সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি, দশ থেকে দশ হাজার, ফেমিনিস্টস ইন রেসিস্টেন্স, অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন, শ্রমজীবী মহিলা সমিতি, উমেন ফর উমেন, দুর্বার, ডব্লিউএসএস, এনএফআইডব্লিউ’র ডাকে, ২৩ আগস্ট কলকাতার মৌলালী মোড়ে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে আফগান জনগণের সংহতিতে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ এবং তালিবান শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সভা অনুষ্ঠিত হয়।
২০২০’র ফেব্রুয়ারীতে ট্রাম্পের নেতৃত্বে আমেরিকা তালিবানদের সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে আফগান দেশের সরকার, জনপ্রতিনিধি বা আফগান নারীদের উপস্থিতি ছাড়াই (যে কোনো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশিকা অনুযায়ী মহিলাদের উপস্থিতি আবশ্যক)। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী কূটনীতির ফলাফল হিসাবে আফগানিস্তানের শাসন ব্যবস্থার হস্তান্তর হল মৌলবাদী তালিবানদের হাতে। ক্ষমতায় এসেই তারা ঘোষণা করেছেন নারীর অধিকার সীমাবদ্ধ থাকবে তাদের স্থির করা ধর্মীয় আইনের লক্ষণরেখার মধ্যে। ক্ষমতায় আসার পর নারী, সাংবাদিক ও তালিবানদের বিরুদ্ধে মুখর যেকোনো মানুষকে চুপ করাতে চলছে নির্মম দমন। তালিবানি শাসন থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টায় দুইজন আফগান যুব জাতীয় ফুটবলার ও ডাক্তার মারা গেছেন। তালিবানরা আফগান মেয়েদের সংবাদ পরিচালনার কাছ থেকে বলপূর্বক সরিয়ে পুরুষদের নিয়ে আসছে। মতপ্রকাশের যেকোনো প্রয়াসকে স্তব্ধ করে দিতে বেপরোয়া মৌলবাদী তালিবানরা। এর বিরুদ্ধে আফগান মানুষেরা নিজেদের জান বাজি রেখে, জাতীয় পতাকা কাঁধে তালিবানদের ক্ষমতা দখলকে অস্বীকার করছেন এবং সাংবিধানিক ভাবে নির্বাচনের দাবি করছেন। অকুতোভয় আফগান মেয়েদের দেখা যাচ্ছে পোস্টার, ব্যানার নিয়ে জনগণের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে।
পাশাপাশি আমাদের দেশে আরএসএস, বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি আফগানিস্তানের পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘৃণ্য কর্মসূচিতে নেমে পড়েছে। ধর্মীয় বৈষম্যের ভিত্তিতে আফগানিস্তানের শরণার্থীদের মধ্যে শুধুমাত্র হিন্দু ও শিখদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত সরকার তাদের ফ্যাসিবাদী মানসিকতার নির্লজ্জ পরিচয় দিয়েছে।
আফগানিস্তানের কুইয়্যার-নারী গণতন্ত্রকামী মানুষের স্বাধীনতার লড়াইয়ের পাশে সংহতির বার্তা নিয়ে ও তালিবানের ছুতোয় ভারতে সাম্প্রদায়িক জিগির তোলা আরএসএস বিজেপিকে রুখে দিতে, সারা দেশের সাথে মৌলালি সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদী সভা অনুষ্ঠিত হয়। মৌলালির সভায় বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব বক্তব্য রাখেন।
২৩ আগষ্ট সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগণার বজবজ গ্রামাঞ্চলে এবং বাখরাহাটে “স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য আফগান জনগনের পাশে দাঁড়ান, সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ এবং তালিবানি শাসনের বিরুদ্ধে একত্রিত হোন” আহ্বানে কর্মসূচি সংগঠিত হয়। বাখরাহাটের কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদিকা কাজল দত্ত সহ মহিলা সমিতির সদস্যরা। সারা ভারত কিষাণ মহাসভার জেলা সম্পাদক দিলীপ পাল ছাড়াও লোকাল কমিটির সম্পাদক নিখিলেশ পাল, কমিটির সদস্য সন্দীপ ধাড়া, নেত্রী পূর্ণিমা হালদার সহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। আফগানিস্তানে তালিবানি শাসন ও সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে সভা শেষ হয়। বজবজ গ্রামাঞ্চলে দেবযানী গোস্বামী, অঞ্জনা মালের নেতৃত্বে কর্মসূচি সংগঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লোকাল সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ দত্ত, কমিটির সদস্য শ্যামসুন্দর গোস্বামী সহ মহিলা সমিতির সদস্যা এবং ছাত্রী কমরেডরা।
অশোকনগরে আফগানিস্তানে আমেরিকার মদতপুষ্ট তালিবান বাহিনীর নারী, শিশু সহ নাগরিকদের উপর নির্যাতন বন্ধের দাবিতে এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর অপচেষ্টা প্রতিহত করতে ২৩ আগস্ট সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির অশোকনগর শাখার পক্ষ থেকে বিক্ষোভসভা করা হয়। বক্তব্য রাখেন সমিতির আঞ্চলিক নেত্রী জয়শ্রী দাস ও রীনা মজুমদার সহ পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী অনির্বাণ দাস ও সিপিআই (এম-এল) এরিয়া সম্পাদক অজয় বসাক। সঙ্গীত পরিবেশন করেন ছাত্রী মেঘনা মজুমদার।
এছাড়াও আইপোয়ার একক উদ্যোগে উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগর, বেলঘরিয়া, খড়দহ, দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিষ্ণুপুর, বাকরাহাট ইত্যাদি অঞ্চলে আফগানিস্তানের মানুষদের লড়াইয়ে পাশে থাকার বার্তা নিয়ে পথসভা ও পোস্টারিং হয়। বক্তব্য রাখেন আইপোয়ার জেলা নেতৃত্ব ও অন্যান্যরা।
২৬ আগস্ট ২০২১
পাটনা শহরে আমাদের সকলের প্রিয় কমরেড ব্রিজবিহারী পাণ্ডের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে সিপিআই(এমএল) স্তম্ভিত। কমরেড পাণ্ডেজি কোলন অপারেশন থেকে সদ্য সেরে উঠেছিলেন। কিন্তু সার্জারির পর থেকে বুকে সংক্রমণ সহ কিছু জটিলতায় ভুগছিলেন। ২৬ আগস্ট ২০২১ হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হল।
“পাণ্ডেজি” নামেই পার্টিতে বিশেষ পরিচিত ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন কানপুরে কমরেড বিনোদ মিশ্রের ছোটবেলার বন্ধু। দুই তরুণ একসাথে দুর্গাপুর রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছিলেন ১৯৬৬ সালে। এখানেই তাঁদের দেখা হয়ে যায় ধূর্জটি প্রসাদ বক্সী ও গৌতম সেনের সাথে। নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলিতে ক্যাম্পাসে বয়ে যাওয়া বিপ্লবের ঝোড়ো হাওয়ায় এইসব তরুণেরা আর ই কলেজ ক্যাম্পাসের কঠোর অনুশাসনের পরিবেশকে উড়িয়ে দিয়ে যুব বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন এবং শ্রমিক ও কৃষকের সংগ্রামের সংহতিতে ছাত্রছাত্রীদের একাত্ম করেছিলেন। পাণ্ডেজি'র প্রয়াণের সাথে সাথে দূর্গাপুর আর ই কলেজের এই চতুষ্টয়েরও অন্তিম অবসান হল।
কমরেড ভিএম ও ডিপি বক্সির সাথে পার্টির সর্বক্ষণের সংগঠক কর্মী হয়ে পাণ্ডেজি বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭৪ সাল থেকে তিনি কাজ করেছেন দিল্লি, পাঞ্জাব, বাংলা ও ঝাড়খণ্ডে (যেখানে কিছু দিন গিরিডি সেক্রেটরি হিসেবে ছিলেন) এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ও পার্টির বিভিন্ন মুখপত্রে যার মধ্যে আছে কেন্দ্রীয় মুখপত্র লোকযুদ্ধ ও লিবারেশন। বর্তমানে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারপার্সন হিসেবে কাজ করছিলেন।
বহু বিচিত্র বিষয়ে ব্যাপক বিস্তৃত জ্ঞান ও বিশ্বকোষের মতো পাণ্ডিত্যের অধিকারি পাণ্ডেজি ছিলেন বহুভাষী। ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা ছাড়াও ভালো পাঞ্জাবি বলতেন এবং এমনকি তামিল বুঝতেন। বিজ্ঞান হোক বা সাহিত্য ও সংস্কৃতি, রাজনীতি হোক বা ইতিহাস — সবেতেই পাণ্ডেজির অসীম অনুরাগ ও বিচরণ ছিল। এবং যে বিষয়েই ঢুকতেন অচিরেই সে বিষয়ে বিশেষ দখল অর্জন করে ফেলতেন। তাঁর বৌদ্ধিক অর্জনের সহযোগি ছিল বিরল প্রকৃতির ধৈর্য যা তাঁকে এক আদর্শ শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক করে তুলেছিল। অসংখ্য তরুণ কমরেড – পার্টি প্রকাশনার সম্পাদকদের থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণসংগঠনের নেতাকর্মী – তাঁর সহৃদয় প্রণোদনা পেয়েছেন। সম্পূর্ণ আনপড় ব্যক্তিকে কম্পিউটার শেখানো হোক বা পদার্থবিদ্যার ছাত্রের সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্স আলোচনা, অথবা জনসংস্কৃতি মঞ্চের কমরেডদের সাথে সদ্য প্রকাশিত কোনও উপন্যাস বা কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা — সবই অত্যন্ত আনন্দের সাথে করতেন তিনি, ঠিক যেমন পার্টি সংগঠকের দৈনন্দিন ঝুটঝামেলার আলোচনাও কমরেডদের সাথে করতেন আনন্দের সাথে।
পাণ্ডেজির জীবনসঙ্গী কমরেড বিভা গুপ্তা (অধিকাংশ কমরেডদের কাছে যিনি ঝুমা নামে পরিচিত) ও তাঁদের মেয়ে অদিতি ও রিয়াকে এই অপার দুঃখের কালে সমগ্র পার্টি ভালোবাসা ও সহযোগিতা জানাচ্ছে।
কমরেড বি বি পাণ্ডে লাল সেলাম।
মুখ্যমন্ত্রী কিছু ঘোষণা শোনালেন রাজ্য সরকারের উপজাতি উপদেষ্টা পর্ষদের এক বৈঠক থেকে। প্রথমত বললেন, যে কোনও মূল্যে রক্ষা করা হবে অরণ্য সম্পদ ও জমির ওপর আদিবাসীদের অধিকার। কেন্দ্রের মোদী সরকার যখন ছলে-বলে-কৌশলে জল-জমি-জঙ্গলের কর্পোরেট হস্তান্তরের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সেই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলায় তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফেরা মমতা সরকারের অরণ্য নীতি ও আদিবাসী জমি নীতির ঘোষণা অবশ্যই স্বাগত জানানোর। কিন্তু তার পরেও দেখার থাকবে। ঘোষণা এক ব্যাপার, আর তার সৎ রূপায়ণ আরেক ব্যাপার। দুইয়ের মধ্যে বাস্তবত স্ববিরোধ থাকছে কিনা বুঝে নিতে হবে সেটা। শঙ্কা জাগছে বিশেষত আরও এই কারণে যে এরকম কিছু অশনি সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। দক্ষিণবঙ্গে কোন কোন অংশে বনসংলগ্ন অধিবাসীরা নতুন করে সম্মুখীন হতে শুরু করেছেন প্রতারণার ও উচ্ছেদের হুমকির। তাই এ বিষয়ে সরকারকে মাপতে হবে কথায় ও কাজে।
