সেদিন ছিল বৃটিশ মুক্ত ভারতের দাবি। আজ ফ্যাসিবাদ মুক্ত ভারতের দাবি। সেদিন ছিল পরাধীনতার হাত থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি। আজ দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তির দাবি। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের আগে ব্রিটিশ বিরোধী বহু আন্দোলন হয়েছিল কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে ছড়িয়ে পরা ৯ আগস্টের স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। ভারতীয় জনগণ তখন মরিয়া একটা শব্দকে সামনে রেখে — স্বাধীনতা। বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুব, কৃষক, শ্রমিক যে যেভাবে পেরেছিলেন আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা এও জানি সাময়িকভাবে আগস্ট আন্দোলনের পরাজয় হলেও পরবর্তীতে স্বাধীনতার দাবির আন্দোলনের তীব্রতাতেই বৃটিশকে চলে যেতে হয়েছিল। ভারতীয় জনগণের জয় হয়েছিল। আজও ভারতীয় জনগণ এক মরিয়া লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন একটা শ্লোগানকে সামনে রেখে ‘ফ্যাসিবাদ হঠাও, ভারত বাঁচাও’।
স্বাধীন ভারতের শ্রমজীবী মানুষদের নতুন করে শৃঙ্খলিত করার এক জঘন্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। শ্রমের সঠিক মূল্য নির্ধারণের দাবি নিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসে আমরা জানি ডঃ বি আর আম্বেদকরের অবদানের কথা। ১৯৪৬ সালের ১১ এপ্রিল, শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি সম্পর্কিত বিলের খসড়াটি উনিই প্রস্তুত করেন যা পরবর্তীতে নূন্যতম মজুরি আইন ১৯৪৮-এ পরিণতি লাভ করে এবং সে বছরের ১৫ মার্চ থেকে তা ভারতবর্ষে লাগু হয়। যে আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবেই উল্লিখিত হয়েছিল
আজ আমরা দেখছি এই সকল উদ্দেশ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে পুঁজিপতিরা কী করে আরো মুনাফা করতে পারে সেই লক্ষ্যে শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সমস্ত আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। স্থায়ী শ্রমিকের পরিবর্তে ঠিকা, অস্থায়ী, কন্ট্রাক্ট প্রথাকে শুধু স্বাভাবিকই করা হল না, তাকে আইনসিদ্ধও করা হল। আমরা জানি ঠিকা বা কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে স্থায়ীকরণের লক্ষ্যে ‘কন্ট্রাক্ট লেবার রেগুলেশন অ্যান্ড অ্যাবোলিশন এ্যাক্ট’ নামে একটা আইন লোকসভায় পাশ করানো হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্ট এবং দেশের সুপ্রিম কোর্টও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্থায়ীকরণের আদেশও দিয়েছিল। কিন্তু আজ সে আইন, আদেশকে ছেঁড়া কাগজে পরিণত করা হল।
একদিকে সংগঠিতক্ষেত্রে বড় মাত্রায় অসংগঠিত শ্রমিকের (ঠিকা, অস্থায়ী, কন্ট্রাক্ট) সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে চলেছে, অপরদিকে বিগত দুই দশক ধরে এক বিশাল সংখ্যার মানুষ কৃষিক্ষেত্র ছেড়ে অকৃষিক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছেন। যা সমস্তটাই অসংগঠিত ক্ষেত্রের (মূলত নির্মাণ শিল্পের সাথে যুক্ত পরিযায়ী) শ্রমিক হিসাবে বড় সংখ্যায় আত্মপ্রকাশ করেছে। যাদের জন্য খাতায় কলমে কিছু আইনি সুরক্ষার কথা থাকলেও বাস্তবে তা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ অসংগঠিত শ্রমিক আজ প্রতিদিন শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছেন। দূর্বল শ্রমজীবী মানুষ যাতে ক্ষমতাবান মালিকশ্রেনীর সাথে দরকষাকষি করতে পারে তারজন্য যে সংগঠিত হওয়ার বা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার অর্জন করেছিলেন তাও আজ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। জাতীয়করণ আইন সংশোধন করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প বা সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ এবং বিলগ্নীকরণের রাস্তা প্রশস্ত করা হচ্ছে।
