টোকিয়ো অলিম্পিকে এবার ভারতের নারী শক্তির জয় জয়কার। পদকের পর পদক জিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন মেয়েরা। পদক জয়ী, অ-জয়ী প্রত্যেক খেলোয়াড়ই খেলার আসরে তাঁদের অসামান্য প্রতিভা দেখিয়েছেন। দেশের মানুষও তাঁদের হাজারো কুর্নিশ জানিয়েছেন। গর্বিত সকলেই। দেশের মানুষ যখন খুশিতে উদ্বেল, এরই মধ্যে এক লজ্জাজনক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটল। হকি দলের সদস্য বন্দনা কাটরিয়া ভারতের একমাত্র মহিলা হকি খেলোয়াড়, যিনি অলিম্পিকে হ্যাট্রিক করেছেন। দলিত বন্দনার এত সাফল্য প্রতিষ্ঠায় উচ্চবর্ণের দম্ভে প্রচন্ড ঘা পড়েছে, তাই গায়ের জ্বালা মেটাতে রোষ উগরে দেওয়া হল সেমিফাইনালে ভারতের হকি দল আর্জেন্টিনার কাছে হেরেছে, কারণ দলিত দলে আছে বলেই এই হার! এই ছুতো ধরে হিংস্র জাতি বিদ্বেষী নারী বিদ্বেষী মনুবাদী দাম্ভিক গুন্ডারা বিজেপি শাসিত উত্তরাখন্ডে বন্দনার পরিবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কুৎসিত বাক্যবাণে তাঁদের বিদ্ধ করল, এমনকি সপরিবারে খুনের হুমকি পর্যন্ত দিল! এই ধিক্কৃত ঘটনায় সকলেই মর্মাহত। প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল, এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় তাৎক্ষণিক দুঃখ প্রকাশ করা ও ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো এবং হামলাকারীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা। কান্নায় ভেঙে পড়া পরাজিত হকি দলকে প্রধানমন্ত্রী সান্ত্বনা দিয়েছিলেন ‘পাশে আছি’। তাঁর এই আচরণকে কি পাশে থাকা বলে? একজন মহিলা খেলোয়াড়কে পর্যন্ত রাষ্ট্র যথাযথ তাঁর সম্মান, নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হল! এটা স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে দেশের সবচেয়ে বড় লজ্জাজনক দিক!
ঐ সময়েই এ বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদের সংকীর্ণ গ্রাসে পড়লেন উচ্চ মাধ্যমিকে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া মুর্শিদাবাদের ছাত্রী রুমানা সুলতানা। আমরা গর্বিত। কিন্তু ফল ঘোষণা করতে গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ সভাপতি ছাত্রীর নাম ঘোষণার সময় বারংবার তাঁর ধর্মীয় পরিচয় উল্লেখ করেছিলেন! যা অত্যন্ত নিন্দনীয়, এই আচরণ শিক্ষা জগতের কলঙ্ক। অধিকাংশ মহিলা খেলোয়াড়কে দারিদ্রের সাথে লড়াই করে উঠে আসতে হয়। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে নিষ্ঠার সাথে প্রবল ইচ্ছাশক্তির বলে নিজেদের হাজির করছেন অলিম্পিক ময়দানে। জয়ী হওয়ার স্বপ্নপূরণে অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোকাবিলার কঠিন চ্যালেঞ্জটাও তাঁদের কাছে বাড়তি চাপ। সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে যে উন্নত পরিকাঠামো জরুরী এ পোড়া দেশে তা নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের সে পরিকল্পনাও নেই, তাই এই খাতে বাজেট বরাদ্দও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে! তার চেয়ে বরং সরকারের কাছে বেশি জরুরি হল বিজেপির নেতা নেত্রীদের নামে ক’টা স্টেডিয়াম বনানো যায়! সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর ‘খেলো ইন্ডিয়া’ প্রকল্প একটা ভাঁওতাবাজি ফাঁকা আওয়াজ।
