সেদিন ছিল বৃটিশ মুক্ত ভারতের দাবি। আজ ফ্যাসিবাদ মুক্ত ভারতের দাবি। সেদিন ছিল পরাধীনতার হাত থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি। আজ দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তির দাবি। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের আগে ব্রিটিশ বিরোধী বহু আন্দোলন হয়েছিল কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে ছড়িয়ে পরা ৯ আগস্টের স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। ভারতীয় জনগণ তখন মরিয়া একটা শব্দকে সামনে রেখে — স্বাধীনতা। বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুব, কৃষক, শ্রমিক যে যেভাবে পেরেছিলেন আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা এও জানি সাময়িকভাবে আগস্ট আন্দোলনের পরাজয় হলেও পরবর্তীতে স্বাধীনতার দাবির আন্দোলনের তীব্রতাতেই বৃটিশকে চলে যেতে হয়েছিল। ভারতীয় জনগণের জয় হয়েছিল। আজও ভারতীয় জনগণ এক মরিয়া লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন একটা শ্লোগানকে সামনে রেখে ‘ফ্যাসিবাদ হঠাও, ভারত বাঁচাও’।
স্বাধীন ভারতের শ্রমজীবী মানুষদের নতুন করে শৃঙ্খলিত করার এক জঘন্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। শ্রমের সঠিক মূল্য নির্ধারণের দাবি নিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসে আমরা জানি ডঃ বি আর আম্বেদকরের অবদানের কথা। ১৯৪৬ সালের ১১ এপ্রিল, শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি সম্পর্কিত বিলের খসড়াটি উনিই প্রস্তুত করেন যা পরবর্তীতে নূন্যতম মজুরি আইন ১৯৪৮-এ পরিণতি লাভ করে এবং সে বছরের ১৫ মার্চ থেকে তা ভারতবর্ষে লাগু হয়। যে আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবেই উল্লিখিত হয়েছিল
আজ আমরা দেখছি এই সকল উদ্দেশ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে পুঁজিপতিরা কী করে আরো মুনাফা করতে পারে সেই লক্ষ্যে শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সমস্ত আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। স্থায়ী শ্রমিকের পরিবর্তে ঠিকা, অস্থায়ী, কন্ট্রাক্ট প্রথাকে শুধু স্বাভাবিকই করা হল না, তাকে আইনসিদ্ধও করা হল। আমরা জানি ঠিকা বা কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে স্থায়ীকরণের লক্ষ্যে ‘কন্ট্রাক্ট লেবার রেগুলেশন অ্যান্ড অ্যাবোলিশন এ্যাক্ট’ নামে একটা আইন লোকসভায় পাশ করানো হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্ট এবং দেশের সুপ্রিম কোর্টও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্থায়ীকরণের আদেশও দিয়েছিল। কিন্তু আজ সে আইন, আদেশকে ছেঁড়া কাগজে পরিণত করা হল।
একদিকে সংগঠিতক্ষেত্রে বড় মাত্রায় অসংগঠিত শ্রমিকের (ঠিকা, অস্থায়ী, কন্ট্রাক্ট) সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে চলেছে, অপরদিকে বিগত দুই দশক ধরে এক বিশাল সংখ্যার মানুষ কৃষিক্ষেত্র ছেড়ে অকৃষিক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছেন। যা সমস্তটাই অসংগঠিত ক্ষেত্রের (মূলত নির্মাণ শিল্পের সাথে যুক্ত পরিযায়ী) শ্রমিক হিসাবে বড় সংখ্যায় আত্মপ্রকাশ করেছে। যাদের জন্য খাতায় কলমে কিছু আইনি সুরক্ষার কথা থাকলেও বাস্তবে তা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ অসংগঠিত শ্রমিক আজ প্রতিদিন শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছেন। দূর্বল শ্রমজীবী মানুষ যাতে ক্ষমতাবান মালিকশ্রেনীর সাথে দরকষাকষি করতে পারে তারজন্য যে সংগঠিত হওয়ার বা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার অর্জন করেছিলেন তাও আজ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। জাতীয়করণ আইন সংশোধন করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প বা সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ এবং বিলগ্নীকরণের রাস্তা প্রশস্ত করা হচ্ছে।
এরকম একটা সময়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষ ৯ আগষ্টের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনকে স্মরণে রেখে ‘ভারত বাঁচাও’এর শপথ গ্রহণ করলেন। পশ্চিমবাংলাতেও চা, কয়লা খনি, রেল, ব্যাঙ্ক, বীমা, ইঞ্জিনিয়ারিং, জুট, পরিবহন, নির্মাণক্ষেত্র সহ সকল অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকরা রাজ্য সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট কোভিড বিধিকে অগ্রাহ্য করেই কারখানার গেট এবং রাজপথ দখল করে নিজেদের সংগঠিত অস্তিত্বকে ঘোষণা করলেন। এআইসিসিটিইউ কোথাও স্বাধীনভাবে কোথাও অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র, মহিলা, কৃষক সংগঠনগুলির সাথে যৌথভাবে এই কর্মসূচি পালন করেছে।
উত্তর ২৪ পরগনায় বারাসাতে এআইসিসিটিইউ, সিআইটিইউ সহ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর যৌথ আইন অমান্য ও প্রতিবাদসভা হয়। অশোকনগর, বসিরহাট, বেলঘরিয়াতে এআইএসএ, এআইসিসিটিইউ, অ্যাপোয়া মিছিল ও সভা করেছে। কাঁচড়াপাড়া রেল ওয়ার্কশপ গেটে এআইসিসিটিইউ, শিবদাসপুরে কৃষিমজুর সংগঠন এবং সিপিআই(এমএল), বারাসাত স্টেশনে এআইএসএ একইসাথে প্রতিষ্ঠা দিবসের কর্মসূচি পালন করেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার কমরেডরা প্রশাসনের সমস্ত প্রতিরোধকে উপেক্ষা করেই বজবজে জেলা অফিস থেকে চড়িয়াল পর্যন্ত মিছিল করেন এবং চড়িয়াল মোড়ে বিক্ষোভ সংগঠিত করেন। বড় বড় ব্যানারে লেখা ছিল ‘বিজেপি হঠাও, দেশ বাঁচাও’, এনএসএ-ইউএপিএ-আফস্পা সহ সমস্ত দমন আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে, কর্পোরেট স্বার্থবাহি ৩টি নয়া কৃষি কানুন বাতিল ও বনাধিকার আইন কার্যকর করতে হবে, ৪টি শ্রমকোড বাতিল করতে হবে, ২০২০’র নয়া বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার করতে হবে। সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক কিশোর সরকার, জেলা কমিটি সদস্য নবকুমার বিশ্বাস ও নিখিলেশ পাল। মহিলাদের সংগঠিত করেন নেত্রী কাজল দত্ত ও দেবযানি গোস্বামী। কোচবিহার জেলায় এআইসিসিটিইউ, এআইকেকেএমএস এবং এআইকেএম’এর অবস্থান, বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়। আলিপুরদুয়ার শহরে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন-এর যৌথমঞ্চের পক্ষ থেকে একটি সুসজ্জিত মিছিল শহরের কোর্ট মোড় থেকে শুরু হয়ে জেলাশাসক-এর দপ্তরের সামনে দিয়ে ঘুরে শহরের মূল রাস্তা ধরে নিউটাউন মহাকালধামে এসে শেষ হয়। মিছিলে এআইসিসিটিইউ, সিটু, আইএনটিইউসি, ইউটিইউসি, এআইটিইউসি, এনটিইউআই’র নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন। আসানসোলে এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে কয়লা খনির শ্রমিকদের নিয়ে বিক্ষোভসভা হয়। প্রতিবাদ সংগঠিত হয় চিত্তরঞ্জনে। কৃষ্ণনগরে কালেকটারি মোড়ে গণসংগঠনগুলোর যৌথ কর্মসূচিতে এআইসিসিটিইউ থাকে অন্যতম শরিক।
কলকাতার ধর্মতলায় কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু, উপস্থিত থাকেন রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী রাজ্য নেতৃত্বের দিবাকর ভট্টাচার্য, প্রবীর দাস ও কলকাতা জেলার নেতৃবৃন্দ। সিআইটিইউ, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, এইচএমএস, ইউটিইউসি, টিইউসিসি, বিএসএনএলইইউ, বিইএফই সহ বিভিন্ন গণসংগঠন।
ঐতিহাসিক ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৭৯তম দিবসে এআইসিসিটিইউ, এআইএসএ, এআইপিডব্লিউ’র যৌথ উদ্যোগে উত্তর ২৪ পরগণা জেলা অফিস থেকে কলোনি বাজার, কে-৮ বাস স্ট্যান্ড হয়ে শহীদ বেদী পর্যন্ত মিছিল হয়। মিছিল শেষে বেলঘরিয়া শহীদ বেদী মোড়ে প্রতিবাদসভা হয়। সাঁতরাগাছি স্টেশন এলাকায়, ভারত বাঁচাও শ্রমিক অধিকার বাঁচাও দাবিতে গণঅবস্থান কর্মসূচি হয়। অল ইন্ডিয়া সেন্টাল কাউন্সিল ওফ ট্রেড ইউনিয়ন, সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়েমজদুর ইউনিয়ন, সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ে ঠিকা শ্রমিক ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক মারা নীতি ও কোম্পানি রাজ কায়েম করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সভায় বক্তব্য রাখেন জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা এন এন ব্যানার্জি, মীনা পাল, নিলাশিস বসু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। শ্রমিক স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে দেবো না যেকোন মূল্যে তা রক্ষা করা হবে — এই অঙ্গীকার করেন নেতৃবৃন্দ। সভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করে বালি ‘সংযোগ সংস্থা’। বসিরহাটে নয়া কৃষি আইন ও শ্রমকোড বাতিল, মাইক্রোফিনান্স ঋণ সহ সমস্ত ক্ষুদ্র ঋণ মকুব, সমস্ত শ্রমজীবী পরিবারকে মাসে ৭,৫০০ টাকা ভাতা, ইউএপিএ, এনআইএ সহ সমস্ত ঔপনিবেশিক ধারার গণতন্ত্র-বিরোধী আইন বাতিল, স্ট্যান স্বামীর জেল হেফাজতে মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি সহ বিভিন্ন দাবিতে কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে এআইসিসিটিইউ ও সারা ভারত কিষাণ মহাসভার আহ্বানে শ্রমিক বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, দেশ বাঁচাও কর্মসূচি সংগঠিত করা হয়। বসিরহাটের টাউন হল থেকে মিছিল করে বোটঘাটে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সভায় এআইসিসিটিইউ’র দেবব্রত বিশ্বাস বক্তব্য রাখেন। সংক্ষিপ্ত সভার শেষে আবার মিছিল করা হয় টাউন হল পর্যন্ত। এভাবেই রাজ্য তথা দেশের শ্রমজীবী মানুষ ৯ আগষ্টে ‘ভারত বাঁচাও’ শ্লোগানকে জোরের সাথে তুলে ধরে আন্দোলনের এক নয়া অধ্যায়ের সূচনা করেন।
এবার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি হতে চলেছে। প্রতিবারের মতো এবারেও ১৫ আগস্টে লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন। সেই ভাষণে আমরা শুনতে পাবো না লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার কারণ কি ছিল? হাজার হাজার মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরার আগেই অনেককে কেন মৃত্যু বরণ করতে হল? অভুক্ত, ঋণগ্রস্ত শ্রমিকেরা কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন? কোটি কোটি মানুষ কেন চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়ে বেরোজগার হয়ে পড়েছেন? লক্ষ কোটি যুবকদের রোজগারহীন থাকার কি কারণ? ব্যাঙ্কে গচ্ছিত জনগণের লক্ষ কোটি টাকা যারা আত্মসাৎ করল তাদের শাস্তি হল না কেন? লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলিকে বেসরকারীকরণ, বিলগ্নিকরণ কাদের লাভের স্বার্থে করা হচ্ছে? লক্ষাধিক কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ কি? কোভিড পর্যায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাওয়ার জন্য সরকার দায় স্বীকার করবে না কেন? শ্রমিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে শ্রমকোড চালু করা হল কেন? কৃষকদের জমি ও ফসলের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কাদের স্বার্থে নয়া কৃষি আইন প্রবর্তন করা হল? না। এসব কিছুই তিনি বলবেন না। আমরা জানি, তিনি বলবেন ‘আচ্ছে দিন’-এর সাঁজোয়া রথে সওয়ার ভারতীয় জনগণ এক নতুন ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়তে চলেছে। যে ভূয়ো রথের সারথি তিনি নিজে।
অপরদিকে আমরা দেখব ঐ দিনই গোটা দেশের শ্রমজীবী মানুষ নিজেদেরকে নয়া দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে স্বাধীনতার তেরঙ্গা পতাকাকে আরেকবার আকাশে ওড়াবেন। দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াইয়ে নিজেদেরকে উপযুক্ত রণসাজে সজ্জিত করার আহ্বান রাখবেন। আকাশ বাতাস মুখরিত করে শ্লোগান তুলবেন “ফ্যাসিবাদ হঠাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, ভারত বাঁচাও”!
