মুখ্যমন্ত্রী কিছু ঘোষণা শোনালেন রাজ্য সরকারের উপজাতি উপদেষ্টা পর্ষদের এক বৈঠক থেকে। প্রথমত বললেন, যে কোনও মূল্যে রক্ষা করা হবে অরণ্য সম্পদ ও জমির ওপর আদিবাসীদের অধিকার। কেন্দ্রের মোদী সরকার যখন ছলে-বলে-কৌশলে জল-জমি-জঙ্গলের কর্পোরেট হস্তান্তরের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সেই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলায় তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরা মমতা সরকারের অরণ্য নীতি ও আদিবাসী জমি নীতির ঘোষণা অবশ্যই স্বাগত জানানোর। কিন্তু তার পরেও দেখার থাকবে। ঘোষণা এক ব্যাপার, আর তার সৎ রূপায়ণ আরেক ব্যাপার। দুইয়ের মধ্যে বাস্তবত স্ববিরোধ থাকছে কিনা বুঝে নিতে হবে সেটা। শঙ্কা জাগছে বিশেষত আরও এই কারণে যে এরকম কিছু অশনি সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গে কোন কোন অংশে বনসংলগ্ন অধিবাসীরা নতুন করে সম্মুখীন হতে শুরু করেছেন প্রতারণার ও উচ্ছেদের হুমকির। তাই এ বিষয়ে সরকারকে মাপতে হবে কথায় ও কাজে।
দ্বিতীয়ত, অভিযোগ আসতে শুরু করেছে ভূয়ো তথ্যের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ভূয়ো এসটি শংসাপত্র হাতানোর। যদিও এর কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী, তবু খতিয়ে দেখে বুঝে নিতে হবে। এরাজ্যে এসটি জনসংখ্যার ভাগ ৫.৮ শতাংশের মতো। মুখ্যমন্ত্রী শোনালেন, ২০১৩ সালে গঠন হওয়া এই উপদেষ্টা পর্ষদের বাজেট এ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে ছয়গুণ। যদিও তার কাজের বিশেষ ছাপ বোঝার উপায় নেই, কারণ সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট কার্ড প্রকাশ করা হয় না। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য জানালেন এই পর্ষদ এবার থেকে ছয় মাস অন্তর সব কিছু নির্ধারণ ও রূপায়ণ করবে।
তৃতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রী আরও বললেন, আদিবাসী উপজাতি জনজাতিদের জন্য কয়েকশ স্কুল তৈরি করা হবে। একনজরে আভাস দিলেন অলচিকি ভাষায় পাঁচশ, রাজবংশীদের জন্য দুশো, ইংরাজি মাধ্যমে একশ এবং দুটি কামতাপুর স্কুল গড়া হবে। এছাড়া সিলেবাস তৈরি চূড়ান্ত হলে স্কুল তৈরি হবে কুর্মী, হিন্দী, গোর্খা, নেপালি, সদগিরি, কুরমালী, লেপচা ও উর্দু ভাষীদের জন্যেও। এ রাজ্যে এত বৈচিত্রপূর্ণ সংখ্যায় মাতৃভাষায় বিদ্যার্জন পরিকল্পনার ভাবনা এর আগে কখনও শোনা যায়নি। স্বাধীনতার পঁচাত্তরে পদার্পণ করেও মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের প্রশ্নে কি বঞ্চনার সমুদ্রেই না হাহুতাশ করে মরতে হয় প্রান্তবাসী সব জনসমুদয়কে! এই অর্থে মমতা সরকারের উপস্থাপনা নতুন। কিন্তু এও সেই একই ব্যাপার, শুধু কথায় না বড় হয়ে কাজ শুরু করে কিনা দেখার। বিজ্ঞাপনী প্রচারে বাজীমাৎ করার পরিবর্তে দীর্ঘকালের অপ্রাপ্তিকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ত্বরান্বিত করা হচ্ছে কিনা সেটাই আসল বিষয়।
প্রান্তিক জনসম্প্রদায় বর্গগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় থাকা বড় কঠিন হয়ে রয়েছে। ২০১৯-২০-র সারা ভারত মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষার রিপোর্ট বলছে, নবম ও দশম শ্রেণীতে স্কুল ছুটের অংশ এখনও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সাধারণ বর্গে যেখানে প্রতি ৯ জনে ১ জন, সেখানে আাদিবাসী/উপজাতিদের ক্ষেত্রে প্রতি ৪ জনে ১, দলিতের ক্ষেত্রে প্রতি ৫ জনে ১ জন হয়ে যায় স্কুল ছুট। পশ্চিমবাংলায় এর শতাংশ ভাগ হল সাধারণ বর্গ (১০.৩), ওবিসি (১৩.৩), এসসি (১৮.৮) এসটি(২১.৬)। সুতরাং অবস্থাটা নিদারুণ।
এর সাথে যুক্ত করুন নিরক্ষরতার হার। এরাজ্যে সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ। তার মানে এখনও ২ কোটি মানুষ রয়েছে নিরক্ষর। রাজ্যের স্কুলশিক্ষা বিভাগের ২০১২ সালে প্রকাশিত 'কলকাতা গেজেটে'ও বহু কথা বলা হয়েছে। গ্রাম-শহরে, পঞ্চায়েত-পৌরসভার তত্ত্বাবধানে, জনশিক্ষা দপ্তর, নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর, সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তর ও মাদ্রাসা এবং পশ্চাদপদ জনজাতি কল্যাণ বিভাগ ইত্যাদির সমন্বয় থাকতে হবে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সরকারি পর্যবেক্ষেণ রাখতে হবে। অতিমারীতে ২০২০-২১ শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যয়ের শিকার। কিন্তু ২০১২ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত রিপোর্ট কার্ড কোথায়? তাছাড়া স্কুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, বিভিন্ন ব্যয়বৃদ্ধি এবং শিক্ষক ঘাটতি ও নতুন শিক্ষক নিয়োগ বা বদলি পলিসিকে কেন্দ্র করে চলছে নৈরাজ্য, দুর্নীতি, দলতন্ত্র। সুতরাং মাপতে হবে কথায় নয়, কাজে।