২০২২’র প্রথম দিকেই উত্তর প্রদেশের নির্বাচন। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই যোগী আদিত্যনাথের অপশাসনের বিরুদ্ধে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্তরের জনগণের সংগ্রামী ঐক্য ও সংকল্প ব্যাপক ও দৃঢ়তর হচ্ছে।
এই ঐক্য ও সংকল্পের সবচেয়ে উৎসাহজনক বহিঃপ্রকাশ নিঃসন্দেহে মুজাফ্ফরনগরের কৃষক মহাপঞ্চায়েত — যেখানে লাখে লাখে কৃষক যোগী-মোদী শাসনের বিরুদ্ধে যথার্থই এক রণহুঙ্কারে সমাবেশিত হয়েছিলেন। যে বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে উঠে আসে তা হল, কৃষকেরা কেবল তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বা হরিয়ানায় বিজেপি সরকার দ্বারা কৃষকদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এমনটা নয়; তাঁরা একই সাথে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের রাজনীতিকে নির্ধারকভাবে প্রত্যাখ্যানও করেছেন, যে রাজনীতি লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিম ইউপি’তে মোদী ও বিজেপিকে বিজয় হাসিল করতে সাহায্য করেছিল।
একদিকে কৃষকেরা যখন লড়াইয়ের রাস্তা দেখাচ্ছেন, শ্রমিকরাও তখন পিছিয়ে নেই। সরকারি কর্মচারি, শিক্ষক, অফিসার ও পেনশনারদের ১০০’র ওপর সংগঠন একসাথে এসে একটি ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গঠন করেছে। ইউপি’র যোগী আদিত্যনাথ নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছ থেকে তাঁরা লাগাতার যে লজ্জাজনক দুর্ব্যবহার পেয়ে আসছেন তার বিরুদ্ধে নিজেদের কথা আরও জোরালো ভাবে তুলে ধরতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন তাঁরা। তাঁরা ক্রুদ্ধ। কারণ সরকার সমস্ত কর্মচারি ও শিক্ষকদের মহার্ঘ্য ভাতা কেড়ে নিয়েছে, সব মিলিয়ে যার পরিমাণ ১০,০০০ কোটি টাকা; পরিবহন ভাতা সহ আরও অন্ততপক্ষে দশ ধরনের যেসব ভাতা কর্মচারিরা এতদিন পেয়ে আসছিলেন সেই সব ভাতা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। চুক্তি-শিক্ষকেরা এবং ‘শিক্ষা মিত্র’ শিক্ষকেরা এখন পাচ্ছেন সাকুল্যে ১০,০০০ টাকা প্রতি মাসে, আগে যা ছিল মাসে ৪৫,০০০ টাকা। এরফলে এক বড় সংখ্যক শিক্ষক বঞ্চনা ও হতাশায় আত্মহত্যা করেছেন; সরকারি ফাণ্ড না পাওয়া স্কুলগুলির শিক্ষকেরা আর সাম্মানিক ভাতাটুকুও পাচ্ছেন না; এবং কস্তুরবা গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়গুলির ২,০০০’র বেশি শিক্ষক ছাঁটাই হয়ে গেছেন। বেসিক স্কুলগুলির অধ্যক্ষের পদ তুলে দেওয়া হয়েছে, শিক্ষকদের প্রমোশনের সুযোগ আর থাকছে না। আর, সর্বোপরি, বুনিয়াদি শিক্ষা দপ্তরের ১,৬০০’র বেশি শিক্ষক ও কর্মচারি কোভিড১৯’এর মধ্যে মারা গেছেন কারণ দ্বিতীয় ঢেউয়ের চুড়ান্ত সময়ে, অসুস্থতা সত্ত্বেও, তাঁদের নির্বাচনে ডিউটি করতে বাধ্য করা হয়।
উত্তরপ্রদেশের যুবরাও যোগী ও মোদী শাসনকে ক্ষমা করে দেওয়ার মেজাজে নেই আর। এই শাসনে ইউপি’তে ও সারা দেশে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ বেকারত্বের রেকর্ড তৈরি হয়েছে। ছাত্র-যুব গ্রুপগুলি একত্রিত হয়ে ইউপি’র রাজধানী লক্ষ্নৌয়ে ‘কাজের অধিকার’ কনভেনশন সংগঠিত করেছে। তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখিয়েছেন যে ২০১৬ থেকে ২০১৯’র মধ্যে বেকারত্বের জ্বালায় দেশে আত্মহত্যার হার ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)’র এই পরিসংখ্যান দেশে কোভিড১৯’এর ধাক্কা আসার আগের। একথা স্পষ্ট যে শেষ দু’বছরে এরকম আত্মহত্যার সংখ্যা অনেক বেড়েছে বৈ কমেনি। বেকারত্বের হার নাকি রাজ্যে ব্যাপক মাত্রায় কমে গেছে — সিএম যোগীর এই মিথ্যাচারের দিকে আঙ্গুল তুলে ছাত্র-যুবরা দাবি করেছেন যে, কাজ হারানোর তথ্য পরিসংখ্যান নিয়ে এভাবে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া থেকে সরকার বিরত হোক এবং ইউপি’র জনতাকে বিপর্যস্ত করা এই কর্মহীনতার সংকটকে স্বীকার করুক। বিশেষত তাঁরা দাবি করেছেন যে বর্তমান সরকারি ফাঁকা পদগুলি পুরণ করতেই সরকার কেন ব্যর্থ হয়েছে, তার উত্তর আগে দিক সরকার। এই প্রশ্নে চূড়ান্ত দুর্নীতি চলছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘পুলিস গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যুরো’র সংকলিত এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে রাজ্য পুলিশের শূন্যপদের বিচারে দেশের মধ্যে এক নম্বরে আছে ইউপি (১,১১,৮৬৫ শূন্যপদ)।
