কেন্দ্র এবার থাবা বাড়াতে চলেছে সমবায় ব্যবস্থার দিকে। ধূয়ো তুলছে — নতুন সমবায় পলিসি চাই, চাই নতুন সমবায় আইন। বহুরাজ্যিক সমবায় ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ঘোষণা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর, তিনি সমবায় মন্ত্রকেরও মাথায়। ইতিমধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মজুদ অর্থভান্ডারের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পলিসি বানিয়ে নেওয়া সারা। আর, সংকোচন ও বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার একই প্রক্রিয়ায় সুপরিকল্পিত উধাওকরণ ও একীকরণ প্রক্রিয়ার দাপাদাপিও শুরু করে দেওয়া হয়েছে। তার ওপর এখন নিশানা বানানো হচ্ছে সমবায় ব্যবস্থাকে। গত জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় সমবায় মন্ত্রক প্রায়োজিত ‘জাতীয় সমবায় সম্মেলন’ মঞ্চ থেকে ঘোষণা শুনিয়ে দিয়েছেন মন্ত্রী অমিত শাহ। কত কীই না বলা হচ্ছে! ‘যুক্তি’ দেওয়া হচ্ছে, বিশেষত পিএসিএস বা প্রাথমিক কৃষি সমবায় সংস্থাগুলির আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণই লক্ষ্য। এখন গড়ে গোটা দশেক গ্রাম ভিত্তিতে একটি করে সমবায় রয়েছে। নয়া আইনে সমবায় গঠন হবে নাকি প্রতিটি গ্রাম পিছু একটি করে। এখন মোট সমবায়ের সংখ্যা পঁয়ষট্টি হাজার, সংখ্যাবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা তিন লক্ষাধিক, সময় ধরা হবে পাঁচ বছর, ২০২৬ পর্যন্ত। তার মানে, ফিবছর গড়ে পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি সংখ্যায় সমবায় তৈরি করা হবে!
যখন নতুন করে সমবায় মন্ত্রক তৈরি করা হল তখন বলা হয়েছিল এটা মূলত রাজ্যের এ্যক্তিয়ারভুক্ত, কেন্দ্র বিশেষ নাক গলাবে না। এখন সম্পূর্ণ বিপরীত সুর। পুরোদস্তুর হস্তক্ষেপ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। বাহানা বানানো হচ্ছে সমবায় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং বয়স্ক কর্মচারীদের আধিক্য মুক্ত করে এর অর্থব্যবস্থায় দ্রুত লেনদেনের সঞ্চালন, পেশাদারিত্ব, কর্পোরেট ধাঁচের পরিচালন শৈলী কিভাবে নিয়ে আসা যায় সেসবই নাকি উদ্দেশ্য। বলা হচ্ছে, নয়া উদ্যোগের লক্ষ্য হল প্রধানমন্ত্রীর ‘ভোকাল ফর লোকাল’ রণনীতির ভিত্তিতে ‘'আত্মনির্ভর ভারত'’ নির্মাণযজ্ঞ শুরু করা। ঘটনা ও প্রবণতাও হল যে, চলমান সমবায় ব্যবস্থায় গভীরে গেঁড়ে রয়েছে চরম আমলাতান্ত্রিক পরিচালন রীতি, দুর্নীতি ও দলতন্ত্র। সারা দেশের ছয় লক্ষাধিক গ্রামজুড়ে লক্ষ লক্ষ (একশ বত্রিশ মিলিয়ন) মানুষের অংশগ্রহণে হাজার হাজার কোটি টাকার কারবার চলে এর মাধ্যমে। তার মধ্যে দুর্নীতি, জালিয়াতি, স্বজনপোষণ, দলতন্ত্র সবই বেশ গুরুতর মাত্রায় জড়িয়ে রয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে মূলত ক্ষমতাসীন শাসকদলের হাতেই রয়েছে নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। আর, যেসব রাজ্যে বিজেপির ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার সেখানে তো জবরদস্তি আরও বেশি। এসবের মূলোৎপাটন লাগাতার গণতদারকি ও গণআন্দোলনের দাবি জানায়। কিন্তু কোনও অর্থেই কেন্দ্র তথা কেন্দ্রের শাসকদলকে এর ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করতে দেওয়া যায় না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সমবায় ব্যবস্থায় ‘নতুন দিন’ নিয়ে আসার ভূয়ো প্রতিশ্রুতি গেলাতে মোদী সরকারের ও আপন ঢাক পেটাচ্ছেন। বলছেন, তিনি নিজে গুজরাটে সমবায় দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে ‘সুদিন ও সুস্বাস্থ্য’ এনে দিয়েছেন! চোরের বাবার বড় গলা। খোদ স্বরাষ্ট্র মায় সমবায় মন্ত্রীপুত্র অবৈধ উপায়ে নিজ ব্যবসায় বাৎসরিক ছিয়াসী শতাংশ মুনাফা কামিয়ে উপরন্তু বিসিসিআই-এর শীর্ষাসনাসীন হয়েছেন। মন্ত্রীর নিজেরও রয়েছে গুজরাটের সমবায় পরিচালনায় জড়িয়ে দুর্নীতির কলঙ্ক। তাছাড়া যে সরকার কৃষি ও কৃষক বিরোধী নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেছে, কৃষি ও কৃষক সমাজকে কর্পোরেটের গোলামে পরিণত করতে চাইছে, ন্যূনতম সরকারি সহায়ক মূল্য দিতে রাজী নয়, কৃষকদের দশ মাস যাবত পথে বসিয়ে রাখছে, ‘মানিটাইজেশনে’র নামে মুদ্রারাক্ষসের মতো দেশের একগুচ্ছ সম্পদ বেচে দিতে চাইছে কর্পোরেটদের কাছে; তার আবার প্রাথমিক কৃষি সমবায় নিয়ে ‘দরদ’ আসে কোথা থেকে! প্রকৃত উদ্দেশ্য হল সব অর্থেই কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। তাই সমবায় নিয়ে কেন্দ্রের এত নতুন ঔৎসুক্য, বলাবাহুল্য বিজেপিরও।