- দিবাকর
আইনের শাসনের জায়গা নেয় যখন শাসকদের আইন, সবার জন্য গণতন্ত্রের দখল নেয় যখন সংখ্যাগুরুবাদ, সকলের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা নিশ্চিত করার বদলে যখন ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ‘দেশদ্রোহী’ দাগিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে হত্যা, ভূয়ো সংঘর্ষের নামে হত্যা, ঔপনিবেশিক আমলের কুখ্যাত সব দমন আইনে বিনা বিচারে ফেলে রেখে, এমনকি ঠিকমতো খেতে না দিয়ে চিকিৎসা না করিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হত্যাই পরিণাম হয়ে দাঁড়ায়; তখন প্রতিবাদে প্রতিরোধে ন্যায়কামী নাগরিক চেতনায় অভিনব সব উদ্যোগ সক্রিয় ও সংগঠিত হতে শুরু করে। যেমন উঠে এসেছে আজীবন আদিবাসীদের জন্য কাজ করে আসা ফাদার স্ট্যান স্বামীর পরিণতি ও তার প্রতিক্রিয়ার কথা। স্বার্থবুদ্ধির চিন্তা পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে যে আদিবাসী প্রাজ্ঞ মানুষটি নিজেকে উজার করে দিয়েছিলেন পরার্থে, পরিব্রাজক হয়েছিলেন শিক্ষার মাধ্যমে আদিবাসী জনসমুদয়কে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে, তিনি রাষ্ট্রের চূড়ান্ত রোষের শিকার হলেন, কিন্তু কোনও আপস করেননি। ক্ষমতাধর কঠোর রাষ্ট্রবাদী বর্বরপন্থীরা আর অপেক্ষায় থাকলো না, সাজানো এক মামলায় জড়িয়ে অশীতিপর অগ্রজ বৃদ্ধকে গারদে পুরে মেরে ছাড়লো। প্রতিক্রিয়ায় ধিক্কার উঠেছে সারা দেশ থেকে। আদিবাসী সমাজের আধুনিক শিক্ষিত অগ্রণী অংশও দাবি তুলছে প্রতিকার চাই। গড়ে উঠছে বহুবিধ গণউদ্যোগ, মঞ্চ, কণ্ঠ। যার এক অভিনব রূপ প্রত্যক্ষ হল কলকাতার বুকে, এক সংখ্যালঘু ফোরাম গঠনের মধ্যে। খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অংশের মানুষেরা মিলে তৈরি করলেন এক সংখ্যালঘু ফোরাম। বেঙ্গল ক্রিশ্চিয়ান কাউন্সিল সংক্ষেপে ‘বিসিসি’ নামধারী এই মঞ্চ তার ঘোষণাপত্রে বলেছে, এতে ধর্মীয় পরিচালকদের অংশগ্রহণে বাধা নেই, তাঁরা থাকলেও এটা কোনও ধর্মীয় বিষয়াদি চর্চার জায়গা নয় বা সেই উদ্দেশ্যে এর গঠন হয়নি। এই মঞ্চের লক্ষ্য হল সম্প্রদায় নির্বিশেষে আদিবাসী, প্রান্তবাসী, জনজাতি, নিপীড়িতদের অধিকার সচেতন করতে শিক্ষিত করা, অধিকারের জন্য লড়াইয়ে সংগঠিত করা। যে লড়াই লড়তে লড়তে আত্মত্যাগ করলেন ফাদার স্ট্যান। ফাদার আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়টিকে দাঁড় করিয়েছিলেন সম্মুখসমরে। সেই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার হাতিয়ার হিসাবেই কাজ করতে চায় উপরোক্ত ফোরাম। এর প্রাথমিক উদ্যোগী খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের চালকরা হলেও আয়োজিত সভায় এসেছিলেন সংখ্যালঘু মুসলিম, জৈন ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিবর্গ; আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে শিখ ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদেরও। এই মঞ্চ গ্রাম ও শহরে ওয়ার্কশপ, সেমিনার, কনভেনশন সংগঠিত করে চলবে। লাগাতার কর্মসূচি নেওয়া এবং ব্যাপকতর সমাবেশ সংগঠিত করা মূল কর্তব্য। সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক হক নিয়ে সরকারপক্ষের সাথে ফয়সালা করাই লক্ষ্য। চলার পথে এই মঞ্চ কীভাবে কি করে তা অবশ্যই পর্যবেক্ষণের বিষয়। কিন্তু এপর্যন্ত যে উদ্যোগ জানান দিচ্ছে তা ইতিবাচক এবং স্বাগত জানানোর। ধর্মাবলম্বীদের সম্প্রদায়গত অধিকার মঞ্চ গঠনকে তুচ্ছ মনে করার কোনো কারণ নেই। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, অধিকার সম্মত সামাজিক ন্যায়, সমতা, সবকিছু অর্জন করতে লড়াই করার সংকল্প নিচ্ছে কীনা। আমরা জানি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সন্ন্যাস বিদ্রোহের কথা, ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামের সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের তৈরি বন্দীশিবিরের কাঁটাতারের দেওয়াল ছিঁড়ে ফেলেছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। তার জন্য আত্মত্যাগও করেছিলেন। তাই বিচার করার আসল বিষয় হল স্বাধীনতা, মুক্তি, গণতন্ত্র, অধিকার, স্বায়ত্ততার জন্য লড়াই করার ইচ্ছাশক্তি জাগছে কীনা।
স্বাধীনতার ৭৫ উদযাপনের প্রাক সপ্তাহে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি আজও হয়ে রয়েছে দুর্বলতর অংশ, বলাবাহুল্য সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দু সমুদয় রয়েছে আধিপত্যকামী প্রবণতায়। হিন্দুত্ব’র সন্ত্রাস, দাপাদাপি রোজকার ঘটনা ও প্রবণতা। সংবিধানের ৪৬ ধারা স্বীকৃত সুরক্ষা, নিরাপত্তা, সম অধিকার কার্যকরি না হলে অসমতা, বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার চলতেই থাকবে। রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ থাকতেই হবে যাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক দুর্বলতর দুরবস্থা দূর হওয়া নিশ্চিত হতে পারে, আর সমস্ত রকমের শোষণ-উৎপীড়ন থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়, আর সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত হয়। আমাদের তুলতেই হবে এই ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক
স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের সেলাম
১৯৭১ সালের ১২-১৩ আগস্ট পুলিশের সহযোগিতায় কংগ্রেসী ঘাতক বাহিনী কাশীপুর-বরানগর অঞ্চলে ভয়ঙ্কর নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। এ এক বিরলতম ঘটনা, রাজ্যের রাজধানী কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় দু'দিন ধরে প্রায় শতাধিক সিপিআই(এমএল) কর্মী ও সমর্থকদের হত্যা করা হয়েছিল। এর আগের বামফ্রন্ট সরকার তদন্ত কমিশন বসিয়েছিল, তার রিপোর্ট দিনের আলোর মুখ দেখেনি। বিপরীতে সেই সব হত্যাকারী পুলিশ অফিসার প্রোমোশন পেয়েছে এবং কংগ্রেসী ঘাতক বাহিনী রাজনৈতিক পুর্নবাসন পেয়েছে। এরা বর্তমানে অনেকেই শাসক দলের সাথে যুক্ত আছেন। তদন্তের প্রশ্নে তৃণমূল সরকারের একটাই কথা কাশীপুর বরানগর গণহত্যার ফাইলের খোঁজ চলছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, মৃতদের পরিবারের জবানবন্দি এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন বিবরণ থেকে জানা যায় বারাসাত হত্যাকাণ্ড ও কাশীপুর-বরানগর গণহত্যাকাণ্ডে কংগ্রেসী ঘাতক বাহিনী প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল। বারাসাত হত্যাকাণ্ডে যিনি অন্যতম পরিকল্পক, তিনি আমৃত্যু বহাল তবিয়েতে কংগ্রেসী রাজনীতি করে গেছেন। ১৯৭০ সালের ১৯ নভেম্বর কানাই ভট্টাচার্য, যতীন দাস, সমীর মিত্র, গণেশ ঘটক, শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, তরুণ দাস, সমেন্দ্র দত্ত এবং স্বপন পাল — দক্ষিণেশ্বর আরিয়াদহের এই ৮ জন কমরেডকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে বারাসাতের রাস্তায় তাঁদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ ফেলে আসে।
বারাসাত গণহত্যার পর কংগ্রেসী ঘাতক বাহিনীর স্পর্ধা আরও বেড়ে যায়। তারই পরিণতিতে ঘটে কাশীপুর-বরানগর গণহত্যা। যার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবাংলার ভারপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। কাশীপুর-বরানগর গণহত্যা কাণ্ডের পর তাকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন ‘সারা রাত ধরে যেখানে গণহত্যা চললো, শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা কী তাহলে আক্রান্ত হলে পুলিশ প্রোটেকশন পাবে না?’ সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের দাম্ভিক উত্তর ‘আগে দেখতে হবে যারা মারা গেছে, তারা শান্তিপ্রিয় ছিল কিনা?’ (সূত্রঃ ‘যুগান্তর’ ১৫ আগস্ট ১৯৭১)।
পুলিশ কর্তা রুনু গুহ নিয়োগী ‘সাদা আমি কালো আমি’ রচনায় লেখে ‘আগস্ট ১২ তারিখে কংগ্রেস নেতা নির্মল চট্টোপাধ্যায়কে হত্যা করা হয় কাশীপুর রোড ও রতনবাবু রোডের মোড়ে। নির্মলবাবু ওই অঞ্চলের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন।... তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তারই পরিণাম, তাঁরা দলবদ্ধভাবে খুঁজে খুঁজে নকশালদের মেরে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেন।... এই প্রথম নকশালরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ পেল।’ সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের উক্তি এবং রুনু গুহ নিয়োগীর সংলাপ থেকে বোঝা যায় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের যোগসাজশেই অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী দেবাশিস ঘোষের লেখা থেকে তা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি লিখছেন ‘১৩ আগস্টের ভোরে রতনবাবু রোড ও চন্দ্রকুমার রায় লেনের মোড় থেকে সশস্ত্র ‘খুনি’রা এগোতে থাকে। এরা হল বাবলু ঘোষ, লকা, পঞ্চম রজক, সমর মুখার্জী, অলোক সাউ, নিমাই দাস (ছোটবাবু) প্রভৃতি। এদের অনেকেরই হাতে পুলিশের রিভলবার। কেন না কর্ড ঝোলানো ছিল রিভলবারের বাটে।’ দেবাশিসবাবু আরও লিখেছেন ‘আবার প্রামাণিক ঘাট রোড হয়ে শ্মশানের পাশ দিয়ে তেড়ে আসছে পরেশ সাউ, ভোম্বল দত্ত, শুভেন্দু, দেবু দত্ত, বংশী, নিতাই, কেলো (হাতকাটা), ট্যারা শঙ্কর, গোরা মন্ডলের মতো মারকুটে কংগ্রেসীরা। স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিই শ্মশানের পাশে থাকা মাটির নৌকায়।’ দেবাশিস ঘোষের পুস্তিকায় মৃতদের ১৭ জনের অসম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাঁরা হলেন--করুণা সরকার, পাঁচু গোপাল দে, অষ্ট খাঁড়া, সমীর বড়াল, ভবানী বিশ্বাস, অমল বিশ্বাস, তপন সামন্ত, নেপাল চট্টোপাধ্যায়, শ্যামসুন্দর মাইতি, দীপু সরকার, পঞ্চানন রায়, অজিত মারিক, সুবোধ মারিক, কেলো, খোকন, খগেন এবং সুভাষ চক্রবর্তী। আটাপড়ায় গগণ চন্দ্র রায় (গোখনা), শ্যাম, শ্যামল চৌধুরী, বাবলা বিশ্বাসদের খুঁজতে গিয়ে জল্লাদরা যা করেছিল সেই নৃশংসতারও কোন নজির নেই। সেই সময়কার সাপ্তাহিকী ‘দর্পণ’ ও ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকায় বিস্তারিত রিপোর্ট বেরিয়েছিল।
