৫ বছর আগের নোট বাতিল, যার গাল ভরা ইংরেজি নাম ছিল ডিমানিটাইজেশন, তার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। সেই ডিমানিটাইজেশনের উদ্দেশ্য ছিল কালো টাকা উদ্ধার, যে টাকা উদ্ধার হলে সরকারের দায় কমত, এবং সরকার দেশের উন্নতিতে, পরিকাঠামো গড়ে তুলতে লাগাতে পারত। সে কালো টাকা সব সাদা হয়ে গেল, প্রধানমন্ত্রীর জনধন যোজনায় আগে থেকেই তৈরি রাখা ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টের সৌজন্যে। কপাল পুড়লো ছোট ব্যবসায়ীদের, ভ্যানচালক, রিক্সাচালক, অটোচালক, বাসচালক তেকে শুরু করে সব দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমজীবী জনতার। প্রধানমন্ত্রী ভাষণে সাত মণ তেল পোড়ালেও রাধা নাচল না, কালো টাকা ফিরল না। অর্থনীতির যে বেহাল অবস্থা তৈরি করলেন তিনি তার ফল এখনো দেশ ভুগেই চলেছে।
সেই ভোগান্তি বাড়তে বাড়তে এই করোনা কালে জিডিপি অধোগতিতে পৌঁছেছে। দেশ এখন সামগ্রিকে ২০১৮ সালের মত গরিব, ২০২০-২১ সালের মাথাপিছু আয় ২০১৭-১৮ সালের থেকেও কম। মোদীজী লালকেল্লা থেকে ভাষণে দেশের অর্থনীতিকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওযার জন্য গর্ব করেন, ভক্তজন উল্লসিত হয়, কিন্তু মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারতের স্থান ১৬২তম, বাংলাদেশেরও পিছনে, তা ভুলেও বলেন না। “নিতি আয়োগ” বলে একটি অম্লানবদনে অনৃত ভাষণকারী ও মোদী তোষণকারী প্রতিষ্ঠান সরকারি পয়সায় তৈরি হয়েছে যার কর্তারা অবলীলাক্রমে সরকার থেকে বেতন গ্রহণ করে সরকারি সম্পদকে ব্যক্তি মালিকানায় তুলে দেওয়ার জন্য ওকালতি করে, ও নীতি তৈরি করে। সেই নীতিহীন "নিতি আয়োগ" দেশের অবস্থা কত ভালো হয়েছে বলে রোজ রিপোর্ট বানাচ্ছেন ওদিকে দিগগজ প্রধানমন্ত্রীর পদাঙ্কিত গরিব কল্যাণ যোজনার ঘোষণা অনুযায়ী ভারতের ৬০শতাংশের বেশি মানুষের (৮০ কোটি) চাল-গম কেনার সাধ্যি নেই।
ওদিকে নিতি আয়োগ, ডিমানিটাইজেশন, জিএসটি, মেক ইন ইন্ডিয়া, আত্মনির্ভর ভারত ইত্যাদি প্রভৃতি বহুবিধ গালভরা প্রতিষ্ঠান ও ঘোষণার দৌলতে কর্মপ্রার্থীদের হাতে কাজ নেই, সরকারি কোষাগারে টাকা নেই, রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির ১০ শতাংশকে কবেই পার করে দিয়েছে, কিন্তু কর্পোরেটদের উপরে কর কমেছে, ধনীদের উপরে কর কমানোর বন্দোবস্ত হয়েছে। তাই সরকার রাজকোষে টাকা জোটাতে গত সত্তর বছরের রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বারংবার বিক্রি করছে, এমনকি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যে রিজার্ভ তহবিল যা দেশের তেমন কোন জরুরি আর্থিক সঙ্কটের সময়ে অর্থব্যবস্থাকে সতেজ রাখতে ব্যবহার করার কথা ছিল তা থেকেও অবলীলাক্রমে টাকা তুলে নিয়েছে। মনে রাখা দরকার, এসবই হয়েছে করোনাকালের আগে। ফলে এই সরকার যে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে তাল সামলাতে অপারগ তা বোঝাই যাচ্ছে। কেবল তাই নয়, সরকারের দেশ পরিচালনায় অকর্মণ্যতার দৌলতে যেসব সম্পদ/রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা মোদী-সীতারামন বেচতে চাইছেন তাও কেনার খদ্দের পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা, সব অর্বুদপতি খরিদ্দাররা দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। ফলে ২০১৯-২০ সালের বাজেটের বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০৫ হাজার কোটি টাকা, পাওয়া গেছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১-এর বাজেটে লক্ষ্য ছিল ২১৪ হাজার কোটি টাকা, পাওয়া গেছে ২৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ এর বাজেটে বাকি ১৭৫ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা রয়েছে। কেউ এগিয়ে আসছে বলে তেমন জানা যায়নি।
