দাবি করছে। এসকেএম এও পুনরাবৃত্তি করছে যে তথাকথিত “সংস্কার” কৃষকদের জন্য উপকারী নয়, সব দলও একই কথা বলছে। এই “সংস্কারগুলি” দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষকের স্বার্থের বিনিময়ে কৃষি কর্পোরেট সংস্থা’ ব্যবসার সুবিধার্থে করা হয়েছে। কৃষকরা এ ধরনের সংস্কার চায়নি, চায়ও না। তারা কর্পোরেটপন্থী এবং কৃষক বিরোধী তিনটি আইন সম্পূর্ণ বাতিল করার দাবি জানাচ্ছে।
ঘটনাবহুল পরম্পরায় অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার ধান সংগ্রহ কেন্দ্র শুরু করতে রাজি হয়েছে। হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য কৃষক বিক্ষোভে সামিল হয়েছে। কেন্দ্রীয় ক্রেতা সুরক্ষা ও খাদ্য সরবরাহ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী প্রচন্ড বিক্ষোভের মুখে পড়ে কৃষকদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছেন। ২ অক্টোবর পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক সবাই স্থানীয় কৃষকদের প্রতিবাদ ও অবরোধের মুখে পড়েছিলেন। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার ডাকা ঐ প্রতিবাদ বিক্ষোভ সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিল। ১১ অক্টোবর ধান সংগ্রহ শুরু করার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে হাজার হাজার কৃষক অংশ নিয়েছিলেন। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীও ছাড় পাননি, কারনালে তার বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছিল। ভিওয়ানিতে কৃষিমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছিল। সোনেপত, জিন্দ্ সিরসা, কুরুক্ষেত্র, পানিপত, আম্বালা, পঞ্চকুলা এবং আরো বহু জায়গায় প্রতিবাদ হয়েছে। ক্রুদ্ধ কৃষকরা কারনাল ও কৈথালে মান্ডি কমিটির অফিসে তালা দিয়ে দিয়েছিল। কিছু জায়গা যেমন কারনালে আর্থিয়া অ্যাসোসিয়েশন প্রতিবাদকে সমর্থন জানাতে এগিয়ে এসেছিল। পাঞ্জাবের বহু জায়গায় কংগ্রেসী মন্ত্রীরা বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। মন্ত্রী বিধায়ক ও সংসদরা জলন্ধর গুরুদাসপুর হোশিয়ারপুর, পাতিয়ালা এবং পাঞ্জাবের অন্যান্য জেলাতেও কৃষক বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন। কিছু জায়গা যেমন মানসা ও সাঙ্গুরে ডিসি অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির সততা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার ইচ্ছা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা বলেছে সংগ্রহ ব্যবস্থার যেন কোনও হেরফের না হয়, যদিও আগের সিদ্ধান্ত বদল করে তারা বলেছে আগের মতই সংগ্রহ অভিযান চলবে। “এটা কৃষকদের যৌথ আন্দোলনের ফসল” বলেছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা।
কৃষক আন্দোলন মহাত্মা গান্ধী এবং লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মবার্ষিকী অত্যন্ত সম্মান এবং নতুন অনুপ্রেরণার সাথে পালন করেছে। এই উপলক্ষে মোর্চায় আজ একদিনের উপবাস পালন করা হয়। কৃষক গোষ্ঠী এই দুই মহান নেতা, যারা দেশবাসীর স্বাধীনতা, ভাগ্য এবং গ্রামীণ ভারতের নৈতিকতা ঠিক করে দিয়েছিলেন, তাঁদের স্মরণে দেশজুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই দিনটি পালন করেছে। ‘জয় জওয়ান, জয় কিষাণ’ জনপ্রিয় শ্লোগানটি শাস্ত্রীজির দেওয়া এবং এটি কৃষক আন্দোলনে প্রতিধ্বনিত হয়। এই স্লোগান কৃষকদের দেশের প্রতি তাদের বিশাল অবদানের জন্য গর্বিত করে এবং স্বীকৃতি দেয়। কৃষক এবং কৃষকদের সমবায়ে বিনিয়োগ করে জাতি-নির্মাণ করার চেষ্টা লাল বাহাদুর শাস্ত্রী করেছিলেন। গান্ধীজির সত্যাগ্রহের আদর্শ সত্য ও অহিংসার শক্তির উপর ভিত্তি করে কৃষক আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে চলছে। সত্যাগ্রহের নীতি এই আন্দোলনকে প্রতিনিয়ত পথ দেখায়।
২ অক্টোবর প্রবল বর্ষণের মধ্যেই হাজার হাজার কৃষক তাদের সমর্থকসহ নরসিংহ বাবা স্টেডিয়ামের এক সমাবেশ থেকে বিহারের চম্পারণ থেকে বারাণসী পর্যন্ত ১৮ দিনের পদযাত্রা শুরু করেছে। মহাত্মা গান্ধীর কর্মভূমি চম্পারণ থেকে, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কর্মভূমি বারাণসী পর্যন্ত এই যাত্রাপথ। বিদেশী কোম্পানি এবং শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ১০৪ বছর আগে নীল চাষিদের সংগ্রামের স্মরণে এই ‘কিষাণ জনজাগরণের জন্য লোকনীতি সত্যাগ্রহ পদযাত্রা’। ভারতে কৃষকদের বর্তমান সংগ্রাম ভিন্ন নয়। যাত্রাটি ঐতিহাসিক চন্দ্রাহিয়া গ্রামে পৌঁছাবে। ২০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী মোদীর নির্বাচনী এলাকা বারাণসীতে এই যাত্রা শেষ হবে। পথে, এটি সমাজতান্ত্রিক নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের গ্রাম সিতাব দিয়ারা দিয়েও যাবে।
একইভাবে, উত্তরাখণ্ডের উধম সিং নগরের রুদ্রপুর থেকে প্রতিবাদী কৃষকদের একটি বড় কাফেলা রওনা হয়েছে। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই কিষাণ যাত্রাটি গাজীপুর সীমান্তে রওয়ানা হয়েছে এবং উত্তরপ্রদেশের রামপুর, মোরাদাবাদ, আমরোহা এবং হাপুর দিয়ে যাওয়ার পর গাজীপুর পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
বিভিন্ন ইস্যুতে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং অন্যান্য রাজ্যের অসংখ্য জায়গায় বিক্ষোভ হচ্ছে। আর কোনও দেরি না করে অবিলম্বে ধান সংগ্রহ শুরু করা নিশ্চিত করার দাবিতে এসকেএম বিক্ষোভের আয়োজন করে। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার বিভিন্ন জেলায় গোলাপী পোকার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত তুলো চাষিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য কৃষক ইউনিয়নগুলিও বিক্ষোভ দেখিয়েছে। এই বছর বাজরা না কিনে, কেবলমাত্র শর্তাধীন মূল্য ঘাটতি দেওয়ার হরিয়ানা সরকারের নতুন নীতির বিরুদ্ধেও কৃষকরা বিক্ষোভ দেখিয়েছে। দেশে ফসল কেনার ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, মোদী সরকারের এই আশ্বাস সত্ত্বেও, কৃষকরা সঠিকভাবেই ইঙ্গিত করছেন যে এই পদক্ষেপটি অশুভ। এই রাজ্যের পাশাপাশি অন্যত্রও, বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের জন্য দুর্যোগজনিত ক্ষতিপূরণের দাবিতে কৃষক প্রতিবাদ করছে। তেলেঙ্গানায় ভাগচাষি সহ সব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট এবং কৃষক সংগঠনগুলি দাবি করছে যে প্রক্রিয়াটি অবিলম্বে শুরু করা উচিত।
হরিয়ানার আম্বালা, কুরুক্ষেত্র এবং ঝাজ্ঝরে, গতকাল বিজেপির অনুষ্ঠানগুলিতে এবং নেতাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষকদের কালো পতাকাসহ বিক্ষোভ জলকামান ব্যবহার করে দমন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তাদের ওপর জলকামান ব্যবহার সত্বেও কৃষকরা নিরুৎসাহিত ও ছত্রভঙ্গ হয়নি এবং এই ধরনের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ তারা চালিয়ে যাবে।
৩ অক্টোবর, লখিমপুর খেরীর টিকুনিয়াতে উত্তর প্রদেশের উপ-মুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্য এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির বিরুদ্ধে পরিকল্পিত কালো পতাকাসহ বিক্ষোভে কৃষকদের বিপুল সংখ্যায় যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন জানায় উত্তরপ্রদেশের এসকেএম নেতৃত্ব। সাম্প্রতিক অতীতে কৃষক নেতাদের বিরুদ্ধে মিঃ টেনির দেওয়া খোলা হুমকির বিরুদ্ধে কৃষকদের আপত্তি এবং প্রতিবাদ জানানোর জন্য এই বিক্ষোভ দেখানোর ডাক।
আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিল কর্মী এবং অন্যান্য বিভিন্ন প্রকল্প কর্মীদের যুক্তমঞ্চ ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ একদিনের ঐক্যবদ্ধ ধর্মঘট সফলভাবে পালন করলেন। তাঁদের বিভিন্ন দাবির মধ্যে আশু দাবি ছিল কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ভাতা এবং কোভিড ডিউটির জন্য বীমার ব্যবস্থা। এরসঙ্গে রয়েছে দীর্ঘদিনের অপূর্ণ দাবি — স্থায়ীকরণ, শ্রমিক/কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি আদায়, ন্যূনতম বেতন, সামাজিক সুরক্ষা, পেনশন এবং বেসরকারিকরণের বিরোধিতা। ধর্মঘট হয়েছে দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে। ধর্মঘটে বহুসংখ্যক কর্মীদের প্রাণবন্ত যোগদান — তৃণমূল স্তর থেকে ব্লক ও গ্রামে বিভিন্ন রূপের ক্রিয়াকান্ডে অংশগ্রহণ দেখা গেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে (খবরের কাগজ, টিভি এবং সমাজ মাধ্যমে) ধর্মঘটের খবর গুরুত্ব পেয়েছে। এই একদিনের ধর্মঘটে পরিষ্কারভাবে দেখা গেল সমগ্র করোনাকালে মোদীর সরকার প্রকল্প কর্মীদের সাথে যে ক্রীতদাসসুলভ পাশবিক ব্যবহার করেছে তার বিরুদ্ধে কর্মীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ক্রোধের সাথে তীব্র লড়াইয়ের দৃঢ় মানসিকতা।
প্রকল্প কর্মীদের সর্বভারতীয় ফেডারেশনের (এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত) আহ্বায়ক শশী যাদব বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন “এই ধর্মঘট ঐতিহাসিক এবং সরকার, প্রশাসনের তরফ থেকে সমস্ত রকমের হুমকি, চোখরাঙানি, বহুরকমের বাধা বিপত্তি কাটিয়ে কর্মীরা ধর্মঘটকে সফল করার জন্য তাঁদের অভিনন্দন”। তিনি সব ইউনিয়নের অগ্রণী কর্মীদের ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নকেও অভিনন্দন জানিয়েছেন। অভিনন্দনের বার্তা দিয়েছেন কৃষক সংগঠনগুলিকে, অন্যান্য সংগঠনকে, সাধারণ জনগণকে ধর্মঘটে সমর্থন জানানোর জন্য। কর্মীদের বলেছেন ভবিষ্যতে আরও বড় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হবার কথা।
দিল্লীতে মান্ডি হাউস থেকে ‘দিল্লী আশা কামগর ইউনিয়ন’ এক প্রতিবাদী মিছিল সংগঠিত করে যেখানে শত শত আশা কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। দিল্লী পুলিশ মান্ডি হাউস থেকে যন্তর মন্তরে মিছিলের অনুমতি না দেওয়ার জন্য মোদী সরকার এবং দিল্লী পুলিশের নিন্দা করে সংগঠকরা বলেন দিল্লী সহ সারা দেশে অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। প্রতিবাদী ঐ সভায় এআইসিসিটিইউ’র সম্পাদক রাজীব ডিমরি সহ অন্যান্য অনেক নেতা এবং আশা কর্মীরা বক্তব্য রাখেন। সভাশেষে শ্বেতা রাজ, এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক সন্তোষ রায়ের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টীম কেন্দ্রীয় শ্রম এবং কর্মসংস্থান মন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদবকে দাবিদাওয়া সম্বলিত স্মারকপত্র দেন ও দাবিগুলি সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন। ধর্মঘটের আগে ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে তাকে আশা কর্মীরা তাঁদের দাবি নিয়ে পোস্টকার্ড পাঠানোর মাধ্যমে একটি প্রচার অভিযান সংগঠিত করেন।
বিহারে আশা, মিড-ডে-মিল, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা এবং অন্যান্য প্রকল্পের কর্মীরাও উৎসাহভরে হাজারে হাজারে অংশগ্রহণ করেন। সরকারের সমস্ত নিষেধাজ্ঞাকে উড়িয়ে দিয়ে ধর্মঘটকে সফল করেন। নেতৃত্ব দেন বিহার রাজ্য আশা কার্যকর্তা সঙ্ঘর নেত্রী শশী যাদব এবং মিড-ডে-মিল কর্মীদের নেতৃত্ব দেন বিহার রাজ্য বিদ্যালয় রসোইয়া সঙ্ঘর নেত্রী সরোজ চৌবে। পাটনা সহ দুই ডজন জেলায় আশা কর্মীদের ধর্মঘটের প্রভাব পড়ে।