দ্বিতীয়ত, অভিযোগ আসতে শুরু করেছে ভূয়ো তথ্যের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ভূয়ো এসটি শংসাপত্র হাতানোর। যদিও এর কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী, তবু খতিয়ে দেখে বুঝে নিতে হবে। এরাজ্যে এসটি জনসংখ্যার ভাগ ৫.৮ শতাংশের মতো। মুখ্যমন্ত্রী শোনালেন, ২০১৩ সালে গঠন হওয়া এই উপদেষ্টা পর্ষদের বাজেট এ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে ছয়গুণ। যদিও তার কাজের বিশেষ ছাপ বোঝার উপায় নেই, কারণ সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট কার্ড প্রকাশ করা হয় না। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য জানালেন এই পর্ষদ এবার থেকে ছয় মাস অন্তর সব কিছু নির্ধারণ ও রূপায়ণ করবে।
তৃতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রী আরও বললেন, আদিবাসী উপজাতি জনজাতিদের জন্য কয়েকশ স্কুল তৈরি করা হবে। একনজরে আভাস দিলেন অলচিকি ভাষায় পাঁচশ, রাজবংশীদের জন্য দুশো, ইংরাজি মাধ্যমে একশ এবং দুটি কামতাপুর স্কুল গড়া হবে। এছাড়া সিলেবাস তৈরি চূড়ান্ত হলে স্কুল তৈরি হবে কুর্মী, হিন্দী, গোর্খা, নেপালি, সদগিরি, কুরমালী, লেপচা ও উর্দু ভাষীদের জন্যেও। এ রাজ্যে এত বৈচিত্রপূর্ণ সংখ্যায় মাতৃভাষায় বিদ্যার্জন পরিকল্পনার ভাবনা এর আগে কখনও শোনা যায়নি। স্বাধীনতার পঁচাত্তরে পদার্পণ করেও মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের প্রশ্নে কি বঞ্চনার সমুদ্রেই না হাহুতাশ করে মরতে হয় প্রান্তবাসী সব জনসমুদয়কে! এই অর্থে মমতা সরকারের উপস্থাপনা নতুন। কিন্তু এও সেই একই ব্যাপার, শুধু কথায় না বড় হয়ে কাজ শুরু করে কিনা দেখার। বিজ্ঞাপনী প্রচারে বাজীমাৎ করার পরিবর্তে দীর্ঘকালের অপ্রাপ্তিকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ত্বরান্বিত করা হচ্ছে কিনা সেটাই আসল বিষয়।
প্রান্তিক জনসম্প্রদায় বর্গগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় থাকা বড় কঠিন হয়ে রয়েছে। ২০১৯-২০-র সারা ভারত মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষার রিপোর্ট বলছে, নবম ও দশম শ্রেণীতে স্কুল ছুটের অংশ এখনও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সাধারণ বর্গে যেখানে প্রতি ৯ জনে ১ জন, সেখানে আাদিবাসী/উপজাতিদের ক্ষেত্রে প্রতি ৪ জনে ১, দলিতের ক্ষেত্রে প্রতি ৫ জনে ১ জন হয়ে যায় স্কুল ছুট। পশ্চিমবাংলায় এর শতাংশ ভাগ হল সাধারণ বর্গ (১০.৩), ওবিসি (১৩.৩), এসসি (১৮.৮) এসটি(২১.৬)। সুতরাং অবস্থাটা নিদারুণ।
এর সাথে যুক্ত করুন নিরক্ষরতার হার। এরাজ্যে সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ। তার মানে এখনও ২ কোটি মানুষ রয়েছে নিরক্ষর। রাজ্যের স্কুলশিক্ষা বিভাগের ২০১২ সালে প্রকাশিত 'কলকাতা গেজেটে'ও বহু কথা বলা হয়েছে। গ্রাম-শহরে, পঞ্চায়েত-পৌরসভার তত্ত্বাবধানে, জনশিক্ষা দপ্তর, নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর, সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তর ও মাদ্রাসা এবং পশ্চাদপদ জনজাতি কল্যাণ বিভাগ ইত্যাদির সমন্বয় থাকতে হবে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সরকারি পর্যবেক্ষেণ রাখতে হবে। অতিমারীতে ২০২০-২১ শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যয়ের শিকার। কিন্তু ২০১২ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত রিপোর্ট কার্ড কোথায়? তাছাড়া স্কুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, বিভিন্ন ব্যয়বৃদ্ধি এবং শিক্ষক ঘাটতি ও নতুন শিক্ষক নিয়োগ বা বদলি পলিসিকে কেন্দ্র করে চলছে নৈরাজ্য, দুর্নীতি, দলতন্ত্র। সুতরাং মাপতে হবে কথায় নয়, কাজে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন শক্তির নিষ্ক্রমণ আর সাথে সাথে মার্কিন অভিভাবকত্বে চলা আশরাফ গনি সরকারের পতন ও তালিবানদের ক্ষমতা দখলকে প্রকৃতপক্ষে মার্কিন শক্তির বোঝাপড়ায় ক্ষমতার হস্তান্তর বলা যেতে পারে যা আফগানিস্তানের পরিস্থিতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছে। আফগানিস্তানের বিভিন্ন স্তরের জনতার ওপর তালিবানদের আক্রমণের ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ আফগানিস্তান ছেড়ে পালানোর মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বাস বা ট্রেনের উপচে পড়া ভিড়ের মত মালবাহী উড়োজাহাজে শত শত মানুষের গাদাগাদি আর প্লেনের ডানা আঁকড়ে থাকা, এক ডাক্তার আর এক ফুটবলারের উড়ন্ত জাহাজ থেকে ঝরে পড়ে ভয়াল মৃত্যু — এসবই দেখিয়ে দেয় কতটা অনিশ্চিত ও আতঙ্কময় পরিবর্তন এখন আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে ঘটে চলেছে। তালিবানরা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা মানুষের জীবনের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়। নারীর অধিকার বিলোপ করতে চায়। নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও প্রতিবাদীদের সন্ত্রস্ত করতে চায়। এবং এমনকি আফগানিস্তানে সরকার নির্বাচনও নাকচ করে দিতে চায়।
আফগানিস্তানের বর্তমান ডামাডোল প্রথমত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি হল আর কত দিনই বা তারা আফগানিস্তানের দেখভাল করবে, এবং এখন তারা আফগানিস্তান ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে আফগানদের অধিকারকে সম্মান জানাতে, যাতে আফগানরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই ঠিক করে নিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যুক্তি চরম মিথ্যাচার, ঠিক যেমন এক সময় আফগানিস্তানে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাও ছিল আরেক মিথ্যাচার। মার্কিন আগ্রাসন তো আফগানিস্তানকে নিদারুণ দুর্দশায় ফেলেছেই, সেই সাথে একথা ভুললেও চলবে না যে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ঘটল তালিবানদের সাথে মার্কিনিদের বোঝাপড়া করা পরিকল্পনা অনুযায়ী। বোঝাপড়ার বেশিরভাগটাই যে পেছনের দরজা দিয়ে হয়েছে তা বলা বাহুল্য। কিছু কিছু অংশ জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে ২০২০’র মার্কিন-তালিবান চুক্তি হিসেবে। চুক্তিটি মার্কিন ছলচাতুরি ও কপটতার ক্লাসিক উদাহরণ।
২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি দোহা শহরে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তার শিরোনাম, “আফগানিস্তানে শান্তি আনতে চুক্তি ‘আফগানিস্তান ইসলামিক আমিরশাহী’-র সাথে যাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তালিবান নামে পরিচিত”। চুক্তি ও তার আগের বোঝাপড়ার সমগ্র প্রক্রিয়া থেকে আফগানিস্তানের মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় চলা সরকারকে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সহযোগিদের সম্পূর্ণত বাদ রাখা হয়। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও তালিবান বন্দিদের মুক্তির রোডম্যাপ তৈরি করা হয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মার্কিনীরা আফগানিস্তান ত্যাগ করার সাথে সাথেই যে তালিবানিরা ক্ষমতা দখল করবে তা একরকম ঠিক করাই ছিল। আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিকে তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আলোচনা ভিত্তিক ক্ষমতা হস্তান্তর হিসেবে বর্ণনা করা যায় যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তালিবানদেরই বিশ্বস্ত উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নিয়েছে।
চুক্তিতে তালিবানদের কেবলমাত্র এই ‘অঙ্গীকার’ করতে বলা হয়েছে যে তারা যেন আফগান ভূমিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিদের বিরুদ্ধে কোনও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহৃত হতে না দেয়। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যাথা কেবলমাত্র নিজের আর নিজের পার্টনারদের সুরক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত যে তালিবান শাসন চলেছিল তা সেদেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, নারী ও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস হামলা এবং গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকারের ওপর সুব্যবস্থিত আক্রমণের জন্য চরম কুখ্যাত ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সঙ্গীরা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে “ওয়েস্টার্ন স্ট্যাণ্ডার্ড” হিসেবে বর্ণনা করতেই অভ্যস্ত (যদিও তারা নির্লজ্জভাবে এই স্ট্যাণ্ডার্ডকে লঙ্ঘন করেই থাকে), সেনা অভিযান চালিয়ে আফগানিস্তানে মার্কিন ও তার সঙ্গীদের দখলদারিকে নাম দেওয়া হয়েছিল “অপারেশন এন্ডিওরিং ফ্রিডম” অর্থাৎ স্থায়ী স্বাধীনতা কায়েমের কার্যক্রম। কিন্তু এইসব তথাকথিত ওয়েস্টার্ণ স্ট্যাণ্ডার্ড বা মূল্যবোধ চুক্তিপত্রে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল।
আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থা নিয়ে মোদী সরকারেরও জবাবদিহি করতে হবে। বিগত বছরগুলো জুড়ে আমাদের ক্রমাগত বলা হয়েছে যে আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে ভারত বড় ভূমিকা নিচ্ছে এবং আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠায় ভারতের অবদান আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করছে। আর এখন আফগানিস্তানের এই ঘটনাক্রম নিয়ে মোদী সরকার একেবারে চুপ মেরে গেছে এবং এমনকি কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসও বন্ধ করে দিয়েছে, যদিও বিজেপি নেতারা এখন দেশের প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে নতুন ধূয়ো বানিয়েছে “আফগানিস্তানে চলে যাও”। নারী, শিশু, মুসলমান, দলিত ও সাধারণ আইন মেনে-চলা শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রতি যে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের শাসনের হীন কায়দা ভারতে চরম কুখ্যাতি অর্জন করেছে সেই যোগী আদিত্যনাথ আফগান নারী ও শিশুদের দুঃখে উত্তর প্রদেশ বিধানসভায় কেঁদে ভাসাচ্ছেন, ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও লাঞ্ছনার বিষাক্ত অভিযান চালাতে তালিবান শব্দটাকে কোড-নেম বানিয়েছেন।
তালিবানরা কি তাদের পূর্বতন শাসনামল থেকে ভিন্ন কিছু করবে বলা প্রত্যাশা করা যায়? আফগানিস্তানে কেবলই যে দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে তা থেকে তো সংশোধিত, পরিমার্জিত ও নিয়ন্ত্রিত তালিবান শাসনের কোনও ছবি আশা করার কোনও উৎসাহ জুটছে না। আফগান নারী ও শিশু এবং শ্রমিক ও কর্মচারীদের মুখচ্ছবিতে যে হতাশা ফুটে বেরোচ্ছে তাতে স্পষ্টতই এক ভয়াল অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ যেন প্রকট হয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলকে ন্যুনতম যেটুকু করতেই হবে তা হল আফগানিস্তানে সকলকে নিয়ে একটি মধ্যবর্তী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যেখানে অ-তালিবান শক্তিগুলিও জায়গা পাবে এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আফগানে অবিলম্বে সরকার নির্বাচন নিশ্চিত করে আফগান জনতাকে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরা নির্ধারণ করতে সহযোগিতা করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবানদের পেছনেই তাদের শক্তি নিয়োগ করে ফেলেছে। মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতাতেই তালিবানদের প্রাথমিক উত্থান ঘটেছিল। ফলত আফগানিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলি অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্যে আছে। তথাপি আমরা আফগানিস্তানে তালিবান সন্ত্রাস ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ক্রমশ বাড়তে দেখছি। গোটা দুনিয়ার স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা আফগান জনতার শান্তি সুরক্ষা মর্যাদা ন্যায় ও অধিকারের লড়াইয়ের পাশে থাকা দরকার, বিশেষত আফগান মহিলা এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের পাশে।
আফগানিস্তানের মানুষের পাশে দ্রুত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ভারতে আমরা কী কী করতে পারি? ভারতে যেসব আফগান নাগরিকেরা পড়াশোনা করছেন তাঁদের ভিসা এক্সটেণ্ড করতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না আফগানিস্তানে শান্তি ও সুস্থিরতা প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের কাউকে জোর করে ফেরত পাঠান যাবে না। এইসব ছাত্রছাত্রীদের ফেলোশিপ প্রোগ্রাম বর্ধিত করতে হবে এবং/অথবা তাঁদের ভিসাকে ওয়ার্ক-ভিসায় পরিবর্তিত করে দিতে হবে যাতে তাঁরা কোনও কাজ খুঁজে নিয়ে টিকে থাকতে পারেন। যেসমস্ত আফগান নাগরিক ভারতে আশ্রয় নিতে আসবেন তাঁদের মধ্যে কোনও রকম বৈষম্য না করে সকলকে আশ্রয় দিতে হবে। এই পরিস্থিতি আরেকবার নতুন করে ‘নাগরিকত্ব সংশোধনি আইন’-এর অদ্ভুত বৈষম্যমূলক চরিত্রকে প্রকাশ করেছে যেখানে আফগানিস্তান থেকে আসা অ-মুসলমান আবেদনকারিকে ভারতীয় নাগরিকত্বর জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এবং একই ধরনের বৈষম্য এখন কায়েম করা হচ্ছে আফগানিস্তান থেকে ভিসার আবেদনকারিদের মধ্যে। আফগানিস্তানে তালিবানদের ক্ষমতায় ফেরাকে স্বাগত জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার জন্যও আসামে ইউএপিএ ধারায় কেস দেওয়া হয়েছে। ভারতে বসবাসকারী ভারতীয় বা আফগানদের রাজনৈতিক মত প্রকাশের জন্য এভাবে উৎপীড়ন করা ভারতে ন্যায় ও মানবাধিকার নস্যাৎ করে দেওয়ার সামিল — এবং তা আরও সাংঘাতিক কারণ সেটা করা হচ্ছে তালিবানদের অত্যাচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলেই।
উত্তরপ্রদেশ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। সংঘ-বিজেপি বাহিনী আফগান সংকটকে ইসলাম-বিদ্বেষি ঘৃণা ও হিংসা অভিযান চরম রূপ দিতে ব্যবহার করার সবরকম চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি সরকার ভারতের ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসকে দেশভাগের ক্ষত নতুন করে বিষিয়ে তুলতে ব্যবহার করেছে বীভৎসতা স্মরণের নামে। আফগান সংকটকেও ওরা হিন্দু ও ভারত খত্রে মে হ্যায় ক্যাম্পেনের ইন্ধন হিসেবে যুক্ত করছে। ভারতের নারীর স্বায়ত্ততা ও অধিকারের প্রশ্নে সংঘ বাহিনীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী তো তালিবান মডেলের মতোই পশ্চাদমুখী। আর, বহুবিধ নিপীড়নমূলক আইন ও বিচার-বহির্ভূত সন্ত্রাসের সমন্বয়ে তাদের শাসন প্রণালিও তো কম অত্যাচারি নয়। তালিবানদের বিরুদ্ধে সংঘ পরিবারের প্রচারাভিযান নারী শিশু বা মানবাধিকারের প্রতি কোনওরকম সম্মান শ্রদ্ধা থেকে উদ্ভুত নয়। তাদের কাছে এ হল মুসলমানদের ভয়াল চেহারা দেওয়ার, হেয় প্রতিপন্ন করার আরেক সুযোগ মাত্র। আফগান জনতার শান্তি সুবিচার গণতন্ত্রের সন্ধানে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আফগানিস্তানের বর্তমান দুর্দশার জন্য দায়ি সমস্ত দুষ্কর্মের দোসর ও অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ভারত সহ সব সহযোগিদের ভূমিকা দৃঢ়তার সাথে উন্মোচিত করতে হবে এবং আফগান নারী ও শিশুদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানোর সমস্ত অপচেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে হবে।
(এম এল আপডেট, সম্পাদকীয়, ২৪ আগস্ট ২০২১)
নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতি লাগু করার নাম করে সারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ডিজিটাল মাধ্যমে এনে ফেলেছে কেন্দ্রীয় সরকার, যার ফল স্বরূপ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ। এই সময়ে দাঁড়িয়ে শিক্ষার খরচও অনেকটা বেড়েছে। কিন্তু এই করোনা মহামারী কালে বাড়েনি ইনকাম, বরং অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে কোর্স ফি-হোস্টেল ফি না বাড়ায়, সেই জন্য বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে আন্দোলন করছিল বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু ছাত্র-ছাত্রী। সেই আন্দোলনকে দমানোর জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বিদ্যুৎ চক্রবর্তী প্রথমদিকে বারংবার ছাত্রছাত্রীদের সাসপেন্ড এবং শেষ পর্যন্ত দুই জন ছাত্র ও একজন ছাত্রীকে বহিষ্কার করেছেন।
এরই প্রতিবাদে ২৫ আগষ্ট বাঁকুড়া আইসা ও আইপোয়া ইউনিটের পক্ষ থেকে বিষ্ণুপুর রবীন্দ্র স্ট্যাচুর মোড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর কুশপুতুল দাহ করা হয়। বক্তব্য রাখেন বিষ্ণুপুর আইসা ইউনিটের সম্পাদক সুশান্ত ধীবর। তিনি বলেন, নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতি ও অনলাইন শিক্ষাদানের ফলে কিভাবে বহু ছাত্রছাত্রী তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আইসার নেতা মঙ্গল মুর্মু বলেন মহামারীর সময় যখন মানুষজন কাজ হারাচ্ছেন, তখন কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরো বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিগুণ-তিনগুণ হারে ফি বৃদ্ধি করেছে। যেখানেই ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলন করেছে সেখানে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের উপর নেমে এসেছে কর্তৃপক্ষের সাসপেনশন কিম্বা বহিষ্কার। বক্তব্য রাখেন আইপোয়ার নেত্রী তিতাস গুপ্ত। তিনি বলেন কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যে কোনো মানুষকে 'দেশদ্রোহী' তকমা দিয়ে ইউএপিএ-র মতো দমন আইনে গ্রেপ্তার করে গণতন্ত্রকে বিরোধীমুক্ত করার চেষ্টা করছে, ঠিক সেই রকমই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন করা ছাত্রছাত্রীদের বহিষ্কার করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্র ভুলুন্ঠিত করেছে। স্লোগান তুলে রবীন্দ্রনাথের মূর্তির সামনে বিশ্বভারতীর ভিসি বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর কুশপুতুল দাহ করা হয়।
কলকাতাতেও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়।