এরকম একটা সময়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষ ৯ আগষ্টের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে স্মরণে রেখে ‘ভারত বাঁচাও’এর শপথ গ্রহণ করলেন। পশ্চিমবাংলাতেও চা, কয়লা খনি, রেল, ব্যাঙ্ক, বীমা, ইঞ্জিনিয়ারিং, জুট, পরিবহন, নির্মাণক্ষেত্র সহ সকল অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকরা রাজ্য সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট কোভিড বিধিকে অগ্রাহ্য করেই কারখানার গেট এবং রাজপথ দখল করে নিজেদের সংগঠিত অস্তিত্বকে ঘোষণা করলেন। এআইসিসিটিইউ কোথাও স্বাধীনভাবে কোথাও অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র, মহিলা, কৃষক সংগঠনগুলির সাথে যৌথভাবে এই কর্মসূচি পালন করেছে।
উত্তর ২৪ পরগনায় বারাসাতে এআইসিসিটিইউ, সিআইটিইউ সহ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর যৌথ আইন অমান্য ও প্রতিবাদসভা হয়। অশোকনগর, বসিরহাট, বেলঘরিয়াতে এআইএসএ, এআইসিসিটিইউ, অ্যাপোয়া মিছিল ও সভা করেছে। কাঁচড়াপাড়া রেল ওয়ার্কশপ গেটে এআইসিসিটিইউ, শিবদাসপুরে কৃষিমজুর সংগঠন এবং সিপিআই(এমএল), বারাসাত স্টেশনে এআইএসএ একইসাথে প্রতিষ্ঠা দিবসের কর্মসূচি পালন করেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার কমরেডরা প্রশাসনের সমস্ত প্রতিরোধকে উপেক্ষা করেই বজবজে জেলা অফিস থেকে চড়িয়াল পর্যন্ত মিছিল করেন এবং চড়িয়াল মোড়ে বিক্ষোভ সংগঠিত করেন। বড় বড় ব্যানারে লেখা ছিল ‘বিজেপি হঠাও, দেশ বাঁচাও’, এনএসএ-ইউএপিএ-আফস্পা সহ সমস্ত দমন আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে, কর্পোরেট স্বার্থবাহি ৩টি নয়া কৃষি কানুন বাতিল ও বনাধিকার আইন কার্যকর করতে হবে, ৪টি শ্রমকোড বাতিল করতে হবে, ২০২০’র নয়া বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার করতে হবে। সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, জেলা কমিটি সদস্য নবকুমার বিশ্বাস ও নিখিলেশ পাল। মহিলাদের সংগঠিত করেন নেত্রী কাজল দত্ত ও দেবযানি গোস্বামী। কোচবিহার জেলায় এআইসিসিটিইউ, এআইকেকেএমএস এবং এআইকেএম’এর অবস্থান, বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়। আলিপুরদুয়ার শহরে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন-এর যৌথমঞ্চের পক্ষ থেকে একটি সুসজ্জিত মিছিল শহরের কোর্ট মোড় থেকে শুরু হয়ে জেলাশাসক-এর দপ্তরের সামনে দিয়ে ঘুরে শহরের মূল রাস্তা ধরে নিউটাউন মহাকালধামে এসে শেষ হয়। মিছিলে এআইসিসিটিইউ, সিটু, আইএনটিইউসি, ইউটিইউসি, এআইটিইউসি, এনটিইউআই’র নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন। আসানসোলে এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে কয়লা খনির শ্রমিকদের নিয়ে বিক্ষোভসভা হয়। প্রতিবাদ সংগঠিত হয় চিত্তরঞ্জনে। কৃষ্ণনগরে কালেকটারি মোড়ে গণসংগঠনগুলোর যৌথ কর্মসূচিতে এআইসিসিটিইউ থাকে অন্যতম শরিক।
কলকাতার ধর্মতলায় কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু, উপস্থিত থাকেন রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী রাজ্য নেতৃত্বের দিবাকর ভট্টাচার্য, প্রবীর দাস ও কলকাতা জেলার নেতৃবৃন্দ। সিআইটিইউ, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, এইচএমএস, ইউটিইউসি, টিইউসিসি, বিএসএনএলইইউ, বিইএফই সহ বিভিন্ন গণসংগঠন।