ইউপি’তে এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে হাজার হাজার আশা, মিড-ডে-মিল এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। বিশেষত রায় বেরিলি, এলাহাবাদ, লক্ষ্মৌ, কানপুরের মিছিল দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানেও প্রত্যেক কেন্দ্রে দাবিসনদ পেশ হয়। উত্তরাখন্ডে সারা রাজ্যে বিশেষত নৈনিতাল, হলদোয়ানি, বাজপুর, দেরাদুন ইত্যাদি শহরে হাজারে হাজারে আশাকর্মী ও অন্যান্য প্রকল্প কর্মীরা অংশ নেন ধর্মঘটে। নেতৃত্বে ছিলেন কমলা কুঞ্জওয়াল, রিতা কাশ্যপ, কৈলাশ পান্ডে ও অন্যান্যরা। লক্ষ্যণীয় ব্যপার হল এরআগে প্রায় একমাস যাবৎ সিটু ও অন্যান্য ইউনিয়নের সাথে এই আশা কর্মীরা ধর্মঘট করেছেন তাও তাঁরা এক মূহুর্তও দ্বিধা না করে এই সর্বভারতীয় ধর্মঘটে যোগ দেন।
এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে বহু অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়নের প্রকল্প কর্মীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ধর্মঘটে সামিল হন ছত্তিসগড়ের রায়পুর, কোরবা, আসামের ডিব্রুগড়ে, মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণায়।
১) কোভিড ডিউটিরত প্রকল্প কর্মীদের সম্মুখসারির কর্মী হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। অবিলম্বে সর্বসাধারণের জন্য বিনামূল্যে ভ্যাকসিন এবং সম্মুখসারির কর্মীদের জন্য অগ্রাধিকার দিতে হবে। ভ্যাকসিন তৈরি দ্রুত বাড়াতে হবে এবং সরকারী নিয়ন্ত্রণে বন্টন করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সকলের ভ্যাকসিন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
২) প্রকল্প কর্মী যারা অতিমারী-নিয়ন্ত্রণে যুক্ত এবং অন্যান্য সম্মুখসারির কর্মী, স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য সমস্ত রকমের প্রতিরোধক পোষাক ও যন্ত্রের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। সম্মুখসারির কর্মীদের মাঝে মাঝেই কোভিড১৯ পরীক্ষা করতে হবে। কোভিড আক্রান্ত হলে সম্মুখসারির কর্মীদের হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৩) স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জিডিপি’র ৬ শতাংশ ধার্য করতে হবে। সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং পরিকাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে কোভিড সংক্রমণ বেড়ে গেলে হাসপাতালে শয্যা, অক্সিজেন এবং অন্যান্য চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া যায়। এরজন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করতে হবে। কোভিড-হীন রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও সরকারী হাসপাতালে নিশ্চিত করতে হবে।
৪) কর্মরত অবস্থায় সম্মুখসারির কর্মীদের মৃত্যুর ঝুঁকির জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বীমা করতে হবে এবং তাদের পরিবারের প্রত্যেকের জন্যও বিনামূল্যে কোভিড চিকিৎসা করতে হবে।
৫) কোভিড ডিউটিরত সমস্ত চুক্তিবদ্ধ ও প্রকল্প কর্মীদের মাসিক দশ হাজার টাকা কোভিড ঝুঁকি ভাতা দিতে হবে। সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের বকেয়া বেতন এবং ভাতা অবিলম্বে মেটাতে হবে।
৬) ডিউটিরত সমস্ত কর্মীদের, যারা কর্মরত অবস্থায় কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ন্যূনতম দশ লক্ষ টাকা দিতে হবে।
৭) শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোড প্রত্যাহার করতে হবে। প্রকল্প কর্মীদের শ্রমিকের বর্গে যুক্ত করতে হবে। সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের নাম ই-শ্রম পোর্টালে ‘নিষ্পত্তির অপেক্ষায়’ বর্গে পঞ্জীকৃত করতে হবে।
৮) কেন্দ্রীয় উদ্যোগভূক্ত প্রকল্প যেমন আইসিডিএস, এনএইচএম এবং এমডিএমএস — এগুলির স্থায়ীকরণ এবং প্রয়োজনীয় অর্থ বাজেটে বরাদ্দ করতে হবে। আইসিডিএস এবং এমডিএমএস প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের জন্য অবিলম্বে উচ্চমানের রেশন যোগান দিতে হবে এবং পরিযায়ীদেরও এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৯) ৪৫তম এবং ৪৬তম আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্প কর্মীদের শ্রমিক হিসাবে মান্যতা দিতে হবে, ন্যূনতম বেতন প্রতিমাসে ২১,০০০ টাকা, পেনশন প্রতি মাসে ১০,০০০ টাকা, ইএসআই এবং পিএফ চালু করতে হবে।
১০) বর্তমানে চালু বীমা প্রকল্প (ক) প্রধানমন্ত্রী জীবন জ্যোতি বীমা যোজনা, (খ) প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বীমা যোজনা, (গ) অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বীমা যোজনা — এগুলি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের এতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
১১) মিড-ডে-মিল কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে যখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি ও অন্যান্য ছুটি চলবে। কোন কেন্দ্রীভূত রান্নাঘর বা চুক্তিপ্রথায় এগুলো চালানো চলবে না।
১২) করোনা-কালের জন্য মাসিক মাথাপিছু দশ কেজি খাদ্যশস্য দিতে হবে। মূল্যবৃদ্ধি রদ করতে হবে, আয়করহীন পরিবারগুলিকে ছয়মাসের জন্য মাসিক ৭,৫০০ টাকা দিতে হবে; কাজ এবং আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে সকলের জন্য।
১৩) স্বাস্থ্যক্ষেত্রে (হাসপাতাল সহ), পুষ্টিক্ষেত্রে (আইসিডিএস এবং এমডিএমএস) এবং শিক্ষাক্ষেত্রের মতো মৌলিক পরিষেবাকে বেসরকারীকরণ করার পরিকল্পনা প্রত্যাহার করতে হবে। এনডিএইচএম এবং নয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ২০২০ প্রত্যাহার করতে হবে। পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজেস এবং পরিষেবাক্ষেত্র বেসরকারীকরণের প্রচেষ্টা বন্ধ কর।
১৪) সমস্ত প্রকল্প-বিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহার কর।
১৫) সরকারী প্রকল্পের সুবিধা প্রাপকদের নাম ডিজিটাইজেশনের নামে বাতিল করার চক্রান্ত বন্ধ কর। ‘পোষণ খোঁজা’ ‘পোষণ বটিকা’ ইত্যাদির নামে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের হয়রানি বন্ধ কর।
১৬) খাদ্যের অধিকার এবং শিক্ষার অধিকারের মতো সবার জন্য স্বাস্থ্য অধিকারের আইন করতে হবে।
১৭) অর্থের সংস্থানের জন্য মহাধনীদের ওপর ট্যাক্স বসাও। ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্প’র মত সমস্ত প্রকল্প বাতিল কর।
১ অক্টোবর উত্তর ২৪ পরগণার ‘পশ্চিমবঙ্গ সংগ্রামী রন্ধন কর্মী (মিড-ডে-মিল) ইউনিয়ন’ ৫ দফা দাবিতে ব্যারাকপুর এসডিও অফিস অভিযান করে। দাবি ছিল,
(১) ২০২০ সালের ন্যায় ২০২১ সালেও ১২ মাসের ভাতা দিতে হবে,
(২) অন্যান্য স্কীম কর্মীদের মতো শারদোৎসবে বিশেষ অনুদান দেওয়া,
(৩) প্রতিটি রন্ধন কর্মীদের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রতিমাসে ভাতা দেওয়া,
(৪) মিড-ডে-মিলের নাম পাল্টানো চলবে না,
(৫) মিড-ডে-মিল কর্মীদের সরকারের নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে।
প্রায় দেড় শতাধিক রন্ধনকর্মী ব্যারাকপুর স্টেশন থেকে মিছিল করে প্রশাসনিক ভবনে যান। মিছিলের দৃপ্ত শ্লোগান রাস্তার দু’ধারের পথচলিত মানুষের নজর কেড়েছে। ডেপুটেশনে পাঁচজন প্রতিনিধির মধ্যে ছিলেন কর্মরত রন্ধনকর্মী রীনা নাথ, মঞ্জু দত্ত, মিলি কর্মকার, ইউনিয়নের রাজ্য নেত্রী অর্চনা ঘটক এবং এআইসিসিটিইউ জেলা সভাপতি নারায়ণ দে। সভায় বক্তব্য রাখেন রন্ধনকর্মী দীপিকা সেন ও কাকলি চক্রবর্তী। খড়দহ বিধানসভা উপনির্বাচন দিন ঘোষণা হওয়ায় এসডিও নির্বাচনী কাজে ব্যস্ততার জন্যে ডেপুটেশন নিতে পারেননি। তবে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দু’বার কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। রন্ধন কর্মীদের ভাতা বৃদ্ধি নিয়ে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে তা বোঝা যায় অল্প সময়ে রন্ধনকর্মীদের উপস্থিতি। সুযোগ আছে রাজ্যব্যাপী কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার।
২ অক্টোবর বিষ্ণুপুরের এসডিও এবং এএলসি’কে গণডেপুটেশনে দাবিপত্র জমা করে এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত বিষ্ণুপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন। সকালে গান্ধীজির প্রতিকৃতিতে মাল্যদানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় অবস্থান। যে মহাত্মা সারাজীবন অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সাফাই কর্মীদের অধিকার রক্ষার তাগিদে সংগ্রাম চালিয়েছেন এবং সর্বোপরি যাঁর আদর্শকে ব্যাবহার করে স্বচ্ছ ভারত অভিযান চালানোর কথা বলছে কেন্দ্রীয় সরকারও, সেখানে সাফাই কর্মীদের বোনাস ও বেতন না দেওয়া এক চরম প্রতারণার উদাহরণ।
বিষ্ণুপুর থানার হস্তক্ষেপে আলোচনার কথা ঠিক হয়। সেইমতো পৌর কর্তৃপক্ষের সহিত ইউনিয়নের প্রতিনিধি দিলবার খান ও দিলীপ বাউরি কথা বলেন। পৌর কর্তৃপক্ষের আশ্বাস, আগামী দু’মাসের মধ্যে দাবি মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এবং শ্রমিকদের দাবিপত্র তাঁরা উচ্চতর কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠিয়েছেন। এরকম নানা প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস আগেও মিলেছে কিন্তু বাস্তবে কোন সুরাহা মেলেনি। তাই ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা তাঁদের আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
“বিষ্ণুপুর শহরবাসীর কথা মাথায় রেখে শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখার স্বার্থে বিশেষত শারদীয়া উৎসব ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে কোনোরকম কর্মবিরতি না করেই তীব্রভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে” বলে ঘোষণা করেন ইউনিয়নের সভাপতি ফারহান হোসেন খান। তিনি আরো বলেছেন, “রাজ্যের অস্থায়ী পৌরকর্মীদের জন্য ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ন্যুনতম ৮,৯০৪ টাকা বেতন ও ৪,৫০০ টাকা বোনাস ঘোষণার আশাব্যঞ্জক নির্দেশ রাজ্য সরকার করে থাকলেও স্থানীয় পৌরপ্রশাসন সেই নির্দেশে ন্যূনতম আমল করছেন না”।
৪ অক্টোবর, শিক্ষার স্বার্থে, শিক্ষার্থীদের স্বার্থে, রাজ্যজুড়ে ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে আইসা সহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলি বিকাশ ভবন অভিযানের ডাক দেয়। পুলিশী আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে ৫২জন কমরেড গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে আন্দোলনের চাপে, তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। জেল থেকে ফেরার পর পরবর্তীতে বৃহত্তর আন্দোলনের শপথ নিয়ে যাদবপুর ৪নং গেটের সামনে প্রতিবাদ সভা হয়। সভায় আইসার পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন রাজ্য সভাপতি নীলাশিস।
শিকল ভাঙার আন্দোলন জারি থাকবে।
দাবি একটাই, ক্যাম্পাস খোলা চাই। হোক আনলক!