দুর্নীতিকে একবিন্দু জায়গা না দেওয়ার যে দাবি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ করে থাকেন তা ভাঁড়ামোতে পরিণত হয়েছে। বেসিক এডুকেশন দপ্তরের মহাপরিচালকের একটি চিঠি উন্মোচিত করে দিয়েছে ৯ কোটি টাকার আর্থিক তছরুপের ঘটনা, যে অর্থ দলিত বালিকাদের কস্তুরবা বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য ধার্য তহবিল থেকে অপসারিত করা হয়েছে। দুর্নীতির আরেকটি ঘটনা সামনে এসেছে রাজা কিং জর্জ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিকে কেন্দ্র করে। সেখানে কোভিড১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত চিকিৎসা সরঞ্জাম অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক অনেক বেশি দামে কেনা হয়েছে। এমনকি বিজেপির বর্তমান এমএলএ’র পুত্রও অভিযোগ তুলেছেন যে যোগী আদিত্যনাথের শাসনে দুর্নীতি এক ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে।
অপরাধ দমন করার বিষয়ে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের বড়াই করা তো আরও নিষ্ঠুর পরিহাস। আইন শৃঙ্খলা সম্পূর্ণতঃ ভেঙে পড়া, মুসলমানদের নিত্যদিন মবলিঞ্চিং-এর শিকার হওয়া আর রাজ্যজুড়ে ধর্ষণের রমরমার বিপ্রতীপে এই পরিহাস আরও প্রকট হয়ে ওঠে। হাথরাস গণধর্ষণ ও হত্যার একবছর পূর্ণ হয়ে গেল। প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে গভীর রাতে সেই দলিত মেয়েটির দেহ জোর করে জ্বালিয়ে দেওয়ার কাজে ধরা পড়েছিল ইউপি পুলিশ। ভিক্টিমের পরিবার এখনও ন্যূনতম বিচার পাননি, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং যে আর্থিক ক্ষতিপূরণ, চাকরি ও বাড়ির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কিছুই পাননি তাঁরা। এনসিআরবি’র হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে খুন, নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ ও দলিতদের ওপর নৃশংসতার তালিকায় ইউপি সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে; আর ধর্ষণের নিরিখে রাজস্থানের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে। মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন ইউপি পুলিশের ‘মিশন শক্তি’র ফলে ২০২০ সাল থেকে ইউপি’তে মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধ অনেক কমে গেছে। কিন্তু এটা ডাহা মিথ্যা। বাস্তবে, মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের নির্দিষ্ট কিছু ক্যাটেগরির, মূলত ‘স্বামী বা আত্মীয়দের দ্বারা নিষ্ঠুরতার’ অভিযোগ, নথিভুক্ত হওয়া সারা দেশেই ২০২০ সালে কমেছে। এটা মোটেই বড়াই করার মত কোনও বিষয় নয়। বরং এটা একটা ব্যর্থতা। লকডাউনের মাঝে গাহর্স্থ্য হিংসার ঘটনা বেড়েছে, কিন্তু পুলিশের কাছে পৌঁছনো বা মহিলা সংগঠনগুলির সহযোগিতা পাওয়া লকডাউনের সময় মুশকিল হয়ে পড়ায় সেই হিংসার অভিযোগ নথিভুক্ত করা তুলনায় অনেক কম হয়েছে।
এনসিআরবি তথ্য পরিসংখ্যান নিশ্চিতভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে ভারতের সবচেয়ে অত্যাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসন হল যোগীরাজ, নৃশংস অগণতান্ত্রিক ইউএপিএ ও রাজদ্রোহ আইন প্রয়োগের নিরিখে ইউপি সর্বোচ্চ চারটি রাজ্যের মধ্যে পড়ে (অন্য তিনটি হল মনিপুর, আসাম ও ঝাড়খণ্ড) এবং ইউপি হল একমাত্র রাজ্য যেখানে কোনওরকম চলমান সশস্ত্র অভ্যুত্থানের গল্পও নেই বিপুল সংখ্যায় এই আইনগুলি প্রয়োগের বাহানা হিসেবে।
সংখ্যালঘু, মহিলা ও দলিতদের ওপর হিংস্রতার মাপকাঠিতে যোগী শাসন সবার থেকে আলাদা পরিচিতি পেয়ে গেছে, আইন কানুনের তোয়াক্কা না করা পুলিশ বাহিনী, ধর্ষকদের সুরক্ষা দেওয়ার তৎপরতা, কর্মহীনতায় ও অনাহারে মৃত্যু, কোভিড১৯ মোকাবিলায় সবচেয়ে খারাপ রেকর্ডে, যা গঙ্গায় ভেসে যাওয়া লাশের প্রবাহে সামনে আসে, বুনিয়াদি নাগরিক অধিকারের ওপর দমন পীড়নে। এই সমস্ত বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে সরকারের একমাত্র উত্তর আসে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ও হিংস্রতায়। কিন্তু কৃষক, শ্রমিক ও যুবরা আশা জাগিয়েছে যে, ইউপি’র জনতা এই সাম্প্রদায়িক, দুর্নীতিগ্রস্ত, অপদার্থ ও অত্যাচারী অপশাসনের অবসান ঘটিয়ে যোগী আদিত্যনাথকে বিদায় করবে।
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২১ সেপ্টেম্বর '২১)