ঝড়ের বেগে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সংসদে একের পর এক পাস করানো হল অনেকগুলো বিল — অচিরেই রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে যা আইনে পরিণত হতে চলেছে। ঠিক যেভাবে গতবছর অতিমারীর সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পাস করানো হয়েছিল শ্রম কোড ও কৃষি বিল, এবার সেই একই ধারায় বিমা শিল্পকে বেসরকারিকরণের দরজা খুলে দিতে, প্রতিরক্ষা শিল্পে ধর্মঘটকে বেআইনী ঘোষণা করতে মোদী সরকার চরম অগণতান্ত্রিক পথে কর্পোরেটদের স্বার্থসিদ্ধি করতে একগুচ্ছ বিলে সবুজ সংকেত দিয়ে বসল।
পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা প্রতিরক্ষা শিল্পের ৪১টি অর্ডন্যান্স কারখানাকে ৭টি কর্পোরেশনে বদলে ধাপে ধাপে সমগ্র এই ক্ষেত্রটাকে বেসরকারিকরণের শয়তানি উদ্দেশ্য নিয়ে মোদী সরকার বিরাট বড় এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এর আগে, কেন্দ্রীয় শ্রম কমিশনারের দপ্তরে এই সংক্রান্ত প্রশ্নে শ্রম বিরোধ মীমাংসার বৈঠকগুলোতে প্রতিরক্ষা শিল্পের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলোকে দু’পায়ে মাড়িয়ে আপস মীমাংসার চলমান প্রক্রিয়াকে অসমাপ্ত রেখেই ঘোষণা করলেন, কেন্দ্রীয় সরকার এই শিল্পকে কর্পোরেশন করতে অঙ্গিকারবদ্ধ। পরিহাস এটাই, যে ইস্যুকে (অর্থাৎ, কর্পোরেশন বানাবার) শ্রম বিরোধ হিসাবে কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক স্বীকৃতি দেয়, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রালয় জানায় যে এই বিষয়টা হল নীতিগত সিদ্ধান্ত, এটা শ্রম বিরোধের পরিসরে আনা যাবে না।
বেশ কিছুদিন আগে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সচিব/ডিরেক্টর পার্সোনাল প্রতিরক্ষা শিল্পের সাথে যুক্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের কাছে এই শিল্পকে আরও কার্যকর ও উৎপাদনমুখী করার কি কি বিকল্প প্রস্তাব রয়েছে, তার লিখিত পরামর্শ দিতে আবেদন করেন। ফেডারেশনগুলো ৩০,০০০ কোটি টাকার উৎপাদন বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা পেশ করে, তা চোখেও না দেখে ফেলে দেওয়া হল বাজে কাগজের ঝুড়িতে। ইতিমধ্যে, ডিফেন্স প্রডাকশন অ্যান্ড এক্সপোর্ট প্রমোশন পলিসি কাউন্সিল, ২০২০ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে সাতটা কর্পোরেশনে বিলগ্নীকরণ করা হবে। বিরোধ মীমাংসার চলমান প্রক্রিয়ায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক তড়িঘড়ি যতি চিহ্ন টেনে দেওয়ায় শ্রমিক কর্মচারীদের কাছে ধর্মঘটের পথে যাওয়া ছাড়া আর ভিন্ন কোন রাস্তা ছিল না। সমস্ত কেন্দ্রীয় ফেডারেশন অগত্যা ২৬ আগস্ট থেকে লাগাতার ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
ইমার্জেন্সি ডিফেন্স সার্ভিস অর্ডিন্যান্স, ২০২১
প্রতিহিংসা পরায়ণ কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত দ্রুততার সাথে প্রত্যাঘাত করল ইমার্জেন্সি ডিফেন্স সার্ভিস অর্ডিন্যান্স, ২০২১ জারি করে। চটজলদি রাষ্ট্রপতি ওই অধ্যাদেশটিতে স্বাক্ষর করে সেই মুহূর্ত থেকেই তাকে কার্যকর বলে ঘোষণা করলেন। চরম দমনমূলক এই অধ্যাদেশ গোটা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেই ধর্মঘটকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে থেমে থাকল না, শ্রম কোডে ধর্মঘটের সংজ্ঞার সীমা অতিক্রম করে কারখানা চত্বরে সমস্ত ধরনের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের রূপ, যেমন, ধর্ণা-অবস্থান, ধর্মঘটের সপক্ষে প্রচার এমনকি, ওভারটাইম করতে সম্মত না হওয়াকেও ধর্মঘটের আওতায় নিয়ে এলো। ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে মারাত্মক শাস্তি, সঙ্গে সঙ্গে ছাঁটাই ও চাকুরি থেকে বহিষ্কার, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের বিধান রয়েছে এই অধ্যাদেশে। পুলিশ-প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে ঢালাও ক্ষমতা, আর এই সমস্ত বেআইনী কার্যকলাপের জন্য শিল্পের আধিকারিক ও প্রশাসনকে বাঁচাতে দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ আইনী সুরক্ষা। আদালতে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করতে পারবে না। তাঁদের আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া হল।
ছল চাতুরি ও প্রতারণার হরেক উদাহরণ
কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশগুলোকে এই বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন যে, এই সাতটি কর্পোরেশন হবে পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন, আর কর্মীদের স্বার্থও থাকবে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। কিন্তু ঘটনা এটাই যে, এই শিল্পে কর্মীদের নিয়োগ করে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩০৯ ধারার অধীনে। কেন্দ্রীয় সরকারের কনসলিডেটেড তহবিল থেকেই কর্মীদের বেতন প্রদান করা হয়। তাঁদের নিয়োগপত্রে কখনো কোথাও একথা লেখা ছিলনা যে, তাঁদের কাজের শর্তাবলী ভবিষ্যতে বদলাতে পারে। কিন্তু এখন, কর্মীদের বেতন দেওয়া হবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পক্ষ থেকে, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে নয়, আর এই সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর আর্থিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, বিএসএনএল’র মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা সেই সাক্ষ্যই বহন করে।
কর্মীদের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
অর্ডন্যান্স ফাক্টরি বোর্ড ইতিমধ্যেই ২৭০টি আইটেমকে নন-কোর বলে ঘোষণা করে দিয়েছে। অর্থাৎ, এই সমস্ত আইটেম এরপর থেকে আর প্রতিরক্ষা কারখানায় তৈরি করা হবে না। ওই সমস্ত ইউনিটের জন্য কর্মকর্তারা জানান এখনো কোনো পথরেখা তৈরি করা হয়নি। পেনশন প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা এখনো সমাধান হল না। শুধুমাত্র পুরনো পেনশন প্রকল্পে নথিভুক্ত কর্মীরাই পেনশন পাবেন। নতুন পেনশন প্রকল্পের অধীনে যে ৪০,০০০ কর্মী রয়েছেন তাঁরা কিভাবে পেনশন পাবেন তা এখন পর্যন্ত ধোঁয়াশাই থেকে গেল। এতদিন পর্যন্ত যে নিয়ম ছিল, তা হচ্ছে, নয়া পেনশন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার কর্মীদের বেতনের ১৪ শতাংশ প্রদান করতো আর কর্মীরা দিতেন ১০ শতাংশ। কর্পোরেশন তৈরি হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদেয় অংশ ১৪ থেকে কমে ১০ শতাংশ হবে, কারণ, একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীরাই ১৪ শতাংশ পাওয়ার অধিকারি, কর্পোরেশনের অধীনে কর্মীরা নন।
আইএনটিইউসি’র ডিগবাজি