বেতাইয়ে আদিবাসী মহিলা ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডর বিরুদ্ধে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পাঁচ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল ৩ অক্টোবর ঘটনাস্থলে সরেজমিন পর্যবেক্ষনের পর দাবি জানালেন — দ্রুত তদন্ত করে অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিদর্শন দলে ছিলেন জেলা কমিটির সদস্য দিলীপ মজুমদার, আলতাফ হোসেন, জীবন কবিরাজ, বিজয় সাহা ও বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জী।
আদিবাসী পরিবার ও গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে প্রতিনিধিদল জানান — ৩০ সেপ্টেম্বর রাত ৯ টা নাগাদ বেতাই থেকে দুই কিমিঃ দূরবর্তী সীমান্ত এলাকায় নফরতপুর গ্রামের সর্দার পাড়ায় সীমা সর্দার (নাম পরিবর্তিত)-কে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয় তারপর খুন করে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। মহিলার স্বামী বাইরে কাজ করেন। ঘরে তাঁর একটি বিবাহিত ছেলে রয়েছে। কেউ কিছু বোঝার আগে যেভাবেই হোক দুস্কৃতিরা এই নৃশংস অপরাধ সংগঠিত করে। পরদিন সকালে পুলিশ দেহ উদ্ধার করে। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায় বেতাইয়ের লালবাজার এলাকার কিছু যুবক ঐ পাড়ায় নিয়মিত আসা যাওয়া করতো। পাড়ার কিছু যুবক ও মহিলাদের থেকে জনৈক সঞ্জয় ভক্ত (নাম পরিবর্তিত)-র নাম জানতে পেরে তার বাড়ীতে পুলিশ যায়। দেখা যায় সে পলাতক। স্বভাবতই সে সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। পুলিশ তদন্তের জন্য সেখানকার একটি ছেলে ও একজন মহিলাকে তুলে নিয়ে আসে। যথারীতি নির্যাতিত মহিলার চরিত্র নিয়ে কিছু মানুষ নানারকম মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অপরাধকে লঘু করে দেওয়ার জন্য এই অপপ্রয়াসের আমরা তীব্র বিরোধিতা করছি। ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও উপযুক্ত তদন্ত করে অপরাধীদের আজও গ্রেপ্তার করা গেলো না কেন? পুলিশ প্রশাসনের কাছে আমরা এই প্রশ্ন তুলে ধরছি। এই দাবীতে ৬ অক্টোবর তেহট্ট থানায় ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ৫ অক্টোবর কৃষ্ণনগরে এসপির কাছে অনুরূপ দাবিতে ডেপুটেশন দেওয়া হয়, ডেপুটেশনে ছিলেন অমল তরফদার, রণজয় সেনগুপ্ত ও জয়তু দেশমুখ।
কলকাতা সহ পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলা, দিল্লী, মুম্বাই, আমেদাবাদ, চন্ডীগড়, গৌহাটি থেকে শতাধিক অধ্যাপক, গবেষক, শিক্ষক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশাসনিক পদাধিকারী গত ২২ সেপ্টেম্বর গণস্বাক্ষর সহ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কাছে এক আবেদন পত্র পাঠিয়েছেন। ঐ আবেদনে এক আদিবাসী অধ্যাপকের প্রতি বিভাগীয় আরেক অধ্যাপকের জাতিবিদ্বেষী আচরণের প্রতিবিধান দাবি করা হয়েছে।
আবেদনপত্রে বলা হয়েছে,
“সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পাপিয়া মান্ডির প্রতি ওই বিভাগের অধ্যাপক ড. নির্মল বেরার ধারাবাহিক জাতিবিদ্বেষী আচরণ, লাঞ্ছনা ও অপমানজনক মন্তব্যের ঘটনার প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এঘটনা ইতিমধ্যেই জনসমক্ষে এসেছে। মহাবিদ্যালয় স্তরেও মাতৃত্বকালীন ছুটি ও বকেয়া বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। সেই মর্মে তিনি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে অভিযোগ জমা করেছেন। এই ঘটনায় আমরা শ্রীমতী মান্ডির সহনাগরিক হিসেবে এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো প্রগতিপন্থী রাজ্যের বাসিন্দা হিসেবে উদ্বিগ্ন।
আদিবাসী ও দলিত পরিবারভূক্ত শিক্ষকদের জাত তুলে লাঞ্ছনা, চাকরি ক্ষেত্রে সংবিধান সম্মত জাতভিত্তিক সংরক্ষণের বিরুদ্ধে বিষোদগার এবং অসভ্য, অসহনীয় ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনা বারংবার সামনে আসছে, অধ্যাপক মান্ডির প্রতি এই জাতিবিদ্বেষ তাতে আরেকটি গুরুতর সংযোজন। কিছুদিন আগে খড়গপুর আইআইটি’র অনলাইন ক্লাসরুমে শিক্ষকের জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য, বছর দুয়েক আগে রবীন্দ্রভারতীতে চারজন অধ্যাপকের অভিজ্ঞতা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের নিগ্রহ — এসবই একদিকে রাজ্যবাসীর কাছে লজ্জার, এবং অন্যদিকে এক গভীর সমস্যার সূচক। এই প্রকার বিদ্বেষ ও বিভাজনের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের স্পষ্ট অবস্থান সত্ত্বেও এগুলো যেভাবে ঘটে চলেছে তা সংবিধান এবং সরকারি নির্দেশনামারও লঙ্ঘন।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও রাজ্যের উচ্চশিক্ষা কাউন্সিল যাতে অধ্যাপক পাপিয়া মান্ডির অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে ও দ্রুত তদন্ত করে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় সে ব্যাপারে আপনার হস্তক্ষেপের আবেদন জানাচ্ছি।
যেহেতু জাতিবিদ্বেষী মনোভাব বহুভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থিত আছে তাই এইসব ক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে পরবর্তীতেও নানাভাবে অসহযোগিতা বা নীরব হেনস্থার শিকার হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, রাজ্যের উচ্চশিক্ষা কাউন্সিল ও রাজ্য সরকারী প্রশাসনকে এটাও নিশ্চিত করার আবেদন জানাই, যাতে শ্রীমতী পাপিয়া মান্ডিকে এরকম প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে না হয়।”
আবেদন পত্রে স্বাক্ষর করেছেনঃ তনুশ্রী হাঁসদা, মেরুনা মুর্মু, রাহী সরেন, সুব্রত টুডু, গুহীরাম কিস্কু, বিশ্বজিৎ মান্ডি, গণেশ টুডু, শত্রুঘ্ন টুডু, ড. মীর রেজাউল, ড. সুবীর মৈত্র, প্রদীপ বসু, সমীর সাহা, তনিকা সরকার, কুমার রাণা, অচিন চক্রবর্তী, উত্তম ভট্টাচার্য, কুমকুম রায়, মল্লারিকা সিংহ রায়, মৃন্ময় প্রামাণিক, আদিত্য শুক্লা, সৌপর্ণ অধিকারি, আজিমুদ্দিন আশররাফি, ওয়াসিম শেখ, ফিরোজ মোল্লা, দীপাঞ্জন চক্রবর্তী, সৈয়দ মিনাজ হোসেন, সায়েরি বসু, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, শুভজিত রায়চৌধুরি, পিনাকপানি নাথ, চন্দ্রদ্বীপ খামরাই, অরুণাভ অধিকারী, মঞ্জীরা সিনহা, ইন্দ্রজিৎ মণ্ডল, ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী, তারা সিংহ, সায়ন প্রধান, শাইলাভ বদরা, প্রবাল দাশগুপ্ত, গুরুপ্রসাদ কর, শশাঙ্ক রায়, রামিজ রহমান, শুভেন্দু বিকাশ ঘোষ, তমাল গুহ, তথাগত গুপ্ত, সোমশঙ্কর ভট্টাচার্য, হাবিবি আহমেদ মোল্লা, সুদীপ মণ্ডল, দেবায়ন জানা, চিরঞ্জীব সিংহ, ড. সাইফুল্লা সামীম, অনুরাধা রায়, জয়তী দাস, রোচনা দাস পোদ্দার, কুণাল চট্টোপাধ্যায়, উভজিৎ নস্কর, মানস ঘোষ, প্রবুদ্ধ ঘোষ, শিল্পা মণ্ডল, সৌনক রায়, নবনীতা চক্রবর্তী, অমিত দাশগুপ্ত, প্রশান্ত শর্মা, পাপিয়া সেনগুপ্ত, শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত, ইন্দ্রাণী মিত্র, সাদ্দাম হোসেন মণ্ডল, রক্তিম সুর, নবনীতা মুখার্জী, অভিজিৎ মজুমদার, ড. তামস রঞ্জন মজুমদার, অজিত রায়, শামিম আহমেদ, সোমা মারিক, পূর্বাশা মণ্ডল, বিশ্বরূপ ঘোষ, সঙ্ঘমিত্রা দাস, শ্যামলেন্দু মজুমদার, মাহফুজ আলম, পৃথা চট্টোপাধ্যায়, মিলন দত্ত, কণিষ্ক চৌধুরি, পার্থপ্রতিম রায়, দীপান্বিতা বসু, বিরাজলক্ষ্মী ঘোষ, সায়নদেব চৌধুরী, দীপ্যমান গাঙ্গুলী, অভিজিৎ করগুপ্ত, পার্থ সারথি মণ্ডল, শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তব্রত দাস, দেবর্ষি দাস, সায়ন চক্রবর্তী, দেবপ্রসাদ মাইতি, শুভাদিত্য ভট্টাচার্য, শোভন চক্রবর্তী, সৌমিত্র নন্দী, প্রিয়দর্শী শতপথী, সুনন্দা চট্টোপাধ্যায়, দেবপ্রতীম দাস, অরিত্র বিশ্বাস, মন্দিরা দাস, মধুমিতা কুণ্ডু, সুরজিৎ দাস, সায়ন লাহিড়ী, রিয়াজুল হক, গার্গী সেন, শেষাদ্রী মজুমদার, রাজেশ কর্মকার, সাহাবুব জাহেদি, স্বরূপ কান্তি সরকার, লোপামুদ্রা মুখোপাধ্যায়, পৌষালি মুখোপাধ্যায়, রম্যাণি চক্রবর্তী, অয়ন চক্রবর্তী, সৌরভ মণ্ডল, অঙ্কন প্রামাণিক, সঙ্কেত দাস, অভিরূপ নস্কর, অঞ্জিষনু বিশ্বাস, অনিন্দ্য বসু, অর্ঘ্য বিশ্বাস, আয়াজ আহমেদ, সৌগত গুহ, দিব্যেন্দু বিশ্বাস, সৌম্যশঙ্কর চক্রবর্তী, অরূপ কুমার মাইতি, বিদ্যা মণ্ডল, প্রণতি জানা, প্রসেনজিত সেন, সুদীপ্ত দাস প্রমুখ আরও অনেকে।
৩ অক্টোবর এক প্রেস বিবৃতিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার বলেন, “ভবানীপুর উপনির্বাচন সহ বাকি দুটি কেন্দ্র, জঙ্গীপুর ও সামসেরগঞ্জ বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে গত ২০-২৫ দিন ধরে রাজ্য রাজনীতি যথেষ্ট আলোড়িত হচ্ছিল। বিশেষত ভবানীপুর কেন্দ্রে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হওয়ায়। বিজেপি ভবানীপুর কেন্দ্রে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীকে পরাজিত করার জন্য। ভবানীপুরকে খিদিরপুর/মিনি বাংলাদেশ না বানানোর আহবান জানিয়ে কুৎসিত সাম্প্রদায়িক প্রচারের পাশাপাশি হিংসা ও উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছিল যেকোনও অজুহাতে নির্বাচন স্থগিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের উপর চাপ সৃষ্টি করা, এমনকি আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত ভবানীপুর সহ তিনটি কেন্দ্রের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং তিনটি কেন্দ্রেই বিপুল মার্জিনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। ভবানীপুর কেন্দ্রে রেকর্ড মার্জিনে মমতা ব্যানার্জি বিজেপি প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন।
এই নির্বাচন বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি ও দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশলকে আরও একবার উন্মোচিত করলো।
উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের আত্মহারা হবার কোনও অবকাশ নেই। রাজ্যের ৮টি জেলায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ বন্যা কবলিত, নিদারুণ যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছেন, অজানা সংক্রমণে উত্তরবাংলার বিভিন্ন জেলায় শিশু মৃত্যু হচ্ছে। রাজ্য সরকার ও প্রশাসনকে আপৎকালীন ভিত্তিতে মানুষকে উদ্ধার করা ও রক্ষা করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।”
উত্তরাখন্ডে ২০২২’র বিধানসভা নির্বাচনে তিন বাম দল ‘বিজেপি হটাও, বাম বিরোধীপক্ষ’ শ্লোগান তুলে যুক্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এই ঘোষণা করা হয়েছে গত ২২ সেপ্টেম্বর দেরাদুনে আয়োজিত এক যুক্ত সংবাদ সম্মেলনে। উপস্থিত ছিলেন উত্তরাখন্ডের সিপিআই রাজ্য সম্পাদক সমর ভান্ডারী, সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক রাজেন্দ্র সিং নেগী ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশন রাজ্য সম্পাদক রাজা বহুগুণা। তিনটি বামপন্থী দলের নেতৃবৃন্দ বলেন, উত্তরাখন্ডে লুঠ ও দুর্নীতির রাজনীতিকে রুখে দিতে এক স্বাস্থ্যকর গণতন্ত্রের প্রয়োজন খুবই, তারজন্য যে কার্যকরি বিরোধীপক্ষের উপস্থিতি থাকা দরকার সেটার অভাব থাকছে। এই অভাব পূরণ করাই বাম দলগুলির লক্ষ্য, সেই উদ্দেশ্যেই বিধানসভার ভিতরে জনগণের কণ্ঠস্বর পৌঁছে দিতে হবে, আর এজন্যই বাম দলগুলি নির্বাচনে যুক্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এবং জনমুখী প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করবে।