চারু মজুমদার, সরোজ দত্তের হত্যা, হাওড়া, বারাসাত, কোন্নগর, ডায়মন্ডহারবার, বেলেঘাটা সহ প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি উঠুক। হাওড়া জেলে (মল্লিক ফটক) ১৯৭৫ সালে শহীদ হন শহীদ কমরেড প্রদীপ চৌধুরীর ভাই প্রবীর (পাখি) চৌধুরী, প্রতীক ঘোষ ও শ্যামল চক্রবর্তী। বেলঘরিয়ায় ফেক এ্যানকাউন্টারে শহীদ হন তপন শূর। নাট্যকর্মী প্রবীর দত্ত, পার্টি কর্মী ও কবি দ্রোনাচার্য ঘোষ, তিমির বরণ সিংহ, মুরারী মুখোপাধ্যায়, অমিয় চট্টোপাধ্যায় (সাগর) সহ সমস্ত শহীদকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করার দায় পার্টিকে নিতে হবে, যাতে তারা শহীদদের উত্তরসূরী হয়ে সংগ্রামে এগিয়ে যান।
আবারও ৭০ দশকের শাসকের আস্ফালন শোনা যাচ্ছে। এই সময়ও সারাদেশে প্রতিবাদীদের আশ্রয় হচ্ছে জেলখানায়, দানবীয় ইউএপিএ আইন দিয়ে বিনাবিচারে তিল তিল করে কারাগারে বন্দীদের হত্যা করা হচ্ছে। স্ট্যান স্বামীর হত্যাকাণ্ড, দিল্লির দাঙ্গা, ৮ আগস্ট পার্লামেন্ট স্ট্রীটে বিজেপির উদ্যোগে গণহত্যার উস্কানিমূলক প্রচার সভা প্রমাণ করে কেন্দ্রীয় শাসক দল নতুন করে বন্দীহত্যা ও গণহত্যার সলতে পাকানো শুরু করেছে। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, রুনু গুহ নিয়োগী, তারাপদ চক্রবর্ত্তী এবং সেদিনকার রাজনৈতিক দলের খুনে বাহিনীর অনেকেই মারা গেছে। তাই বলে কি সত্য উদঘাটিত হবে না? ১৯৭০-৭৫ সাল বা তার পরের সমস্ত বন্দী হত্যা ও গণহত্যার ঝাঁপি খুলতে হবে, ভবিষ্যতে গণহত্যা রোধের স্বার্থে। চিৎকার করে শাসকদের জানাতে হবে ‘আর নয় গণহত্যা’, বিচার চাই বিচার কর। কাশীপুর-বরানগর হত্যাকাণ্ডে নিহত সমস্ত শহীদ কমরেডদের জানাই লাল সেলাম।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র তিমিরবরণ সিংহ বহরমপুর জেলে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে শহীদ হন। প্রিয় ছাত্রর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষ এই কবিতাটি লেখেন।
আন্দোলন
ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়
দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ
তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
তোমার ছিন্ন শির তিমির।
নিহত ছেলের মা
আকাশ ভরে যায় ভস্মে
দেবতাদের অভিমান এইরকম
আর আমাদের বুক থেকে চরাচরব্যাপী কালো হাওয়ার উত্থান
এছাড়া
আর কোন শান্তি নেই কোন অশান্তিও না।
- নবেন্দু দাশগুপ্ত
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার : ‘কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার (১৯৭১) রহস্য কি সত্যি উদঘাটিত হবে?’ পি সি রায়)
(দিল্লীতে বিজেপি অনুগতদের এক জমায়েত থেকে মুসলিম-বিরোধী গণহত্যার ডাক দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সিপিআই(এমএল)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির দেওয়া বিবৃতিটির ভাষান্তর আমরা এখানে রাখছি।)
স্বাধীনতা দিবসের এক সপ্তাহ আগে গত ৮ মার্চ বিজেপির দিল্লীর পূর্বতন মুখপাত্র অশ্বিনী উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জাতীয় রাজধানী দিল্লীর পারলিয়ামেন্ট স্ট্রীটে ৫০০০ লোকের এক জমায়েত সংগঠিত করা হয়। ওরা ঐ অনুষ্ঠানের নাম দেয় ‘জেগে ওঠো ভারত’ এবং শ্লোগান দেয় “মুসলিমদের গণহত্যা করা হলে তারা রামের (হিন্দু দেবতা) নাম নাম নিয়ে চিৎকার করবে।” জমায়েতের সংগঠকরা একটা প্রচারপত্র বিলি করে যাতে জনগণের উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন রাখা হয় যে, তারা “ইসলামকে খতম করতে” আগ্ৰহী কি না। ঐ জমায়েতের জন্য পুলিশের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি, এ সত্ত্বেও সেদিন পুলিশ কোনো অংশগ্ৰহণকারীকেই ছত্রভঙ্গ বা গ্ৰেপ্তার করেনি। ব্যাপক প্রতিবাদ এবং সক্রিয় ব্যবস্থা গ্ৰহণের দাবি ওঠার পরই কেবল দিল্লী পুলিশ উপাধ্যায় এবং আরো চার জনকে গ্ৰেপ্তার করে। তবে, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে আইনের তুলনামূলকভাবে দুর্বল ধারাই প্রয়োগ করেছে।
“জেগে ওঠো ভারত” কর্মকাণ্ডের দুই সংগঠক প্রীত সিং ও অশ্বিনী উপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা ভারতের ‘বিদেশী’ আইনি কাঠামো বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন এবং আরো দাবি জানাচ্ছেন যে, ভারতীয় সংবিধানে “এক হাজার সংশোধনী” আনতে হবে যাতে তা “হিন্দু রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করতে পারে”। এটা কিন্তু সুস্পষ্ট রূপে ধরা পড়ে যে, “বিদেশী” আইন বলতে তাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহ, ইউএপিএ, সেনা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন আফস্পা-র মতো ঔপনিবেশিক যুগের এবং ঔপনিবেশিক শাসন অনুপ্রাণিত আইনগুলোকে বোঝাননি। তাঁরা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানকেই কলুষিত করতে চান যাতে তা হিন্দু কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়।
এই ঘটনার উল্লেখও জরুরি যে, গত ৪ জুলাই হরিয়ানা বিজেপির মুখপাত্র সুরজ পল আমু পাতৌদিতে এক জমায়েত পরিচালিত করেন যেখান থেকেও রামের নাম নিয়ে মুসলিম গণহত্যার আহ্বান জানানো হয়, এবং আমু নিজেই বলেন, “প্রয়োজন হলে গলা কেমন করে কাটতে হয় তা আমরা জানি।” আমু এখনও বিজেপির মুখপাত্র আছেন এবং কি হরিয়ানার পুলিশ কি ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কেউই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দিল্লীর ঘটনা স্পষ্টতই এমন কোনো ঘটনা ছিল না যা মাত্র একবারই ঘটেছে এবং কোনো “প্রান্তিক গোষ্ঠীও” তা ঘটায়নি। ভারতের হিন্দু কর্তৃত্ববাদী শাসক দল বিজেপিই দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যাকারী হিংসা চালানোয় প্রস্তুত করতে হিংস্র জনতাকে প্রণালীবদ্ধভাবে সংগঠিত করছে ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
গত এক বছরে জাতীয় রাজধানীতে যত মুসলিম-বিরোধী হিংসার ঘটনা ঘটেছে, তার সবকটিতেই হাত থেকেছে জাতীয় রাজধানী সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ জেলার দাসনা মন্দিরে ঘাঁটি করা এক সহিংস ও বিপজ্জনক সংগঠনের। আগস্টের ৮ তারিখে জমায়েত হওয়া জনতাও এর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। গাজিয়াবাদের দাসনার শিব শক্তি ধাম মন্দিরের ‘মহন্ত’ ইয়াতি নরসিংহানন্দ সরস্বতী জানিয়েছেন যে, সেদিনের ঘটনায় “তাঁর বহু শিষ্যই উপস্থিত ছিলেন”। রামের নামে মুসলিমদের গণহত্যা করার সমর্থনে তিনি এই যুক্তি দিয়েছেন যে, “সেদিনের ঘটনার যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল এবং যারা শ্লোগানগুলো তুলেছিল তাদের পক্ষে সেগুলো এই জন্যই ন্যায়সংগত ছিল যে, হিন্দুদের যথেষ্ট অবরুদ্ধ ক্রোধ রয়েছে।…” হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যকারীদের “সশস্ত্র প্রশিক্ষণ” দেন বলে যিনি ঘোষণা করেছেন, সেই নরসিহানন্দের কথাকে কি উত্তরপ্রদেশ সরকার কি কেন্দ্রীয় সরকার কোনো গ্ৰাহ্যই করেনি, ব্যবস্থা নেওয়াতো দূরের কথা।
ভারতের জাতীয় রাজধানীর চারপাশে প্রকাশ্য সহিংস সমাবেশের জন্য মোদী সরকারই বিশেষভাবে দায়ী। গত এক বছরে বহু বিজেপি, আরএসএস এবং এবিভিপি নেতা এবং অন্যান্য হিন্দু আধিপত্যবাদী পুরুষ ও মহিলা দিল্লী এবং জাতীয় রাজধানী অঞ্চলে প্রকাশ্যেই মুসলিম-বিরোধী হিংসায় ইন্ধন জুগিয়েছেন, কিন্তু পুলিশ বা সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র মুসলিমদের গুলি করে মারার কথা বলে মুসলিম-বিরোধী হিংসায় ইন্ধন জুগিয়েছেন; রাম ভক্ত গোপাল জামিয়া মিলিয়া ক্যাম্পাসে ছাত্রদের বিরুদ্ধে গুলি ছুঁড়েছেন; এবিভিপি নেতা কোমল শর্মা এক উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে পরিচালিত করেন যারা লোহার রড দিয়ে জেএনইউ-র ছাত্র ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে হিংস্র আক্রমণ চালায়; উত্তর-পূর্ব দিল্লীতে মুসলিম খুনে হিংস্র জনতাকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে দম্ভোক্তি করেছিলেন রাগিনী তিওয়ারি। মিশ্র, শর্মা বা তিওয়ারির বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি; নরম অভিযোগ দিয়ে গোপালকে কিছু সময় গ্ৰেপ্তার করে রাখা হয়েছিল, তারপর জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়।
প্রতিবাদকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে একাকার করে তুলে অহিংস আন্দোলনের সংগঠকদের দানবীয় আইনে জেলে পোরা হলেও মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষ বচন এবং হিংসা শাস্তি থেকে অব্যাহতি পেয়ে এসেছে এবং মোদী ও শাহর নেতৃত্বাধীন সরকারের মদতও লাভ করেছে।
