স্বাধীন মত প্রকাশ ও প্রতিবাদের অধিকার রক্ষায় চলমান জাতীয় প্রচারাভিযানে আগামী ২৮ আগস্ট, ভীমা কোরেগাঁও গ্রেপ্তারির তৃতীয় বার্ষিকীতে, পশ্চিমবাংলায় বিভিন্ন শহরে অবস্থান বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা সংগঠিত হবে। জাতীয় স্তরে ১৬৬টি সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রচারাভিযান চালাচ্ছে (আইপোয়া, আইসা, এআইসিসিটিইউ, এআইপিএফ সহ বিভিন্ন সংগঠন যুক্ত আছে)। এরাজ্যের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, ছাত্রছাত্রী সংগঠন ও নারীবাদী সংগঠন, গণ সংগঠন, প্রতিবাদী মঞ্চ ও ব্যক্তিবর্গ কর্মসূচি সংগঠিত করছে। কলকাতা, শিলিগুড়ি, কুচবিহার, বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, বাঁকুড়া, হাওড়া, বারাসাত ইত্যাদি জেলা শহর সহ বিভিন্ন ব্লক সেন্টার ও পঞ্চায়েতে ২৮ আগস্টের কর্মসূচি সংগঠিত হবে। গত ২৪ আগস্ট কলকাতা প্রেস ক্লাবে ও শিলিগুড়ি জার্নালিস্টস ক্লাবে যুগপৎ দুটি সংবাদ সম্মেলনে সমগ্র বিষয়টি তুলে ধরেন উদ্যোক্তা সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরা। কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, ছোটন দাস, মিতালি বিশ্বাস, জিনাত রেহেনা ইসলাম, প্রতীক নাগ, অক্ষয় ও সোমা। শিলিগুড়ির প্রেস কনফারেন্স হয় পার্থ চৌধুরি ও অজিত কুমার রায়ের নেতৃত্বে। প্রচারাভিযানের মূল দাবিগুলি হল,
১) রাষ্ট্রদ্রোহ আইন এবং ইউএপিএ সহ বিভিন্ন দমনমূলক আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার,
২) রাজ্য সরকার দ্বারা সত্বর ইউএপিএ প্রয়োগ বন্ধ করার ঘোষণা,
৩) রাজনৈতিক বন্দীদের নিঃশর্তে মুক্তি এবং বিচারাধীন ব্যক্তিদের জামিনের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি,
৪) গণআন্দোলন-কর্মী সহ বিভিন্ন নিরপরাধ ব্যক্তিদের ওপর চাপানো মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার সহ পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান,
৫) এনআইএ'র মতো স্বৈরাচারী তদন্ত সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া।
কলকাতা প্রেস ক্লাবে চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি প্রথমে জাতীয় অভিযান সম্পর্কে বলেন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেভাবে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদের অধিকারকে চরম স্বৈরাচারী কায়দায় দমন করছে তার উল্লেখ করে তিনি বলেন যে গত ২৩ জুলাই সারা দেশের সাথে এরাজ্যের বহু জায়গায় প্রতিবাদ দিবস সংগঠিত হয়। ২৬ জুলাই এক অনলাইন গণ কনভেনশনে রাজ্যের বহু সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক ধারার দমন আইনগুলি প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির প্রশ্ন ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবসে আদিবাসী মূলবাসীদের অধিকার ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয় এবং ১৫ আগস্ট ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসে রাজ্য জুড়ে পতাকা উত্তোলনের সাথে অঙ্গীকার পত্র পাঠ, সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ ও বিতরণ, আলোচনা সভা ইত্যাদির মাধ্যমে মৌলিক অধিকারগুলি ও তাদের তাৎপর্য সম্পর্কে চর্চা হয়। এই ধারাবাহিকতায়, ভীমা কোরেগাঁও-এর কুখ্যাত গ্রেপ্তারির তৃতীয় বার্ষিকীতে, দেশ জুড়ে ২৮ আগস্টের প্রতিবাদ দিবস সংগঠিত হচ্ছে। ছোটন দাস কেন্দ্রের দমনমূলক স্বৈরাচার সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন এবং যেসব বিরোধী দল যৌথ বিবৃতিতে ইউএপিএ বন্দীদের মুক্তির দাবি তুলেছে তারা নিজেদের চালানো রাজ্য সরকারগুলির ক্ষেত্রে বন্দীদের মুক্তি দিচ্ছেন না কেন সে প্রশ্ন তোলেন। প্রতীক নাগ বলেন এরাজ্যেও গণতন্ত্রের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলছে, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করলেই বেছে বেছে ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট এক্ট প্রয়োগ করা হচ্ছে, এরাজ্যেও অনেক ইউএপিএ বন্দী আছেন। মিতালি বিশ্বাস এরাজ্যের মহিলা বন্দিদের বিষয়ে বলেন। সম্প্রতি বেশ কিছু নারী সংগঠন একত্রিত হয়ে সংশোধনাগার দপ্তরের হেড কোয়ার্টারে ডেপুটেশন দেন। কেন মহিলা বন্দীদের সাথে নারী সংগঠনের কর্মীদের দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না সে প্রশ্ন তোলেন। তিনি জানান বেশ কয়েকজন মহিলা বিনা বিচারে দশ বারো বছর ধরে জেলে আটকে আছেন। তাঁদেরকে পরিবারের সাথে পর্যন্ত দেখা করতে দেওয়া হয় না। অনেকেই অসুস্থ। কম বয়সী বন্দিরা পড়াশোনা করতে চাইলেও তাদের সে সুযোগ দেওয়া হয় না। এই সব বিষয়গুলি সংশোধনাগার দপ্তরের ডিআইজির কাছে তুলে ধরা হয়েছে। আগামীতে নারী সংগঠনগুলি বিভিন্ন জেলের মহিলা বন্দীদের সাথে দেখা করা ও তাদের পরিস্থিতি জনসমক্ষে আনার উদ্যোগ জারি রাখবে।
কলকাতার প্রেস মিটে যোগ দিতে বহরমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন জিনাত রেহেনা ইসলাম। তিনি একজন স্কুল শিক্ষিকা এবং নারী আন্দোলনের কর্মী। কিছুদিন আগে বহরমপুর সংশোধনাগারে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন বন্দী শোভা মুণ্ডার সাথে দেখা করতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সকলের সামনে তুলে ধরে সাংবাদিকদের কাছে তিনি আবেদন জানান এ বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হতে। তিনি বলেন, সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদেরই মুক্তির দাবি আছে, কিন্তু মহিলা রাজনৈতিক বন্দীদের বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। কারণ অনেক সামাজিক প্রতিকুলতা পেরিয়েই মেয়েরা প্রগতির পথে রাজনীতিতে সক্রিয় হন, আর তাদের ওপরেই নামে অতিরিক্ত অত্যাচার। মেয়েদের অংশিদারীত্ব বিঘ্নিত করতে এসব চরম আঘাত নামে। অথচ এ বিষয়ে কথা বলতে সমাজে ও গণমাধ্যমে প্রবল অনীহা দেখা যায়। জিনাত স্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন করেন, কেন শোভা মুণ্ডার কথা শুনলেই বাংলার সংবাদ মাধ্যম গুটিয়ে যায়? কেন এদের নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে মুখ বুজে রয়েছে সাংবাদিকেরা? জিনাত অত্যন্ত আন্তরিক ভঙ্গিতে সরাসরি সাংবাদিকদের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং আবেদন জানান মহিলা বন্দীদের বিষয় মুখ খুলতে। দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির পক্ষ থেকে অক্ষয় নতুন ট্রাফিকিং আইন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বলেন এই আইন পাচারকারিদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার নামে আসলে যৌনকর্মীর পেশায় থাকা সমস্ত মহিলাদেরই বিপন্ন ও অপরাধী করে তুলছে। সবশেষে সোমা আরেকবার বন্দীমুক্তির প্রশ্ন তুলে ধরেন। শিলিগুড়ির প্রেস মিট থেকেও অনুরূপ বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়। আগামী ২৮ আগস্ট সর্বত্র আরও বিস্তারিতভাবে জনসমক্ষে সমগ্র বিষয়টি তুলে ধরা হবে।