মোদী সরকারের ধ্বংসাত্মক নীতিগুচ্ছ উত্তরাখন্ডের জন্য বিপর্যয় প্রমাণিত হয়েছে, এর নির্দিষ্ট নজীর হল ২০১৮ সালে তৈরী হওয়া ভূমিসংস্কার আইন ও সমস্ত ধরণের আবহাওয়া উপযোগী সড়ক নির্মাণের প্রশ্ন। উত্তরাখন্ডের বিজেপি জমানা বরাবর স্মরণে থাকবে বেকারি, মুদ্রাস্ফীতি, ভেঙে পড়া শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং নিরন্তর মুখ্যমন্ত্রী বদলের কারণে। যেখানে বিজেপি, কংগ্রেস ও আম আদমী পার্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ক্ষমতার জন্য, সেখানে বাম দলগুলির লক্ষ্য হল বিধানসভার অভ্যন্তরে সাধারণ জনগণের বক্তব্য তুলে ধরা।
[ গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ অল ইণ্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন (এআইবিইএ)-এর পশ্চিমবঙ্গ ইউনিট আয়োজিত বেসরকারিকরণ বিরোধী এক ওয়েবিনারে আমন্ত্রিত বক্তা কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের ভাষণ ]
অল ইণ্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের জন্ম ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে। অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ১৯২০ সালেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ভারত যখন ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছিল, ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ নিজেদের অধিকারের লড়াইকে দেশের স্বাধীনতাকামী এবং ভারতের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সম্পদের জাতীয়করণের লড়াইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল। ১৯৪৭এ জাতীয় স্বাধীনতার পরে ভারতের মূল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোর ধারাবাহিক জাতীয়করণের জন্য মঞ্চ তৈরি হয়ে গেল। ১৯৫৬ সালে জীবন বীমার জাতীয়করণ হয়। আর তার পর পর ১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্ক এবং ১৯৭৩ সালে কয়লাখনি জাতীয়করণ হয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এই অভিমুখই নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। আজ এই অভিমুখকে মারাত্মক বিপজ্জনক গতিতে একেবারে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের উচ্চকিত আবাহণ আসলে ভারতীয় অর্থনীতির মূল ক্ষেত্রগুলির আগ্রাসী বি-জাতীয়করণ বা বেসরকারিকরণের রণহুঙ্কার।
পুঁজি গড়ে তোলায় ব্যাঙ্ক একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তারা সাধারণ মানুষকে সঞ্চয় ব্যাঙ্কে রাখতে আকৃষ্ট করে তা থেকে ঋণ পুঁজি তৈরি করে। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মাধ্যমে ব্যাঙ্কগুলি স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা পেয়েছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও সম্পর্কিত গ্রামীণ ও সমবায় ব্যাঙ্কের অজস্র শাখা বিস্তারের মাধ্যমে ব্যাঙ্কশিল্প বিপুল প্রসার লাভ করেছে। যদি ব্যাঙ্কঋণ কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলিকে সহায়তার উদ্দেশ্যে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষেত্রগুলিতে চালিত হত তাহলে সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি আরও বড় ভূমিকা রাখতে পারতো। প্রকৃতপক্ষে সেটা কখনোই ঘটেনি। বেসরকারি বড় বড় বাণিজ্যিক সংস্থা ব্যাঙ্কঋণের বেশিরভাগটা ছিনিয়ে নিয়েছে। ক্রোনি পুঁজির উত্থানের পর থেকে, কোম্পানিগুলির নেওয়া ঋণ ক্রমশ বেশি বেশি করে ‘খেলাপী’ ঋণে রূপান্তরিত হচ্ছে, সুললিত ভাষায় যাকে ‘নন-পারফর্মিং অ্যাসেট’ বা এনপিএ বলা হয়। আর পরের পর সরকারগুলো এইসব ঋণের বেশির ভাগটাই ‘রাইট অফ’ করার (ব্যাঙ্কের হিসেবের খাতার বাইরে রাখার) পথেই হেঁটেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাঙ্কের সংকটের এটাই মূল কারণ। আর মোদী সরকার এই সংকটকেই, ব্যাঙ্কগুলিকে ধারাবাহিকভাবে বি-জাতীয়করণ বা বেসরকারিকরণের পথে ঠেলে দিতে কাজে লাগিয়ে চলেছে।
অন্যভাবে বললে, ক্রোনি পুঁজি ব্যাঙ্কিং নীতিকে পথভ্রষ্ট ও বিকৃত করার জন্য যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাকে গোটা ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ক্ষেত্রটিকে দুর্বল ও ধ্বংস করা এবং এটিকে আরও সরাসরি কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে আনার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। শোধ না করা ঋণের পাহাড়ের ওপর বসে থাকা বাণিজ্য সংস্থাগুলো, যাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সরকারের মদতে এমনকি দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন, এখন তাদের হাতে ব্যাঙ্কিং শিল্পের লাগাম তুলে দেওয়া হচ্ছে। এতদিন ঋণ দখল করেছে, এখন তারা নিজেরাই ঋণ কারখানা নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করবে। ব্যাঙ্কিং-সংকটের সমাধানের নামে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার আসল তাৎপর্য এটাই! সংযুক্তিকরণ (বড় ব্যাঙ্কের সঙ্গে ছোটগুলোকে মিশিয়ে দেওয়া) এবং গোটা ব্যাঙ্ক ব্যবসাকে সংহত করে এক সুতোয় গেঁথে ফেলা, ‘রাইট অফ’ করা ও খেলাপি ঋণ কিনে নেওয়া থেকে শুরু করে প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলোর জন্যে সুযোগ সম্প্রসারিত করা ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর সরাসরি বেসরকারিকরণ — ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার সংস্কারের এইসব পদক্ষেপের নিশানা হচ্ছে, যাকে আমরা এককথায় বলতে পারি, ব্যাঙ্ক শিল্পের বেসরকারিকরণ। ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার পাশাপাশি বীমা ক্ষেত্রটিরও বেসরকারিকরণ চলছে।
আর্থিক ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ মোদী সরকারের ধ্বংসাত্মক বৃহত্তর বেসরকারিকরণ উদ্যোগের অপরিহার্য অংশ। স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবহন থেকে পরিকাঠামো নির্মাণ ও সংরক্ষণ — সবক্ষেত্রেই সরকার অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিজের দায় ঝেড়ে ফেলছে এবং অর্থনীতিটাকে বেসরকারি খেলুড়েদের হাতে তুলে দিচ্ছে। যেহেতু নয়া উদারবাদী নীতিগুলি এক বিরাট সংকটে পড়েছে এবং বেসরকারিকরণের অবস্থান ক্রমশ উন্মোচিত ও একটি খারাপ ধারণা হিসেবে নিন্দিত হচ্ছে, পর পর সরকারগুলো সরকার-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বা পিপিপি ধরণ, বিলগ্নীকরণ, আউটসোর্সিং-এর মত বাঁকা পথ নিয়েছে। আর এক্ষেত্রে নবতম সংযোজন মোদী সরকারের সাম্প্রতিকতম ‘অ্যাসেট মানিটাইজেশন’ নীতি। গুপ্ত বেসরকারিকরণের এইসব পদক্ষেপে, রাষ্ট্রীয় মালিকানা অক্ষুণ্ণ থাকার এক মিথ্যা গল্প জিইয়ে রেখে সরকার মানুষকে বিভ্রান্ত করছে আর তলে তলে কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ আর স্থায়ী রাজস্ব বেসরকারি হাতে তুলে দিচ্ছে।
সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসা ‘ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন’ প্রকল্পটিকে একটু নিবিষ্ট চোখে খুঁটিয়ে দেখা যাক। এই প্রকল্পের অভীষ্ট লক্ষ্য হল, গড়ে ন্যূনতম চল্লিশ বছরের জন্য ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে সরকারি বা জাতীয় সম্পদ ভাড়া দেওয়া। ঐ লিজ-এর মেয়াদ ৪০ বছরে পর পর দুটি ভারতীয় প্রজন্ম ভোটাধিকার প্রাপ্তির উপযুক্ত হয়ে উঠবে! লিজের জন্য তালিকাভুক্ত সম্পদগুলি হল — সড়ক ও রেল পরিবহন, জাহাজ বন্দর ও বিমান বন্দর, পাওয়ার ট্রান্সমিশনের নেটওয়ার্ক, টেলিকম্যুনিকেশন এবং ইন্টারনেট পরিষেবা সংযোগের মত ১৩টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। বেসরকারি কর্পোরেশনগুলোর, এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলির বিপুল সম্ভার শোষণের একচেটিয়া নিরঙ্কুশ অধিকার পাওয়া আসলে খুব বিরাট মাপের সম্পদ লুঠের প্রকাশ্য কর্মসূচি ছাড়া আর কিছু নয়! এই তথাকথিত ‘অ্যাসেট মানিটাইজেশন’এর মাধ্যমে আগামী চার বছরে সরকারি কোষাগারে যে অর্থ জমা পড়বে বলে দেখানো হচ্ছে, তা ভারতের দুটি শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেট সংস্থা ঐ সময়ে, তাদের সম্পদ অর্জনের বর্তমান হারে যা আয় করবে তার দশভাগের মাত্র একভাগ, নতুন করে দখল নেওয়া সম্পদ থেকে অর্জিত অতিরিক্ত আয়কে হিসেবের বাইরে রেখেই বলা যায়। সরকারি কোষাগার যখন ধুঁকবে, বিজেপি’র বেনামে কর্পোরেট ক্যাশ সংগ্রহ করা ইলেক্টোরাল বন্ডগুলো তখন ফুলে ফেঁপে উঠবে, যেহেতু মোদী সরকার তার ঘনিষ্ঠতম কর্পোরেট বন্ধুদের দেশের মূল্যবান সম্পদ উপহার দিয়ে দিচ্ছে।
বেসরকারিকরণ চাকরির বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং শ্রমিকদের অধিকারকে ক্ষয় করবে। সম্পদের হস্তান্তরের সঙ্গে সঙ্গে ইউনিয়নের ও যৌথ দরকষাকষির অধিকার সহ নিরাপদ চাকরির সুযোগ ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাবে। সরকারি চাকরির সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাওয়া মানে, সংরক্ষণের মাধ্যমে নিপীড়িত শ্রেণীর মানুষদের এমনকি সীমিত পরিমাণে যেটুকু সামাজিক গতিশীলতা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ আছে সেক্ষেত্রেও বিপর্যয়কর পরিবর্তন ঘটতে থাকবে। আর এই সংকটজনক পরিবর্তন ছাড়াও অসংগঠিত ক্ষেত্রে আসবে আরও বড় আঘাত। লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, রাস্তার ফেরিওয়ালা, দিনমজুরি উপার্জন করেন যারা, সকলের জীবিকায় নেমে আসবে এক বিপর্যয় যেহেতু তাদের নতুন ভাবে কর্পোরেট অধিকৃত সম্পদের পরিসর থেকে উৎখাত হতে হবে। বেসরকারিকরণের প্রভাবে এইভাবে একদিকে যেমন কর্পোরেটদের সম্পদ ফুলে ফেঁপে উঠবে, আরেক দিকে জনসাধারণের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলবে। বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক মাত্রাটিকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। যদি আমরা মোদী সরকারের বেসরকারিকরণ হামলাকে রুখতে ও তার অভিমুখ পাল্টে দিতে ইচ্ছুক থাকি, এটা নিশ্চয়ই সম্ভব এবং একান্তই দরকার।
কর্পোরেট ক্ষমতার সম্প্রসারণ ও তাকে সংহত তথা সুদৃঢ় করার স্বার্থেই বেসরকারিকরণ। বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াই তাই কর্পোরেট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। আর এই সংগ্রামে, ব্যাঙ্ক কর্মচারী ও শ্রমজীবী শ্রেণীর ব্যাপকতর অংশ চলমান কৃষক আন্দোলনে দৃঢ় মৈত্রীবদ্ধ সহযোগী হয়ে উঠেছে। গত প্রায় একবছর ধরে, ভারতের কৃষকরা আদানি-আম্বানি কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ঐক্য ও দৃঢ় সংকল্পের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। এই যুদ্ধ মোদীরাজের কৃষক বিরোধী ও কর্পোরেট-মুখী চরিত্রকে একেবারে নগ্ন করে দিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী বলেই চলেছেন, তার সরকারের কোনও ব্যবসায়ে থাকার মতলব নেই। দেশবাসী এখন খুব ভালোই বুঝেছেন মোদী সরকার এখন কোন্ ব্যবসায়িক লেনদেনের মধ্যে আছে। সরকারটা সারাক্ষণ গালভরে ‘আত্মনির্ভর ভারতের’ শ্লোগান আউড়ে, তার আড়ালে আসলে কর্পোরেটদের স্থায়ী সমর্থন কেনার জন্যে জাতীয় সম্পদ বেচায় ব্যস্ত। আরও বেশি বেশি করে মানুষ এই খেলার গূঢ় অর্থ অনুধাবন করছেন ও দেশবাসীর টাকায় দশকের পর দশক ধরে গড়ে ওঠা জাতীয় সম্পদের এই মর্মপীড়াদায়ী কলঙ্কজনক বিক্রির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের, জাতীয় সম্পদ বেচা, এই বিদেশি ও ভারতীয় কর্পোরেট লুঠেরাদের কাছে ভারতকে নিলামে তোলা বন্ধের জন্য বৃহত্তর জনগণের প্রচারাভিযানে সামিল হতে হবে।