ওদিকে সরকারের ভাঁড়ে মা ভবানী। মোদিীসাহেব তিন বছর ধরে পরিকাঠামোয় শতাধিক লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ করে কোটি কোটি যুবকের কর্মপ্রার্থনা পূরণের বাণী লালকেল্লার স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে দিয়ে চলেছেন। ২০১৯, ২০২০ ও অতি সম্প্রতি ২০২১-এর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে তিনি পরিকাঠামোয় যথাক্রমে ১০০ লক্ষ কোটি, ১১০ লক্ষ কোটি ও ১০০ লক্ষ কোটির বেশি টাকা বিনিয়োগ করবেন বলেছেন, একই কুমীরছানা দেখানো হচ্ছে ধূর্ত শেয়ালের মতো। বাজেটে কোনও অর্থের সংস্থান নেই। কর্পোরেটদের উপর করও বাড়াবেন না বা বসাবেন না, ধনীদের উপরেও করের বোঝা(?) বাড়ানো চলবে না। ওরাই টাকা দেন বলে বিজেপি সর্বাধিক ধনী পার্টি। আগেই বলেছি বিলগ্নিকরণ করেও টাকা উঠছে না। তাই নতুন জুমলা। সম্পদ মুদ্রাকরণ বা এ্যাসেট মানিটাইজেশন। ২০১৬ সালে ডিমানিটাইজেশন, আর ২০২১ সালে মানিটাইজেশন। সেটি করে ৬ লক্ষ কোটি টাকা তোলা হবে ৪ বছর ধরে। আর সেই টাকা দিয়ে পরিকাঠামো বানানো হবে। সামাজিক অর্থনীতির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের সম্পদ এভাবে মানিটাইজ করা উচিত-অনুচিতের প্রশ্নের বাইরে দুটি জিজ্ঞাসা অনিবার্য। মোদীজী ৩ বার লালকেল্লার ভাষণে পরিকাঠামাোয় যে বিনিয়োগের পরিমাণ ঘোষণা করেছেন তা যোগ করলে ৩১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি হয়। তাহলে আগামী ৪ বছরে ৬ লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে কীভাবে মোদীবাবার স্বপ্নপূরণ হবে? যদি তিনবারের ঘোষণাকে পুনরাবৃত্তি বলে মেনে নিই, তাহলেও ১১০ লক্ষ কোটি টাকার পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ কি ৬ লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে মেটানো যাবে? দ্বিতীয়ত, এই মোদী-সীতারামন-শাহ-গোয়েলরা অবিরাম বলে চলেছেন বিগত ৭০ বছরে দেশে কিছুই হয়নি, তাহলে এই মানিটাইজেশনের জন্য সম্পদগুলি কোথা থেকে এল? এগুলি কি সব মোদী সরকার গত ৭ বছরে বানিয়েছে? দুটি প্রশ্নের উত্তরই মোদী সরকারের গালে চূণকালি মাখাবে। অবশ্য তাতে কিছুই যায় আসে না। ডিমানিটাইজেশন হোক বা মানিটাইজেশন, ব্যর্থতা এই সরকারের অনিবার্যতা, আর ব্যর্থতাকে অস্বীকার করা মোদী সরকারের বৈশিষ্ট্য।
মানিটাইজেশনের অর্থ হল, সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার মালিকানায় থাকা বিভিন্ন সম্পদকে দীর্ঘকালিন লীজের ভিত্তিতে বেসরকারি মালিককে ব্যবহার বা ব্যবসা করতে দেওয়া হবে। ব্যবসায়ী তা থেকে মুনাফা করবে ও লীজের সময়কালের শেষে সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেবে। এই খাতে সরকার ২০২১-২২ সালে ৮৮১৯০ কোটি, ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ সালে যথাক্রমে ১৬২৪২২, ১৭৯৫৪৪ ও ১৬৭৩৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। অপরদিকে সরকার যে সব সম্পদ ব্যবহার করতে দিয়ে ওই টাকা পাবে তা মোটামুটি এরকম: ১.