বিজেপি ও আর এস এস আমাদের দেশকে “রক্ত-গঙ্গা বওয়ানো জবাইখানায়” পরিণত করতে চাইলে ভারতের জনগণ কিন্তু মুখ বুজে বসে থাকবেন না। আমরা জনগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছি – ১১ ও ১২ আগস্ট প্রতিবাদ সংগঠিত করুন এবং নিম্নলিখিত দাবিগুলো তুলে ধরুন –
১) অশ্বিনী উপাধ্যায় ও ইয়াতি নরসিংহানন্দকে এবং ঘৃণাপূর্ণ প্রচারপত্রটির জন্য যারা দায়ী তাদের গ্ৰেপ্তার করে সংশ্লিষ্ট সমস্ত আইনে অভিযুক্ত করতে হবে।
২) ৮ আগস্টের জমায়েতকে থামাতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য দিল্লী পুলিশ প্রধানকে পদত্যাগ করতে হবে।
৩) সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়ে ৮আগস্টের জমায়েতকে থামাতে ব্যর্থ হয়েছে দিল্লী পুলিশের যে অফিসাররা, তাদের চিহ্নিত করে বরখাস্ত করতে হবে।
৪) কপিল মিশ্রর ‘হিন্দু ইকোসিস্টেম’ এবং ইয়াতি নরসিংহানন্দের ‘শিব শক্তি ধাম মন্দির’ সহ দিল্লী-এনসিআর-এর হিন্দু-আধিপত্যবাদী নেটওয়ার্কগুলোর স্বরূপ উন্মোচন করে সেগুলোর বিলোপ ঘটাতে আদালতের নজরদারিতে এক তদন্ত চালাতে হবে।
১ - ৯ আগস্ট দেশব্যাপী প্রচার অভিযান
৯ আগস্ট ভারত ছাড়ো দিবসের দিনে দেশব্যাপী প্রতিবাদ বিক্ষোভ
প্রিয় সাথী
বিপর্যয় ও ধ্বংস আজ মোদী-২ জমানার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ’র সময় সরকারের অপরাধসম অবহেলার কারণে গোটা দেশ বিরাট বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। ভুক্তভোগীদের জন্য মোদী সরকার এক কানাকড়ি ক্ষতিপূরণও দিল না। শ্রমজীবী মানুষদের জীবন-জীবিকা ছারখার হয়ে গেছে। ব্যাপক মাত্রায় অনাহার, ক্রমশ মাথা তুলে দাঁড়ানো দারিদ্র ও বৈষম্য, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, চারটি শ্রমকোডের মাধ্যমে তাঁদের নিক্ষিপ্ত করা হচ্ছে দাসত্বে। চাষিদের কাছ থেকে পরিকল্পিত ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে জমি, তিনটি কৃষি আইনের মাধ্যমে ভারতের কৃষিকে বরবাদ করে দেওয়া হচ্ছে। প্রতি ইঞ্চি জমি, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলোকে বেচে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেটদের কাছে। ভিন্ন স্বর ও প্রতিটি প্রতিবাদী কণ্ঠকে রুদ্ধ করা হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহ, ইউএপিএ’র মতো দানবীয় আইন জারি করে। ঘৃণার রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ দিয়ে আরএসএস বাহিনী দেশজুড়ে আগুন লাগিয়েছে। আর এসবই হল মোদী-২ জমানার বৈশিষ্ট্য। বিপর্যয়ের দিক থেকে মোদী-২ এবং কোভিড-২ আজ সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রমাণিত হয়েছে, কোভিড-২ হল মোদী-২ পরিচালিত গণহত্যা। যখন ভারতীয় জনতা অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে, যখন নদীর জলে ভেসে বেড়াচ্ছে সার সার মৃতদেহ, ঠিক তখন মোদী সরকার বাংলা দখল করতে, কুম্ভ মেলা সংগঠিত করতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়ে। আর, দু’কান কাটা বেহায়া এই সরকার নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা পরিসীমা অতিক্রম করে সংসদে ঘোষণা করল অক্সিজেনের অভাবে একজনও মারা যায়নি। বিভিন্ন সমীক্ষা দেখাচ্ছে, কোভিডে মৃতের সংখ্যা ৪০ লক্ষেরও বেশি, যা সরকারের ৫ লাখের মিথ্যা ঘোষণাকে বে-আব্রু করে দেয়। কোভিডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে পদক্ষেপ এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হল টিকাকরণ। কিন্তু, সেটাও চলছে শম্বুকগতিতে (এখন পর্যন্ত জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশকে টিকা দেওয়া গেছে)। আর এটাই মোদীর টিকা উৎসবের প্রহসনকে উদঘাটিত করে। অতিমারীর ছোবল যখন আরও মজবুত ও নিঃশুল্ক সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার দাবি সামনে হাজির করছে তখন সরকার অতিরিক্ত মুনাফার স্বার্থে টিকাকরণকে তুলে দিচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে।
গোটা দেশ যখন অতিমারির প্রকোপে বিধ্বস্ত, তখন মোদী কর্পোরেটদের জন্য ‘সুযোগকে সুবিধায় পরিণত করতে’ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কর্পোরেট স্বার্থবাহী শ্রমকোড ও কৃষি আইনকে মোদী লাগু করেন, জরুরি পরিষেবা সহ সরকারি সংস্থা ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ করে। প্রতিবাদ ও ধর্মঘটের অধিকারকে দমন করতে প্রতিরক্ষা শিল্প ক্ষেত্রের জন্য অর্ডন্যান্স জারি করা হয়। এটা শুধু এই ক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, আগামী দিনে তা রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকারি ক্ষেত্রের কর্মীদের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হবে।
গরিব-দুঃস্থ, পরিযায়ী শ্রমিক, যারা অনাহার দারিদ্রে আজ নিক্ষিপ্ত, তাঁদের জন্য আর্থিক অনুদান, লকডাউন মজুরি ভীষণভাবে প্রয়োজন। গোটা অতিমারির পর্যায়ে বিনামূল্যে রেশন ও অত্যন্ত দরকারি। কিন্তু অর্থবহ কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বদলে নির্মম মোদী সরকার পেট্রোপণ্যের উপর মাশুল বৃদ্ধি ঘটিয়ে সার্বিক সর্বনাশ নামিয়ে আনল। এরফলে খাদ্যসামগ্রি সহ সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে পড়ল, সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। নোটবন্দীর মধ্য দিয়ে আম জনতার জীবন জীবিকাকে ধ্বংস করার যে যাত্রা শুরু হয়, কোভিড-২ ও তার অনুসারি নির্দয়, অবিবেচনা প্রসূত লকডাউন ও ধ্বংসাত্মক নীতি চরম পর্যায়ে গেছে, কর্মহীনতা সমস্ত রেকর্ড ভেঙেছে। প্রথম লকডাউনের সময় বেশির ভাগ সংস্থা বন্ধ ছিল, এবার তা চালু থাকলেও স্তব্ধ রয়েছে গণপরিবহন ব্যবস্থা। শ্রমজীবী মানুষেরা পড়েছে নিদারুণ সমস্যায়, খোয়া গেছে কোটি কোটি কাজ। যারা যারা কোনো মতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নিজ নিজ কর্মস্থলে পৌঁছাতে পেরেছেন, তাঁদের নিজের গ্যাটের থেকে খরচ করতে হয়েছে ফি মাসে ৩,০০০-৫,০০০ টাকা। আর, এরফলে সংকুচিত হয়েছে তাঁদের প্রাপ্য মজুরি। ছাঁটাই, মজুরি সংকোচন, কোনো রকম বেঁচে বর্তে থাকার মতো মজুরি, ১২ ঘন্টা কর্ম দিবস, অনিয়মিত ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, ইউনিয়ন গঠন করতে না দেওয়া, প্রতিবাদের পথে বাধা, বিশেষ করে ধর্মঘটের অধিকারের উপর নেমে আসা হামলা এখন এক সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠেছে, সমস্ত ধরনের বেআইনি পদক্ষেপেই আজ শ্রমকোড আইনি জামা পরিয়েছে। করোনা যোদ্ধা নামে সরকার যাদের গৌরবান্বিত করছে, তাঁরা আজ চরম উপেক্ষিত। মারণ কোভিডের মুখে দাঁড়িয়ে জীবন বিপন্ন করে লড়াই করলেও এই করোনা যোদ্ধাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
এখন চলছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা। এটাই মোদী-শাহ জমানায় নতুন স্বাভাবিক। এই জমানায় ভিন্ন স্বর ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে শ’য়ে শ’য়ে কর্মীকে দমনমূলক আইনে কারারুদ্ধ করা হচ্ছে। ফাদার স্ট্যান স্বামী এই মোদীরাজের দমনমূলক আইনের বলি হলেন, তাঁর মৃত্যু এই জমানায় হেফাজত হত্যা। আর এখন, গণতন্ত্রের সমস্ত শাখা-প্রশাখাকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে মোদী জমানা বিভিন্ন রাজনৈতিক বিরোধী দলের নেতা সহ সাংবাদিক, নাগরিক সহ অনেককে পেগাসাস স্পাই ওয়্যারের মাধ্যমে নজরদারি শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি ওঠার সাথে সাথে টিভি ও সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে হানা দিতে লাগলো আয়কর দপ্তর, যে সংবাদমাধ্যমগুলো কোভিড মৃত্যু ও নজরদারির ঘটনা নিয়ে শোরগোল তুলেছে।
আমরা নিদারুণ এক সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি, যখন আম জনতার রুটি-রুজি, গণতন্ত্র, সংবিধানকে মোদী-শাহ দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে শ্রমিক শ্রেণী, সাধারণ মানুষের সামনে এই জমানা-সৃষ্ট বিপদটা সবচেয়ে মারাত্মক — আগে যা কখনও সামনে আসেনি। কিন্তু, মানুষ হাল ছেড়ে দেয়নি। মোদীর কর্পোরেটরাজের বিরুদ্ধে মেহনতী জনতা আজ সম্মুখ সমরে। শ্রমজীবী মানুষের সমস্ত স্তর ও অংশ এই জমানার ধ্বংসাত্মক নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রতিরোধের রাস্তা বেছে নিয়েছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে নজর কাড়া প্রতিরোধ হল দীর্ঘ আট মাস ধরে চলমান দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কৃষক আন্দোলন। এখন সময় এসেছে, মোদীর কোম্পানিরাজকে উৎখাত করতে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্যের মজবুত ভিত্তির উপরে নির্ণায়ক লড়াই গড়ে তোলা।
ঐতিহাসিক ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ব্রিটিশ বিরোধী সুমহান ঐতিহ্যকে সামনে রেখে, আসুন, আমরা সেই সংগ্রামী পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মোদী-শাহ জমানার বিরুদ্ধে গড়ে তুলি দুর্বার আন্দোলন।
দাবি সনদ