কৃষকদের আন্দোলন থেকে আমাদের সকলের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখার আছে। এটি শুরু হয়েছিল মোদী সরকারের কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে। কিন্তু যখন সরকার কৃষকদের কথা শুনতে অস্বীকার করল এবং কৃষক আন্দোলনকে কৃষক বিরোধী প্রচার ও দমনপীড়ন দিয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করল, কৃষকরা খুব দ্রুতই বুঝে নিয়েছিলেন যে আইন বাতিলের জন্য এই সরকারটাকে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। আজ কৃষক আন্দোলন মোদী সরকারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিস্পর্ধা হয়ে উঠেছে এবং রাস্তায় থেকে সরকারের উদ্দেশে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের আন্দোলন গত তিন দশক ধরে শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিরোধের পুরোভাগে আছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি যদি এখনও ব্যাঙ্কিং পরিষেবাক্ষেত্রে আধিপত্যকারী অবস্থানে থাকে, ব্যাঙ্কগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার কৃতিত্ব নিশ্চিতপক্ষে ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ লড়াইয়ের। কিন্তু এখন সরকারের সর্বাত্মক হামলার মুখে প্রতিরোধকেও হতে হবে সর্বাত্মক। কৃষক আন্দোলনের মতো, শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনকেও হয়ে উঠতে হবে এই সরকারের শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।
বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুধু চালু ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য রক্ষণাত্মক সংগ্রাম নয়। এটি কর্পোরেটদের সেবা নয়, জনগণকে পরিষেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্কিং পরিষেবাক্ষেত্রের নীতি ও অগ্রাধিকারে পরিবর্তন আনারও এক সংগ্রাম। এটি সেই ঋণদান রীতি বা আদর্শ পরিবর্তনের সংগ্রাম যে রীতি ঋণগ্রস্ত কৃষককে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়, মাইক্রোফিনান্স প্রকল্পগুলিকে অত্যাচারী চক্রে পরিণত করে, যার নিশানা গরিব মহিলারা যারা জীবিকার প্রয়োজনে ঋণ নিয়েছেন। এই নীতির সৌজন্যে, ভর্তুকিযুক্ত ঋণ নিয়ে ক্রোনি পুঁজিপতিরা পালাচ্ছেন এবং মেগা ঋণখেলাপীদের পর্যায়ক্রমিক বেলআউট প্যাকেজে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াই কর্পোরেট শক্তির এবং লাগামছাড়া এই শক্তির সমর্থনে বেড়ে ওঠা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যাপকতর লড়াইয়ের এক অপরিহার্য অংশ। আমরা চাই এই সংগ্রামে এআইবিইএ এবং ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে বিজয়। এই লক্ষ্যে আমাদের পূর্ণ সংহতির অঙ্গীকার থাকলো।
আজ পর্যন্ত মানবতার সামনে সবচেয়ে বড় সংকট হিসাবে আছড়ে পড়ে কোভিড১৯। এই অতিমারি সৃষ্ট নজিরবিহীন স্বাস্থ্য সংকট দুনিয়া জুড়ে প্রায় সমস্ত ধরনের আর্থিক কর্মকান্ডকে স্তব্ধ করে দেয়, ঘনিয়ে তোলে কল্পনাতীত আর্থিক বিপর্যয়। এই স্বাস্থ্য বিপর্যয় দুনিয়াব্যাপী যে অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনে তার সুদুরপ্রসারি প্রভাব পড়েছে কর্মক্ষেত্রে — লক্ষ কোটি শ্রমজীবী মানুষ রুটি রুজি হারিয়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন চরম আর্থিক দুর্দশার নিঃসীম অন্ধকারে। দুনিয়া জুড়ে এই অতিমারি মোকাবিলায় নানা পদ্ধতি প্রকরণের মধ্যে লকডাউন ছিল অন্যতম এক হাতিয়ার, আর মোদীর ঘোষিত লকডাউন ছিল পৃথিবীর মধ্যে নির্মমতম, কঠোরতম। লকডাউন-১ এর পর জনজীবনে তার বিপর্যয়কারী প্রভাব সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমীক্ষা প্রকাশ করে আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়। যা আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত। সেই রিপোর্ট অতিমারী বিপর্যস্ত নাগরিকদের রুটি রুজি আর্থিক সুরক্ষা দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একাধিক প্রস্তাব দেয়, যা মোদী সরকারের স্বভাবধর্ম ঔদ্ধত্য ও অনুভূতিহীন মনোভাবের দ্বারা প্রত্যাখাত হয়। এই প্রথম, সংসদের শ্রম সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটি এক পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করে, ‘ইম্প্যাক্ট অফ কোভিড১৯ অন রাইজিং আনএমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড লস অফ জবস্/লাইভলিহুড ইন অরগানাইজড অ্যান্ড আনঅরগানাইজড সেক্টরস্’। সংসদের দুই কক্ষ — লোকসভা ও রাজ্যসভায় এই রিপোর্ট পেশ করা হয় গত ৩ আগস্ট ২০২১। বলা যায়, এটাই প্রথম প্রকাশিত সরকারি ভাষ্য, আর সেকারণে এর গুরুত্ব আছে বৈকি। এতে প্রকাশিত হয়েছে লকডাউনের ফলে সাধারণ মানুষের অসীম যন্ত্রণা, দুঃখ দুর্দশার ধারাবিবরণী। রয়েছে আর্থিকভাবে বিধ্বস্ত গরিব মানুষদের ব্যাঙ্কে সরাসরি নগদ প্রদানের প্রস্তাব, এই পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা পদক্ষেপ সম্পর্কে মন্তব্য। কিছুটা প্রশংশা, কিছুটা সমালোচনা। তবে বেশ তথ্য সমৃদ্ধ এই রিপোর্ট জানিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের থেকে শুরু করে অন্যান্য অসংগঠিত শ্রমিকদের দুরাবস্থার কথা, মনরেগা প্রকল্পকে আরও প্রসারিত করা, শহুরে কর্মসংস্থানকে উৎসাহিত করা ইত্যাদি।
এই রিপোর্ট তৈরি করার প্রক্রিয়ায় স্ট্যান্ডিং কমিটি এআইসিসিটিইউ সহ ১২টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের কাছ থেকে লিখিত বক্তব্য নেওয়ার পাশাপাশি সাক্ষাতেও মতামত নেয়, সরাসরি বাণিজ্য ও বণিক সংস্থাগুলোর মতামতও সংগ্রহ করে।
আইএলও’র রিপোর্ট, ‘কোভিড১৯ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ার্ক’কে উল্লেখ করে সংসদীয় কমিটি জানাচ্ছে এটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘনিয়ে ওঠা ১৯৩০’র বিরাট মন্দার পর সবচেয়ে মারাত্বক আর্থিক সংকট, যা দুনিয়াব্যাপী ২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের কাজ কেড়ে নিয়েছে। যা আর কোনদিন ফিরে আসবেনা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ইনফর্মাল সেক্টরের সাথে যুক্ত পৃথিবীর দরিদ্রতম অগণন শ্রমজীবী মানুষ। আর, আইএলও’র রিপোর্ট (যা এই কমিটি উল্লেখ করেছে) অনুযায়ী ৪০ কোটি ইনফর্মাল শ্রমিক চরম দারিদ্রের কবলে পড়বে।
শ্রম সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট জানিয়েছে, সংগঠিত ক্ষেত্রেও ব্যাপক মাত্রায় কর্মচ্যুতি হয়েছে। সিএমআইই’র তথ্য উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, ২০২০তে সংগঠিত ক্ষেত্রের অর্ধেক শ্রমশক্তি ফর্মাল থেকে ইনফর্মাল ক্ষেত্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, আয়ের ক্ষেত্রে বিরাট মাত্রায় সংকোচন হওয়ায় উৎকট বৈষম্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, কাজ হারানো ও মজুরি হ্রাস পাওয়ায় জাতীয় ন্যূনতম মজুরির নিচে নতুন করে প্রবেশ করেছে ২৩০ কোটি মানুষ। এই হিসাব আগে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় উঠে আসে। এবার বলা যায়, তাতে পড়ল সরকারি শিলমোহর। জুন ২০২০’র পর অর্থনীতি আবার মুখ তুলেছে বলে কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি কার্যত খারিজ করে কমিটির রিপোর্ট জানাচ্ছে যে লকডাউন ও বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার পর আর্থিক কর্মকান্ড আবার শুরু হলেও আর্থিক পুনরুজ্জীবন থমকেই থাকে। ২০২০’র ডিসেম্বরে প্রায় ২০ শতাংশ শ্রমিক কাজ হারানোর পর তা আর ফিরে পাননি, আর সবচেয়ে চিন্তাজনক বিষয় হল, ওই সময়কালে (২০২০’র ডিসেম্বর) পরিবার পিছু প্রকৃত আয় প্রাক অতিমারির সাপেক্ষে কমে যায় ১২ শতাংশ হারে! কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ সন্দেহাতীত ভাবে প্রথমটির তুলনায় আরও অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক থাকলেও সেই সময়কার কোন সমীক্ষা এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। তবে নানা সূত্র ও প্রামান্য তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে দ্বিতীয় পর্বে ইনফর্মাল সেক্টরে আঘাত আরও অনেক বেশি মারাত্মক ছিল। দারিদ্র সীমার অনেক নিচে নতুন করে আরও অসংখ্য মানুষ নিক্ষিপ্ত হন, কাজ খোয়ানো মানুষের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।
কমিটির রিপোর্ট কর্মহীনতা সংক্রান্ত সিএমআইই’র যে তথ্য উল্লেখ করেছে তা ২০২০’র এপ্রিল-জুন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু তার পরের চিত্র পাওয়া যায় প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী অধ্যাপক কৌশিক বসুর লেখায়। তিনি উক্ত সংস্থার ২ সেপ্টেম্বরের রিপোর্ট তুলে দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র আগস্ট মাসে ১৫ লক্ষ মানুষ কাজ হারায়, আর কর্মহীনতার হার জুলাই মাসে ছিল ৬.৯৫ শতাংশ, যা মাত্র একমাসে, আগস্টে লাফ দিয়ে বেড়ে হয়েছে ৮.৩২ শতাংশ! এটা স্পষ্ট, আরো গভীর সংকট দেশের অর্থনীতিকে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে।
কমিটির রিপোর্টে অনেকগুলো দিক আলোচিত হয়েছে। দীর্ঘ রিপোর্টে মূল মূল কিছু বিষয় ও তার সুপারিশ সম্পর্কে আমরা এখানে দৃষ্টিপাত করবো।
কর্মহীনতা
সংসদীয় কমিটির এই রিপোর্ট স্পষ্ট ভাবেই তুলে ধরেছে যে কোভিডের আগে থেকেই দেশে কর্মহীনতা উত্তুঙ্গে ছিল, আর অতিমারি সেই মরার উপরই নামিয়ে আনলো খাঁড়ার ঘা। মোদী সরকার যা কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না। তারা এইভাবেই দেখায় যেন সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল, হঠাৎ কোভিড এসে সাজানো বাগানটাকে লন্ডভন্ড করে দিল। কমিটির রিপোর্ট সেই মান্যতা দিল না। রিপোর্ট আরও একবার জোরের সাথে ঘোষণা করল যে, দেশের ৯০ শতাংশ শ্রমিকই হলেন ইনফর্মাল, ৪৬ কোটি ৫ লক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে ৪ কোটি ১৯ লক্ষ ইনফর্মাল ক্ষেত্রভুক্ত! বিপুল এই বাহিনীর কাজের মরশুমি চরিত্র, শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে অস্পষ্টতা, এই কারণগুলোই এদের দুর্দশা আরও বেশি ডেকে আনে। গভীর উদ্বেগের সঙ্গে রিপোর্ট লিখেছে, এই বিরাট সংখ্যক মানুষের কর্মহীনতা, ক্রমে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা বেকারত্ব, তীব্র ঋণগ্রস্থতা, পরিবারের সদস্যদের অপুষ্টি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত এই করুণ অবস্থা দেশের অর্থনীতির উপর দীর্ঘ এক ছায়া বিস্তার করে আগামী দিনে অপরিসীম ক্ষতি ডেকে আনবে যা আর মেরামত করা যাবে না। গোটা এই ক্ষেত্রকে সংগঠিত চেহারা দেওয়া (বলাই বাহুল্য, এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ), উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, তাঁদের বর্তমান জীবন যাপনের চারপাশের অবস্থাকে আরও উন্নত ও মজবুত করা, আকর্ষণীয় রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচের চারপাশে নিয়ে আসা, নতুন নতুন উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা — এই সমস্ত সুপারিশ করেছে কমিটি। সর্বোপরি, কোভিড অতিমারীতে বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত বিপুল ইনফর্মাল শ্রমিকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি নগদ অর্থ পাঠানোর জোরালো সুপারিশ করা হয়েছে।
সাবেক ক্ষেত্রগুলোতে আরও অনেক বেশি সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’কে মজবুত করতে স্থানীয় স্তর থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেক্টরে নতুন নতুন প্রযুক্তি এনে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবার প্রস্তাব ও রাখা হয়েছে। অন্যান্য ইনফর্মাল শ্রমিকদের মতো, এই অতিমারি মারাত্মকভাবে আঘাত নামিয়েছে মহিলা-অল্পবয়সী তরুণ ও স্বনিযুক্ত পেশার মানুষদের উপর। অসংগঠিত ক্ষেত্রের পাশাপাশি কোভিড যে সংগঠিত ক্ষেত্রকেও মোক্ষম আঘাত দিয়েছে, তা কমিটির রিপোর্ট উল্লেখ করেছে।
