আবেদন
আগস্ট ২০২১-এর আহ্বান : নিষ্ঠুর জুলুমশাহী থেকে স্বাধীনতা, লুণ্ঠন থেকে স্বাধীনতা
The Call of August 2021

১৫ আগস্ট ২০২১ ভারতের ব্রিটিশ পরাধীনতা-মুক্তির পঁচাত্তরতম বার্ষিকী শুরু হল। কিন্তু কী বিচিত্র পরিহাস! আজ স্বাধীনতার প্রাপ্তিগুলির উদযাপন তো বহু দূরের কথা, ভারতবাসীকে বেশি বেশি করে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে ঔপনিবেশিক যুগের নিষ্ঠুরতা ও দমন পীড়নের দুঃসহ স্মৃতি। কারণ দেশ আজ কোভিড-২ এবং মোদী-২-এর সাঁড়াশি আক্রমণে যন্ত্রণাজর্জরিত। অবস্থা এমনই যে, স্বয়ং ভারতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানাকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কৈফিয়ত চাইতে হয়েছে — কেন এতগুলো বছর পর আজও তাদের ঔপনিবেশিক শাসকের সিডিশন ল’ বা রাষ্ট্রদ্রোহ আইন দরকার হচ্ছে! রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বা ভারতীয় পিনাল কোডের ১২৪এ ধারা, যা ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দমনের জন্য ব্যবহার করত, সমালোচক বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য বর্তমান শাসকদের সেই আইনের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আর এটা ঔপনিবেশিক শাসনের কোন বিচ্ছিন্ন নিদর্শন নয়।

আইনগুলোর থেকেও বড় কথা, সমসাময়িক শাসনের নিষ্ঠুরতা, নাগরিকদের প্রতি ভারতের বর্তমান শাসকদের মনোভাব — যে নাগরিকদের ‘নগণ্য প্রজা’ হিসেবে দেখার বহরটা দিন দিন বাড়ছে। এই প্রবণতাই ঔপনিবেশিক তুলনাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলছে। ইউএপিএ আইনের একটা ঔপনিবেশিক-উত্তর ধারাবাহিকতা আছে, যা ঔপনিবেশিক যুগকেও হয়তো লজ্জা দেবে। এক অশীতিপর যাজক ও মানবাধিকার কর্মী যিনি জীবনের বেশিরভাগ সময়টা কাটিয়েছেন ঝাড়খণ্ডে আদিবাসী অধিকারের জন্য লড়াই করে, যিনি লড়েছেন উচ্ছেদের বিরুদ্ধে এবং মর্যাদার জন্য, জেলে যেসব বন্দীরা বছরের পর বছর সাধারণ সুযোগ সুবিধা ও অধিকার বঞ্চিত অমানবিক পরিবেশে জীবনীশক্তি খুইয়ে চলেছেন তাদের মুক্তির জন্য, সেই মানুষটিকে ঝাড়খণ্ড থেকে উৎখাত করে মহারাষ্ট্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে জেলে মেরে ফেলার জন্য! পার্কিনসন্স আক্রান্ত ফাদার স্ট্যান স্বামীকে জল পান করার জন্য একটা সিপার আর একটা স্ট্র পর্যন্ত দেওয়া হয়নি দীর্ঘদিন। জীবনের শেষ ক’টা দিন রাঁচিতে নিজের পরিচিত জনের মধ্যে কাটানোর শেষ ইচ্ছেটুকু পর্যন্ত বারে বারে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সেই জামিন-শুনানিরই একটি দিনে এল তাঁর মৃত্যু সংবাদ।

ফাদার স্ট্যান স্বামীর ঘটনাটিও বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, অনেক বড় একটি ছককেই উন্মোচিত করেছে মাত্র। তিনি ছিলেন, আদ্যন্ত সাজানো ভীমা কোরেগাঁও মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বিনা বিচারে আটক ষোল জনের একজন। আর অধিকার রক্ষার আন্দোলনের কর্মী ও প্রতিবাদী নাগরিকদের বিরুদ্ধে এরকম বেশ কয়েকটি ‘ষড়যন্ত্র’ মামলা খাড়া করা হয়েছে; ‘দিল্লী দাঙ্গা মামলা’ যেটিতে নাতাশা, দেবাঙ্গনা এবং আসিফ সম্প্রতি দিল্লীর হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন, কিন্তু এখনও অনেককেই যে জেলে পচতে হচ্ছে সেটা বিশেষ করে আরেকটি নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যের নমুনা। এরকম সাজানো প্রত্যেকটি ষড়যন্ত্র মামলা, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নির্যাতন করার জন্য ব্রিটিশ শাসকদের মামলাগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। আর ব্রিটিশ শাসকদের যেমন প্রধানত দানবীয় আইন আর দমন পীড়ন মূলক পদক্ষেপের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল, মোদী সরকারেরও আছে ইচ্ছেমত ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো এবং নির্দোষকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য বৈদ্যুতিন তথা প্রমাণ গোপনে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য অশুভতম নজরদারির অস্ত্রভাণ্ডার।

