অলিম্পিক্স ও সংখ্যাগুরুবাদী জাতীয়তাবাদ
Olympics

‘পৃথিবীর মহত্তম প্রদর্শনী’ অলিম্পিক্সের সমাপ্তি ঘটল। অলিম্পিক্সের আসরে এতদিনের মধ্যে ভারতের ফল ‘সবচেয়ে ভালো’ হওয়া এবং অ্যাথলেটিক্সে একটা স্বর্ণপদক পাওয়াকে কেন্দ্র করে শাসক প্রতিষ্ঠান থেকে জাতীতাবাদের হাওয়া বওয়ানোর চেষ্টা হল। অলিম্পিক্স ক্রীড়ায় সাতটা পদক লাভ (২০১২ লণ্ডন অলিম্পিক্সে প্রাপ্ত পদকের সংখ্যা ছিল ৬) ১৪০ কোটি জনসংখ্যার সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ তা অবশ্যই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। ভারতের ক্রীড়া পরিকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল, খেলাধুলাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে এক প্রাণোচ্ছল ক্রীড়া সংস্কৃতি বিকাশের উদ্যোগ শাসকদের অগ্ৰাধিকারে পড়ে না। সোনার ডিম পাড়া ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলাধুলায়, কি শাসকদের কি স্পনসরদের হাতকে তেমন প্রসারিত হতে দেখা যায়না। এবারের বাজেটে নরেন্দ্র মোদী সরকারের ক্রীড়াক্ষেত্রে বরাদ্দকে ২৩০.৭৮ কোটি টাকা হ্রাস করাটা কখনই খেলাধুলায় প্রেরণা সঞ্চারের পরিচায়ক নয়। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা যেটুকু সাফল্য অর্জন করেছেন তা অবশ্যই গৌরবের এবং অভিনন্দন যোগ্য। কিন্তু শাসক দলের মন্ত্রী ও নেতারা নিজেদের শুধু ক্রীড়াবিদদের কৃতিত্বের অংশিদার করে তুলতেই আসরে নামছেন না, তাঁদের মার্কামারা যে জাতীয়তাবাদ তাকেও উস্কিয়ে তুলতে সক্রিয় হচ্ছেন। আসামের পদকজয়ী মেয়ে লাভলিনা বরগোহাঁইয়ের সাফল্যকে অভিনন্দিত করতে পোস্টার ছাপানো হল, আর তাতে শুধু বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার ছবি, পোস্টারে লাভলিনার নামটুকু ছাড়া ছবির কোন চিহ্নই নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রতিটা পদক প্রাপ্তিতে সোৎসাহে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে গেছেন এবং নিজের ছবি সহ সেই অভিনন্দন বার্তাকে প্রচারের বস্তু করে তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাপানের অলিম্পিক্স আয়োজকদের ধন্যবাদ দিতে গিয়ে বলেছেন, “ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ভালোভাবে সংগঠিত করার জন্য জাপানের সরকার ও জাপানের জনগণ, বিশেষভাবে টোকিওর জনগণকে বিশেষ ধন্যবাদ।... এটা আরও দেখিয়ে দিয়েছে যে খেলাধুলা কিভাবে ঐক্যের এক মহান সংগঠক হয়ে ওঠে।” ক্রীড়ার ঐক্যকারী ভূমিকাকে মোদী কি সত্যিই অন্তরে লালন করেন? ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্যকে ধরে নিজেদের বিভেদ ও বিদ্বেষের মতাদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসী কি তিনি হননি?