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই শিল্পে বাম মনোভাবাপন্ন একটি ফেডারেশন, আইএনটিইউসি, বিএমএস — এই তিনটি সরকার স্বীকৃত ফেডারেশন রয়েছে, আর এর বাইরে রয়েছে তিনটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সম্মিলিত কেন্দ্রীয় ফেডারেশন (এআইসিসিটিইউ, টিইউসিসি এবং এলপিএফ)’র এনপিডিএফ যারা সর্বভারতীয় স্তরে ক্রিয়াশীল। সকলে মিলেই ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয় ও এই দানবীয় অধ্যাদেশের বিরোধিতা করে। কিন্তু, কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সাথে বৈঠক চলাকালীন আকস্মিকভাবে আইএনটিইউসি কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর হাতে খামে মোড়া এক চিঠি দিয়ে কর্পোরেশন গঠনের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের পক্ষে দাঁড়িয়ে যুক্ত কার্যক্রম থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নেয়। তিনটি স্বীকৃত ফেডারেশনের মধ্যে ফাটল ধরে। অতঃপর, আইএনটিইউসি বাদে বাকি ফেডারেশনগুলি নিজেদের মধ্যে বৈঠক শেষে যুক্ত আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আইএনটিইউসি মনে করে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যখন আশ্বাস দিয়েছেন যে কর্মীদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে আর কর্পোরেশনগুলো থাকবে পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন, তাই এপ্রশ্নে আর না এগোনোই ভালো। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের কথা কোন সার্কুলার মারফত তারা নীচুতলায় কর্মী মহলে জানায়নি, আর তাই, গত ২৩ জুলাই কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা শিল্পে দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচিতে এরাজ্যে তাদের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ সামিল না হলেও কারখানা স্তরের নেতারা সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
তবে, দিন কয়েক আগে আইএনটিইউসি’র রাজ্য নেতৃবৃন্দ জানান যে প্রতিরক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্ত আন্দোলনে তাদের সংগঠন সক্রিয়ভাবেই যুক্ত থাকবে।
আশার আলো
প্রতিরক্ষা শিল্পের উচ্চতর কর্তৃপক্ষ প্রতিটি কারখানার আধিকারিককে নির্দেশ পাঠায়, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের আহূত বিক্ষোভ কর্মসূচিতে কারখানার কোন কোন শ্রমিক অংশ নিচ্ছেন তার একটা তালিকা যেন প্রস্তুত করা হয়। ২৩ জুলাই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে দেখা গেল, বিক্ষোভকারীদের ভিডিও রেকর্ড করার ব্যবস্থা। কিন্তু এত চোখরাঙানি সত্ত্বেও এআইসিসিটিইউ’র কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল কারখানার কর্মী নেতারা সদলবলে অংশ নেন প্রকাশ্য ওই বিক্ষোভ সভাগুলোতে। ইছাপুর রাইফেল কারখানা ও দমদম অর্ডন্যান্স কারখানার গেটে সংগঠিত বিক্ষোভসভায় এআইসিসিটিইউ সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন অংশ নেয়।
ইতিমধ্যে, কেন্দ্রীয় স্তরে, আইএনটিইউসি বাদে চারটি ফেডারেশন, সারা ভারত ডিফেন্স এমপ্লয়িস ফেডারেশন, বিএমএস অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় প্রতিরক্ষা মজদুর সংঘ, এআইসিসিটিইউ, টিইউসিসি ও এলপিএফ অনুমোদিত ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ ডিফেন্স এমপ্লয়িস ফেডারেশন এবং সারা ভারত বহুজন ডিফেন্স এমপ্লয়িজ ফেডারেশন প্রতিরক্ষা শ্রমিকদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংসদের পিটিশন কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে স্বাক্ষর সম্বলিত এক ডেপুটেশন দেওয়া হবে আর সেই লক্ষে ২ অক্টোবর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান। ইডিএসও বিল ২০২১ রদ করা ও প্রতিরক্ষা শিল্পকে কর্পোরেশন করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবিতেই চলবে এই প্রচার অভিযান।
- অতনু চক্রবর্তী