ঐতিহাসিক ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৭৯তম দিবসে এআইসিসিটিইউ, এআইএসএ, এআইপিডব্লিউ’র যৌথ উদ্যোগে উত্তর ২৪ পরগণা জেলা অফিস থেকে কলোনি বাজার, কে-৮ বাস স্ট্যান্ড হয়ে শহীদ বেদী পর্যন্ত মিছিল হয়। মিছিল শেষে বেলঘরিয়া শহীদ বেদী মোড়ে প্রতিবাদসভা হয়। সাঁতরাগাছি স্টেশন এলাকায়, ভারত বাঁচাও শ্রমিক অধিকার বাঁচাও দাবিতে গণঅবস্থান কর্মসূচি হয়। অল ইন্ডিয়া সেন্টাল কাউন্সিল ওফ ট্রেড ইউনিয়ন, সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়েমজদুর ইউনিয়ন, সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ে ঠিকা শ্রমিক ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক মারা নীতি ও কোম্পানি রাজ কায়েম করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সভায় বক্তব্য রাখেন জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা এন এন ব্যানার্জি, মীনা পাল, নিলাশিস বসু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। শ্রমিক স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে দেবো না যেকোন মূল্যে তা রক্ষা করা হবে — এই অঙ্গীকার করেন নেতৃবৃন্দ। সভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করে বালি ‘সংযোগ সংস্থা’। বসিরহাটে নয়া কৃষি আইন ও শ্রমকোড বাতিল, মাইক্রোফিনান্স ঋণ সহ সমস্ত ক্ষুদ্র ঋণ মকুব, সমস্ত শ্রমজীবী পরিবারকে মাসে ৭,৫০০ টাকা ভাতা, ইউএপিএ, এনআইএ সহ সমস্ত ঔপনিবেশিক ধারার গণতন্ত্র-বিরোধী আইন বাতিল, স্ট্যান স্বামীর জেল হেফাজতে মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি সহ বিভিন্ন দাবিতে কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে এআইসিসিটিইউ ও সারা ভারত কিষাণ মহাসভার আহ্বানে শ্রমিক বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, দেশ বাঁচাও কর্মসূচি সংগঠিত করা হয়। বসিরহাটের টাউন হল থেকে মিছিল করে বোটঘাটে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সভায় এআইসিসিটিইউ’র দেবব্রত বিশ্বাস বক্তব্য রাখেন। সংক্ষিপ্ত সভার শেষে আবার মিছিল করা হয় টাউন হল পর্যন্ত। এভাবেই রাজ্য তথা দেশের শ্রমজীবী মানুষ ৯ আগষ্টে ‘ভারত বাঁচাও’ শ্লোগানকে জোরের সাথে তুলে ধরে আন্দোলনের এক নয়া অধ্যায়ের সূচনা করেন।
এবার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি হতে চলেছে। প্রতিবারের মতো এবারেও ১৫ আগস্টে লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন। সেই ভাষণে আমরা শুনতে পাবো না লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার কারণ কি ছিল? হাজার হাজার মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরার আগেই অনেককে কেন মৃত্যু বরণ করতে হল? অভুক্ত, ঋণগ্রস্ত শ্রমিকেরা কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন? কোটি কোটি মানুষ কেন চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়ে বেরোজগার হয়ে পড়েছেন? লক্ষ কোটি যুবকদের রোজগারহীন থাকার কি কারণ? ব্যাঙ্কে গচ্ছিত জনগণের লক্ষ কোটি টাকা যারা আত্মসাৎ করল তাদের শাস্তি হল না কেন? লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে বেসরকারীকরণ, বিলগ্নিকরণ কাদের লাভের স্বার্থে করা হচ্ছে? লক্ষাধিক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ কি? কোভিড পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাওয়ার জন্য সরকার দায় স্বীকার করবে না কেন? শ্রমিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে শ্রমকোড চালু করা হল কেন? কৃষকদের জমি ও ফসলের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কাদের স্বার্থে নয়া কৃষি আইন প্রবর্তন করা হল? না। এসব কিছুই তিনি বলবেন না। আমরা জানি, তিনি বলবেন ‘আচ্ছে দিন’-এর সাঁজোয়া রথে সওয়ার ভারতীয় জনগণ এক নতুন ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়তে চলেছে। যে ভূয়ো রথের সারথি তিনি নিজে।
অপরদিকে আমরা দেখব ঐ দিনই গোটা দেশের শ্রমজীবী মানুষ নিজেদেরকে নয়া দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে স্বাধীনতার তেরঙ্গা পতাকাকে আরেকবার আকাশে ওড়াবেন। দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াইয়ে নিজেদেরকে উপযুক্ত রণসাজে সজ্জিত করার আহ্বান রাখবেন। আকাশ বাতাস মুখরিত করে শ্লোগান তুলবেন “ফ্যাসিবাদ হঠাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, ভারত বাঁচাও”!
- দিবাকর