খবরা-খবর
সোনারপুর থানার গ্রামে সংখ্যালঘুদের ওপর পুলিশী মব লিঞ্চিং
minorities in Sonarpur

সোনারপুর থানার একদল পুলিশ কর্তা ও সিভিক ভলান্টিয়ার বাহিনী মবলিঞ্চিং চালালো বেনিয়া বৌ গ্রামের সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর। কোনো এক হোসেন আলি নামক আসামীকে ধরতে আসার নাম করে অন্য এক থানার (অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগণা) পুলিশ কনস্টেবল সুরাফ হোসেনের (বেনিয়া বৌ গ্রামে তাঁর বসত বাড়ি) সঙ্গে অনাবশ্যক বচসা বাধিয়ে তাঁর ওপর সিভিল পোশাকে মদ্যপ অবস্থায় চড়াও হয় এসআই সোমনাথ দাস। পুলিশরা ছিল সাদা পোশাকে, সিভিকরা ছিল পুলিশের পোশাকে চটি পায়ে। বাড়ি ও এলাকার লোকজন ছাড়াতে এলে সোমনাথ দাস ফোন করে থানা থেকে বাহিনী ডেকে আনে। প্রি-ইন্সপেক্টর প্রিয়া সেনের নেতৃত্বে বাহিনী লাঠিচার্জ করে বহু মানুষকে আহত করে সরিয়ে দেয়। তারপর গোটা বাহিনীর সবাই মিলে সুরাফকে পাশের খেলার মাঠে প্রকাশ্যে উলঙ্গ করে প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে পাশবিক অত্যাচার চালায়। ঘৃণাপূর্ণ সাম্প্রদায়িক গালাগালি করে। সুরাফ অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে আবার মার শুরু হয় থার্ড ডিগ্রির স্তরে। তাঁর পরিবারের লোকজন বাধা দিতে এলে তাঁদেরকেও পেটানো হয়। তাঁর অন্তঃসত্বা স্ত্রী তানিয়া পারভীনকে পুলিশ ধাক্কা মেরে বাড়ির সিঁড়িতে ফেলে দিলে, সেই আঘাতে তাঁর গর্ভ নষ্ট হয়। প্রকাশ্যেই সুরাফের ওপর যৌন নির্যাতন চালায় উন্মত্ত প্রিয়া সেন নিজে। সুরাফের কন্যাকে চড় মেরে তার স্কুলের ক্লাস করার মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয় পুলিশ। সুরাফের হাতের আঙ্গুল প্রিয়া সেন জুতো দিয়ে থেঁতলে দেয়, যৌনাঙ্গে ক্ষত সৃষ্টি করে। তারপর তাঁকে মারতে মারতে গরুর দড়ি দিয়ে পশুর মতো বেঁধে গাড়ীতে তুলে থানায় নিয়ে যায় বাড়ির লোকজন সহ। তাঁদের বিরুদ্ধেই সরকারি কাজে বাধাদান সহ অনেক কঠিন কেস দেওয়া হয়। ঐদিন প্রকাশ্যে নিরপরাধ মানুষকে পুলিশের থার্ড ডিগ্রী নির্যাতনের সাক্ষী থাকলেন ঐ গ্রামের আমজনতা।

সুরাফ হোসেন একজন জাতীয়স্তরের প্রতিভাবান ফুটবল। মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের একদা খেলোয়াড়, আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচ অনেকবার খেলেছেন। গুড কন্ডাক্টের কারণে মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে রাজ্যস্তরের পুলিশ বিভাগের পুরস্কারও পেয়ছেন। এমন মানুষের প্রাণনাশের সম্ভাবনা ছিল সেদিন ঐ অত্যাচারে।

খবর পেয়ে আমাদের পার্টির পক্ষে চারজনের এক প্রতিনিধি দল বেনিয়া বৌ গ্রামে গিয়ে সুরাফ ও তাঁর পরিবারের সাথে দেখা করে। আরও অন্যান্য কিছু সংগঠন, এপিডিআর, সেভ ডেমোক্রেসি, বন্দীমুক্তি কমিটি, জামাতে উলেমা-এ হিন্দ্ নিজেদের স্বাধীন উদ্যোগে ঐ গ্রামে আক্রান্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গিয়েছিলেন, তাঁরা পরস্পর যোগাযোগ করে ২১ আগষ্ট সোনারপুর থানা ঘেরাও করেন। থানা গেটে বিক্ষোভসভা চলে, ভেতরে চলে ডেপুটেশন। একুশের ডাক, ছাত্রসংগঠন আইসা প্রভৃতি কয়েকটি সংগঠনের যৌথ প্রতিনিধিদল ভেতরে যান। সেকেন্ড অফিসার ডেপুটেশন গ্রহণ করার সময় ঘটনাটিকে অনভিপ্রেত বলে স্বীকার করেন এবং আইনী পথে বিচারের রায়কে স্বাগত জানাবেন বলেন। কিন্তু কেস তারা তুলতে নারাজ। অর্থাৎ চ্যালেঞ্জ তারা বজায় রাখল। দ্রুততার সাথে মুখ্যমন্ত্রী, মানবাধিকার কমিশন সহ প্রশাসনের সমস্ত প্রাসঙ্গিক স্থানে সুরাফ ও তানিয়ার পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়।

গণমাধ্যমগুলির নিশ্চুপতা লক্ষনীয়। উল্টে ২৪ ঘন্টারও বেশি সময় জেলবন্দী থাকায় সুরাফ হোসেন নিজেই অশোকনগর থানার চাকরি থেকে সাসপেন্ড হয়ে আছেন নিয়মানুযায়ী। যদিও অশোকনগর থানা জানিয়েছে তাঁরা বিষয়টিতে সুরাফ হোসেনের পক্ষেই থাকবেন ও তাঁকে নিয়মিতকরণের চেষ্টা চালাবেন।

এরমধ্যে বেনিয়া বৌ গ্রামে বিভিন্ন সংগঠন যৌথভাবে গ্রামে একাধিক সভা, ঘরোয়া পরিকল্পনা মিটিং, হ্যান্ডবিল প্রচার, মাইক প্রচার, পোস্টারিং, সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচার ইত্যাদি নানা কর্মসূচি নেওয়া চলছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর, বারুইপুরে বড় জমায়েত ও মিছিল করে দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলাশাসকের কাছে বিক্ষোভ-ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনরকমের সদর্থক সরকারি পদক্ষেপের ইঙ্গিত মেলেনি।

পশ্চিমবঙ্গকে উত্তরপ্রদেশ হতে দেওয়া যাবেনা। আমলা-প্রশাসনের মাধ্যমে বাংলায় আরএসএসের অনুপ্রবেশের অপচেষ্টাকে নির্মূল করতে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে জোট বাঁধতে হবে। যেখানেই অত্যাচার সেখানেই প্রতিরোধ, এই হোক আজকের এধরণের ঘটনাবলীতে মানুষের মূলমন্ত্র।

- নবকুমার বিশ্বাস

খণ্ড-28
সংখ্যা-35