সে সময়টা ছিল ছাত্র যুবদের আত্মত্যাগের উজ্জ্বল সময়, সে সময়টা ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অন্ধকারতম সময়। সাতের দশকে মুক্তির মহাকাব্য লিখতে মরণপণ করা যুবকদের শেষ করতে রাষ্ট্র তার সমস্ত শক্তিকে নিয়োজিত করেছিল, সেটা ছিল খুনে সিদ্ধার্থ জমানার সময়, কংগ্রেসী গুন্ডা এবং আরও কিছু শক্তি যোগ দিয়েছিল নরমেধ যজ্ঞে। বারাসত, বেলেঘাটা, কোন্নগর, ডায়মন্ডহারবার — একটার পর একটা জায়গায় সংগঠিত হচ্ছিল গণহত্যা, ময়দানে খুন হন কবি ও রাজনৈতিক নেতা সরোজ দত্ত। সেই সময়েই কাশীপুর-বরানগরে সংগঠিত হয়েছিল নারকীয় গণহত্যা, ১২-১৩ আগস্ট দু’দিন দু’রাত্রি ধরে একটা অঞ্চলের শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যাদের অধিকাংশ ছিল কিশোর, তরুণ, যুবক। মুখে আলকাতরা মাখিয়ে যে হুগলি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তরতাজা যুবকদের, সেই হুগলি নদী দিয়ে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে বয়ে গেছে অনেক জল। তারপর ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসন আর এক দশকের তৃণমূল শাসন অতিক্রান্ত, ভঙ্গ হয়েছে গণহত্যার বিচারের প্রতিশ্রুতি।
ইতিমধ্যে আবার এক তমসাচ্ছন্ন সময়ে প্রবেশ করেছে ভারতবর্ষ। আর তাই কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার ৫০ বছর পূর্তি নতুন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে।
১৩ আগস্ট, প্রত্যেক বছর এই দিনটিতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সমবেত হয় কলকাতার উত্তর শহরতলীর সিঁথি মোড়ে শহীদ স্মারকস্তম্ভের সামনে। এবারের শহীদস্মরণ কর্মসূচিতে সামিল হয়েছিল আরও কিছু ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন। প্রথমে মাল্যদান ও নীরবতা পালনের মাধ্যমে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, তারপরে কয়েক ঘন্টার সভা থেকে এক জীবন্ত দিকনির্দেশের বার্তা বেরিয়ে আসে।
দীর্ঘ অসুস্থতা সত্বেও হাজির হয়েছিলেন পার্টি নেতা পার্থ ঘোষ, তিনি সেই সময়ে সারা পৃথিবী জুড়ে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াইয়ে ছাত্র যুবদের রাস্তার লড়াই-এর স্মৃতি তুলে ধরে ধরেন এবং বলেন “এই গণহত্যার বিচারের দাবিতে লড়াই চলতে থাকবে, আজকের ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের জন্যও এটা জরুরি”। পার্টি নেতা কার্তিক পাল বলেন, “আমরা আজ আওয়াজ তুলেছি বাংলার বুকে গণহত্যা আর নয়, একথার অর্থ গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে”। এই গণহত্যার সত্য উদঘাটনে যে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল তাতে শহিদ পরিবারের বহু মানুষ যেমন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তেমনি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন অনেক গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ। এআইসিসিটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তিনি বলেন আজও সেই তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলোনা। উত্তর ২৪ পরগণার সিপিআই(এমএল) নেতা নবেন্দু দাশগুপ্ত বলেন, “নতুন প্রজন্মের কাছে কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার ইতিহাস পরিচিত করানো দরকার। ন্যায়বিচারের দাবিতে চাপ জারী রাখতে হবে।” ‘আজকের দেশব্রতী’ পত্রিকার সম্পাদক বলেন, “ইতিহাসের চাপা পড়া সত্যকে তুলে আনতে হয়, কংগ্রেসী যে নেতার মৃত্যুকে অজুহাত করে গণহত্যালীলা চালানো হয়েছিল সেই হত্যায় পাঁচ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল, অথচ শতাধিক মানুষের হত্যাকান্ডের আজও কোনও তদন্ত হল না, বিচার হল না, একজনেরও সাজা হল না।” সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সেই অন্ধকার জমানা এবং জরুরী অবস্থার সেই দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনার বিজেপির কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলনের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) রেড স্টারের পক্ষে রাজু সিংহ, নিউ ডেমোক্র্যাসির সুশান্ত ঝা, শ্রমিক আন্দোলনের সাথী কুশল দেবনাথ ও ভারতের সাম্যবাদী দলের নেত্রী বর্ণালী মুখার্জী। রাষ্ট্র এই হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষ মদত দিয়েছিল।
একুশ শতকের গোড়ায় গুজরাট থেকে শুরু হয়ে আজ ছত্রিশগড়, কাশ্মীর, দিল্লীতে গণহত্যা ঘটে চলেছে; শহীদ চারু মজুমদারের মতোই জেল হেফাজতে খুন হচ্ছেন ফাদার স্ট্যান স্বামী, প্রতিবাদীদের জেলে পোরা হচ্ছে, তাই রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করা ও তার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার গুরুত্ব তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন নাট্যব্যক্তিত্ব দেবাশিস চক্রবর্তী, মহিলা নেত্রী ইন্দ্রানী দত্ত, ছাত্র নেতা নীলাশিস বসু। সভায় উচ্চারিত হয় নির্মাতা নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের তথ্যচিত্র ‘উজান বেয়ে’র প্রসঙ্গ। সঙ্গীত পরিবেশন করেন বাবুনি মজুমদার ও মেঘনা মজুমদার, ছাত্র সাথী সায়ন, অগ্নিবীণা সাংস্কৃতিক সংস্থা, নীতীশ রায় ও শান্তনু ভট্টাচার্য, কবিতা পাঠ করেন শোভনা নাথ ও ভিয়েত ব্যানার্জি। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জয়তু দেশমুখ ও অন্বেষা গণহত্যার বিচার চেয়ে ও ফ্যাসিবাদকে রোখার স্লোগান তুলে সভার কাজ শেষ করেন। এই কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় নজর কেড়েছে নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা — আইসা’র সদস্যরা।