২০১৮ সালে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে জনগণনায় জাতিগণনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু আসন্ন জনগণনার আগে সংসদে মোদী সরকার জানিয়েছে যে জাতিগণনা করবে না সরকার। সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ব্রিটিশরা ১৮৭২ সালে যখন জনগণনা শুরু করে তখন থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত জনগণনায় জাতিগণনা হয়েছে। স্বাধীনতার পর তা বন্ধ করে কেবলমাত্র এসসি ও এসটি তালিকার জন্য জাতিগণনা হয়েছে, বাকি সকলকে জেনেরাল ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানে বর্ণিত ‘অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী’র যে বিপুল জনসংখ্যা আছে তার গণনা কখনই হয়নি। শেষে ২০১১ সালে নতুন করে আর্থ সামাজিক ও জাতিগণনা সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু সেই গণনার তথ্য মোদী সরকার প্রকাশ করতে চাইছে না। সরকার বলছে ওই তথ্যের গুণগত মান নাকি ভালো নয়। সরকারের এই বক্তব্য আরও প্রশ্নের জন্ম দেয়। স্পষ্ট ও সঠিক গুণমানের তথ্য সংগ্রহ করতেই তো জনগণনার মাধ্যমে সুব্যবস্থিত দক্ষতায় জাতিগুলির নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা দরকার। নাকি মোদী সরকার সংরক্ষণ ব্যবস্থাকেই স্তব্ধ করে দিতে চাইছে? সাধারণভাবে বিজেপি-আরএসএস সর্বদাই সংরক্ষণের সাংবিধানিক অধিকারের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে থাকে। মূলত উচ্চবর্ণের আধিপত্য কায়েম করাই তাদের লক্ষ্য। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতির আঙিনায় প্রকাশ্যে সেই অবস্থান নেওয়া বিজেপির পক্ষে একটু কঠিন। তাই কি সংরক্ষণ ব্যবস্থার যৌক্তিক ভিত্তিটাই নাকচ করে দিতে চায় তারা। নইলে কেন বিভিন্ন পশ্চাদপদ শ্রেণীর প্রকৃত তথ্য পরিসংখ্যান সামনে আনতে চাইছে না তারা? এই তথ্য হালনাগাদ করে সংরক্ষণকে যৌক্তিক ভিত্তি দেওয়া দরকার। এসসি, এসটি, ওবিসিদের সর্বমোট সংরক্ষণের ঊর্ধ্বসীমা যেখানে বেঁধে দেওয়া হয়েছে তার বাস্তব ভিত্তি কী? ‘ক্রিমি লেয়ার’কে সংরক্ষণের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয় ১৯৯৩-এ সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের মাধ্যমে। ‘ক্রিমি লেয়ার’কে বাদ দেওয়ার যুক্তি আসলে সংরক্ষণ ব্যবস্থার মূল অন্তর্বস্তুকেই নাকচ করে দেওয়ার সামিল। কিন্তু সেই বিতর্কে না গিয়েও বর্তমান প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলা যায় যে কারা ক্রিমি লেয়ার তা কীভাবে ঠিক হবে যদি আর্থ সামাজিক জাতিগণনা সম্পন্ন না হয়? জাতিগণনা থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পিছু হঠায় এই প্রশ্নগুলো সামনে এসেছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে দাবি উঠেছে জাতিগণনা চালানোর। বিহার রাজ্য থেকে শাসক ও বিরোধী সহ সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও জাতিগণনার পক্ষে বলে জানিয়েছেন।
পাটনায় সংবাদ সম্মেলনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য জাতিগণনার দাবিকে সমর্থন করে বলেন, সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে যুক্তিপূর্ণ ভিত্তি দিতে জাতিগণনা জরুরি। তিনি বলেন, সরকার বিষয়টি থেকে নজর ঘোরাতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইনের কথা বলছে। গত তিনদশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে এবং বর্তমান সময়ে জনসংখ্যা কোনও ইস্যু নয়।
তিনি বলেন যে ওবিসি সংরক্ষণ প্রশ্নে একটি বিল শাসক জোট ও বিরোধী দলগুলির সর্বসম্মতিতে সংসদে পাশ হয়েছে। এটা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু সেটুকুই যথেষ্ট নয়। সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে মসৃণ ও যথাযথ যুক্তিপূর্ণভাবে কার্যকর করতে জাতিগণনা প্রয়োজন। ১৯৩১ সালের পর থেকে আর জাতিগণনা হয়নি। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশগুলিও সেই ১৯৩১’র গণনার ওপর ভিত্তি করেই করা হয়েছিল। ২০১১ সালে যে জাতিগণনা করা হয়েছে তার রিপোর্টও এখনও প্রকাশ্যে এলনা। যদি সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে হালনাগাদ করতে হয় তাহলে জাতিগণনা অতি অবশ্যই করা দরকার।
কমরেড দীপঙ্কর বলেন, বর্তমানে সরকারি চাকরি দ্রুতহারে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং বেকারত্ব অত্যন্ত দ্রুতহারে ছড়িয়ে পড়ছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা ছাড়া সংরক্ষণের উদ্দেশ্যও মাটি হয়ে যাবে। আমাদের ছাত্রছাত্রী ও তরুণ প্রজন্ম লাগাতার এই প্রশ্ন উত্থাপন করে আসছে। জাতিগণনার মধ্যে কোনও হিন্দু-মুসলমান ইস্যু নেই, সমস্ত ক্ষেত্রেই জাতিগণনা চালানো জরুরি।
বিহার রাজ্যের সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে জাতিগণনার দাবি জানিয়েছেন। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বিধায়ক মেহবুব আলম। ডেপুটেশন থেকে ফিরে মেহবুব পাটনায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ১৯৩১ সালের পর থেকে আর জাতিগণনা হয়নি। কিন্তু এই মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের সামাজিক কাঠামোয় বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। দলিত/ওবিসিদের সংরক্ষণ অধিকার ও উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্পকে অর্থপূর্ণ ও যৌক্তিক করতে জাতিগণনা আবশ্যিক। এই অংশের জন্য এখন পর্যন্ত ৫০% সংরক্ষণ আছে। কিন্ত সমাজ বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস এই অংশ মোট জনসংখ্যার অন্তত পক্ষে ৭০% অথবা তারও বেশি। ফলত জাতিগণনা করলে তবেই দলিত/ওবিসিদের সঠিক শতাংশ নির্ণয় করা যেতে পারে এবং তার মধ্যে দিয়ে সরকারি প্রকল্পগুলিকে যুক্তিযুক্ত করে তোলা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন যে এই জাতিগণনা সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই করা দরকার। মুসলমান সমাজের মধ্যে জাতব্যবস্থা মোটেই নেই এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। সীমাঞ্চলের প্রায় এক কোটি জনসংখ্যার সূর্যপুরি জনগোষ্ঠিকে বিহার সরকার ওবিসি হিসেবে গণ্য করে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের তালিকায় কোথাও সূর্যপুরি জনগোষ্ঠির নাম নেই। তারফলে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ সরকারের বহু প্রকল্প থেকে বাদ পড়ে যায়। সুতরাং কোনও বৈষম্য না করে সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যেই জাতিগণনা করা বিশেষ জরুরি।