মানবাধিকার কমিশনগুলোর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে আর সেগুলো গঠিত হওয়ার পিছনে মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে নিরস্ত করার ব্যাকুলতা কাজ করেছিল বলে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন। বিভিন্ন রাজ্যের জনগণের বিদ্রোহ দমনে সেনা বাহিনী ও পুলিশদের বাড়াবাড়ি এমন মাত্রা নিয়েছিল, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এতটাই তীব্র হয়েছিল যে নানান মহল থেকেই তার প্রশমনের আর্জি গুরুত্ব সহকারে উঠে আসছিল। মনদীপ তিওয়ানা তাঁর “প্রয়োজন: ভারতে অধিকতর কার্যকরী মানবাধিকার কমিশনগুলি” নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “পাঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মীর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের বৃদ্ধি হচ্ছিল ১৯৮০’র দশক থেকে শুরু হয়ে ১৯৯০’র দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত এবং সরকার কঠোর হাতে এর মোকাবিলা করছিল। সংবাদমাধ্যম, নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো এবং সাধারণ জনগণ বিদ্রোহ মোকাবিলায় পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর পদক্ষেপ এবং সরকারের মধ্যে চলা শাস্তিহীনতার সংস্কৃতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন — জাতীয় নিরাপত্তার নামে বুনিয়াদি মানবাধিকারকে উপেক্ষা করা হচ্ছিল।…
এই পরিপ্রেক্ষিতে রচিত হয় মানবাধিকার রক্ষা আইন, ১৯৯৩ যা দিল্লীতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং চোদ্দটা রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠাকে সম্ভব করে তোলে।…” এরথেকে অতএব প্রতীয়মান হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়াটাই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষে বাঞ্ছনীয়। কিন্তু অতি সম্প্রতি এর বিপরীতটাই ঘটতে দেখা গেল — জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিশানা বানালো সরকারের বিরুদ্ধে চলমান কৃষক আন্দোলনকে। কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি কৃষক স্বার্থ বিরোধী তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকদের আন্দোলন চলছে দশ মাসেরও বেশি সময় ধরে। সরকার কৃষকদের দাবিকে, তাদের সঙ্গে আলোচনা জারি রাখাকে গুরুত্বদানের বিষয় বলে মনে করেনি। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে অব্যাহত রাখতে বেশ কয়েকশ কৃষক প্রাণও দিয়েছেন। মানবাধিকার কমিশনের কাছে এসব বিচার্য হয়নি, সে বরং ব্যস্ত হয়ে পড়ল শিল্প ও পরিবহণের ওপর এই আন্দোলনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে, আন্দোলনের ফলে নিত্যযাত্রী, রোগী বয়স্ক মানুষদের কি অসুবিধা হচ্ছে তার বিচারে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দিল্লীতে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানায়, “শিল্প সংস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়া নিয়ে অভিযোগ এসেছে, ৯,০০০’র বেশি অতি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় কোম্পানি গুরুতর রূপে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই অভিযোগও এসেছে যে, পরিবহণের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যারফলে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হওয়ায় নিত্যযাত্রী, রোগী, প্রতিবন্ধী মানুষ ও বয়স্ক নাগরিকরা অসুবিধায় পড়ছেন।” এই সমস্ত অসুবিধায় মানুষ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে কমিশন যেহেতু মনে করছে, কমিশন তাই কেন্দ্র এবং দিল্লী, রাজস্থান, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছে নোটিস পাঠিয়েছে রিপোর্ট দেওয়ার জন্যে — এই সমস্ত অসুবিধা দূর করতে কি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা জানিয়ে। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ এবং স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রককেও নোটিস পাঠিয়েছে বিক্ষোভস্থলে কৃষকরা কোভিড বিধি মানছে কি না তা নিয়ে রিপোর্ট পাঠাতে। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিল্লী স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্ককেও কমিশন অনুরোধ করেছে, তারা যেন সমীক্ষা চালিয়ে জীবন, জীবিকা এবং বয়স্ক ও দুর্বল মানুষদের ওপর কৃষক আন্দোলনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে রিপোর্ট পাঠায়। কৃষক আন্দোলনের ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে এত ধরনের রিপোর্ট মানবাধিকার কমিশন চেয়েছে যাতে মনে হয় যে, সমালোনামূলক রিপোর্টের ভারে কৃষক আন্দোলনকে কলঙ্কিত করাই তার অভিপ্রায়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কি সত্যিকারের মানবাধিকারের ইস্যু খুঁজে পাচ্ছেনা বলেই তাদের কৃষক আন্দোলনে মাথা গলাতে হল, কৃষক আন্দোলনের ফলে সাধারণ মানুষের কত ক্ষতি হচ্ছে তার বিচারে নামতে হল? ভারতে আজ মানবাধিকার যাতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হচ্ছে তা হল সরকারের পক্ষে সরকার বিরোধিতাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ বলে গণ্য করা। সমাজ আন্দোলনের কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, এমনকি সাংবাদিকরাও সরকারের সমালোচনা করলে তাদের জেলে পোরা হচ্ছে, তারা এমনকি দৈহিক আক্রমণেরও শিকার হচ্ছেন। পুলিশি নৃশংসতার নিদর্শনও কম দেখা যায়না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই এবছরেরই আগস্ট মাসে লোকসভায় জানিয়েছেন — গত তিন বছরে ভারতে পুলিশি হেফাজতে মারা গেছে ৩৪৮ জন, আর বিচারবিভাগীয় হেফাজতে মারা গেছে ৫,২২১ জন। হেফাজতে পুলিশি পৈশাচিকতার এবং জেলের কয়েদিরা কি অবস্থায় থাকে তার বিবেচনা কি মানবাধিকারের আওতায় পড়ে না? সংখ্যালঘু, দলিত এবং সমাজের প্রান্তিক অংশের মানুষরা আজ রাষ্ট্র এবং আধিপত্যকারী সম্প্রদায়গুলোর কাছ থেকে ক্রমেই বেশি বেশি আক্রমণের মুখে পড়ছে। মবলিঞ্চিং বা গণপিটুনি সংখ্যালঘু এবং দলিতদের কাছে নিপীড়নের এক বিশেষ পরিঘটনা রূপে হাজির হয়েছে। চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সামনে আজ বিপুল বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিরোধী মতের প্রতি মর্যাদাদানে সরকারের অসম্মতি। কাশ্মীরের জনগণের মানবাধিকার আজ কোন অবস্থায়? গত ১৭ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কেউ প্রশ্ন কোরো না’ নিবন্ধে তাপস সিংহ উল্লেখ করেছেন, “নাগরিক সমাজের ওপর যে কোনো অত্যাচার, বাড়াবাড়ি, নিরাপত্তার নামে তুলে নিয়ে গিয়ে হেফাজতে রেখে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন, হাজার হাজার যুবক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক, সমাজকর্মীকে জেলে পুরে দেওয়া, যে কোনো বিরুদ্ধ স্বর স্তব্ধ করে দেওয়া, মিডিয়ার কণ্ঠ রোধ করা — এসবই কাশ্মীরে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা।” হস্তক্ষেপের জন্য এই পরিস্থিতি কি মানবাধিকার কমিশনের কাছে আবশ্যকীয় নয়?