কৃষি ও কৃষক বিরোধী কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইনের বিরোধিতায়, দিল্লীতে আন্দোলনকারী কৃষকদের যৌথ মঞ্চ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ও অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির ডাকে দেশজুড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হল। বিভিন্ন রাজ্যের ব্লকে ও গ্রামে সরকারি দপ্তরের সামনে দেশের হাজার হাজার জায়গায় স্থানীয় কৃষক, মজদুর ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে মোদী সরকারের কৃষি বিরোধী ও জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। আওয়াজ ওঠে “কৃষি আইন বাতিল করো, কর্পোরেট কোম্পানিগুলো ভারত ছাড়ো”। পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন জেলার ব্লকে ব্লকে একইভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। রাজ্যের বিভিন্ন কৃষক সংগঠন, মজদুর সংগঠন, বিভিন্ন গণসংগঠন ও মহিলা সংগঠন এইসব বিক্ষোভ সমাবেশে যোগদান করে।
এই উপলক্ষে আজ ৯ আগস্ট কলকাতার মৌলালীর মোড়ে এআইকেএসএসসি পশ্চিমবঙ্গ শাখার পরিচালনায় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। রাজ্যের বিভিন্ন কৃষক সংগঠন তাদের সদস্য সমর্থক সহ এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যোগ দেন। এছাড়াও বহু সামাজিক সংগঠন, গণসংগঠন, ছাত্র সংগঠন, কবি, লেখক, শিল্পী, নাট্যকর্মী স্বতস্ফূর্তভাবে এই কর্মসূচিতে যোগদান করে তাদের সংহতি জানিয়ে যান। বিভিন্ন মহিলা সংগঠন ও তাদের সদস্য সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এআইকেএসসিসি’র সঞ্জয় পুততুণ্ড, কার্তিক পাল, সমীর পুততুন্ড, অভীক সাহা, সুশান্ত ঝা, দিলীপ পাল, ফরিদ মোল্লা, দাউদ গাজী, প্রভাত মজুমদার, মিহির পাল ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। মহিলা সংগঠনের তরফ থেকে বক্তব্য রাখেন ইন্দ্রাণী দত্ত, শিখা সেন, তপতী চ্যাটার্জি, ডঃ রত্না পাল, ভাস্বতী ঘোষ ও অন্যান্য নেত্রীরা। শ্রমিক সংগঠনদের তরফ থেকে বক্তব্য রাখেন হারান বিশ্বাস, বাসুদেব বসু ও দেবাঞ্জন চক্রবর্তী।
- সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি (এআইকেএসসিসি)
পশ্চিমবঙ্গ শাখার অন্তর্ভুক্ত ২১টি কৃষক সংগঠনের পক্ষে,
অমল হালদার এবং কার্তিক পাল
কর্পোরেট ভারত ছাড়ো! দেশী বিদেশী কর্পোরেটদের এজেন্ট মোদী সরকার গদি ছাড়ো! কোম্পানি রাজ হঠাও! কৃষি বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও, দেশ বাঁচাও! ৯ আগস্ট এইসব শ্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে এই রাজ্যের সমস্ত জেলা সদর। মিছিল-বিক্ষোভ-প্রতিবাদী সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ৯ আগস্ট পালিত হল ‘ভারত ছাড়ো দিবস’। ১৯৪২’র আহ্বানের ৭৯ বছর পর যেন ইতিহাসের পাতা থেকে মূর্ত হয়ে উঠে এলো আজকের বাস্তবতায়। আজও সেই বণিকের মানদন্ড দেখা দিচ্ছে রাজদন্ড রূপে। সেদিন ছিল ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন আর আজ আম্বানি-আদানিদের মুনাফার গ্রাসে দেশের কৃষি শিল্প সমস্ত কিছুই বিপন্ন। তাই দিল্লীর যন্তর-মন্তরে আয়োজিত কৃষক সংসদ থেকে শুরু করে এরাজ্যের পথে প্রান্তরে আওয়াজ উঠছে — এসো গড়ে তুলি ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।
বর্তমান সময়কালে অত্যন্ত সংকটের মধ্যে রয়েছে গ্রামবাংলা। একদিকে অতিবৃষ্টি-বন্যা পরিস্থিতি, অপর দিকে চাষের মরসুমে তুমুল কর্মব্যস্ত কৃষক সমাজ। এসব সত্বেও তাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির আহ্বানে এবং কিষাণ মহাসভা ও অন্যান্য বামপন্থী কৃষক সংগঠনের আয়োজনে জেলায় বা ব্লকের নানাবিধ বিক্ষোভ কর্মসূচিগুলিতে। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি থেকে শুরু করে বন্যা বিধ্বস্ত দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে যে প্রধান বার্তা উঠে এলো, কৃষকের রক্ত জল করা শ্রমে উৎপাদিত ফসল নিয়ে মুনাফাখোরী, কালোবাজারি, মজুতদারীর স্বার্থে তৈরি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে দেশব্যাপী প্রতিরোধ। কেবল দিল্লীর বুকেই নয়, সমস্ত রাজ্যেই কৃষকরা দৃঢ়পণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, কিছুতেই নয়া কৃষি আইন চালু করতে দেওয়া হবে না। আট মাস হয়ে গেল লক্ষাধিক কৃষক দিল্লীর বর্ডারগুলির সড়ক দখল করে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, তোমরা চুক্তিচাষের আইন করে আমাদের কৃষি জমি দখল করতে চাইছো? এর পাল্টা আমরা তোমাদের রাজধানীর ঝাঁ চকচকে ছয় লেনের সড়ক দখল করে বসে থাকব। প্রয়োজনে ২০২৪ সালে লোকসভা ভোট পর্যন্ত থাকব। ভগৎ সিং-এর সেই গান যেন আজও কিষাণের সংগ্রামের প্রত্যয় তুলে ধরেছে “দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজু কাতিল মে হ্যায়” আমরাও দেখে নেবো। সরকারের এতো অনমনীয়তা কেন? অন্নদাতাদের জীবন রক্ষার দায় সরকার নেবেনা কেন? মজুতদারীকে বৈধ করে জনজীবনে চাপিয়ে দেওয়া এই অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি কেন?
অতিমারী লকডাউনের এই সময়ে সবকিছুই বন্ধ হয়ে যেতে পারে, দেশের কৃষি কিন্তু থেমে নেই! কৃষি উৎপাদন কিছুটা পরিমাণে হলেও বেড়েছে — এই তথ্য তুলে ধরে মোদী সরকার এর কৃতিত্ব দাবি করছে। কিন্তু না, এর কৃতিত্ব দেশের কৃষক সমাজের। সরকার উল্টে চাষির ফসলের সরকারি ক্রয় বন্ধ করে দিয়ে, ডিজেল সার সহ কৃষি উপকরণের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি করে কৃষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তাঁদের ঠেলে দিয়েছে চরম লোকসানের পথে। আর এখন কৃষক দরদী সাজার জন্য পিএম কিষাণের নামে যৎসামান্য খয়রাতি সাহায্য দিচ্ছে। সরকারপক্ষ কৃষক প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার সময় ‘দেওয়া কথা’ রাখেনি। বিদ্যুৎ বিল সংশোধনী ২০২০ লোকসভায় পেশ করেছে। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে দেশী-বিদেশী কর্পোরেটদের মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত করে আগামীদিনে কৃষি সহ সর্বক্ষেত্রে বিপুল মাত্রায় মাশুল বৃদ্ধির পথ সুগম করে দিচ্ছে। বিএসএনএল বনাম জিও টেলিকমের মতো বিদ্যুৎ ক্ষেত্রেও সেই একই কিসসার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইছে।
প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্তের নানান স্তরের কৃষক ও মেহনতি মানুষ দিল্লীর আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। কেবল সংহতিই নয়, একে নিজের আন্দোলন বলে অনুভব করেই তারা পথে নামছেন। যেমন পশ্চিমবাংলার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এখানে ক্ষুদ্র কৃষি অর্থনীতিতে কৃষি উৎপাদন প্রধাণত ভোগের জন্য ব্যয়িত হলেও বেশ কিছু অংশ বাজারে যায়, বিশেষত অর্থকরী ফসলের চাষ উত্তরোত্তর বাড়ছে। এরাজ্যের চাষিরা পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতো মান্ডিতে বিক্রি করতে পারে না, ফলে অভাবী বিক্রির সংকট তাঁরা দুর্বিষহ বোঝার মতো টের পায়। আলু, ধান, পাটচাষিরা দেখছেন তারা যে দামে ফসল বিক্রি করেন তার চার থেকে ছয় গুণ দামে ব্যবসায়ীরা সেটা বাজারে বিক্রি করে। এভাবে ছোট মাঝারি ফাটকা ব্যবসায়ীরা মুনাফার কারবার করে চলেছে। আগামীদিনে বড় বড় কর্পোরেট হাঙ্গর কুমীর বা রাঘব বোয়ালরা ফসল কেনার একচেটিয়া লাইসেন্স পেলে তার কুফল কি হতে পারে তা ভাবতে গেলে ঘুম ছুটে যায়। যেমন, এবার পাট গোড়ার দিকে ওঠার সময় বাজার দর ছিল ৮ হাজার টাকা কুইন্টাল। আর এখন যখন ব্যাপক পরিমাণে পাট উঠছে তখন দাম নেমে এলো ৫ হাজার টাকায়! ক্রমশ কমছে। চাষির মাথায় হাত, বিপুল লোকসান! অথচ কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের পাট কেনার বা চাষির স্বার্থে তাঁর দাম ধরে রাখার কোন ব্যবস্থাপনাই নেই। পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছে ফাটকা ব্যবসায়ীরা! অপরদিকে সার বীজ ডিজেলের বিপুল মূল্যবৃদ্ধি চাষিদেরও চরম সংকটে ফেলে দিয়েছে। এছাড়া কৃষি আইন অনুযায়ী সরকার ফসল না কিনলে আগামীতে ওরা সরবরাহ বা গণবন্টণ ব্যবস্থাটাই ধাপে ধাপে তুলে দেবে। আধার সংযোগের নামে গরিবদের বাদ দেওয়া হচ্ছে, নগদ ভর্তুকির নামে অদুর ভবিষ্যতে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকির মতো সেই ভর্তুকি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবে। ১০০ দিনের প্রকল্পে জাতিগত শংসাপত্র চালু করে, বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে গরিবদের কাজের ছিটেফোঁটা যতটুকু সুযোগ আছে তাও কেড়ে নেবে। এরাজ্যের তৃণমূল সরকারও ফসলের সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছে। গ্রীষ্মে ধান সরকার কিনলোই না। কেন্দ্রের মতো সেই একই কায়দায় তারাও কিছু প্রকল্প চালু করেছে। কিন্তু তাতে গরিবদের বঞ্চিত করা, দুর্নীতি দলবাজি কায়েম করছে। এই বিষয়গুলি তুলে ধরে কিষাণ ও কৃষিমজুর সংগঠনের নেতৃবৃন্দ কর্মসূচিগুলিতে বক্তব্য রাখেন।