ভারতের পুরুষ হকিদল প্রবল পরাক্রম দেখিয়ে জার্মানিকে ৪-৩ গোলে পরাজিত করে ব্রোঞ্জ পদক জয় করে ৫ আগস্ট। তাঁদের বিভেদের পঞ্জিতে ৫ আগস্ট যে বিশেষ স্থান নিয়ে আছে সে কথা মোদী ভুলতে পারলেন না। তিনি বললেন, “এরমধ্যে দিয়ে ৫ আগস্ট বিশিষ্ট, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই দিনটা বছর-বছর ধরে ইতিহাসে স্থান করে নেবে।” কিন্তু কেন? এই দিনটাতেই ২০১৯ সালে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিলোপ ঘটানো হয়েছিল, রাজ্যের মর্যাদা হরণ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে দুটো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছিল। কাশ্মীরকে পরিণত করা হয়েছিল এক বৃহৎ কারাগারে, বন্দী করা হয়েছিল কাশ্মীরের নেতৃবৃন্দ ও বহুসংখ্যক মানুষকে, যাঁরা কারারুদ্ধ হয়নি তাঁরাও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হন। এই পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতা বোধ তীব্রতর হয়ে ওঠে। আর তাই ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্য, নীরজ চোপড়ার স্বর্ণপদক প্রাপ্তিও কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে একটুও আলোড়ন তুলতে পারেনি। পুরুষ হকি দলের ব্রোঞ্জ প্রাপ্তির দিন কাশ্মীরে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়, দোকানপাট বন্ধ থাকে। আবার ২০২০ সালের ৫ আগস্ট তিনি অযোধ্যায় বাবরি মন্দির ধ্বংস-স্থলে রামমন্দির তৈরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, “৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ রদের ফলে সাত দশক পরে জম্মু-কাশ্মীরের প্রত্যেক বাসিন্দা সব অধিকার ও সুবিধা ভোগ করার অধিকার পেয়েছিলেন। আবার গত বছরের ৫ আগস্ট রাম মন্দির তৈরির পথে প্রথম পদক্ষেপ করেছিলেন কোটি-কোটি দেশবাসী। আবার ৫ আগস্টেই দেশের তরুণ প্রজন্ম হকিতে গর্বের স্থান ফিরিয়ে আনার পথে বড় পদক্ষেপ করেছে।” এছাড়া, মহিলা হকি দল ব্রোঞ্জ পদক জয়ে সফল না হলেও যে পরাক্রমের নজির স্থাপন করে, নরেন্দ্র মোদী তারমধ্যে ‘নতুন ভারতের উদ্দীপনা’ খুঁজে পেয়েছেন। মোদীদের ‘নতুন ভারত’ বিজেপি ও আরএসএস-এর উত্থানকেই নির্দেশিত করে। নরেন্দ্র মোদী কখনই বিভেদের এজেণ্ডাকে, সংখ্যাগুরুবাদী মনোবৃত্তিকে দূরে রাখতে পারেন না। কাশ্মীরকে বৃহত্তর কারাগারে পরিণত করার ও কাশ্মীরের জনগণকে অধিকারচ্যুত করার এবং রাম মন্দির নির্মাণের সংখ্যাগুরুবাদী এজেণ্ডাকে ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্যের সঙ্গে একাকার করে তোলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারলেন না নরেন্দ্র মোদী। ভারতীয় রাজনীতিকে নির্দিষ্ট অভিমুখে চালিত করতে কাশ্মীরকে যেভাবে কাজে লাগানো হয়, সংখ্যাগুরু ভোটকে নিজেদের পক্ষে টানতে কাশ্মীরকে যেভাবে তুরুপের তাস করা হয়, অলিম্পিক্সে ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্যকেও সেই লক্ষ্যে ব্যবহার করতে সক্রিয় হলেন নরেন্দ্র মোদী।