মনুবাদীরা যতই মেয়েদের অবলা বানানো এবং ঘরবন্দী করার হাজারো চেষ্টা করুক, পারবে না। জাত ধর্ম নির্বিশেষে সর্বক্ষেত্রে মেয়েরা আজ সম অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের সামনের সারিতে। সে মহাকাশ অভিযানে হোক আর লাশ কাটা ঘরে (ল্যাব অ্যাটেন্ডেট), সমান স্বচ্ছন্দ্য। অতিমারীর কষ্টকর পরিবেশ মোকাবিলা করে, মীরাবাই চানু, লাভলিনা বারগোহাঁই, পি ভি সিন্ধুরা যখন দেশের হয়ে অলিম্পিকের মাঠে পদক জয়ের কঠিন লড়াই লড়ছেন, ঠিক সেই সময়ে উত্তরপ্রদেশে এক ঘৃণ্য ঘটনা ঘটল, সপ্তদশী নেহাকে জিনস্ পরার অপরাধে পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক প্রভুরা তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলল! একই ঘটনা ঘটল মধ্যপ্রদেশে, মোবাইল ফোন ব্যবহারের জন্য দুই নাবালিকাকে অকথ্য অত্যাচারে অর্ধমৃত করা হল। মধ্যযুগীয় ঘটনা প্রবাহ গুজরাতেও ঘটল! গুজরাত তো আবার নারী নিপীড়নে আরও এগিয়ে, সামান্য সুযোগ পেলেই মেয়েদের উচিত শিক্ষা দিতে নির্যাতনের যত নিকৃষ্টতম রূপ আছে তা প্রয়োগ করে পরিবার থেকে প্রশাসন। পৈশাচিক গুজরাত দাঙ্গা তার চরম নিদর্শন। লকডাউনে গোটা দেশের জনজীবন যখন স্তব্ধ এবং অস্বাভাবিক তখনও মেয়েরা কোথাও সুরক্ষিত নয়! অতি সম্প্রতি আরও একটা নিঃশব্দ হাতরাস কান্ড ঘটে গেল দিল্লীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নয় বছরের শিশু কন্যা বাড়ির পাশেই শ্মশানের কুলার থেকে পানীয় জল নিতে গিয়ে আর ফিরল না! নরপশু শ্মশানের পুরোহিত ও তার সঙ্গীদের লালসার শিকার হল মেয়েটি, তারা ছিঁড়ে খেলো তাঁকে, আবার ঐ শ্মশানেই পুড়িয়ে দিল দেহটা, তারপর শিশুটির মাকে খবর দেওয়া হল তাঁর মেয়ে বিদ্যুৎ পিষ্ট হয়ে মারা গেছে, কি মর্মান্তিক কষ্ট কর! মাকে শেষ দেখাটাও দেখতে দিল না নরপিশাচসরা। উচ্চবর্ণের লোকেরা এভাবেই দলিত মেয়েদের শেষ করে দিতে চাইছে! শাসক দলের মদত না থাকলে এমন ঘটনা বার বার ঘটে? অবশ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থাটাই তো ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কব্জায়। প্রধানমন্ত্রীর ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ প্রকল্প যে কত ভেক তা নারী সমাজ ধরে ফেলছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ আর মুখোশ খসে পড়ছে সর্বক্ষেত্রে। একদিকে মহিলা খেলোয়াড়রা দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন আর এই উজ্জ্বলতার নীচে এক অদ্ভূত অন্ধকারের দিকে ক্রমশ মেয়েদের ঠেলে দিচ্ছে এই পিতৃতান্ত্রিক ফ্যাসিষ্ট সরকার।
একবিংশ শতাব্দীর কি পরিহাস!
নারীর সুরক্ষার এবং ক্ষমতায়ন মোদী সরকার যে চায় না তা আরও একবার স্পষ্ট হল। বহু লড়াইয়ের ফসল হিসেবে নির্ভয়া তহবিল গঠন হয়েছিল। এই তহবিল সমস্ত রকম নারী কল্যাণে ব্যয় হবে। কিন্তু সম্প্রতি অক্সফ্যাম সংস্থার রিপোর্ট বলছে, ২০১৯-২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই তহবিলের জন্য ৪৩৫৭.৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। অথচ এই তহবিলের সিংহ ভাগ টাকা অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কাজে লাগিয়েছে। অর্থাৎ পুলিশের হাতকেই শক্তিশালী করেছে! যত ধর্ষণ খুন যৌন হেনস্থা গাহর্স্থ্য হিংসা অ্যাসিড হামলা বাড়ছে, ততোধিক অবহেলিত হচ্ছে নির্ভয়া ফান্ড। সমস্ত রকম ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়া তো বহুদূরের কথা, ধর্ষিতা নারীরা যাতে দ্রুত ন্যায় বিচার পান, তার প্রমাণ সংরক্ষিত রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো এখনও তৈরিই হয়নি। এবং নির্যাতিতাকে এই সংক্রান্ত যা যা পরিষেবা দেওয়া জরুরি সে সব ব্যবস্থার কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনাও সরকারের নেই। এমনকি এই দপ্তরের আধিকারিকরা জানেন না, কিভাবে কোন খাতে এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে! নারী সুরক্ষার নামে চলছে পুরো ধাপ্পাবাজী। নারী সুরক্ষার আইন অনেক আছে, কিন্তু রক্ষকই তো ভোগী! তাহলে কার্যকরি পদক্ষেপ নেবে কে? বরং বেটিদের রক্ষার নামে তাদের মূক বধির করে ঘরে ফেলে রাখার চক্রান্ত চলছে। তবে অত সহজ নয়, বাংলার মেয়েরা তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। গত নির্বাচনে ফ্যাসিষ্ট মোদী-যোগীর বাংলায় ক্ষমতা কায়েমের বিরুদ্ধে যোগ্য জবাব দিয়েছেন। আশা করব, আগামী নির্বাচন গুলোতেও উদ্ধত পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরাচারী বিজেপির বিরুদ্ধে মেয়েরা রুখে দাঁড়াবেন।
নির্যাতন অন্য রূপেও হচ্ছে, কোভিড বিধি পালনে প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞাপনের বহর খুব, ‘দুগজ কি দূরী, মাস্ক পহেন না, হাত ধোনা জরুরি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মেহনতি কাজ হারানো মানুষ পেটের ভাত জোটাতে প্রতিদিন গাদাগাদি করে ট্রেনে বাসে যাতায়াত করছেন। অথচ ভ্যাকসিনের সাপ্লাই নেই, মেয়েরা তো সবচেয়ে কম ভ্যাকসিন পাচ্ছেন। আশা স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষার জন্য কোনো পিপিই কিট দেওয়া হচ্ছে না। সেবা দিতে গিয়ে কত আশাকর্মীর কোভিডে মৃত্যু হল কিন্ত তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হল না। কোভিডকালে কৃষক বিরোধী, জনবিরোধী তিন আইন বাতিলের দাবিতে কিষাণের সাথে কৃষাণীরা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় মাসের পর মাস দিল্লির রাস্তায় ধর্ণায় বসে আছেন। সরকারের মদত পুষ্ট গুণ্ডারা তাঁদের ওপর অত্যাচারও চালিয়েছে! মাইক্রো ফিনানস কোম্পানিগুলোর জ্বালায় হাজার হাজার গরিব মেয়েরা প্রায় প্রতিদিন এ ঋণ মকুবের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যা করছেন! সরকারের তাতে কোনো হেলদোল নেই। বরং কোভিড কালে মোদী সরকার একের পর এক জনবিরোধী নীতি নেওয়ার ফল স্বরূপ নিজেই মানুষকে বিধি ভাঙ্গতে বাধ্য করেছে এবং কোভিড ছড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর এই ফালতু লোক ঠকানো বিজ্ঞাপনে বিপুল অর্থ ব্যয় না করে, গরিব মানুষের খাওয়া-চিকিৎসার জন্যে তা ব্যয় করলে এত মানুষের কোভিডে এবং অনাহারে মৃত্যু আটকানো যেত। অবশ্য মানুষ মরল কি বাঁচল, তাতে কান্ডজ্ঞানহীন এই সরকারের কিছু যায় আসে না! ওনারা তো সর্বদা কর্পোরেটদের সেবায় ব্যস্ত কি না! সরকারের এই উদাসীনতার জন্য মানুষ এতটাই বিপর্যস্ত ও বিপদগ্রস্ত যে সুপ্রিম কোর্টও কেন্দ্রীয় সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। যদিও কোর্টের নির্দেশকে পাত্তা না দিলেও উদ্ধত মোদী সরকার বেশ চাপে আছে। এত সব সমস্যা নিয়ে বেশি হৈচৈ করলে ‘দেশপ্রেমিক’ প্রধানমন্ত্রী আবার ‘রাষ্ট্র দ্রোহ’ আইন ঠুকে দিচ্ছেন!
এ রাজ্যের মেয়েরাও সুরক্ষিত নয়, ধর্ষণ খুন শ্লীলতাহানি অব্যাহত। তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পিছনে মেয়েদের ভোট একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে। বাংলার নারীসমাজ তাই আশা করে, তাঁদের সার্বিক সুরক্ষার জন্য রাজ্য সরকার দ্রুত উল্লেখযোগ্য ও কার্যকরি পদক্ষেপ নেবে। আন্দোলন তো চলবেই।
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে আওয়াজ উঠুক, নির্ভয় স্বাধীনতার লক্ষ্যে মেয়েরা জোট বাঁধছে, এগিয়ে চলেছে।
- চৈতালি সেন