বাঁকুড়া জেলায় যৌথভাবে বামপন্থী কিষাণ ও শ্রমিক সংগঠনগুলির এক দৃপ্ত মিছিল শহর পরিক্রমা করে জেলা শাসকের দপ্তরে আসে, ডেপুটেশন দেয়। বক্তব্য রাখেন আয়ারলা’র বাবলু ব্যানার্জী। ডেপুটেশনে ছিলেন এআইকেএম-এর বৈদ্যনাথ চিনা। মূল দাবিগুলির পাশাপাশি জেলায় নদী থেকে বৈধ ভাবে বালি তোলা বন্ধ করার বিরুদ্ধে, জেলায় সিমেন্ট কারখানা চালু করা, আদিবাসীদের বাস্তু জমির পাট্টা দেওয়া প্রভৃতি দাবিও তুলে ধরা হয়। বর্ধমান জেলায় কালনার বৈদ্যপুরে ১০০ দিনের কাজের দাবিতে, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে হস্তক্ষেপ ও জনগণের অংশগ্রহণ ঘটানোর মধ্য দিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন চলছে, সেখানে মিছিল ও প্রতিবাদসভা হয়। নেতৃত্ব দেন সফিকুল রহমান। পূর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া, ১নং ব্লকের ইসলামপুর ও মেমারী ২নং ব্লকের নিমোতে অনুরূপ কর্মসূচি হয়। নেতৃত্বে ছিলেন আয়ারলা’র সজল পাল, আনসারুল আমান মন্ডল, এআইকেএমের সলিল দত্ত, অশোক চৌধুরী, সমীর বসাক, জিয়াদুল সেখ, কুনাল বক্সী, সাধন কর্মকার প্রমুখ। জলপাইগুড়ি শহরে কদমতলা মোড়ে এক যৌথ প্রতিবাদসভা সংগঠিত হয়, ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সভা শেষে তিনটি কৃষি আইনের প্রতিলিপি জ্বালানো হয়। নেতৃত্বে ছিলেন এআইকেএমের ভাস্কর দত্ত, আয়ারলা’র শ্যামল ভৌমিক। মেদিনীপুর শহরে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে বাম সংগঠনগুলি প্রতিবাদসভা করে, তারপরে মানববন্ধন করে, তাতে অংশগ্রহণ করেন আয়ারলার শৈলেন মাইতি, রাজু দাস। হাওড়া জেলার বাঙালপুরে বিক্ষোভসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন দিলীপ দে, নবীন সামন্ত, সনাতন মনি। নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর কালেকটরি মোড়ে এক যৌথ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। বামপন্থী কৃষক ও কৃষিমজুর সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে আয়োজিত এই যৌথ অবস্থানে বিভিন্ন শ্রমিক ও কৃষক নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। অসংগঠিত ক্ষেত্র ও পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের ব্যাপক সংখ্যক গরিব মানুষ অংশগ্রহণ করেন। শহরের নাগরিকরাও ভালো সংখ্যায় উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য রাখেন এআইসিসিটিইউ’র জীবন কবিরাজ এবং এআইকেএমের পক্ষে এই প্রতিবেদক।
- জয়তু দেশমুখ
৯ আগস্ট ঐতিহাসিক ‘ভারত ছাড়ো’ দিবসে বিভিন্ন গণসংগঠনের পক্ষ থেকে ‘কোম্পানিরাজ নিপাত যাক’, ‘ফ্যাসিস্ট মোদীরাজ নিপাত যাক’ আওয়াজ তুলে আগস্ট ক্রান্তি দিবসের দুই বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী হাজরা ও অরুণা আসফ আলি নামাঙ্কিত মঞ্চে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয় হুগলির পান্ডুয়ায়।
এই দিনটি আদিবাসী দিবসও, তাই কর্মসূচির একটি পর্বে আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ জল জঙ্গল জমি থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ রদ, ‘হাসা ভাষা লায় লাকচার’, লোকশিল্প ভাতা নিয়ে বঞ্চনার অবসান ইত্যাদি দাবিগুলি নিজস্ব ভাষায় তুলে ধরেন। আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক পাগান মুর্মুর তোলা স্লোগানে গলা মেলান অবস্থান মঞ্চে উপস্থিত দাবি সম্বলিত পোস্টার হাতে আদিবাসী মহিলারা। কৃষি আইন বাতিল করার দৃঢ় পণ, কৃষক সংগ্রামকে সংহতি জানিয়ে এবং তার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের নির্দিষ্ট দাবি আলু ধান সহ ফসলের ন্যায্য দাম প্রদানে রাজ্য সরকারকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলা হয়। ক্ষুদ্রঋণে জর্জরিত গরিব মহিলাদের দুঃখ এবং ক্রোধ ও লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেন ঋণমুক্তি কমিটির রুমা আহেরি। ক্ষেতমজুর ঘরের মেয়ে শ্রাবণী মালিক জোরালো ভাষায় রেশন কার্ডে আধার সংযুক্তি নিয়ে গরিব মানুষদের হয়রানির বিরুদ্ধে ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। আবাস যোজনা, কোভিড টিকাকরণে দুর্নীতি, শিক্ষক পদে চাকুরী প্রার্থীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর পুলিশি হামলা প্রভৃতিতে রাজ্য সরকারের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করা হয়।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এই ঐতিহাসিক দিনে নতুন করে কোম্পানিরাজ প্রতিষ্ঠা করার বিজেপির চক্রান্ত, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলোতে কর্পোরেটদের অনুপ্রবেশ ঘটানো এবং শ্রমকোডের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ। বক্তব্য রাখেন সজল অধিকারী (আয়ারলা রাজ্য সম্পাদক), গোপাল রায়, প্রগতিশীল মহিলা সমিতির চৈতালি সেন ও অর্পিতা রায়, বিপ্লবী যুব সমিতির সজল দে, আইসার সৌরভ, এআইসিসিটিইউ জেলা সম্পাদক বটকৃষ্ণ দাস, প্রদীপ সরকার, ভিয়েত ব্যানার্জি, মানবাধিকার কর্মী স্বপন মাতব্বর, এআইকেএম নেতা শুভাশিস চ্যাটার্জি। আবৃত্তি পরিবেশন করেন দীপনিকা সাহা ও তুষার বসু, সঙ্গীত পরিবেশন করেন বালির সংযোগ সাংস্কৃতিক দল, কর্মসূচি সঞ্চালনা করেন এআইকেএম জেলা সম্পাদক মুকুল কুমার। দীর্ঘ প্রায় ছ’ঘন্টা ধরে চলা এই অবস্থানে আদ্র এবং উষ্ণ আবহাওয়া উপস্থিত সাথীদের সংগ্রামী মেজাজকে টলাতে পারেনি, অবস্থান মঞ্চের অদূরে অবস্থিত নমাজগ্রামের মিড-ডে-মিলের মহিলা কর্মীরা দল বেঁধে অবস্থানে যোগদান করেন, জিটি রোডের পথ চলতি মানুষ এবং অন্যান্য বেশ কিছু অন্য বামপন্থী সংগঠনের কর্মীরাও উৎসাহের সাথে বক্তব্য শোনেন।
শ্লোগান
রান্নাঘরের উত্তাপ দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে রান্নার গ্যাসের দাম! গত ছ’মাসে গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বেড়েছে ১৪০ টাকা! অথচ লকডাউনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতি নিম্নবিত্ত মানুষের আয় কমে গেছে! যারা বিনা পারিশ্রমিকে সকলের মুখে খাবার তুলে দেন সেই মহিলারা প্রতিবাদে পথে নামছেন। পেট্রোল ডিজেল সহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির উদ্যোগে ধুবুলিয়া নেতাজী পার্কে সংগঠিত হল এক প্রতিবাদ সভা। স্থানীয় মহিলা কর্মীরা ছাড়াও সভায় অংশগ্রহণ করেন বিড়ি শ্রমিক মহিলারা। বিগত দু’বছরে যাদের মজুরি একটাকাও বাড়েনি, ছিটেফোঁটা সরকারি প্রকল্প যতটুকু ছিল সমস্ত কিছুই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অসংগঠিতক্ষেত্রের শ্রমজীবী মহিলাদের ন্যায্য মজুরি, কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করা প্রভৃতি দাবিতে সভা সোচ্চার হয়ে ওঠে। মহিলাদের উপর পুরুষতান্ত্রিক হামলার বিরুদ্ধে সভা থেকে তীব্র ধিক্কার জানানো হয়। সম্প্রতি ভারতীয় মহিলা হকি টিমের একজন খেলোয়াড়ের উপর জাতিবিদ্বেষী হামলার নিন্দা জানিয়ে এই অপকর্মে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলে ধরা হয়।
সভায় বক্তব্য রাখেন এ্যাপোয়ার রাজ্য নেত্রী ইন্দ্রাণী দত্ত, আরওয়াইএ’র সন্তু ভট্টাচার্য, এআইকেএম’র কৃষ্ণ প্রামানিক, সিপিআই(এমএল) জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ। সঞ্চালনা করেন ধুবুলিয়া ব্লকের এ্যাপোয়া নেত্রী বেলা নন্দী।
গত ৭ আগস্ট সাতটি নারীবাদী ও মহিলা অধিকার রক্ষার সংগঠন রাজ্যের সংশোধনাগার বিভাগের এডিজি ও আইজি’র উদ্দেশ্যে যৌথভাবে ডেপুটেশন দিতে যায়। প্রসঙ্গত প্রেক্ষাপট হিসাবে উল্লেখ করা হয়, ফাদার স্ট্যান স্বামীর হেফাজতে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে ধিক্কার ওঠার সাথে সাথে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে তোলপার হচ্ছে। সংগঠনগুলির আরও বক্তব্য হল, এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সহ ১০ জন বিরোধী দলনেতা রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখে স্ট্যান স্বামী হত্যার ঘটনা এক ক্ষমাহীন অপরাধ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা সঠিকভাবেই ইউএপিএ’কে ‘দমন আইন’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এই স্পিরিট লক্ষ্য করে নারীবাদী ও মানবাধিকার রক্ষার সংগঠনগুলি পশ্চিমবাংলার সংশোধনাগারগুলিতে বহুবছর যাবত থাকা নারী রাজনৈতিক বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তির বিষয় খতিয়ে দেখতে তৎপর হয়েছে। তারা প্রাথমিক খোঁজ করে জেনেছেন, অন্তত এরকম ৬ জন মহিলা রাজনৈতিক কর্মী গত ১০-১২ বছর যাবত আলিপুর, বহরমপুর ও দমদম সংশোধনাগারে বন্দী হয়ে রয়েছেন। এঁদের যা বন্দীদশার মেয়াদ, তাতে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট শাস্তি ভোগ করা হয়েছে। এঁদের স্বাস্থ্য রক্ষা, শিক্ষা পাওয়া, পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ইত্যাদি মৌলিক অধিকার সহ আরও অন্যান্য অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়। রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে স্বীকার করা উচিত, কিন্তু সেটা করা হয়না, সেইমতো মর্যাদা দেওয়া হয় না।
নারীবাদী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলি কারা-সম্পর্কিত এডিজির কাছেই দাবিগুচ্ছের স্মারকলিপি দিতে চেয়েছিল। তিনি না থাকায় এক স্পেশ্যাল আইজি ইমরাম ওয়াহাবের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর কাছে দাবি জানানো হয় বন্দী রাজনৈতিক মহিলাদের সঙ্গে দেখা করতে দিতে হবে। না দিলে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন গণ্য হয়। স্পেশ্যাল আইজি বলেন, বন্দীদের পরিবার পরিজন ও বন্ধুরা যাতে ব্যক্তিগতভাবে দেখাসাক্ষাৎ করতে পারেন সেটা তিনি দেখবেন। ডেপুটেশন প্রতিনিধিদল বলে আসে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা দাবিগুচ্ছ বিবেচনা হওয়ার বিষয়টা তাদের দ্রুত জানাতে হবে। রাজনৈতিক বন্দী মহিলারা বছরের পর বছর দীর্ঘকাল কারান্তরালে, সরকার তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগ এখনও প্রমাণ করে উঠতে পারছে না, এটা আমাদের ‘গণতন্ত্রে’র কলঙ্ক। ওই বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি চাই, সেটা যতদিন না হচ্ছে ততদিন তারা যাতে মৌলিক মানবাধিকারের সুযোগ-সুবিধা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