২০১৮ সালে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে জনগণনায় জাতিগণনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু আসন্ন জনগণনার আগে সংসদে মোদী সরকার জানিয়েছে যে জাতিগণনা করবে না সরকার। সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ব্রিটিশরা ১৮৭২ সালে যখন জনগণনা শুরু করে তখন থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত জনগণনায় জাতিগণনা হয়েছে। স্বাধীনতার পর তা বন্ধ করে কেবলমাত্র এসসি ও এসটি তালিকার জন্য জাতিগণনা হয়েছে, বাকি সকলকে জেনেরাল ক্যাটেগরিতে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানে বর্ণিত ‘অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী’র যে বিপুল জনসংখ্যা আছে তার গণনা কখনই হয়নি। শেষে ২০১১ সালে নতুন করে আর্থ সামাজিক ও জাতিগণনা সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু সেই গণনার তথ্য মোদী সরকার প্রকাশ করতে চাইছে না। সরকার বলছে ওই তথ্যের গুণগত মান নাকি ভালো নয়। সরকারের এই বক্তব্য আরও প্রশ্নের জন্ম দেয়। স্পষ্ট ও সঠিক গুণমানের তথ্য সংগ্রহ করতেই তো জনগণনার মাধ্যমে সুব্যবস্থিত দক্ষতায় জাতিগুলির নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা দরকার। নাকি মোদী সরকার সংরক্ষণ ব্যবস্থাকেই স্তব্ধ করে দিতে চাইছে? সাধারণভাবে বিজেপি-আরএসএস সর্বদাই সংরক্ষণের সাংবিধানিক অধিকারের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে থাকে। মূলত উচ্চবর্ণের আধিপত্য কায়েম করাই তাদের লক্ষ্য। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতির আঙিনায় প্রকাশ্যে সেই অবস্থান নেওয়া বিজেপির পক্ষে একটু কঠিন। তাই কি সংরক্ষণ ব্যবস্থার যৌক্তিক ভিত্তিটাই নাকচ করে দিতে চায় তারা। নইলে কেন বিভিন্ন পশ্চাদপদ শ্রেণীর প্রকৃত তথ্য পরিসংখ্যান সামনে আনতে চাইছে না তারা? এই তথ্য হালনাগাদ করে সংরক্ষণকে যৌক্তিক ভিত্তি দেওয়া দরকার। এসসি, এসটি, ওবিসিদের সর্বমোট সংরক্ষণের ঊর্ধ্বসীমা যেখানে বেঁধে দেওয়া হয়েছে তার বাস্তব ভিত্তি কী? ‘ক্রিমি লেয়ার’কে সংরক্ষণের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয় ১৯৯৩-এ সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের মাধ্যমে। ‘ক্রিমি লেয়ার’কে বাদ দেওয়ার যুক্তি আসলে সংরক্ষণ ব্যবস্থার মূল অন্তর্বস্তুকেই নাকচ করে দেওয়ার সামিল। কিন্তু সেই বিতর্কে না গিয়েও বর্তমান প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলা যায় যে কারা ক্রিমি লেয়ার তা কীভাবে ঠিক হবে যদি আর্থ সামাজিক জাতিগণনা সম্পন্ন না হয়? জাতিগণনা থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পিছু হঠায় এই প্রশ্নগুলো সামনে এসেছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে দাবি উঠেছে জাতিগণনা চালানোর। বিহার রাজ্য থেকে শাসক ও বিরোধী সহ সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও জাতিগণনার পক্ষে বলে জানিয়েছেন।
পাটনায় সংবাদ সম্মেলনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য জাতিগণনার দাবিকে সমর্থন করে বলেন, সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে যুক্তিপূর্ণ ভিত্তি দিতে জাতিগণনা জরুরি। তিনি বলেন, সরকার বিষয়টি থেকে নজর ঘোরাতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইনের কথা বলছে। গত তিনদশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে এবং বর্তমান সময়ে জনসংখ্যা কোনও ইস্যু নয়।
তিনি বলেন যে ওবিসি সংরক্ষণ প্রশ্নে একটি বিল শাসক জোট ও বিরোধী দলগুলির সর্বসম্মতিতে সংসদে পাশ হয়েছে। এটা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু সেটুকুই যথেষ্ট নয়। সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে মসৃণ ও যথাযথ যুক্তিপূর্ণভাবে কার্যকর করতে জাতিগণনা প্রয়োজন। ১৯৩১ সালের পর থেকে আর জাতিগণনা হয়নি। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশগুলিও সেই ১৯৩১’র গণনার ওপর ভিত্তি করেই করা হয়েছিল। ২০১১ সালে যে জাতিগণনা করা হয়েছে তার রিপোর্টও এখনও প্রকাশ্যে এলনা। যদি সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে হালনাগাদ করতে হয় তাহলে জাতিগণনা অতি অবশ্যই করা দরকার।
কমরেড দীপঙ্কর বলেন, বর্তমানে সরকারি চাকরি দ্রুতহারে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং বেকারত্ব অত্যন্ত দ্রুতহারে ছড়িয়ে পড়ছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা ছাড়া সংরক্ষণের উদ্দেশ্যও মাটি হয়ে যাবে। আমাদের ছাত্রছাত্রী ও তরুণ প্রজন্ম লাগাতার এই প্রশ্ন উত্থাপন করে আসছে। জাতিগণনার মধ্যে কোনও হিন্দু-মুসলমান ইস্যু নেই, সমস্ত ক্ষেত্রেই জাতিগণনা চালানো জরুরি।
বিহার রাজ্যের সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে জাতিগণনার দাবি জানিয়েছেন। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বিধায়ক মেহবুব আলম। ডেপুটেশন থেকে ফিরে মেহবুব পাটনায় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ১৯৩১ সালের পর থেকে আর জাতিগণনা হয়নি। কিন্তু এই মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের সামাজিক কাঠামোয় বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। দলিত/ওবিসিদের সংরক্ষণ অধিকার ও উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্পকে অর্থপূর্ণ ও যৌক্তিক করতে জাতিগণনা আবশ্যিক। এই অংশের জন্য এখন পর্যন্ত ৫০% সংরক্ষণ আছে। কিন্ত সমাজ বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস এই অংশ মোট জনসংখ্যার অন্তত পক্ষে ৭০% অথবা তারও বেশি। ফলত জাতিগণনা করলে তবেই দলিত/ওবিসিদের সঠিক শতাংশ নির্ণয় করা যেতে পারে এবং তার মধ্যে দিয়ে সরকারি প্রকল্পগুলিকে যুক্তিযুক্ত করে তোলা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন যে এই জাতিগণনা সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই করা দরকার। মুসলমান সমাজের মধ্যে জাতব্যবস্থা মোটেই নেই এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। সীমাঞ্চলের প্রায় এক কোটি জনসংখ্যার সূর্যপুরি জনগোষ্ঠিকে বিহার সরকার ওবিসি হিসেবে গণ্য করে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের তালিকায় কোথাও সূর্যপুরি জনগোষ্ঠির নাম নেই। তারফলে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ সরকারের বহু প্রকল্প থেকে বাদ পড়ে যায়। সুতরাং কোনও বৈষম্য না করে সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যেই জাতিগণনা করা বিশেষ জরুরি।
স্বাধীন মত প্রকাশ ও প্রতিবাদের অধিকার রক্ষায় চলমান জাতীয় প্রচারাভিযানে আগামী ২৮ আগস্ট, ভীমা কোরেগাঁও গ্রেপ্তারির তৃতীয় বার্ষিকীতে, পশ্চিমবাংলায় বিভিন্ন শহরে অবস্থান বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা সংগঠিত হবে। জাতীয় স্তরে ১৬৬টি সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রচারাভিযান চালাচ্ছে (আইপোয়া, আইসা, এআইসিসিটিইউ, এআইপিএফ সহ বিভিন্ন সংগঠন যুক্ত আছে)। এরাজ্যের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, ছাত্রছাত্রী সংগঠন ও নারীবাদী সংগঠন, গণ সংগঠন, প্রতিবাদী মঞ্চ ও ব্যক্তিবর্গ কর্মসূচি সংগঠিত করছে। কলকাতা, শিলিগুড়ি, কুচবিহার, বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, বাঁকুড়া, হাওড়া, বারাসাত ইত্যাদি জেলা শহর সহ বিভিন্ন ব্লক সেন্টার ও পঞ্চায়েতে ২৮ আগস্টের কর্মসূচি সংগঠিত হবে। গত ২৪ আগস্ট কলকাতা প্রেস ক্লাবে ও শিলিগুড়ি জার্নালিস্টস ক্লাবে যুগপৎ দুটি সংবাদ সম্মেলনে সমগ্র বিষয়টি তুলে ধরেন উদ্যোক্তা সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরা। কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, ছোটন দাস, মিতালি বিশ্বাস, জিনাত রেহেনা ইসলাম, প্রতীক নাগ, অক্ষয় ও সোমা। শিলিগুড়ির প্রেস কনফারেন্স হয় পার্থ চৌধুরি ও অজিত কুমার রায়ের নেতৃত্বে। প্রচারাভিযানের মূল দাবিগুলি হল,
১) রাষ্ট্রদ্রোহ আইন এবং ইউএপিএ সহ বিভিন্ন দমনমূলক আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার,
২) রাজ্য সরকার দ্বারা সত্বর ইউএপিএ প্রয়োগ বন্ধ করার ঘোষণা,
৩) রাজনৈতিক বন্দীদের নিঃশর্তে মুক্তি এবং বিচারাধীন ব্যক্তিদের জামিনের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি,
৪) গণআন্দোলন-কর্মী সহ বিভিন্ন নিরপরাধ ব্যক্তিদের ওপর চাপানো মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার সহ পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান,
৫) এনআইএ'র মতো স্বৈরাচারী তদন্ত সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া।