আরেকটা নজরকাড়া সুপারিশ করেছে এই কমিটি। এযাবৎ অনুসৃত আর্থিক বৃদ্ধির গতিপথকে আমূল বদলে কর্মসংস্থানমুখী শ্রমনিবিড় শিল্প গঠনের কথা বলা হয়েছে, যে শিল্প অনিয়মিত অসংগঠিত শ্রমশক্তি মারফত পরিচালিত হবেনা, বরং তা হবে অনেক সংগঠিত চরিত্র সম্পন্ন, শ্রমশক্তিকে আরও দক্ষতা সম্পন্ন করতে যেখানে গড়ে তুলতে হবে নানা ধরনের ইউনিট। ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে মেরামত ও আধুনিক করতে বিশেষ আর্থিক বরাদ্দ এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবাকে আইনী বাধ্যতা দিতে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কোভিডকালে, কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত ক্ষেত্রে কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী অল্প কিছু সংখ্যক কর্মীর চাকরিতে ছেদ, অনিয়মিত বেতন, বা বেতন না পাওয়ার অভিযোগ থাকলেও বেশিরভাগ বা সর্বত্রই তার সমাধানের রিপোর্ট পাওয়া গেছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত ক্ষেত্রগুলোতে এ প্রশ্নে রেকর্ড মোটেই ভালো নয় বলে জানাচ্ছে কমিটি। এপ্রিল ২০২০ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত পর্যায়ে কর্মীদের কাছ থেকে বহু অভিযোগ পাওয়া গেলেও সেগুলোর সমাধান হয়নি। এব্যাপারে যে রাজ্য সরকারগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে, সেগুলো হল মহারাষ্ট্র, দিল্লী, হরিয়ানা, কর্ণাটক, পশ্চিমবাংলা ও উত্তরাখন্ড।
নির্মাণ শ্রমিক
কোভিডের প্রথম ঢেউ’র সময়, কমিটির কাছে পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন রাজ্য নির্মাণ শ্রমিকদের সরাসরি নগদ অর্থ প্রদান করেছে। কমিটি জানাচ্ছে, আনুমানিক ৫,৬১৮ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে ১ কোটি ৮২ লক্ষ ৪৪ হাজার ২৭৮ নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নির্মাণ শ্রমিকরা নাকি টাকা পেয়েছেন পশ্চিমবাংলায় —২১ লক্ষ ৯৮ হাজার ৩৪৯ জন। পশ্চিমবাংলা, অন্ধ্র প্রদেশ, ওড়িশা, উত্তর প্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও বিহার — এই সাতটি রাজ্য ছাড়া আর কোনও রাজ্যই এমনকি দ্বিতীয় কোভিডের বিধ্বংসী ছোবলের সময়ে ও নির্মাণ শ্রমিকদের নিজস্ব কল্যাণ তহবিলের থেকে অর্থ প্রদান করেনি।
কমিটি সুপারিশ করেছে, আরও ব্যাপক সংখ্যায় ও মাত্রায় নতুন নতুন নির্মাণ শ্রমিকদের নথিভুক্ত করতে হবে, পুরানো সমস্ত শ্রমিকদের নাম নবীকৃত করতে হবে, নথিভুক্তির প্রক্রিয়া আরও সহজ সরল ও শ্রমিকদের বোধগম্য করতে হবে যাতে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে পারেন।
অন্যান্য অসংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ও নির্মাণ শ্রমিকদের অভিজ্ঞতার আলোকে অনুরূপ সেস তহবিল গঠন করার প্রস্তাব কমিটি দিয়েছে।
পরিযায়ী শ্রমিক
কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, লকডাউনের প্রথম ধাক্কায় বিভিন্ন রাজ্য থেকে নিজভূমে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা ১ কোটি ১৪ লক্ষ ৩০ হাজার ৯৬৮। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিভিন্ন রাজ্য থেকে পাঠানো তথ্য থেকেই কমিটি ওই রিপোর্ট দিয়েছে। আর, দ্বিতীয় কোভিডের ঢেউ’র সময় ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যাটি হল ৫ লক্ষ ১৫ হাজার ৩৬৩। উল্লিখিত রিপোর্টে এরাজ্যের সরকার যে তথ্য দিয়েছে তা হল, প্রথম লকডাউনের সময় ফিরে আসা শ্রমিকদের সংখ্যা হল ১৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৬৯৩। উত্তর প্রদেশ (৩২ লক্ষ ৪৯ হাজার ৬৩৮) ও বিহারের (১৫ লক্ষ ৬১২ হাজার) পরই এরাজ্যের স্থান। বুঝতে অসুবিধে হয় না, গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার মোদীর দাবির বিপরীতে মমতার রাজ্যে কৃষিতে তিনগুণ আয় বৃদ্ধির গালগপ্পো নিছক অন্তঃসারশূন্য আরেকটি ভাওতা মাত্র। পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যাই তা প্রমাণ করে।
প্রথম লকডাউনের পর পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নেমে আসা হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা, অশেষ লাঞ্চনা ও বর্ণনাতীত কষ্ট নেমে আসার পরেও কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবলেশহীন মনোভাবকে তীব্র সমালোচনা করেছে কমিটি।
মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প
কাজ হারা ডুবন্ত মানুষের একমাত্র সহায় হিসাবে এই প্রকল্পটি যেন পরিত্রাতার ভূমিকা নিয়ে লকডাউন পরবর্তী দুঃসময়ে আবির্ভূত হয়। যে প্রকল্পটিকে নিয়ে মোদী একসময়ে তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গ করেন। এই প্রকল্পটিকে আরও সম্প্রসারিত করা, বিপুল অর্থ বরাদ্দ, পরিবার পিছু কাজ বরাদ্দ না করে পরিবারের সদস্য পিছু কাজ দেওয়া, ন্যূনতম ২০০ দিনের কাজ ও কাজের শেষে সাথে সাথে মজুরি প্রদান এবং সমস্ত মনরেগা শ্রমিকদের বাধ্যতামূলকভাবে স্বাস্থ্যবিমার অধীনে নিয়ে আসতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে কমিটি। এই ধরনের সুপারিশ করেন বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্রী জয়তী ঘোষ, আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়।
এরই পাশাপাশি শহুরে গরিবদের এই দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কমিটি একাধিক প্রকল্প চালু করতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখে। শুধু আর্থিক বিষয় নয়, শহুরে গরিবদের আশ্রয়, বাসস্থান, সু-চিকিৎসার পাশাপাশি তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ তৈরি করতে, নগদ অর্থ প্রদানের ও সুপারিশ করা হয়েছে। মূল অভিঘাত থেকেছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবার।
হকার
প্রধানমন্ত্রী স্বনিধি প্রকল্পের অধীনে হকারদের কার্যকরী মূলধন জোগাতে ৫০ লক্ষ হকারদের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার এক প্রকল্প ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার। এই প্রকল্পের অধীনে সমস্ত হকাররা পাবেন ১০ হাজার টাকার ঋণ। কমিটি জানাচ্ছে, এখন পর্যন্ত ওই প্রকল্পের সুবিধা নিতে ৪২.৪৫ লক্ষ আবেদন পত্র জমা পড়লেও মাত্র ২৫.০৩ লক্ষ আবেদনপত্র মঞ্জুর হয়েছে, ২,১৩০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে ২১.৫৭ লক্ষ উপভোক্তাকে, ২৮ জুন ২০২১ পর্যন্ত। এর থেকেই প্রমাণিত, কেন্দ্রীয় সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত ‘স্টিমুলাস প্যাকেজ’গুলোর আসল পরিণাম।
শ্রমজীবী মহিলা
বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত, ভারতীয় শ্রম বাজারে মহিলা শ্রমিকদের স্থান হচ্ছিল না। যাঁদের কোনোক্রমে জায়গা হয়েছে, তাঁরাও মজুরির প্রশ্নে পুরুষদের তুলনায় বিরাট ফারাক নিয়ে মুখবুজে কাজ করে যাচ্ছেন। আইএলও’র সমীক্ষা দেখাচ্ছে, জেন্ডার ওয়েজ গ্যাপে ভারত সবচেয়ে এগিয়ে।
অতিমারির সুদুরপ্রসারি সর্বব্যাপী আঘাত মহিলাদের আরও বেশি করে ছিটকে দিয়েছে কাজের বাজার থেকে। যেগুলো পড়ে আছে, তা ভীষণ ধরণের শ্রমসাধ্যই শুধু নয়, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মহিলা শ্রমিকদের প্রশ্নে কমিটির রিপোর্ট খুবই দায়সারা। মূল সমস্যার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। যে অসংখ্য শ্রমজীবী আশা কর্মীরা কোভিড যোদ্ধা হিসাবে মুখবুজে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে গেলেন গোটা কোভিড১৯’এ, তাঁদের সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষার কোনও সুপারিশ এই কমিটির তরফ থেকে দেখা গেলনা। এ প্রশ্নে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশগুলো খুবই উল্লেখযোগ্য। স্কিম কর্মীদের অস্তিত্বই যেন কমিটি বেমালুম চেপে গেছে। আর, শ্রমজীবী মহিলাদের সামাজিক সুরক্ষার মতো কিছু মামুলি কথাবার্তা কিছুটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে উল্লেখিত হয়েছে।
এই কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জানতে চায়, কোভিডে কতজন শ্রমিকের প্রাণহানি হয়েছে। দেখা গেল, এ প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কোনও তথ্য নেই। তারা শুধু এটা জানিয়েছে ইএসআই একটা প্রকল্প চালু করে। কোভিডে মৃত শ্রমিক ইএসআই ভুক্ত হলে তাঁর উপর নির্ভরশীল পরিবার সেই প্রকল্প অনুযায়ী কিছু আর্থিক সাহায্য পাবেন। আর, ২৫ জুন ২০২১ পর্যন্ত মৃত পরিবারগুলোর তরফ থেকে ওই প্রকল্পের জন্য মাত্র ৪১৭ আবেদন বা ক্লেইম জমা পড়েছে। বলাই বাহুল্য, ভারতে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক আজও ইএসআই’র বহু যোজন দূরে অবস্থান করছে। তাই তাঁদের খবর রাখার কোন প্রতিষ্ঠান আজও এই দেশে গড়ে ওঠেনি। এদিকে, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রক জানিয়েছে, ৭ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত তাদের দপ্তরের হিসাবে দেশে মোট ৪ লক্ষ ৪ হাজার ২১১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে কোভিডের কারণে। মোদী সরকারের এটা হল আরেকটা ডাহা মিথ্যাচার!
যেখানে মোদী সরকার শ্রমকোডের মাধ্যমে হরণ করে নিতে চাইছে এযাবত শ্রমিকদের পিএফ-ইএসআই’র মতো সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচগুলো, সেখানে এই কমিটি কিছুটা ভিন্ন কথা শুনিয়েছে। এই দুটো সংস্থা যেন তাদের লিখিত নির্দেশিকা বা প্রকল্পের নিগড়ে বন্দী না থেকে এই গভীর দুঃসময়ে মানব কেন্দ্রীক, সহানুভূতি সম্পন্ন মনোভাব নিয়ে ব্যাপকতম দরিদ্র পীড়িত লাঞ্ছিত শ্রমজীবী মানুষের পাশে কিভাবে দাঁড়াতে পারে, তারজন্য উদ্ভাবনী উপায় বার করার পরামর্শ দিয়েছে।
বেশ কিছু প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশংসা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে উভয় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রচ্ছন্ন ও তীর্যক সমালোচনা রয়েছে এই রিপোর্টে। তবে এটা কবুল করা দরকার, এই প্রথম আমলা নির্ভর বদ্ধ ঘরে বসে প্রতিবেদন তৈরি করার পরিবর্তে সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন সহ বহুপক্ষীয় আলাপ আলোচনা, মত বিনিময় ও গ্রহণ করার এক ইতিবাচক মনোভাব দেখা গেছে গোটা এই প্রক্রিয়ায়, মোদী জমানায় যা সত্যিই বিরল।
ক্ষমতার অলিন্দ্য থেকে উঠে আসা কিছু ভিন্ন ধরনের সুর বোধহয় শোনা গেল এই প্রথম।
- অতনু চক্রবর্তী
কেন্দ্রের ‘আশা প্রকল্প’, ‘জননী সুরক্ষা যোজনা’ ও ‘মাতৃ বন্দনা যোজনা’, রাজ্য সরকারের ‘বাংলা মাতৃ প্রকল্প’ — মা ও সদ্যোজাতর কল্যাণে কত না যোজনা, কত না ঘোষণা! কিন্তু বিসমিল্লায় গলদ! বাস্তবে আজও শিশুর জন্মলগ্নটা অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কায় মোড়া।
সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির হুগলি জেলা শাখার তরফ থেকে পোলবা-দাদপুর, ধনিয়াখালি, পান্ডুয়া, বলাগড়, মগরা — এই পাঁচটি গ্রামীণ ব্লকে আগষ্ট-সেপ্টেম্বরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেল সর্বত্র ব্লক হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা থাকলেও বলাগড়, পোলবা-দাদপুর ও মগরায় সিজারিয়ান ডেলিভারির কোনো ব্যবস্থা নেই। সুতরাং সিজারিয়ানের প্রয়োজন হলে তাঁদের যেতে হবে সেই সদর হাসপাতালে। আর প্রতি সপ্তাহে পান্ডুয়ায় মাত্র একদিন, ধনিয়াখালিতে চারদিন সিজারিয়ান হয়। অর্থাৎ অন্য দিনগুলোতে যদি কোনো সন্তানসম্ভবার সিজারিয়ানের প্রয়োজন হয় তবে তাঁকে ছুটতে হবে সদর হাসপাতালে। আবার সিজারিয়ানের জন্য নির্ধারিত ঐ দিনগুলোতে ব্লকের ডাক্তাররা গর্ভবতীর কোনো জটিলতা দেখলে সদর হাসপাতালে রেফার করে দেন। কারণ ব্লক হাসপাতালে সিজারিয়ানের কোনো উন্নত ব্যবস্থা নেই। অথচ সরকার নাকি মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে!