এই উদ্যোগে একজোট হয়েছে এআইপিডব্লিউএ, ফেমিনিস্ট ইন রেজিস্ট্যান্স, কমিটি ফর দি রিলিজ অফ পলিটিক্যাল প্রিজনার্স, ফেমিনিস্ট ডট কম, দশ থেকে দশ হাজার, শ্রমজীবী মহিলা সমিতি, উওমেন এগেইনস্ট সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স এ্যান্ড স্টেট রিপ্রেশন।
৯ আগস্ট ঐতিহাসিক ভারতছাড়ো আন্দোলনের সূচনার দিনে, বিশ্ব আদিবাসী দিবসে ও আইসার ৩২তম প্রতিষ্ঠা দিবসে আইসা হাওড়া জেলা কমিটি ও এআইসিসিটিইউ বালি-বেলুড় ইউনিটের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হল ‘স্বেচ্ছা রক্তদান শিবির’ বালি শ্রমজীবী পাঠশালায়। সদ্য প্রয়াত শ্রমিক নেতা কমরেড রাজেন্দ্র গুপ্তার স্মৃতিতে উৎসর্গীকৃত এই রক্তদান শিবিরের সূচনা হয় শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মাধ্যমে। উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ নেতা বাসুদেব বসু, বর্ষীয়ান সিপিআই(এমএল) নেতা কল্যাণ গোস্বামী সহ জেলা ও স্থানীয় নেতৃত্ব ।
সফলভাবে এই শিবিরটি আয়োজন করতে সার্বিকভাবে সহায়তা করেছে বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতাল ব্ল্যাডব্যাঙ্ক।
‘পৃথিবীর মহত্তম প্রদর্শনী’ অলিম্পিক্সের সমাপ্তি ঘটল। অলিম্পিক্সের আসরে এতদিনের মধ্যে ভারতের ফল ‘সবচেয়ে ভালো’ হওয়া এবং অ্যাথলেটিক্সে একটা স্বর্ণপদক পাওয়াকে কেন্দ্র করে শাসক প্রতিষ্ঠান থেকে জাতীতাবাদের হাওয়া বওয়ানোর চেষ্টা হল। অলিম্পিক্স ক্রীড়ায় সাতটা পদক লাভ (২০১২ লণ্ডন অলিম্পিক্সে প্রাপ্ত পদকের সংখ্যা ছিল ৬) ১৪০ কোটি জনসংখ্যার সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ তা অবশ্যই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। ভারতের ক্রীড়া পরিকাঠামো অত্যন্ত দুর্বল, খেলাধুলাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে এক প্রাণোচ্ছল ক্রীড়া সংস্কৃতি বিকাশের উদ্যোগ শাসকদের অগ্ৰাধিকারে পড়ে না। সোনার ডিম পাড়া ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলাধুলায়, কি শাসকদের কি স্পনসরদের হাতকে তেমন প্রসারিত হতে দেখা যায়না। এবারের বাজেটে নরেন্দ্র মোদী সরকারের ক্রীড়াক্ষেত্রে বরাদ্দকে ২৩০.৭৮ কোটি টাকা হ্রাস করাটা কখনই খেলাধুলায় প্রেরণা সঞ্চারের পরিচায়ক নয়। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা যেটুকু সাফল্য অর্জন করেছেন তা অবশ্যই গৌরবের এবং অভিনন্দন যোগ্য। কিন্তু শাসক দলের মন্ত্রী ও নেতারা নিজেদের শুধু ক্রীড়াবিদদের কৃতিত্বের অংশিদার করে তুলতেই আসরে নামছেন না, তাঁদের মার্কামারা যে জাতীয়তাবাদ তাকেও উস্কিয়ে তুলতে সক্রিয় হচ্ছেন। আসামের পদকজয়ী মেয়ে লাভলিনা বরগোহাঁইয়ের সাফল্যকে অভিনন্দিত করতে পোস্টার ছাপানো হল, আর তাতে শুধু বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার ছবি, পোস্টারে লাভলিনার নামটুকু ছাড়া ছবির কোন চিহ্নই নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রতিটা পদক প্রাপ্তিতে সোৎসাহে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে গেছেন এবং নিজের ছবি সহ সেই অভিনন্দন বার্তাকে প্রচারের বস্তু করে তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাপানের অলিম্পিক্স আয়োজকদের ধন্যবাদ দিতে গিয়ে বলেছেন, “ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ভালোভাবে সংগঠিত করার জন্য জাপানের সরকার ও জাপানের জনগণ, বিশেষভাবে টোকিওর জনগণকে বিশেষ ধন্যবাদ।... এটা আরও দেখিয়ে দিয়েছে যে খেলাধুলা কিভাবে ঐক্যের এক মহান সংগঠক হয়ে ওঠে।” ক্রীড়ার ঐক্যকারী ভূমিকাকে মোদী কি সত্যিই অন্তরে লালন করেন? ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্যকে ধরে নিজেদের বিভেদ ও বিদ্বেষের মতাদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসী কি তিনি হননি?
ভারতের পুরুষ হকিদল প্রবল পরাক্রম দেখিয়ে জার্মানিকে ৪-৩ গোলে পরাজিত করে ব্রোঞ্জ পদক জয় করে ৫ আগস্ট। তাঁদের বিভেদের পঞ্জিতে ৫ আগস্ট যে বিশেষ স্থান নিয়ে আছে সে কথা মোদী ভুলতে পারলেন না। তিনি বললেন, “এরমধ্যে দিয়ে ৫ আগস্ট বিশিষ্ট, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই দিনটা বছর-বছর ধরে ইতিহাসে স্থান করে নেবে।” কিন্তু কেন? এই দিনটাতেই ২০১৯ সালে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিলোপ ঘটানো হয়েছিল, রাজ্যের মর্যাদা হরণ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে দুটো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছিল। কাশ্মীরকে পরিণত করা হয়েছিল এক বৃহৎ কারাগারে, বন্দী করা হয়েছিল কাশ্মীরের নেতৃবৃন্দ ও বহুসংখ্যক মানুষকে, যাঁরা কারারুদ্ধ হয়নি তাঁরাও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হন। এই পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতা বোধ তীব্রতর হয়ে ওঠে। আর তাই ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্য, নীরজ চোপড়ার স্বর্ণপদক প্রাপ্তিও কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে একটুও আলোড়ন তুলতে পারেনি। পুরুষ হকি দলের ব্রোঞ্জ প্রাপ্তির দিন কাশ্মীরে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়, দোকানপাট বন্ধ থাকে। আবার ২০২০ সালের ৫ আগস্ট তিনি অযোধ্যায় বাবরি মন্দির ধ্বংস-স্থলে রামমন্দির তৈরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, “৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ রদের ফলে সাত দশক পরে জম্মু-কাশ্মীরের প্রত্যেক বাসিন্দা সব অধিকার ও সুবিধা ভোগ করার অধিকার পেয়েছিলেন। আবার গত বছরের ৫ আগস্ট রাম মন্দির তৈরির পথে প্রথম পদক্ষেপ করেছিলেন কোটি-কোটি দেশবাসী। আবার ৫ আগস্টেই দেশের তরুণ প্রজন্ম হকিতে গর্বের স্থান ফিরিয়ে আনার পথে বড় পদক্ষেপ করেছে।” এছাড়া, মহিলা হকি দল ব্রোঞ্জ পদক জয়ে সফল না হলেও যে পরাক্রমের নজির স্থাপন করে, নরেন্দ্র মোদী তারমধ্যে ‘নতুন ভারতের উদ্দীপনা’ খুঁজে পেয়েছেন। মোদীদের ‘নতুন ভারত’ বিজেপি ও আরএসএস-এর উত্থানকেই নির্দেশিত করে। নরেন্দ্র মোদী কখনই বিভেদের এজেণ্ডাকে, সংখ্যাগুরুবাদী মনোবৃত্তিকে দূরে রাখতে পারেন না। কাশ্মীরকে বৃহত্তর কারাগারে পরিণত করার ও কাশ্মীরের জনগণকে অধিকারচ্যুত করার এবং রাম মন্দির নির্মাণের সংখ্যাগুরুবাদী এজেণ্ডাকে ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্যের সঙ্গে একাকার করে তোলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারলেন না নরেন্দ্র মোদী। ভারতীয় রাজনীতিকে নির্দিষ্ট অভিমুখে চালিত করতে কাশ্মীরকে যেভাবে কাজে লাগানো হয়, সংখ্যাগুরু ভোটকে নিজেদের পক্ষে টানতে কাশ্মীরকে যেভাবে তুরুপের তাস করা হয়, অলিম্পিক্সে ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্যকেও সেই লক্ষ্যে ব্যবহার করতে সক্রিয় হলেন নরেন্দ্র মোদী।
মহিলা হকি দল কোনো পদক জিততে না পারলেও কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি ফাইনাল এবং ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে তাদের লড়াই ক্রীড়ামোদীদের এবং বিশেষজ্ঞ মহলের সম্ভ্রম কুড়িয়েছে। কিন্তু জাতপাতের কারবারিরা, ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শের অনুচররা মেয়েদের এই লড়াইকে কোন চোখে দেখেছেন? আর্জেন্টিনার কাছে ৪ আগস্ট ভরতীয় দল সেমিফাইনালে ১-২ গোলে পরাজিত হওয়ার পর উচ্চবর্ণের কিছু মানুষ হরিদ্বারে মহিলা হকি দলের সদস্য বন্দনা কাটারিয়ার বাড়ির কাছে গিয়ে হুল্লোড় করতে থাকে। বন্দনার অপরাধ — তারা দলিত। বন্দনার পারদর্শিতা নয়, দেশের জন্য তার প্রাণপণ লড়াইয়ের নজির নয়, তার জাত পরিচয়ই এদের কাছে একমাত্র বিবেচনার বিষয় হয়ে ওঠে। বন্দনার বাড়ির কাছে তারা বাজি ফাটিয়ে নৃত্য করতে থাকে। তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে এই শব্দগুলো, “তোরা ভারতীয় দলে ঢুকেছিস বলেই ভারত হেরেছে। তোদের খুন করে ফেলা উচিত।” ওদের কাছে ভারতীয় দলের পরাজয়ের জন্য বাকি খেলোয়াড়রা দায়ী নয়, দায়ী দলের একমাত্র দলিত সদস্য! ভারতীয় দলের পরাজয়ের জন্যই যেন ওরা অপেক্ষা করছিল আর হার হতেই ওরা দলিত-বিরোধী ঘৃণা ও তর্জনগর্জনকে উগরে দিতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে ৪-৩ গোলে জয়ে বন্দনার হ্যাট্রিক (যে কৃতিত্ব মহিলা হকি দলের অন্য কোনো সদস্যের নেই), ব্রোঞ্জ ম্যাচে প্রবল লড়াই ও একটা গোল — এগুলোর কোনোটাই ঐ বর্ণবাদী মাতব্বররা সমাদরের বিষয় বলে মনে করতে পারেনি। দলিত হয়ে বন্দনা কেন ভারতীয় দলে জায়গা পেল, দেশ-বিদেশের কোটি-কোটি মানুষ কেন একটা দলিত মেয়ের লড়াইকে চাক্ষুষ করতে থাকল — এইভাবেই ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের কৃতিত্বকে ছাপিয়ে দলিত-বিরোধী বিদ্বেষেই জাতপাতবাদীরা নিজেদের নিমজ্জিত রাখে। বন্দনার বাড়ির কাছে সেদিনের উপদ্রবের পর বন্দনার ভাই চন্দ্রশেখর বলেন, “ভারতীয় দল হেরে যাওয়ায় আমরা সবাই যখন মর্মাহত, তারা তখন বাজি ফাটিয়ে উল্লাস করছে — এতেই আমরা বিস্মিত।” নরেন্দ্র মোদী জমানায় দলিত দমনে উদ্যত বর্ণবাদীরা যে অনেক উৎসাহিত ও স্পর্ধিত হয়েছে, সে কথা কি বন্দনাদের নতুন করে জানতে হবে?