৬ লক্ষ কোটি টাকা পাওয়া যাবে ২৬৭০০ কিমি ন্যাশনাল হাইওয়েজ লীজ দিয়ে। রেলওয়েজ থেকে ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা, ৪০০ স্টেশন, ৯০ টি প্যাসেঞ্জার ও ৬০টি মালবাহী ট্রেন বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে। পাওয়ার ট্রান্সমিশনের সার্কিট থেকে ৪৫৩০০ কোটি টাকা; এনটিপিসি, এনএইচপিসি'র বিদ্যুত উৎপাদনের সুবিধা বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে ৪০ হাজার কোটি; গেইলের কাছে থাকা জাতীয় গ্যাস পাইপলাইন থেকে ২৪ হাজার কোটি; টেলিকমের ক্ষেত্রে ভারত নেটের ২.৮৬ লক্ষ কিমি ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক থেকে ৩৫১০০ কোটি, ২১০ লক্ষ মেট্রিক টনের খাদ্য গুদাম থেকে ২৯ হাজর কোটি, ১৬০টা খনি থেকে ২৯ হাজার কোটি, ২৫টি এয়ারপোর্ট থেকে ২১ হাজার কোটি, ৯টি পোর্ট থেকে ১৩ হাজার কোটি, দুটো জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে ১১ হাজার কোটি ও শহরে রিয়াল এস্টেট থেকে ১৫ হাজার কোটি অর্থাৎ, জল স্থল অন্তরীক্ষ যেখানে যা আছে তার বড় অংশই তুলে দেওয়া হবে ব্যক্তি মালিকানার হাতে। সরকারের হাতে শেষমেশ থাকবে পেন্সিল।
এত বড় পরিমাণে দেশের সর্বজনীন সম্পদ কতিপয় পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া ঘোষণা করাটা এই নিকৃষ্টতম সরকারের কাছেও অসুবিধাজনক হওয়ায় অর্থমন্ত্রী বারবার বলে চলেছেন বিক্রি তো করছিনা, অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করতে দিচ্ছি। সময়কাল শেষ হলে তা আবার সরকারের কাছে চলে আসবে। প্রথমত তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। ব্যবসাটি লাভজনক হলে কর্পোরেট তা কখনোই ফেরত দেবে না। অন্যদিকে অলাভজনক হলে টাকা না দিয়ে তা ফেরত দিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত ক্ষেত্র বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার ভাবনা তা এতই গুরুত্বপূর্ণ সেগুলিতে একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজি এসে উপস্থিত হলে একদিকে উপভোক্তাকে অধিক অর্থ দিতে হবে। যেমন, রেলওয়েজ বা টেলিকম। রেলওয়েজ ভারতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার জনসাধারণের জীবনরেখা। সেই রেলওয়েজকে ব্যক্তি মুনাফার কেন্দ্রে নিয়ে গেলে শ্রমজীবী জনসাধারণের ঘাড়ে বোঝা বাড়বেই।
অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রগুলিতে কর্মসংস্থান হয়। বেসরকারি হাতে গেলে চুক্তি শ্রমিক, অস্থায়ী শ্রমিক, ফার্মিং আউটের মত চূড়ান্ত অমানবিক পদ্ধিতিগুলি আরো শক্তিশালী বাবে চালু করা হবে। কর্মসংস্থান কমবে। কেবল তাই নয়, সামাজিক ন্যায়ের জন্য যে সংরক্ষণ প্রথা সরকারি নিয়োগে চালু আছে তা বেসরকারি ক্ষেত্রে নেই। ফলে ক্রমাগত বিরাষ্ট্রীয়করণ বা গালভরা নাম মানিটাইজেশন যাই হোক না কেন সংরক্ষণ প্রথার বারোটা বাজিয়ে দেওয়াও হবে এর মধ্য দিয়ে।
একটি শ্লোগান দক্ষিণপন্থীরা সেই নরসিংহ রাও-মনমোহন সিং-চিদাম্বরমের সময় থেকে বলে চলেছে, ইংরেজিতে, “গভার্নমেন্ট হ্যাজ নো বিজিনেস টু ডু বিজিনেস (সরকারের ব্যবসা করা কাজ নয়)”। মনে হচ্ছে বলার সময় এসেছে, “গভার্নমেন্ট হ্যাজ এভ্রি রাইট টু ডু বিজিনেস এন্ড হ্যাজ অল দ্য ডিউটি টু ডু বিজিনেস হোয়েন বিজিনেসেস ওনলি প্রোফিটিয়ার এন্ড মেক দ্য ইকোনোমি সিক এ্যালোঙ্গ উইথ ইটস মাসেস” (সরকারের ব্যবসা করার সবরকম অধিকার আছে এবং তা করা কর্তব্য যখন ব্যবসাগুলি কেবল মুনাফাবাজি করে অর্থনীতিকে ও দেশের জনগণকে রুগ্ন করে তোলে)”। ডিমানিটাইজেশন থেকে মানিটাইজেশন — জনসাধারণকে দরিদ্র করার ট্রাডিশন সমানে চলেছে।
- অমিত দাশগুপ্ত