কলকাতা প্রেস ক্লাবে চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি প্রথমে জাতীয় অভিযান সম্পর্কে বলেন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেভাবে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদের অধিকারকে চরম স্বৈরাচারী কায়দায় দমন করছে তার উল্লেখ করে তিনি বলেন যে গত ২৩ জুলাই সারা দেশের সাথে এরাজ্যের বহু জায়গায় প্রতিবাদ দিবস সংগঠিত হয়। ২৬ জুলাই এক অনলাইন গণ কনভেনশনে রাজ্যের বহু সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঔপনিবেশিক ধারার দমন আইনগুলি প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির প্রশ্ন ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবসে আদিবাসী মূলবাসীদের অধিকার ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয় এবং ১৫ আগস্ট ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসে রাজ্য জুড়ে পতাকা উত্তোলনের সাথে অঙ্গীকার পত্র পাঠ, সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ ও বিতরণ, আলোচনা সভা ইত্যাদির মাধ্যমে মৌলিক অধিকারগুলি ও তাদের তাৎপর্য সম্পর্কে চর্চা হয়। এই ধারাবাহিকতায়, ভীমা কোরেগাঁও-এর কুখ্যাত গ্রেপ্তারির তৃতীয় বার্ষিকীতে, দেশ জুড়ে ২৮ আগস্টের প্রতিবাদ দিবস সংগঠিত হচ্ছে। ছোটন দাস কেন্দ্রের দমনমূলক স্বৈরাচার সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন এবং যেসব বিরোধী দল যৌথ বিবৃতিতে ইউএপিএ বন্দীদের মুক্তির দাবি তুলেছে তারা নিজেদের চালানো রাজ্য সরকারগুলির ক্ষেত্রে বন্দীদের মুক্তি দিচ্ছেন না কেন সে প্রশ্ন তোলেন। প্রতীক নাগ বলেন এরাজ্যেও গণতন্ত্রের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলছে, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করলেই বেছে বেছে ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট এক্ট প্রয়োগ করা হচ্ছে, এরাজ্যেও অনেক ইউএপিএ বন্দী আছেন। মিতালি বিশ্বাস এরাজ্যের মহিলা বন্দিদের বিষয়ে বলেন। সম্প্রতি বেশ কিছু নারী সংগঠন একত্রিত হয়ে সংশোধনাগার দপ্তরের হেড কোয়ার্টারে ডেপুটেশন দেন। কেন মহিলা বন্দীদের সাথে নারী সংগঠনের কর্মীদের দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না সে প্রশ্ন তোলেন। তিনি জানান বেশ কয়েকজন মহিলা বিনা বিচারে দশ বারো বছর ধরে জেলে আটকে আছেন। তাঁদেরকে পরিবারের সাথে পর্যন্ত দেখা করতে দেওয়া হয় না। অনেকেই অসুস্থ। কম বয়সী বন্দিরা পড়াশোনা করতে চাইলেও তাদের সে সুযোগ দেওয়া হয় না। এই সব বিষয়গুলি সংশোধনাগার দপ্তরের ডিআইজির কাছে তুলে ধরা হয়েছে। আগামীতে নারী সংগঠনগুলি বিভিন্ন জেলের মহিলা বন্দীদের সাথে দেখা করা ও তাদের পরিস্থিতি জনসমক্ষে আনার উদ্যোগ জারি রাখবে।
কলকাতার প্রেস মিটে যোগ দিতে বহরমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন জিনাত রেহেনা ইসলাম। তিনি একজন স্কুল শিক্ষিকা এবং নারী আন্দোলনের কর্মী। কিছুদিন আগে বহরমপুর সংশোধনাগারে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন বন্দী শোভা মুণ্ডার সাথে দেখা করতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সকলের সামনে তুলে ধরে সাংবাদিকদের কাছে তিনি আবেদন জানান এ বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হতে। তিনি বলেন, সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদেরই মুক্তির দাবি আছে, কিন্তু মহিলা রাজনৈতিক বন্দীদের বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। কারণ অনেক সামাজিক প্রতিকুলতা পেরিয়েই মেয়েরা প্রগতির পথে রাজনীতিতে সক্রিয় হন, আর তাদের ওপরেই নামে অতিরিক্ত অত্যাচার। মেয়েদের অংশিদারীত্ব বিঘ্নিত করতে এসব চরম আঘাত নামে। অথচ এ বিষয়ে কথা বলতে সমাজে ও গণমাধ্যমে প্রবল অনীহা দেখা যায়। জিনাত স্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন করেন, কেন শোভা মুণ্ডার কথা শুনলেই বাংলার সংবাদ মাধ্যম গুটিয়ে যায়? কেন এদের নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে মুখ বুজে রয়েছে সাংবাদিকেরা? জিনাত অত্যন্ত আন্তরিক ভঙ্গিতে সরাসরি সাংবাদিকদের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং আবেদন জানান মহিলা বন্দীদের বিষয় মুখ খুলতে। দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির পক্ষ থেকে অক্ষয় নতুন ট্রাফিকিং আইন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বলেন এই আইন পাচারকারিদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার নামে আসলে যৌনকর্মীর পেশায় থাকা সমস্ত মহিলাদেরই বিপন্ন ও অপরাধী করে তুলছে। সবশেষে সোমা আরেকবার বন্দীমুক্তির প্রশ্ন তুলে ধরেন। শিলিগুড়ির প্রেস মিট থেকেও অনুরূপ বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়। আগামী ২৮ আগস্ট সর্বত্র আরও বিস্তারিতভাবে জনসমক্ষে সমগ্র বিষয়টি তুলে ধরা হবে।
পাড়ায় পাড়ায় বিপুল চাঞ্চল্য। মহিলারা এবার সরকারি হাতখরচ পাবেন! পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা, পঁচিশ থেকে ষাটের মধ্যে যাদের বয়েস, যাদের কোনো বাঁধা রোজগার নেই, যাদের পরিবার আয়করের আওতামুক্ত এবং যাদের পারিবারিক মালিকানায় দু'হেক্টরের কম জমি আছে, সেই মহিলারা মাসে ৫০০ টাকা (জেনারেল কাস্ট ও ওবিসি) আর এসসি/এসটি-ভুক্ত মহিলারা মাসে ১০০০ টাকা করে পাবেন। সরাসরি নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
‘স্বাস্থ্যসাথীর’ হাত ধরে এল ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’। অনেকেই বিরস বদনে মন্তব্য করেছেন, “হ্যাঁ, আমাদের করের টাকায় মেলা খেলা ফুটবল বিতরণ-এবার মেয়েদের বিলাসব্যসন! সব ভোটের অঙ্ক!” এমনিতেই গৃহকর্ত্রীর নামে স্বাস্থ্য সাথী কার্ড-এর ব্যাপারটা তারা ভালো মনে নেননি। ‘মেয়েছেলেকে’ মাথায় তোলা কেন? তাদের কোন্ যোগ্যতা আছে? এবার আবার বসে বসে 'হাতখরচ'!
হ্যাঁ, ঠিক জায়গাতেই ঘা পড়েছে! নির্বাচনী প্রচারে যখন ‘মেয়েছেলে’কে ‘পায়ের তলার চটি’ ভাবায় অভ্যস্তরা ‘দিদি! অ দিদি!’ বা ‘মমতা বেগম’ বলে নারীর সম্মানহানি করতে পেরেছেন, তার বিপ্রতীপে মেয়েদের সমাজে, পরিবারে মাথা উঁচু করে বাঁচার ভাবনা থেকে এল স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। এবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মেনে আসছে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ - রাজ্য বাজেটে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা রাজ্যের এক কোটি ঊনসত্তর লক্ষের বেশি মহিলাকে এই সহায়তার জন্য ব্যয়বরাদ্দে টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে ।
এই প্রকল্পটির টার্গেট গ্রুপ যারা, সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত ভাবে যদি প্রকল্প রূপায়িত হয়, তাহলে সত্যিই কি এটা সরকারের ‘অনুৎপাদক’ ব্যয় হবে? কন্যাশ্রী রূপশ্রী আর বিধবা ভাতা বার্ধক্য ভাতার মাঝখানে এই অংশটি গরিব নিম্নবিত্ত পরিবারের বধূ যারা উদয়াস্ত সংসারের জন্য পরিশ্রম করেন, স্বামী-সন্তানের বাড়তি পুষ্টির জন্য, ছেলে মেয়েদের ঠিকঠাক পড়াশুনোর জন্য মুখে রক্ত তুলে খাটেন, কিন্তু নিজের জন্য এক পয়সা রাখার সঙ্গতি যাদের নেই। মাসে মাসে এই টাকার ভরসায় কেউ হয়তো সংসারের প্রয়োজনে, ঘরবাড়ির সংস্কারের জন্য, বা পরিবারের ছোট্ট ব্যবসা চালানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নিতে পারবেন। শেষ বিচারে সে অর্থ সমাজের অর্থনীতির মূল স্রোতে মিশে তাকেই খানিকটা চাঙ্গা করবে বৈকি! সুতরাং লকডাউন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা যে সরকারকে মানুষের হাতে টাকা দেওয়ার কথা বলেছিলেন তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এই উদ্যোগ।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবেই এই প্রকল্পের সূচনা থেকেই দুর্নীতি সঙ্গ নিয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রশাসনিক স্তরে দিশাহীনতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব। মুখ্যমন্ত্রী যেখানে একাধিকবার জানিয়েছেন, অন লাইনে বা অন্য কোনও ভাবে নয়, ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্প থেকে ফর্ম পাওয়া যাবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে, সেক্ষেত্রে বহু জায়গা থেকেই পয়সা নিয়ে আগাম ফর্ম বিক্রি এবং পয়সা নিয়ে ফর্ম ফিল আপ করার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ফর্ম বিলি থেকে শুরু করে গোটা প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে শাসকদলের আধিপত্য এবং তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতিগ্রস্ততার কারণে। ফলে প্রকৃত প্রয়োজন যাদের আছে, তাদের হাতে টাকা পৌঁছানো নিয়েও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।
লকডাউন-উত্তর আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ এই মুহূর্তে একটি বিশেষ উদ্যোগ। বিশেষত উপর্যুপরি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তাণ্ডববিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন তথা প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সরকার কতটা আগ্রহী? নারীর মর্যাদা তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যখন সামাজিক উৎপাদন তথা অর্থনীতিতে তাদের প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে। হাত পেতে নেওয়া নয়, পরিশ্রমী হাত দুটোকে, মেধা, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে স্বোপার্জনেই আজকের নারী আগ্রহী। তাতেই তাদের মর্যাদা ও গৌরব! সেই সুযোগ কতটা পাচ্ছে রাজ্যের নারীসমাজ? দরিদ্র নিম্নবিত্ত পরিবারের অশিক্ষিত, সাক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত মহিলাদের কর্মসংস্থানের কতটা সুযোগ তৈরি হয়েছে আজ পর্যন্ত?
গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটি মহিলাদের জন্য বিশেষত অতিমারী পরিস্থিতিতে সংকুচিত হয়ে গেছে। ভিন রাজ্যে কাজে যাওয়া শ্রমিকরা ঘরে ফিরে আসায় একশো দিনের কাজে মহিলাদের সুযোগ কমে গেছে। (এখন অবশ্য দাবি ২০০ দিনের কাজ এবং পরিবারের সবার জন্য জব কার্ড। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনাও তাতে বড় রকম বাদ সাধছে)। পশ্চিমবঙ্গ এ ব্যাপারে দেশের মধ্যে এগিয়ে থাকলেও এখানে গড়ে ৬২ দিনের বেশি শ্রমদিবস তৈরি করা যায়নি। কৃষি, মৎস্যচাষ, খাদ্যপ্রক্রিয়ন, ফল-ফুলের চাষ, কুটির শিল্প ও লোকসংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ও তাকে আধুনিক নাগরিক সমাজে তুলে ধরা, প্রসূতি মা ও শিশুর পরিচর্যা, কুসংস্কার, অপবিজ্ঞানের বিরোধিতা করে গ্রামীণ জনজীবনে সমাজমনস্কতা, বিজ্ঞান চেতনা, স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে তোলা, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ – এ সব ক্ষেত্রে মহিলাদের কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে । চাই সরকারের সদিচ্ছা ও বাস্তবোচিত সুষ্ঠু পরিকল্পনা। চাই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সামাজিক নিরাপত্তা। চাই আধুনিক প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার। চাই দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসনের আন্তরিক সহযোগিতা, নিয়মিত তদারকি। এ সব,আপাতত সোনার পাথরবাটি মনে হলেও, সত্যিই সম্ভব।
দু'টি বিষয়ের উল্লেখ করে শেষ করব। পাশের বাড়ির বধূটি জানালো, শ্বশুর ‘স্বাস্থ্যসাথী’র আওতাভুক্ত হতে নারাজ, কারণ তার সন্দেহ এটা বাড়ি হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত! (স্বাস্থ্যসাথী কার্ড না থাকলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের জন্য আবেদন করা যাবে না)। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মানসিকতার বদল কতটা জরুরি সেটা সরকারকে ভাবতে হবে।
মনে পড়ে গেল, প্রতিবেশিনী অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের এক মেয়ে কথা প্রসঙ্গে চোয়াল শক্ত করে বলেছিল, “এখন আর আমি শান্ত নেই! বাইরে কাজে বেরিয়ে বুঝেছি আজ মুখ খোলা কত জরুরি!” ও একটা শপিং মলে কাজ করত। টিঁকতে পারেনি। নতুন কাজের সন্ধানে আছে। এ রকম অজস্র মেয়ে ছোট ছোট কারখানায়, মলে, কলসেন্টারে, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নার্সারি স্কুলে প্রতিনিয়ত ঘাম ঝরিয়ে চলেছে, যৎসামান্য পারিশ্রমিকে। নারীশ্রম লুণ্ঠন তো চলছেই, তার সঙ্গে জুটছে লাঞ্ছনা, অসম্মান। ওরা রুখে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু এই মুহূর্তে ওরা অসহায় – যদি কাজটা চলে যায়! সরকার ওদের পাশে দাঁড়াবে? কীভাবে? কবে? যেখানে নিজেই প্রকল্প কর্মীদের শ্রম লুণ্ঠন করে চলেছে!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
৫ বছর আগের নোট বাতিল, যার গাল ভরা ইংরেজি নাম ছিল ডিমানিটাইজেশন, তার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। সেই ডিমানিটাইজেশনের উদ্দেশ্য ছিল কালো টাকা উদ্ধার, যে টাকা উদ্ধার হলে সরকারের দায় কমত, এবং সরকার দেশের উন্নতিতে, পরিকাঠামো গড়ে তুলতে লাগাতে পারত। সে কালো টাকা সব সাদা হয়ে গেল, প্রধানমন্ত্রীর জনধন যোজনায় আগে থেকেই তৈরি রাখা ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টের সৌজন্যে। কপাল পুড়লো ছোট ব্যবসায়ীদের, ভ্যানচালক, রিক্সাচালক, অটোচালক, বাসচালক তেকে শুরু করে সব দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমজীবী জনতার। প্রধানমন্ত্রী ভাষণে সাত মণ তেল পোড়ালেও রাধা নাচল না, কালো টাকা ফিরল না। অর্থনীতির যে বেহাল অবস্থা তৈরি করলেন তিনি তার ফল এখনো দেশ ভুগেই চলেছে।
সেই ভোগান্তি বাড়তে বাড়তে এই করোনা কালে জিডিপি অধোগতিতে পৌঁছেছে। দেশ এখন সামগ্রিকে ২০১৮ সালের মত গরিব, ২০২০-২১ সালের মাথাপিছু আয় ২০১৭-১৮ সালের থেকেও কম। মোদীজী লালকেল্লা থেকে ভাষণে দেশের অর্থনীতিকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওযার জন্য গর্ব করেন, ভক্তজন উল্লসিত হয়, কিন্তু মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারতের স্থান ১৬২তম, বাংলাদেশেরও পিছনে, তা ভুলেও বলেন না। “নিতি আয়োগ” বলে একটি অম্লানবদনে অনৃত ভাষণকারী ও মোদী তোষণকারী প্রতিষ্ঠান সরকারি পয়সায় তৈরি হয়েছে যার কর্তারা অবলীলাক্রমে সরকার থেকে বেতন গ্রহণ করে সরকারি সম্পদকে ব্যক্তি মালিকানায় তুলে দেওয়ার জন্য ওকালতি করে, ও নীতি তৈরি করে। সেই নীতিহীন "নিতি আয়োগ" দেশের অবস্থা কত ভালো হয়েছে বলে রোজ রিপোর্ট বানাচ্ছেন ওদিকে দিগগজ প্রধানমন্ত্রীর পদাঙ্কিত গরিব কল্যাণ যোজনার ঘোষণা অনুযায়ী ভারতের ৬০শতাংশের বেশি মানুষের (৮০ কোটি) চাল-গম কেনার সাধ্যি নেই।
ওদিকে নিতি আয়োগ, ডিমানিটাইজেশন, জিএসটি, মেক ইন ইন্ডিয়া, আত্মনির্ভর ভারত ইত্যাদি প্রভৃতি বহুবিধ গালভরা প্রতিষ্ঠান ও ঘোষণার দৌলতে কর্মপ্রার্থীদের হাতে কাজ নেই, সরকারি কোষাগারে টাকা নেই, রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির ১০ শতাংশকে কবেই পার করে দিয়েছে, কিন্তু কর্পোরেটদের উপরে কর কমেছে, ধনীদের উপরে কর কমানোর বন্দোবস্ত হয়েছে। তাই সরকার রাজকোষে টাকা জোটাতে গত সত্তর বছরের রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বারংবার বিক্রি করছে, এমনকি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যে রিজার্ভ তহবিল যা দেশের তেমন কোন জরুরি আর্থিক সঙ্কটের সময়ে অর্থব্যবস্থাকে সতেজ রাখতে ব্যবহার করার কথা ছিল তা থেকেও অবলীলাক্রমে টাকা তুলে নিয়েছে। মনে রাখা দরকার, এসবই হয়েছে করোনাকালের আগে। ফলে এই সরকার যে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে তাল সামলাতে অপারগ তা বোঝাই যাচ্ছে। কেবল তাই নয়, সরকারের দেশ পরিচালনায় অকর্মণ্যতার দৌলতে যেসব সম্পদ/রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা মোদী-সীতারামন বেচতে চাইছেন তাও কেনার খদ্দের পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা, সব অর্বুদপতি খরিদ্দাররা দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। ফলে ২০১৯-২০ সালের বাজেটের বিলগ্নিকরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০৫ হাজার কোটি টাকা, পাওয়া গেছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১-এর বাজেটে লক্ষ্য ছিল ২১৪ হাজার কোটি টাকা, পাওয়া গেছে ২৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ এর বাজেটে বাকি ১৭৫ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা রয়েছে। কেউ এগিয়ে আসছে বলে তেমন জানা যায়নি।
ওদিকে সরকারের ভাঁড়ে মা ভবানী। মোদিীসাহেব তিন বছর ধরে পরিকাঠামোয় শতাধিক লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ করে কোটি কোটি যুবকের কর্মপ্রার্থনা পূরণের বাণী লালকেল্লার স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে দিয়ে চলেছেন। ২০১৯, ২০২০ ও অতি সম্প্রতি ২০২১-এর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে তিনি পরিকাঠামোয় যথাক্রমে ১০০ লক্ষ কোটি, ১১০ লক্ষ কোটি ও ১০০ লক্ষ কোটির বেশি টাকা বিনিয়োগ করবেন বলেছেন, একই কুমীরছানা দেখানো হচ্ছে ধূর্ত শেয়ালের মতো। বাজেটে কোনও অর্থের সংস্থান নেই। কর্পোরেটদের উপর করও বাড়াবেন না বা বসাবেন না, ধনীদের উপরেও করের বোঝা(?) বাড়ানো চলবে না। ওরাই টাকা দেন বলে বিজেপি সর্বাধিক ধনী পার্টি। আগেই বলেছি বিলগ্নিকরণ করেও টাকা উঠছে না। তাই নতুন জুমলা। সম্পদ মুদ্রাকরণ বা এ্যাসেট মানিটাইজেশন। ২০১৬ সালে ডিমানিটাইজেশন, আর ২০২১ সালে মানিটাইজেশন। সেটি করে ৬ লক্ষ কোটি টাকা তোলা হবে ৪ বছর ধরে। আর সেই টাকা দিয়ে পরিকাঠামো বানানো হবে। সামাজিক অর্থনীতির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের সম্পদ এভাবে মানিটাইজ করা উচিত-অনুচিতের প্রশ্নের বাইরে দুটি জিজ্ঞাসা অনিবার্য। মোদীজী ৩ বার লালকেল্লার ভাষণে পরিকাঠামাোয় যে বিনিয়োগের পরিমাণ ঘোষণা করেছেন তা যোগ করলে ৩১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি হয়। তাহলে আগামী ৪ বছরে ৬ লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে কীভাবে মোদীবাবার স্বপ্নপূরণ হবে? যদি তিনবারের ঘোষণাকে পুনরাবৃত্তি বলে মেনে নিই, তাহলেও ১১০ লক্ষ কোটি টাকার পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ কি ৬ লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে মেটানো যাবে? দ্বিতীয়ত, এই মোদী-সীতারামন-শাহ-গোয়েলরা অবিরাম বলে চলেছেন বিগত ৭০ বছরে দেশে কিছুই হয়নি, তাহলে এই মানিটাইজেশনের জন্য সম্পদগুলি কোথা থেকে এল? এগুলি কি সব মোদী সরকার গত ৭ বছরে বানিয়েছে? দুটি প্রশ্নের উত্তরই মোদী সরকারের গালে চূণকালি মাখাবে। অবশ্য তাতে কিছুই যায় আসে না। ডিমানিটাইজেশন হোক বা মানিটাইজেশন, ব্যর্থতা এই সরকারের অনিবার্যতা, আর ব্যর্থতাকে অস্বীকার করা মোদী সরকারের বৈশিষ্ট্য।