আমরা এখন জানি যে একটি ইজরায়েলি কোম্পানি সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধ মোকাবিলার নামে সাইবার-নজরদারির স্পাইওয়্যার বিক্রি করেছিল (এই সংস্থা খোলাখুলি তাদের যাচাই করা পছন্দের সরকারগুলিকে প্রযুক্তি বেচার কথা স্বীকার করেছে) এবং গোটা বিশ্ব জুড়ে ইতিমধ্যেই ৫০,০০০ ফোনকে নিশানা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পাওয়া ভারতের তালিকায় রয়েছেন বিরোধী নেতা ও ভোট কুশলী, অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী (এর মধ্যে ফাদার স্ট্যান স্বামীও আছেন), একজন নির্বাচন কমিশনার (যিনি ২০১৯-এর নির্বাচনে মোদীকে আদর্শ আচরণ বিধি লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন), ভারতের প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছিলেন যে মহিলা তার পরিবারের সদস্য এবং এমনকি কর্মরত বিচারকরা ও মোদীর নিজের মন্ত্রীসভার সদস্যরাও। এ থেকে আমাদের একটা পরিষ্কার ধারণা হয় যে কী ভয়ঙ্কর আক্রমণাত্মক নজরদারি এবং ব্ল্যাকমেল-এর উপর মোদী-শাহ রাজ তার সরকার পরিচালনার স্থাপত্য গড়ে তুলেছে!

যখন পুলিশ প্রশাসন, জেল ও গোপন নজরদারির প্রযুক্তি সমেত গোটা দমনমূলক ব্যবস্থা সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে এবং আন্দোলন ও সন্ত্রাসবাদকে একাকার করে ফেলা হয়েছে, তখন সেইসব সন্ত্রাসবাদী যারা বিদ্বেষপরায়ণ এবং ভয়ঙ্কর মুসলিম-বিরোধী জনতাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদের অবাধ বিচরণের কোনো বাধা নেই! স্বাধীনতা দিবসের এক সপ্তাহ আগে, বিজেপি নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ৫০০০ হিন্দুত্ববাদীর এক জনতা ভারতের জাতীয় রাজধানী দিল্লীর পার্লামেন্ট স্ট্রিটে জড়ো হয়ে মুসলিম হত্যার শ্লোগান দিতে থাকে। ঐ জমায়েত দাবি করতে থাকে — “বিদেশি” আইন বাতিল করে ভারতীয় আইন লাগু করতে হবে। এই ধরণের উগ্র হিন্দুত্ববাদী জনতার আগ্রাসী সাম্প্রদায়িকতার আদি উৎস আরএসএস কিন্তু “বিদেশি” আইন বলে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, ইউএপিএ বা এএফএসপিএ-এর মত ঔপনিবেশিক যুগের আইনগুলোর কখনও বিরোধিতা করেনি! বরং আর এস এস সবসময় ভারতীয় সংবিধানকে “পশ্চিমী ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত” বলে ঘোষণা করে এসেছে এবং এই সংবিধান বাতিল করে তার জায়গায় ‘মনুস্মৃতি’কে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে যেটি আসলে নারী ও নিপীড়িত বর্ণগুলির দাসত্বের এক দলিল।

কোভিড অতিমারি পরিস্থিতি, বিশেষ করে কোভিড-এর প্রাণঘাতী দ্বিতীয় ঢেউ বাস্তবটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। গোটা বিশ্ব দেখেছে কীভাবে কাতারে কাতারে ভারতবাসীকে অক্সিজেনের অভাবে মরতে হয়েছে, কীভাবে সেই সব মৃতদেহ চরম অমর্যাদা ও তাচ্ছিল্যে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং কীভাবে গণচিতা জ্বালিয়ে পোড়ানো হয়েছে আর গণকবর খুঁড়ে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। এখন সরকার সংসদে বলছে, ভারতে অক্সিজেনের অভাবে কেউ মারা যায়নি! জনসাধারণের কোভিড পরীক্ষা ও চিকিৎসা থেকে শুরু করে মৃতদেহের গণনা পর্যন্ত আমরা শুধু দেখে গেলাম মানুষের জীবনের প্রতি এই সরকারের কী ভয়ঙ্কর তাচ্ছিল্য আর অশ্রদ্ধা।

চরম উদ্ধত এবং চরম উদাসীন এই সরকার অনবরত বার্তা দিয়ে চলেছে যে এই বিপুল প্রাণহানি নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই, তারা গ্রাহ্যই করে না। মোদীর, ‘বিপর্যয়ের মধ্যে সুযোগ খোঁজার’ আপ্তবাক্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে এই সরকার অতিমারীকে শুধু কর্পোরেট মুনাফা বাড়ানো এবং জনসাধারণের সম্পদ, অধিকার, এমনকি প্রাণ পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার একগুচ্ছ সুযোগ হিসাবে কাজে লাগিয়ে চলেছে।

১৯৪৭ সালে ভারত আত্মপ্রকাশ করেছিল এক আধুনিক গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের স্বপ্ন এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য নিয়ে। আজ ভারত পরিণত হয়েছে এক ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে’ এবং ভারতবাসী দিন কাটাচ্ছেন জুলুমশাহীর দুঃস্বপ্নের মধ্যে। এক দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন এই মুহূর্তের জরুরি আহ্বান : চাই জুলুম শাহী থেকে স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় মদতে বিপর্যয় ও ধ্বংস থেকে স্বাধীনতা, ফ্যাসিবাদ থেকে স্বাধীনতা!

(এম এল আপডেট, ১০ আগস্ট, ২০২১)

খণ্ড-28
সংখ্যা-31