পরিকাঠামোগত সমস্যাও অনেক আছে। প্রয়োজনের তুলনায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স এবং বেড অপ্রতুল। কোনো হাসপাতালেরই নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স নেই। পেশেন্ট পার্টি ১০২ নম্বরে ফোন করে মাতৃযান অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে পারেন। কিন্তু সবসময়ে তা পাওয়া যায় না। তখন ‘আশা’ দিদিরা প্রাইভেট গাড়ির ব্যবস্থা করে সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট গাড়ি, ভ্যান রিকশা যাই হোক না কেন আসন্ন প্রসবাকে খানা-খন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে দীর্ঘ পথ বেয়ে নিয়ে যাওয়া ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। তাতে মা ও গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা অনেক সময় আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে, এমনকি প্রাণহানিরও নজির আছে। তাই গর্ভবতী ও তাঁর পরিবারের লোকজন অনেক সময় সদর হাসপাতালে যাওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে ধার-দেনা করে হলেও কাছাকাছি কোনও নার্সিংহোমে যেতে বাধ্য হন। যাঁদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে তাঁদের কিছুটা আর্থিক সুরাহা হয় বটে, কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রসব না হওয়ার জন্য প্রসূতিরা নার্সিংহোমে যাতায়াতের কোনও গাড়ি ভাড়া এবং প্রসবের পর মায়েরা সরকারি প্রকল্পের যে প্রাপ্য অর্থ — কোনোটাই পান না। যাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব হয় সেই মায়েদেরও যদিও কেন্দ্রের ‘মাতৃ বন্দনা যোজনা’র ৬,০০০ টাকা ও রাজ্যের ‘বাংলা মাতৃ প্রকল্প’র ৫,০০০ টাকা প্রাপ্য, তা ধাপে ধাপে পাওয়ার কথা, কিন্তু খুব ছোট্ট অংশই পাচ্ছেন এখন। অর্থাৎ কিনা, মা ও শিশুর পুষ্টির প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অজুহাত — করোনাকাল! আবার যে ‘আশা’ দিদি গর্ভবতীকে প্রায় দশ মাস নিষ্ঠার সাথে পরিষেবা দেন তিনিও সরকারি হাসপাতালে প্রসব বাবদ প্রাপ্য ৩০০ টাকা থেকে বঞ্চিত হন।
এছাড়া ব্লক হাসপাতালে সদ্য-ভূমিষ্ঠ শিশুর কোন শারীরিক সমস্যা হলে, সেখানে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় তাকে সদর হাসপাতালে সিক নিউবর্ণ স্টেবিলাইজেশন ইউনিটে (এসএনএসইউ) রেফার করা হয়। তখন সদ্যোজাতকে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়াও অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোই গর্ভবতীদের মূল পরিষেবা কেন্দ্র। অথচ সেখানে গাইনোকোলজিস্ট নেই। সেই দায়িত্ব পালন করতে হয় এএনএম (অক্সিলিয়ারি নার্স মিডওয়াইফ)দের।
মেয়েদের আরও ভোগান্তির কথা জানা গেল। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিভিন্ন রকম টেস্ট হওয়ার কথা, কিন্তু সর্বত্র তা হয় না। গ্রামীণ হাসপাতালগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। পান্ডুয়া ব্লকে চারটি হাসপাতালের মধ্যে বিএলএম মুখার্জি বৈঁচি গ্রাম হাসপাতাল ও ইটাচুনা হাসপাতাল দুটি চলছে। পোলবা-দাদপুর ব্লকে এখন নামে চারটি হাসপাতাল, কিন্তু কি করুণ হাল, পোলবার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রই মানুষের ভরসা। তবে ভালো পরিষেবার জন্যে পোলবা-দাদপুরের মানুষ সদর হাসপাতাল চুঁচুড়ায় চলে যান। ধনিয়াখালি ব্লকে চারটি হাসপাতালের মধ্যে মাদ্রা আর ধনিয়াখালি হাসপাতাল চলছে, বাকি দুটির মধ্যে বাগনান হাসপাতাল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে আর ভান্ডারহাটি হাসপাতালে বহু মানুষ আসতেন প্রাথমিক পরিষেবাটুকু পেতেন, স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থাও ছিল, এখন তা এক জরাজীর্ণ পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে! বলাগড় ও মগরা ব্লকে মাত্র একটা করে গ্রামীণ হাসপাতাল, তা মোটামুটি চলছে। ২০১৮ সালে ধনিয়াখালি হাসপাতালকে মুখ্যমন্ত্রী স্টেট জেনারেল হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করলেও, পরিষেবা ও পরিকাঠামোর কোনও উন্নতি আজও হয়নি। বর্তমানে কোভিড চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার তুলে নেওয়া হয়েছে শহরে, একটি হাসপাতাল বাদে প্রায় সর্বত্রই এখনও ডাক্তারদের ফিরিয়ে আনা হয়নি। গ্রামের প্রতি চিরন্তন অবহেলার আর এক নিদর্শন।
এই সমস্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে উপরোক্ত পাঁচটি ব্লকে আলোচনার জন্য মহিলা সমিতির প্রতিনিধিরা বিডিও এবং ব্লক মেডিক্যাল আধিকারিকদের ডেপুটেশন দেন। তাঁরা সমস্যাগুলোর কথা মেনে নিয়ে বলেন — আপনারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে ধরেছেন, এই কর্মসূচি চালিয়ে যান। এমনকি আরও নানা ঘাটতির তথ্য দিয়ে আমাদের সাহায্য করেন। যেহেতু সমাধানের ক্ষমতা তাঁদের হাতে নেই, তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে বলাগড় এবং পান্ডুয়া ব্লক প্রশাসন ভারপ্রাপ্ত ব্লকের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে ভীষণ উদাসীন। বরং সমিতির প্রতিনিধিরা এবিষয়ে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করান।
ভিতরে ডেপুটেশন চলাকালীন বাইরে সমিতির ব্যানারে বিক্ষোভ প্রদর্শন চলে ।
সমগ্র কর্মসূচি সফল করতে বিশেষ ভূমিকা নেন জেলা যুগ্ম সম্পাদিকা শিপ্রা চ্যাটার্জি ও চৈতালি সেন, সভানেত্রী শোভা ব্যানার্জি, অর্পিতা রায়, পার্বতী মুর্মু ও সাবিয়া খাতুন প্রমুখ। এছাড়া রন্ধন কর্মী ইউনিয়নের সদস্যরা, ‘আশা’ দিদিরা এবং কিছু সাধারণ মহিলারাও এব্যাপারে নানা ভাবে সহযোগিতা করেন। আমাদের সমীক্ষা চলবে এবং আরও কিছু কর্মসূচির নেওয়ার পরিকল্পনা আছে ।
গ্রাম বাংলায় ছোট পরিধির এই অনুসন্ধান ও আন্দোলন করতে গিয়ে সঙ্গী-সাথীদের যে উৎসাহ ও সাধারণ মানুষের তথা স্বাস্থ্য কর্মীদের যে সাড়া পাওয়া গেছে, তাতে দু’টি কথা বারবারই মনে হয়। এক, আরও কয়েকটি জেলায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য বহু ইস্যু তো রয়েছে তা নিয়ে এ ধরনের অনুসন্ধান-আন্দোলন গড়ে তোলা খুব প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, মা ও শিশুর সমস্যাগুলো বৃহত্তর জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের এক ক্ষুদ্র অঙ্গ মাত্র। এই ইস্যুতে রাজ্যস্তরে ‘একুশের ডাক’ ব্যানারে একটা কনভেনশন করা যেতে পারে। এবং সমস্যাগুলোর সমাধান মূলত: রাজ্য সরকারের ওপরেই বর্তায়, পরবর্তীতে স্বাস্থ্যভবন যাওয়া যায়।
মোদী সরকারের ‘আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প’ আর রাজ্য সরকারের ‘স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প’ হোক, কোনোটাতেই স্বাস্থ্য পরিষেবা ও পরিকাঠামোর সার্বিক উন্নতি হবে না। কোভিড১৯’এর ঝড় তা আরও একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ‘স্বাস্থ্য আমার অধিকার’ — এই দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সামিল করে বড় পরিধিতে আন্দোলন গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি।
- চৈতালি সেন
অতিধনী ‘দেশপ্রেমিক’দের ধনের প্রতি উগ্র লোভ মেটার নয়। তার সঙ্গে যদি সংগত করতে থাকে রাজনীতির ‘মহান’ নেতারা। ৫ বছর আগে ফাঁস হয়েছিল পানামা পেপারস। নাম ছিল কোটিপতি বানানোর মালিক বিখ্যাত অভিনেতার, ছিল দেশের ‘বরেণ্য’ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের। আরো অনেকের। কালো টাকা উদ্ধারে ‘কৃতসংকল্প’ প্রধান সেবক কী করেছেন তাদের? কেউ ভারতকে ‘স্বচ্ছ’ করার বিজ্ঞাপনে নিয়োজিত হয়েছেন তো কেউ সংসদ আলো করে রেখেছেন। ওদিকে কালো টাকা উদ্ধারের নাম করে গরিবকে আরো গরিব করেছেন প্রধান সেবক। ৫ বছর বাদে আবার ফাঁস হচ্ছে অতিধনী কিছু মানুষের কীর্তিকলাপ। প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ দলিল দস্তাবেজ ফাঁস হয়েছে। নাম এসে পড়েছে বহু ‘গুণীজনের’, দেশবিদেশের। যথাবিহিত এদেশের খ্যাতনামারাও রয়েছেন তালিকায়। এত কাগজ এত নাম যে নামকরণ হয়েছে ‘প্যান্ডোরা পেপারস’। কথিত আছে, অতিলোভী একজন প্যান্ডোরার বাক্স খুলেই বের করেছিল পৃথিবীর যত খারাপ বিষয়, পাপ, লোভ, ভয়, হতাশা ইত্যাদি। এবারের প্যান্ডোরার বাক্সও সন্ধান দিচ্ছে সেইসব পাপীদের।
প্যান্ডোরার বাক্স থেকে বেরিয়ে পড়েছে রাশি রাশি দলিল দস্তাবেজ, পাওয়া যাচ্ছে দেশবিদেশের সকল ‘দেশপ্রেমিক’ ধনী শিল্পপতি, গায়ক, খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদদের অর্থলগ্নির আইনি-বেআইনি-অতি আইনি তথ্যসমূহ। সবে গত রবিবার থেকে এসম্পর্কে জানাজানি হতে শুরু করেছে। ব্রিটেনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা, ‘বিবিসি’ ও ভারতের ‘দ্য ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ সমেত বিশ্বের ১৫০ টি প্রচার মাধ্যম সংস্থা নিয়ে গঠিত অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন (দ্য ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) দাবি করেছে তাদের হাতে প্রায় ১২০ লক্ষ গোপন দস্তাবেজ এসেছে যাতে বিশ্বের বহু অতি ধনীর গোপন আর্থিক লেনদেনের তথ্য রয়েছে। দেশবিদেশের তাবড় সব মানুষজনের সাগরপাড়ে বিনিয়োগের যে সমস্ত কাহিনী শোনা যাচ্ছে তাতে নাম শোনা যাচ্ছে এদেশের ক্রিকেট মহানায়ক শচীন তেন্দুলকার, শিল্পপতি অনিল আম্বানি, শিল্পপতি কিরণ শ মজুমদারের স্বামী জন শ-র । নাম রয়েছে পপ সঙ্গীত শিল্পী সাকিরা, নাম করা মডেল ক্লদিয়া শিফার প্রভৃতির। যদিও তেন্ডুলকার বা শাকিরা কিংবা শিফারের উকিলরা বলেছেন যে তাঁদের বিনিয়োগ আইন মেনেই হয়েছে। সাগরপাড়ে আর্থিক লেনদেনে জড়িত রাজনীতিবিদদের বিশ্বজোড়া পরিসংখ্যানের নিরিখে সংখ্যার দিক দিয়ে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে ভারত ও সপ্তম স্থানে পাকিস্তান।