মানিটাইজেশনের অর্থ হল, সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার মালিকানায় থাকা বিভিন্ন সম্পদকে দীর্ঘকালিন লীজের ভিত্তিতে বেসরকারি মালিককে ব্যবহার বা ব্যবসা করতে দেওয়া হবে। ব্যবসায়ী তা থেকে মুনাফা করবে ও লীজের সময়কালের শেষে সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেবে। এই খাতে সরকার ২০২১-২২ সালে ৮৮১৯০ কোটি, ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ সালে যথাক্রমে ১৬২৪২২, ১৭৯৫৪৪ ও ১৬৭৩৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। অপরদিকে সরকার যে সব সম্পদ ব্যবহার করতে দিয়ে ওই টাকা পাবে তা মোটামুটি এরকম: ১.৬ লক্ষ কোটি টাকা পাওয়া যাবে ২৬৭০০ কিমি ন্যাশনাল হাইওয়েজ লীজ দিয়ে। রেলওয়েজ থেকে ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা, ৪০০ স্টেশন, ৯০ টি প্যাসেঞ্জার ও ৬০টি মালবাহী ট্রেন বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে। পাওয়ার ট্রান্সমিশনের সার্কিট থেকে ৪৫৩০০ কোটি টাকা; এনটিপিসি, এনএইচপিসি'র বিদ্যুত উৎপাদনের সুবিধা বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে ৪০ হাজার কোটি; গেইলের কাছে থাকা জাতীয় গ্যাস পাইপলাইন থেকে ২৪ হাজার কোটি; টেলিকমের ক্ষেত্রে ভারত নেটের ২.৮৬ লক্ষ কিমি ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক থেকে ৩৫১০০ কোটি, ২১০ লক্ষ মেট্রিক টনের খাদ্য গুদাম থেকে ২৯ হাজর কোটি, ১৬০টা খনি থেকে ২৯ হাজার কোটি, ২৫টি এয়ারপোর্ট থেকে ২১ হাজার কোটি, ৯টি পোর্ট থেকে ১৩ হাজার কোটি, দুটো জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে ১১ হাজার কোটি ও শহরে রিয়াল এস্টেট থেকে ১৫ হাজার কোটি অর্থাৎ, জল স্থল অন্তরীক্ষ যেখানে যা আছে তার বড় অংশই তুলে দেওয়া হবে ব্যক্তি মালিকানার হাতে। সরকারের হাতে শেষমেশ থাকবে পেন্সিল।
এত বড় পরিমাণে দেশের সর্বজনীন সম্পদ কতিপয় পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া ঘোষণা করাটা এই নিকৃষ্টতম সরকারের কাছেও অসুবিধাজনক হওয়ায় অর্থমন্ত্রী বারবার বলে চলেছেন বিক্রি তো করছিনা, অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করতে দিচ্ছি। সময়কাল শেষ হলে তা আবার সরকারের কাছে চলে আসবে। প্রথমত তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। ব্যবসাটি লাভজনক হলে কর্পোরেট তা কখনোই ফেরত দেবে না। অন্যদিকে অলাভজনক হলে টাকা না দিয়ে তা ফেরত দিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত ক্ষেত্র বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার ভাবনা তা এতই গুরুত্বপূর্ণ সেগুলিতে একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজি এসে উপস্থিত হলে একদিকে উপভোক্তাকে অধিক অর্থ দিতে হবে। যেমন, রেলওয়েজ বা টেলিকম। রেলওয়েজ ভারতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার জনসাধারণের জীবনরেখা। সেই রেলওয়েজকে ব্যক্তি মুনাফার কেন্দ্রে নিয়ে গেলে শ্রমজীবী জনসাধারণের ঘাড়ে বোঝা বাড়বেই।
অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রগুলিতে কর্মসংস্থান হয়। বেসরকারি হাতে গেলে চুক্তি শ্রমিক, অস্থায়ী শ্রমিক, ফার্মিং আউটের মত চূড়ান্ত অমানবিক পদ্ধিতিগুলি আরো শক্তিশালী বাবে চালু করা হবে। কর্মসংস্থান কমবে। কেবল তাই নয়, সামাজিক ন্যায়ের জন্য যে সংরক্ষণ প্রথা সরকারি নিয়োগে চালু আছে তা বেসরকারি ক্ষেত্রে নেই। ফলে ক্রমাগত বিরাষ্ট্রীয়করণ বা গালভরা নাম মানিটাইজেশন যাই হোক না কেন সংরক্ষণ প্রথার বারোটা বাজিয়ে দেওয়াও হবে এর মধ্য দিয়ে।
একটি শ্লোগান দক্ষিণপন্থীরা সেই নরসিংহ রাও-মনমোহন সিং-চিদাম্বরমের সময় থেকে বলে চলেছে, ইংরেজিতে, “গভার্নমেন্ট হ্যাজ নো বিজিনেস টু ডু বিজিনেস (সরকারের ব্যবসা করা কাজ নয়)”। মনে হচ্ছে বলার সময় এসেছে, “গভার্নমেন্ট হ্যাজ এভ্রি রাইট টু ডু বিজিনেস এন্ড হ্যাজ অল দ্য ডিউটি টু ডু বিজিনেস হোয়েন বিজিনেসেস ওনলি প্রোফিটিয়ার এন্ড মেক দ্য ইকোনোমি সিক এ্যালোঙ্গ উইথ ইটস মাসেস” (সরকারের ব্যবসা করার সবরকম অধিকার আছে এবং তা করা কর্তব্য যখন ব্যবসাগুলি কেবল মুনাফাবাজি করে অর্থনীতিকে ও দেশের জনগণকে রুগ্ন করে তোলে)”। ডিমানিটাইজেশন থেকে মানিটাইজেশন — জনসাধারণকে দরিদ্র করার ট্রাডিশন সমানে চলেছে।
- অমিত দাশগুপ্ত
করোনাভাইরাসের অভিঘাত এড়াতে গত বছর লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর দেশে নানা প্রান্তে দেখা গিয়েছিল একই ছবি। রাস্তায় হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক। পুরুষদের পাশাপাশি সেই দলে রয়েছেন বিপুল সংখ্যক মহিলাও। কর্মক্ষেত্র ছেড়ে তাঁরা হেঁটে চলেছেন বাড়ির পথে।
সেই ছবি যে জাতীয় অর্থনীতিতে কী ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে, তার আঁচ এবার পাওয়া গেল বেকারত্বের হিসেবে। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে, লকডাউন ঘোষণার পরে এপ্রিল থেকে জুন মাসে মহিলাদের শ্রম-অংশীদারিত্ব ১৫.৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। যা ভারতের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। প্রতিবেশী বাংলাদেশে এই হার ৩০.৫ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় ৩৩.৭ শতাংশ।
বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া অন্য একটি হিসেব অবশ্য বলছে, নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে মহিলা শ্রমিকদের কাজ হারানোর ঘটনা ক্রমশ বেড়েছে। ২০০৫ সালে মনমোহন সিংহ সরকারের জমানায় মহিলা শ্রমিক ছিলেন ২৬ শতাংশেরও বেশি। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতির আগেই ২০১৯ সালে তা নেমে আসে ২০.৩ শতাংশে।
গত বছর আনলক পরিস্থিতিতেও মহিলা শ্রমিকদের হালের তেমন বদল হয়নি। কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য জানাচ্ছে, গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে করোনার কারণে কাজ হারিয়েছেন বহু মহিলা শ্রমিক। ফলে মহিলা শ্রমিকদের অংশীদারিত্ব নেমে এসেছে ১৬.১ শতাংশে। ওই সময় কাজ হারিয়েছেন প্রায় ১৫.৮ শতাংশ মহিলা শ্রমিক। পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে কাজ হারানোর হার ছিল ১২.৬ শতাংশ।
- এই সময়, ০৩ আগস্ট ২০২১
সম্পাদক সমীপেষু,
আজকের দেশব্রতী
১৯ আগস্ট ২০২১ তারিখের সম্পাদকীয় নিয়ে কয়েকটি কথা।
২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার ‘টুইন টাওয়ারস্’ ধ্বংসে, প্রায় চার হাজার অসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়। আমেরিকা এই ধ্বংসলীলার জন্য আলকায়দা ও তার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করে। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার খবর অনুযায়ী বিন লাদেন সেই সময় আফগানিস্তানে ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবান সরকারের কাছে বিন লাদেনের হস্তান্তর দাবি করে। কিন্তু তালিবান সরকার হস্তান্তরে অস্বীকার করে।
৭ অক্টোবর ২০০১ পশ্চিমী জোট আফগানিস্তানে বোমা বর্ষণ শুরু করে। আমেরিকা এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’ নামে তালিবান বিরোধী একটা আফগান মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে তালিবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৩ নভেম্বর ২০০১ সালে কাবুলের পতন হয়। ‘আল কায়দা’ পাকিস্তান-আফগান সীমন্তে আশ্রয় নেয়। বেশ কয়েক বছর পর মার্কিন বাহিনী আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে।
আফগানিস্তানকে আক্রমণ করে আল কায়দাকে পরাজিত করা, তালিবানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার মার্কিন উদ্দেশ্য সফল হয়। এই অভিযানে ‘নারী স্বাধীনতা’ বা অন্য কোনও মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না। যত দিন গেছে আফগানিস্তান আমেরিকার গলায় কাঁটা হিসাবেই ছিল। এখন সেই কাঁটা উপড়ে ফেলে দিতে চাইছে।