মানবাধিকার কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান অরুণ মিশ্র সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন এবং মোদী সরকারের পক্ষে ও আদানির মতো পুঁজিপতিদের অনুকূলে রায় দেওয়ার জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিচারপতি লোয়ার রহস্যজনক মৃত্যুতে তদন্তের অনুমতি দেওয়ার আবেদন ছিল রাজনৈতিক দিক থেকে সংবেদনশীল মামলা, কেননা, সেই মামলায় জড়িয়ে ছিল অমিত শাহর নাম। সেই মামলা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র অরুণ মিশ্রর বেঞ্চে ফেলায় ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি চার বিচারপতি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। যে প্রশ্নটা আজ সচেতন নাগরিকদের মনে নাড়া দিচ্ছে তা হল — জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও কি সিবিআই, ইডি, আয়কর দপ্তরের মত এমন একটা সংস্থায় পরিণত হচ্ছে যেটাকে নরেন্দ্র মোদীরা নিজেদের স্বার্থে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারবেন, বিরোধীদের বিরুদ্ধে তাকে লেলিয়ে দিতে পারবেন?
কৃষক আন্দোলন দশ মাস ধরে অব্যাহত থাকায় কিছু মানুষের কিছু অসুবিধা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বিপর্যয়ের যে আশঙ্কা কৃষকদের আন্দোলনের পথে এনেছে তার তাৎপর্যও সুবিপুল। জমি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার, কর্পোরেটদের ক্রীতদাসে পরিণত হওয়ার মহাসংকটের মুখে কৃষকদের অস্তিত্ব। মানবাধিকার কমিশন যাদের কাছে নোটিস পাঠিয়েছে, তাদের রিপোর্ট পেয়ে হয়ত কৃষকদের কিছু বদনাম করা যাবে, তাদের আন্দোলনে মানুষের কত কষ্ট হচ্ছে তা নিয়ে কিছু বলার সুযোগ নরেন্দ্র মোদীদের হাতে পৌঁছবে। তাতে কি কৃষক আন্দোলনের সমর্থন ভিত্তিতে ফাটল ধরানো যাবে? এটা হলফ করে বলাই যায় যে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পদক্ষেপে কৃষক আন্দোলন একটুও দমে যাবে না। অনেক চেষ্টা করেও নরেন্দ্র মোদী সরকার কৃষক আন্দোলনকে পিছু হঠাতে পারেনি। যত দিন গেছে কৃষকরা কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনকে আরো তীব্র করে তুলতে উৎসাহিত হয়েছেন — বিজেপিকে জোরালো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছেন। কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলন তাদের কাছে জীবন-মরণের প্রশ্ন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। হরিয়ানায় কৃষকদের বিরুদ্ধে এক বছরে ১৪০টা এফআইআর করে ভারতীয় দণ্ডবিধির অধীনে গুরুতর অভিযোগ এনে এবং তাদের রক্ত ঝড়ানোর পরও হরিয়ানার বিজেপি সরকারকে কৃষকদের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে। কৃষক আন্দোলন যে কৃষকদের অস্তিত্বের প্রশ্নের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত সে কথা বিজেপি নেতারাও স্বীকার না করে পারছেন না। নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন এমন এক বিজেপি নেতা চৌধরী বীরেন্দর সিং কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন — “আন্দোলন যে প্রাণবন্ত রয়েছে তার পিছনে কারণ এই নয় যে কোনো বড় নেতা বা রাজনৈতিক দল এটাকে পরিচালিত করছে। মূল কারণ হল এই আশঙ্কা যে, এই কৃষি আইনগুলো রূপায়িত হলে তারা ভূমিহীন হয়ে পড়বে। এটাই আন্দোলনকে উদ্দীপ্ত করে তুলছে এবং কোনো কথাই তাদের আশঙ্কাকে মুছে দিতে পারবে না।” জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কি কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে আলোকপ্রাপ্ত হয়ে সে সম্পর্কে নিজের ধারণায় পরিবর্তন আনবেন?
- জয়দীপ মিত্র