আই সি আই জে-র বক্তব্য অনুযায়ী ওই সমস্ত গোপন দস্তাবেজ জর্ডানের রাজা, কেনিয়া, ইকুয়েডোর ও ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার প্রভৃতির সাগরপাড়ের আর্থিক লেনদেনের তথ্য প্রকাশ করছে। এছাড়াও রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিনের সাগরদের ও রাশিয়া, আমেরিকা, তুরস্ক ও অন্যান্য দেশের ১৩০ জন অর্বুদপতির (বিলিয়নেয়ার) নামও রয়েছে। আইসিআইজে-র মতে তাদের বিশ্বজোড়া অনুসন্ধান দেখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে সারা বিশ্বে আইনের শাসনকে দোমড়ানো মোচরানো ও ভাঙা চলছে সম্পদশালী দেশগুলির দ্বারা সৃষ্ট এক আর্থিক গোপনীয়তার মাধ্যমে। ওই সমস্ত গোপন দস্তাবেজ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের ১৪টা সাগপাড়ের পরিষেবা সংস্থার থেকে পাওয়া গেছে যেগুলি আর্থিক লেনদেন গোপনে রাখতে চায় এমন সব মক্কেলদের জন্য সাগরপাড়ে খোলস (শেল) কোম্পানি সৃষ্টি করে। আইসিআইজে-র অনুসন্ধান দেখিয়ে দিচ্ছে যে বিশ্ব রাজনীতিতে গোপন অর্থলগ্নি কীভাবে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে, যার ফলে সরকার ও বিশ্ব প্রতিষ্ঠানসমূহ সাগরপাড়ের আর্থিক অপব্যবহার রুখতে কিছুই করতে পারেনি।
২০১৬ সালের পানামা পেপার কান্ডের পরে ধনী ভারতীয়দের অনেকেই তাদের সাগরপাড়ের সম্পত্তি ও বিনিয়োগের নতুন বন্দোবস্ত করেছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা গুচ্ছের সাগরপাড়ের ট্রাস্ট তৈরি করেছে যাতে ব্যাঙ্ক বা অন্য ঋণদাতাদের পক্ষে তাদের সম্পত্তি ছোঁয়া সম্ভব না হয়। বিভিন্ন অর্থনৈতিক অপরাধে অভিযুক্তরা বিভিন্ন করমুক্ত দ্বীপে জাল বিছিয়ে রেখেছে।
প্যান্ডোরা পেপারের তথ্য অনুযায়ী ভারতীয় ব্যাঙ্কে হাজার হাজার কোটি টাকার খাতকরা তাদের সম্পত্তির এক বৃহৎ পরিমাণ সাগরপাড়ের কোম্পানিতে সরিয়ে দিয়েছে। একজন বর্তমানে জেলে থাকা অর্থনৈতিক অপরাধী একটি বোম্বার্ডিয়ার চ্যালেঞ্জার বিমান কিনেছে একটি সাগরপাড়ের সংস্তার মাধ্যমে। বহু সংস্তার প্রোমোটাররা তাদের ব্যবসায় ঋণ শোধে অপারগ হলে যাতে তাদের সম্পত্তিকে না ছোয়া যায় তাই সাগরপাড়ের ট্রাস্টে তা গচ্ছিত রেখেছে। এছাড়া রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যাক্তিরা রয়েছে। ভারতের সেরকম লোকেদের মধ্যে প্রাক্তন সাংসদরা আছে, আছে সরকারি কর্তাব্যক্তিরা। ফাঁস হয়ে যাওয়া দস্তাবেজ এমনটাও দেখাচ্ছে যে যাদের কাজ ছিল সাগরপাড়ের এই অর্থলগ্নির লেনদেনকে বন্ধ করার তারাও ওই ধরনের লুকোনো কোম্পানি বা ট্রাস্টে সম্পত্তি সরিয়েছে। যেমন, রাজস্ব বিভাগের প্রাক্তন কর্তা, একজন প্রাক্তন আয়কর কমিশনার, একজন প্রাক্তন সেনা কর্তা, একজন আইন বিভাগের কর্তা।
- অমিত দাশগুপ্ত
চতুষ্পার্শ্বে শুধু যন্ত্রণার জলছবি! প্রকৃতি রুষ্টা হইয়াছেন। গাঙ্গেয় উপত্যকায় অবস্থিতি এবং সমুদ্র সমীপবর্তী হওয়ায় বঙ্গভূমির উপর কোপ কিঞ্চিৎ বেশি।
কয়েকটি জেলায় ঘরবাড়ি চাষের জমি ফসল গবাদিপশু সকলই প্রবল জলস্রোতে ভাসিয়া গিয়াছে। কতজনের সলিল সমাধি হইয়াছে কে জানে! আশ্বিন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। আকাশ এখনও বিরহিনী কন্যার মতো সাশ্রুনয়না। কোথায় সেই স্বর্ণাভ উজ্জ্বল রৌদ্রে ভাসমান বর্ষণক্ষান্ত মেঘের ডিঙ্গা! কোথায় বা সরলা বালিকার মতো শেফালি-প্রভাত, কোথায় বা কাশের হাসি! শারদ প্রকৃতির সেই সবুজ-হিল্লোলিত গৌরবস্মিত ছবি জলবায়ু পরিবর্তনের দাপটে শুধু সাহিত্যের পাতায় বুঝি থাকিয়া যাইবে।
প্রকৃতির রুদ্ররোষের মাঝেই দিনকতক পূর্বে প্রভাতী দৈনিকের পাতায় এক ছবি নজর কাড়িয়াছিল। ক্যানিং-২ ব্লকের সারেঙ্গাবাদ গ্রাম পঞ্চায়েতের সিংহেশ্বর সাবস্টেশন। ব্যাগ কারখানার কারিগর এক নবীন যুবা নিজামুদ্দিন হাঁড়িমধ্যে সদ্যোজাত সন্তানকে ভাসাইয়া প্রায় কোমর জল ঠেলিয়া আশা দিদিদের নিকট চলিয়াছেন সন্তানদের পোলিও খাওয়াইতে। বড়টি ছিল পশ্চাদবর্তী সঙ্গীর স্কন্ধে। আশাদিদি ও এএনএম-রা সকাল হইতে সাপ জোঁকের সানন্দ বিচরণের মধ্যে প্রায় বুকসমান জলরাশি ঠেলিয়া ঠেলিয়া, কোথাও ভেলা ভাসাইয়া বাড়ি বাড়ি হাঁকিয়া ফিরিতেছিলেন। শুনা যায় স্বাস্থ্য অধিকর্তা দিদিদের কর্তব্যপরায়ণতায় মুগ্ধ হইয়া প্রশংসার বান ডাকিয়াছেন। (যদিও প্রশংসা নহে, তাহাদের দরকার সামাজিক সুরক্ষা, ন্যায্য বেতন, শ্রমিকের মর্যাদা।) সে যাহা হউক, আম জনতার পোলিও-সচেতনতা আর প্রকল্পকর্মীদের শিশু-স্বাস্থ্য ও পুষ্টির প্রতি প্রতিনিয়ত সতর্ক দৃষ্টি-উভয়ই অত্যন্ত স্বস্তির বিষয়।
কিন্তু এই ছবিটি ধূসর হইয়া গেল সাম্প্রতিক প্রায় প্রত্যহের এক উদ্বেগবার্তায়। উত্তরবঙ্গে এক অজানা জ্বরে আক্রান্ত হইয়া প্রতিদিন সদ্যোজাত হইতে ১০ বছরের বালক বালিকারা ব্যাপক সংখ্যায় হাসপাতালে ভর্তি হইতেছে। উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ, রায়গঞ্জ ও মালদহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুবিভাগ কার্যত দিশাহারা। শিলিগুড়ি, খড়িবাড়ি, ইসলামপুর, জলপাইগুড়ি, ফালাকাটা, চোপড়া অর্থাৎ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল হইতে তাহারা জ্বর তো বটেই, অন্যান্য উপসর্গ লইয়াও আসিতেছে। এবং অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হইল দিনকয়েক ধরিয়া প্রতিদিন তাহাদের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। কেহ জ্বর ও শ্বাসকষ্ট, কেহ জন্মকালে অত্যন্ত কম ওজন, কেহ জন্মের আগে-পরে অক্সিজেনের অভাবে, কেহ হইপারটেনসিভ এনসেফ্যালোপ্যাথি, কেহ হৃদরোগ ইত্যাদির কারণে মারা যাইতেছে। বর্ধমান ও বীরভূমেও শিশুদের এই জ্বর হানা দিয়াছে। শিশুর জন্মকালে ওজন কম হয় কেন? নিশ্চয়ই গর্ভধারণকালে মায়ের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর আহার জুটে নাই। এবং সেই সমস্যা ব্যক্তিগত স্তরে নাই, একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সমস্যা হইয়া উঠিয়াছে। কোভিড কালে গর্ভবতী মা ও শিশুর পরিচর্যা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হইয়াছে, সন্দেহ নাই। বিশেষজ্ঞরাই সঠিক কারণ নির্ণয় করিতে পারিবেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ইহা লইয়া স্বাস্থ্য প্রশাসনে বা নাগরিক পরিসরে কোন উচ্চ-বাচ্য নাই! কেন? তাহারা গরিবের সন্তান বলিয়া? উহারা তো এমনিই অনাহার, অপুষ্টি, রোগভোগ, সাপের কামড়ে, বজ্রাঘাতে মারা যাইবে! উহাদের জন্য অশ্রুপাতের আবশ্যকতা নাই ! ব্যাপারটা কি ইহাই? এই মৃত্যুস্রোত আজ পর্যন্ত অব্যাহত।
অতিবর্ষণে শহর ও শহরতলিতেও মৃত্যুর খতিয়ান বেদনাদায়ক যে মৃত্যু হয়তো অনিবার্য ছিল না। কলিকাতার আহিরীটোলা স্ট্রিটে জীর্ণ দ্বিতল বাড়ি অতিবর্ষণে ভাঙিয়া পড়িয়া প্রাণ কাড়িয়াছে এক শিশু ও প্রৌঢ়ার। আড়াই বৎসরের শিশু যাহার দিনকয় পরে নূতন জামাটি, সস্তায় ক্রীত বাহারী চটিটি পরিয়া হাতে বেলুন বা চরকি লইয়া পূজামণ্ডপে হাসিয়া খেলিয়া ছুটিয়া বেড়াইবার কথা ছিল, কাহার, কাহাদের অপরাধে তাহার সরল হাসিমুখটি চিরদিনের জন্য হারাইয়া গেল? কলিকাতায় নাকি ৩০০০টি বিপজ্জনক বাড়ি আছে যাহার ১০০টি এখনই ভাঙিয়া ফেলা উচিত। কিন্তু পুরসভা শুধু নোটিশ ঝুলাইয়া ক্ষান্ত কেন? কেন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক বাড়িগুলি ভাঙা যাইতেছে না? জটিলতা নাই তাহা নহে। প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িগুলি শরিকী সমস্যা ও বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া সংঘাতে জর্জরিত। অত্যন্ত অল্প ভাড়ায় তিন প্রজন্মের বসবাস। অনেকে রেন্ট কন্ট্রোলে ভাড়া জমা দেন। অনেক মালিকানা মামলা কন্টকিত। তথাপি সেগুলি ভাঙার দায় এড়ানো যায় না। গতকাল কলুটোলা স্ট্রিটে এইরূপ এক জীর্ণ বাড়িতে বিধ্বংসী আগুন লাগে। ইহাও আরেক বিপর্যয়। নামমাত্র ভাড়ার জন্য এইখানে যত গুদাম ঘর। তাহাতে বিবিধ দাহ্য পদার্থ মজুত থাকে। বৈদ্যুতিক তারের জটিল জটাজাল। সংকীর্ণ গলি। অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণের অপ্রতুল পরিকাঠামোর সুযোগ গ্রহণও হয়তো সে কারণে সম্ভব হয় না। কলুটোলার ঘটনায় অন্তত দশজন ফায়ার ফাইটার জখম হইয়াছেন।
খেপে খেপে অতিবর্ষণের মধ্যে আরেক বিপর্যয়-বিদ্যুৎ স্পষ্ট হইয়া মৃত্যু। সম্প্রতি নজিরবিহীনভাবে শহর ও শহরতলিতে তো বটেই, গোটা রাজ্য জুড়িয়া বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হইয়া কতগুলি প্রাণ একসঙ্গে চলিয়া গেল যাহার মধ্য কয়েকটি শিশু ও নাবালকও রহিয়াছে। এখানেও অনেকক্ষেত্রেই সেই একই সমস্যা। জীর্ণ বাড়ি বা আবাসনের জীর্ণতর ওয়্যারিং। ইহাদের মধ্যে সরকারি আবাসনও আছে। শুধুমাত্র কলিকাতা, দমদম, সল্ট লেকেই এবং পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের অধীনে ৭২টি সরকারি আবাসন আছে যাহার মধ্য ২৫টির এই মুহূর্তে সংস্কার প্রয়োজন। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর প্রাণের ঝুঁকি নিয়া বসবাস। সরকারের হেলদোল আছে?
জমা জল, বিদ্যুতের ছেঁড়া তার, জীর্ণ প্রকোষ্ঠে অভাবী সংসারের রুগ্ন শিশুর কান্না — এসব তো ছিলোই। আছে। থাকিবে। যতদিন নাগরিক-অধিকার উন্নত পুর পরিষেবার দাবিতে উচ্চকণ্ঠ না হইতেছে। প্রশাসন শহরের অভিজাত অঞ্চলের পরিষেবা লইয়া ব্যতিব্যস্ত। ঝাঁ চকচকে রাস্তা, বহুতল বিপণি, ফ্লাইওভার, দ্রুত ও পরিবেশ বান্ধব যান-এসব শহর উপহার পাইতেছে। কিন্তু এই কোভিড বিধ্বস্ত অর্থনীতির অনিবার্যতায় অনেকেরই কাজে যাওয়া-আসায় গণপরিবহনের ভাড়া গোণার সামর্থ্য নাই। তাহারা সাইকেল-সওয়ার হইয়া দীর্ঘ দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিতেছেন। বাধ্য হইয়া। তাহাদের জন্য একটি নিরাপদ নিরুপদ্রব পথ যে বড় দরকার!
কিন্তু এসবের মাঝে ফ্যাতাড়ু পুলকিত বঙ্গ নারীদের গতিচাঞ্চল্য দেখিয়া। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধাভোগী হওয়ার জন্য অধিকার সচেতন মহিলারা কী না করিতেছেন! ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খোলা হইতে ব্যক্তিগত নথিপত্র সংগ্রহ করা, গুছাইয়া সযত্নে রাখা, মোবাইল ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া-খুব দ্রুত এসব ঘটিতেছে!
ফ্যাতাড়ু নিশ্চিন্ত-বঙ্গবাসী অশুভ শক্তিকে চিহ্নিত করিয়া তাহাদের আবারও প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন! করিবেন!
ফ্যাতাড়ু আশান্বিত — বঙ্গবাসী অজেয়, পরাক্রান্ত — রাইফেল মণ্ডল ও তাহার সঙ্গীরাই তাহার প্রমাণ দিয়াছেন। জলস্রোতে আন্দোলিত কাঁটাগাছের মগডালে চাপিয়া কাঁটাক্ষত শরীরের যন্ত্রণায় দৃকপাত না করিয়া, পাঁচনি দিয়া পায়ের গোড়ায় বিষাক্ত সাপ তাড়াইয়াও নিকষ আঁধারে উদ্ধারকারীর আলোকবিন্দুর প্রতি তীক্ষ্ম নজর রাখিয়াছেন! এই দুর্জয় মনোবল বাঙালীর সম্বল!