মহিলা হকি দল কোনো পদক জিততে না পারলেও কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি ফাইনাল এবং ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে তাদের লড়াই ক্রীড়ামোদীদের এবং বিশেষজ্ঞ মহলের সম্ভ্রম কুড়িয়েছে। কিন্তু জাতপাতের কারবারিরা, ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শের অনুচররা মেয়েদের এই লড়াইকে কোন চোখে দেখেছেন? আর্জেন্টিনার কাছে ৪ আগস্ট ভরতীয় দল সেমিফাইনালে ১-২ গোলে পরাজিত হওয়ার পর উচ্চবর্ণের কিছু মানুষ হরিদ্বারে মহিলা হকি দলের সদস্য বন্দনা কাটারিয়ার বাড়ির কাছে গিয়ে হুল্লোড় করতে থাকে। বন্দনার অপরাধ — তারা দলিত। বন্দনার পারদর্শিতা নয়, দেশের জন্য তার প্রাণপণ লড়াইয়ের নজির নয়, তার জাত পরিচয়ই এদের কাছে একমাত্র বিবেচনার বিষয় হয়ে ওঠে। বন্দনার বাড়ির কাছে তারা বাজি ফাটিয়ে নৃত্য করতে থাকে। তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে এই শব্দগুলো, “তোরা ভারতীয় দলে ঢুকেছিস বলেই ভারত হেরেছে। তোদের খুন করে ফেলা উচিত।” ওদের কাছে ভারতীয় দলের পরাজয়ের জন্য বাকি খেলোয়াড়রা দায়ী নয়, দায়ী দলের একমাত্র দলিত সদস্য! ভারতীয় দলের পরাজয়ের জন্যই যেন ওরা অপেক্ষা করছিল আর হার হতেই ওরা দলিত-বিরোধী ঘৃণা ও তর্জনগর্জনকে উগরে দিতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে ৪-৩ গোলে জয়ে বন্দনার হ্যাট্রিক (যে কৃতিত্ব মহিলা হকি দলের অন্য কোনো সদস্যের নেই), ব্রোঞ্জ ম্যাচে প্রবল লড়াই ও একটা গোল — এগুলোর কোনোটাই ঐ বর্ণবাদী মাতব্বররা সমাদরের বিষয় বলে মনে করতে পারেনি। দলিত হয়ে বন্দনা কেন ভারতীয় দলে জায়গা পেল, দেশ-বিদেশের কোটি-কোটি মানুষ কেন একটা দলিত মেয়ের লড়াইকে চাক্ষুষ করতে থাকল — এইভাবেই ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের কৃতিত্বকে ছাপিয়ে দলিত-বিরোধী বিদ্বেষেই জাতপাতবাদীরা নিজেদের নিমজ্জিত রাখে। বন্দনার বাড়ির কাছে সেদিনের উপদ্রবের পর বন্দনার ভাই চন্দ্রশেখর বলেন, “ভারতীয় দল হেরে যাওয়ায় আমরা সবাই যখন মর্মাহত, তারা তখন বাজি ফাটিয়ে উল্লাস করছে — এতেই আমরা বিস্মিত।” নরেন্দ্র মোদী জমানায় দলিত দমনে উদ্যত বর্ণবাদীরা যে অনেক উৎসাহিত ও স্পর্ধিত হয়েছে, সে কথা কি বন্দনাদের নতুন করে জানতে হবে?

ক্রীড়াবিদদের সাফল্য বর্তমান শাসকদের ঐক্য গড়ার পথে প্রণোদিত করবে বলে কেউ যদি মনে করে থাকেন, তার চেয়ে ভ্রান্তিজনক আর কিছু হতে পারে না। অলিম্পিক্সের আয়োজনকে ‘ঐক্যকারী’ বলে অভিহিত করে নরেন্দ্র মোদী আরএসএস-এর এজেণ্ডার মহিমাকীর্তনে নেমেছেন। নরেন্দ্র মোদীদের জাতপাতবাদী অনুচররা অলিম্পিক্স ক্রীড়াকে দলিত-বিরোধী বিদ্বেষ উদগিরণের এক উপলক্ষ করে তুলেছেন। ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্যকে ধরে বিভেদ ও বিভাজনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সংখ্যাগুরুবাদী জাতীয়তাবাদে উগ্ৰতার এক প্রলেপ দিতেই উন্মুখ হয়েছেন নরেন্দ্র মোদীরা।

- জয়দীপ মিত্র 

খণ্ড-28
সংখ্যা-30