দেশব্রতী সম্পাদকীয় লিখেছে, “আফগানিস্তানে তালিবানদের আরেকবার ক্ষমতা দখল বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। উদ্বেগের কেন্দ্রে আছে নারী স্বাধীনতার প্রশ্ন। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সেনা অভিযান চালানোর অন্যতম যুক্তি হিসেবে ‘নারীর অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়াই’কে সামনে তুলে ধরেছিল। সেই সময়কার আফগান নারীকে তুলে ধরা হয়েছিল অধিকারহীনতার প্রতীক হিসেবে। নিদারুণ বাস্তবতা থেকে আফগান মহিলাদের মুক্ত করার লক্ষ্যে আফগানিস্তানে মার্কিন মিলিটারি আগ্রাসন চালানো এক জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা হয়েছিল।” (সম্পাদকীয়, দেশব্রতী, ১৯ আগস্ট ২০২১)
আমেরিকা “নারীর অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়াইকে সামনে তুলে ধরেছিল।” আফগানিস্তান দখলের এই ‘মহান’ উদ্দেশ্য আগে আমরা জনতে পারিনি। মার্কিনীদের এতো মহান করে দেখাবার কারণ আমার এই ক্ষুদ্র মাথায় ঢোকেনি। একটা শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে, যা শুনছি ও দেখছি প্রচারে সাম্রাজ্যবাদ ক্রমশ পিছনে চলে যাচ্ছে বা সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদকে একই বন্ধনীতে নিয়ে আসা হচ্ছে। দেশব্রতী কি সেই আলোকেই সম্পাদকীয় লিখেছে? আমার মতো প্রবীণ সনাতনী বাম কর্মীর রজ্জুতে সর্পভ্রম হতে পারে, আমার ভুল শুধরে দিলে উপকৃত হব।
- নবেন্দু দাশগুপ্ত, বেলঘরিয়া
অশক্ত শরীর, বয়সের ভারে ঠিকমতো চলতে পারতেন না, কিন্তু আজীবন সংগ্রামী চেতনায় ছিলেন দৃঢ়। পার্টির যে কোন প্রোগ্রামের কথা শুনলেই বলতেন, আমি যাবো, নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। কখনও প্রোগ্রামের গাড়ীতে কখনও বা মোটর সাইকেলের পিছনে বসে তিনি হাজির হয়ে যেতেন এলাকার সমস্ত কর্মসূচিতে, বসে থাকতেন একেবারে সামনের সারিতে। নদীয়া জেলার নাকাশীপাড়া ব্লকের ধর্মদা এলাকার দীর্ঘদিনের সিপিআই(এমএল) কর্মী ধূলো সেখ গত ১১ আগস্ট ভোররাতে প্রয়াত হয়েছেন। বয়সজনিত কারণেই তিনি চলে গেলেন। একসময় ধুবুলিয়া পার্টি অফিসে ছিল তাঁর নিয়মিত যাতায়াত। ধর্মদা এলাকায় সুবোধ মজুমদার, সুবিমল সেনগুপ্তের সাথে মিলে কাঁধে লালঝান্ডা নিয়ে জমি দখল থেকে শুরু করে নানাবিধ সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। এলাকায় সুপরিচিত ছিলেন। এলাকার ব্যাপক মানুষ তাঁকে সমীহ করতো। বিগত বিধানসভা নির্বাচনের সময় পাড়ার চা দোকানে, গলির মহল্লায় লিফলেট বিলিও করেছিলেন। তাঁর দীর্ঘদিনের সাথী প্রতিবেশী রহিম সেখ কিছুদিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন। ধর্মদার এই দুই বরিষ্ঠ কমরেডের ঘনিষ্ঠ ছবি সকলের স্মৃতিতে চিরদিন অমলিন থেকে যাবে। ধূলো সেখ লাল সেলাম। তাঁর স্মৃতি অবিনশ্বর হোক। তাঁর বাড়িতে গিয়ে অন্তিম শ্রদ্ধা জানান পার্টির জেলা ও রাজ্য নেতৃবৃন্দ কাজল দত্তগুপ্ত, সন্তু ভট্টাচার্য, অনিমা মজুমদার, জয়তু দেশমুখ প্রমুখ।
গত ২৭ জুলাই প্রয়াত হন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বালি-বেলুড় লোকাল কমিটির সদস্য এবং বেলুড় মহাদেও জুটমিলের শ্রমিক নেতা রাজেন্দ্র সাউ (গুপ্তা)। ২২ অগাস্ট বালি পার্টি অফিসে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন বালি-বেলুড় লোকাল কমিটির উদ্যোগে শ্রমিক নেতা রাজেন্দ্র গুপ্তা (সাউ)’র স্মরণসভা সংগঠিত হয়। সভা পরিচালনা করেন অঙ্কিত মজুমদার এবং তপন ঘোষকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী। মাল্যদান এবং নীরাবতা পালনের পরে লোকাল কমিটির পক্ষ থেকে শোকবার্তা পাঠ করেন পার্টির লোকাল সম্পাদক নীলাশিস। গণসঙ্গীত পরিবেশন করে বালি সংযোগ সাংস্কৃতিক সংস্থা। পাঠ করা হয় এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু এবং বিসিএমএফ রাজ্য সম্পাদক অতনু চক্রবর্তীর পাঠানো শোকবার্তা। রাজেন্দ্র গুপ্তার স্মৃতিচারণা করে বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, বিসিএমএফ রাজ্য সভাপতি নবেন্দু দাশগুপ্ত, শ্রমিক নেতা তপন ঘোষ, মহাদেও জুটমিলের শ্রমিক রাধেশ্যাম দাস, বালি গ্রামাঞ্চলের পার্টি সংগঠক মাধব মুখার্জী, অরুণ গুহ, দীপক চক্রবর্তী, বর্ষীয়ান পার্টি নেতা রঘুপতি গাঙ্গুলি, গোপাল বেরা, ছাত্র নেতা অমিতাভ সহ অন্যান্যরা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন অমিতাভ ব্যানার্জী। উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত রাজেন্দ্র গুপ্তার মেয়ে রাখি গুপ্তা। স্মরণসভায় মহাদেও জুটমিলের শ্রমিক কমরেড এবং ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের সহযোদ্ধা আজীবন কমিউনিস্ট বিপ্লবী প্রয়াত কমরেড মিহির রায়চৌধুরীর স্মরণসভা এবং তাঁর নামাঙ্কিত পাঠাগার ও অবৈতনিক কোচিং সেন্টারের উদ্বোধন হল গত ২২ আগস্ট বেহালা সরশুনা ব্যানার্জী পাড়া বাইলেনের এক কামড়ার ঘরে। বক্তব্য রাখেন ১২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কোঅর্ডিনেটর নীহার ভক্ত, মিহির রায়চৌধুরীর ভাই অশোক রায়চোধুরী, সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য জয়তু দেশমুখ, এপিডিআর প্রতিনিধি মদনমোহন হালদার, সিপিআই(এমএল) বেহালা লোকাল কমিটির পক্ষে শুক্লা সেন, অশোকনগর লোকাল কমিটি সম্পাদক অজয় বসাক, আইসা বেহালা জোনাল সহ-সম্পাদক অত্রি, জোনাল সভাপতি শুভদীপ, সিপিআই(এমএল) কলকাতা জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী। উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সম্পাদক নীতীশ রায়। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে স্মরণসভার কর্মসূচি শেষ হয়। পাঠাগার উদ্বোধনের ফলে এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন দেখা যায়, তারা শুভকামনা করেন।
স্মৃতি বেঁচে থাকবে সমকালের মাঝে
“হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়।
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়।”
- শঙ্খ ঘোষ
বলা যায় অসাধ্যসাধন! ব্যক্তিগত সম্পত্তির স্বার্থসর্বস্ব আজকের এই সময়কালে কারও ঘরবাড়িকে সংগঠনের আওতায় নিয়ে আসা খুব একটা সহজ কাজ নয়! কিন্তু এই কঠিন কাজটা সম্ভব হয়ে উঠলো দুই প্রজন্মের মূল্যবোধ আর স্পর্ধিত উদ্যমের সমন্বয়ে। একদিকে প্রয়াত কমরেড মিহির রায় চৌধুরী। যিনি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কলকাতার বেহালা এলাকার সরশুনায় তাঁর এক কামরার ফ্ল্যাটে উদ্বোধন করা হল স্মারক লাইব্রেরি ও কোচিং সেন্টার। না, মিহিরদা কোনও দানপত্র বা লিখিত কাগজপত্র দিয়ে যাননি। চলে যাওয়ার আগে সেই সুযোগটুকুও পাননি। সহায়তা করলেন উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগরে তাঁর আদি নিবাসে বসবাসকারী মিহিরদার পরিবার। আজকের দিনে যা সত্যিই বিরলতম। ৭০ দশকে নকশালবাড়ির আদর্শে দাদার আত্মত্যাগ, আজীবন কমিউনিষ্ট মূল্যবোধ ও সক্রিয়তার প্রতি মিহিরদার একমাত্র উত্তরাধিকারী তাঁর ভাই ও সমগ্র পরিবারের মধ্যে রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা। এখান থেকে গড়ে ওঠে তাঁদের দায়বদ্ধতা। মিহিরদার স্মৃতি জাগরুক করে রাখার লক্ষ্যে তাঁর ঘরটিকে লাইব্রেরি হিসাবে ব্যবহারে পরিবারের দ্বিধাহীন অনুমোদন পাওয়া গেল। বোঝা গেল স্বপ্নের পাখীগুলো সব মরে যায়নি!
অপর দিকে রয়েছে বেহালা সরশুনা এলাকায় এগিয়ে আসা আইসার এক ঝাঁক উজ্জ্বল ছাত্র যুবরা, যারা মিহিরদার সাথে ঘনিষ্ঠতায় তাঁর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল প্রকৃত কমিউনিস্টের তাৎপর্য, তাঁর জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছিল ওদের রোল মডেল। মিহিরদা ছিলেন একাধারে ছাত্রযুবদের বন্ধু এবং আদর্শগত শিক্ষক। তাই মিহিরদাকে অন্তর থেকে ভালোবেসে ছাত্র যুবদের নাছোড়বান্দা প্রচেষ্টা আর উদ্যমে শুরু হল লাইব্রেরী আর কোচিং সেন্টার। গঠনমূলক সামাজিক কর্মকান্ডের পথে চলা। এভাবেই বিপ্লবী সংগ্রাম তথা অনুশীলনের আলোর মশাল অথবা দীর্ঘস্থায়ী অভিযানের ব্যাটন চলে আসে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের হাতে।
এলাকার কিছু মানুষ নানা অজুহাতে আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু সর্বস্তরের মানুষের সাথে মেলামেশার মধ্য দিয়ে মিহিরদা এলাকার জনজীবনে যে গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে গেছেন এবং পাড়ার নবীন প্রজন্মের ছাত্ররা যেভাবে প্রত্যয়ের সাথে এগিয়ে এসেছে, সেই জোড়ালো প্রত্যুত্তরের মুখে অচিরেই সমস্ত বাধা দূর হয়ে যায়। লাইব্রেরি চালু হয়। এভাবেই মিহিরদার স্মৃতি অবিনশ্বর হয়ে থাকবে। তাঁর আকাঙ্খিত আটটা নটার সূর্যরা নিয়ে আসবে নতুন বসন্ত। এই বিশ্বাস সঞ্চারিত করতে সার্থক হবে সরশুনার ব্যানার্জী পাড়া লেনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া তাঁর স্মৃতিচিহ্ন। আজীবন বিপ্লবী কমিউনিস্ট কমরেড মিহির রায়চৌধুরী লাল সেলাম।
- জয়তু দেশমুখ
== সমাপ্ত ==