ক্রীড়াবিদদের সাফল্য বর্তমান শাসকদের ঐক্য গড়ার পথে প্রণোদিত করবে বলে কেউ যদি মনে করে থাকেন, তার চেয়ে ভ্রান্তিজনক আর কিছু হতে পারে না। অলিম্পিক্সের আয়োজনকে ‘ঐক্যকারী’ বলে অভিহিত করে নরেন্দ্র মোদী আরএসএস-এর এজেণ্ডার মহিমাকীর্তনে নেমেছেন। নরেন্দ্র মোদীদের জাতপাতবাদী অনুচররা অলিম্পিক্স ক্রীড়াকে দলিত-বিরোধী বিদ্বেষ উদগিরণের এক উপলক্ষ করে তুলেছেন। ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্যকে ধরে বিভেদ ও বিভাজনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সংখ্যাগুরুবাদী জাতীয়তাবাদে উগ্ৰতার এক প্রলেপ দিতেই উন্মুখ হয়েছেন নরেন্দ্র মোদীরা।
- জয়দীপ মিত্র
(৩০ জুলাই ২০২১ হুল দিবসে একুশের ডাক গণকনভেনশনে ইতিহাসবিদ তনিকা সরকারের বক্তব্য)
একুশের ডাককে অনেক অভিনন্দন। কিন্তু এখানে কিছু বলার যোগ্যতা আমার একেবারেই নেই, কারণ আমি খুব সামান্যই কাজ করেছি দলিত আদিবাসী ইতিহাস নিয়ে। এই ইতিহাস নিয়ে অনেকেই কাজ করে এসেছেন কয়েক বছর ধরে, কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হল বাঙ্গালির ইতিহাস চেতনা বা কোনও চেতনাতেই তার কোনও ছাপ পড়েনি। আমরা যুগপুরুষ মহাপুরুষ মাহামানব মহামানবী যাদের বলে থাকি তাঁরা সবাই উচ্চকোটির উচ্চবর্ণের মানুষ, তাঁরা খুব একটা যে এই সমস্যাগুলো নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন তার সেরকম নিদর্শন আমরা দেখতে পাই না। যেমন ধরুন হুল হয়েছে এবং বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলন হয়েছে একদম এক সময়। অথচ দুটো যেন ভিন্ন ভিন্ন গ্রহের ঘটনা, দুটোর মধ্যে কোনও সংযোগ নেই।
অনেকেই হয়তো অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কিন্তু, দলিত আদিবাসী বর্গের নিজস্ব রাজনীতি, নিজস্ব প্রতিবাদকে এগিয়ে নিয়ে চলার কথা বলেননি বা সেই স্বাধীনতা তাঁরা দেননি। সে রবীন্দ্রনাথই হোন বা বিবেকানন্দই হোন বা অন্য যে কেউই হোন না কেন।
নিশ্চয়ই বামফ্রন্ট বা বাম রাজনীতি অনেক দলিত আদিবাসীকে সংঘর্ষে টেনে নিয়েছিল এবং বামফ্রন্টের নীতি তাঁদের অনেক উপকার করেছিলো। কিন্তু সেটা তাঁদের শ্রেণিভিত্তিক পরিচয়ের জন্য। তাঁদের আদিবাসী বা দলিত পরিচয়ের জন্য নয়। এবং তাঁদের সাংস্কৃতিক মর্যাদা দেওয়া এমনকি তাঁদের ন্যূনতম রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অধিকারগুলিকে স্বীকার করার সেরকম দায়িত্ব তারা নেয়নি। তাঁদের শ্রেণি চরিত্রের পরিচয়টা অনেক বেশি বড় ছিল। দলিত বা আদিবাসী হিসেবে তাঁদের অবস্থান নিয়ে কোনও ভাবনা বড় বড় বামফ্রন্ট নেতাদের মধ্যে আসেনি। এবং এখনও পর্যন্ত দেখা যায় যে ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের নেতাদের মধ্যে উচ্চজাতের প্রাধান্য সবথেকে বেশি, সবথেকে শক্তিশালী। এই বিশাল তাচ্ছিল্যের বিষময় ফল নিয়ে কিছু কথা বলে আমি আমার বক্তব্য শুরু করব।
সংঘ পরিবার এই তাচ্ছিল্য এই অবহেলা কীভাবে নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে, যেসব প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান অর্গানাইজেশন এগুলোকে নিয়ে আগে এগিয়ে চলতে পারতেন তারা সেই প্রচেষ্টা করেননি বলে সংঘ পরিবার তার সুযোগটা কীভাবে নিচ্ছে?
এটা অবশ্যই স্বীকার্য যে এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে আদিবাসী বা দলিত সমাজের অবস্থার কোনও মৌলিক পরিবর্তন বা বদল সংঘ পরিবার একেবারেই চায় না। বরঞ্চ উল্টোটা। দলিতদের নিজস্ব প্রতিবাদ-রাজনীতি কোনোখানে হলেই তারা অত্যন্ত সুকঠোর হাতে তা দমন করে। এবং যে কেউ, যে কোনও মানুষ, তা সে উচ্চবর্ণেরই হোক বা নিম্নবর্ণেরই হোক, যদি সেগুলোর অনুমোদনে এগিয়ে যান তাহলে তাদের সঙ্গে সঙ্গে জেলে পুরে দেওয়া হয়, জেলের অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়। কিন্তু যেখানে তাঁরা আছেন সেখানেই তাঁদের যাতে রেখে দেওয়া যায় এবং সন্তুষ্টভাবেই রেখে দেওয়া যায় তা করতে সংঘ কয়েকটা খুব বিচিত্র অভিনব প্রক্রিয়া বার করেছে। সেগুলো সম্বন্ধে কিছু বলব।
কেমন করে দলিত আদিবাসীদের সংঘে টেনে নেওয়া যায়, তা নিয়ে সেই যবে থেকে গণতন্ত্র এসেছে আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর, তখন থেকেই সংঘ পরিবার চিন্তা করে আসছে। দ্বিতীয় সরসংঘ চালক গোলওয়ালকর তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ বইতে এব্যাপারে একরাশ প্র্যাক্টিকাল উপদেশ দিয়েছেন যা ভেবে দেখার মতো। তিনি বলছেন বারবার এদের মধ্যে যাও, এদের সাথে লাগাতার কথা বল, বারবার তাদের স্পর্শ কর। এই স্পর্শ করার ব্যাপারটা উনি খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাদের আলিঙ্গন কর কথায় কথায়, তাদের লেখাপড়ায় সাহায্য কর, নিজেদের বাড়িতে অনবরত তাদের নেমন্তন্ন করে একসাথে একপাতে খেতে বস। বাড়ির মহিলাদের তিনি বলছেন, তোমার পাড়ায় কাছাকাছি যারা দলিত পরিবার আছে তাদের অন্তত একজন শিশু একজন মহিলাকে সামান্য লিখতে পড়তে শেখাও। সংঘের যুবকদের বলছেন তাদের মধ্যে গিয়ে বসবাস করে প্রাথমিক শিক্ষা চালু কর। এগুলো কিন্তু কথার কথা বা নিস্ফল উপদেশ নয়। পরের দিকে বনবাসী কল্যাণ আশ্রম বা সেবা ভারতী স্কুল এসবের ফসল, অথবা একল বিদ্যালয়। বেশিরভাগ সময় এইখানে সংঘ সেবকরা খুব কম মাইনে এমনকি বিনা মাইনেতে বছরের পর বছর কাজ করে যান একথা ভুললে চলবে না। এই বিপদটা যাতে আমরা ভালো করে বুঝতে পারি, তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে না দিই সেইজন্য এই কথা বলছি আমি। যে কাজটা প্রগতিশীলদের করা উচিত ছিল সে কাজটা তারা করেননি এবং সেই কাজটা এখন এদের হাতে চলে গেছে। এবং এর ফল এর প্রভাব একটা পড়ে। ভানোয়ার মেঘসিং বলে একজন দলিত ভদ্রলোক, মধ্যপ্রদেশের, তিনি এই সুযোগগুলো পেয়েছিলেন সংঘ পরিবারের কাছ থেকে এবং বহুদিন তিনি সংঘ পরিবারে নিষ্ঠাভরে সেবা করে গেছেন। তাঁকে লেখাপড়া শেখানো, তাঁর হস্টেলের ব্যবস্থা করা, তাঁর ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা, সংঘ পরিবার থেকে করা হত। এবং উনি প্রথমবার যখন বাবরি মসজিদে হানা দেওয়া হয় তারমধ্যে সামিল ছিলেন। সংঘের সমস্ত কাজ তিনি করতেন। একেবারে আকস্মিকভাবে তিনি আবিষ্কার করলেন একদিন যে সংঘের লোকের বাড়িতে গিয়ে, সংঘীদের বাড়িতে গিয়ে তিনি খেতে পারেন, তাঁকে আদর করে খাওয়ানো হয়, কিন্তু তাঁর মা যদি ওদের নিমন্ত্রণ করেন নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে চান তাহলে সেই রান্না ওরা নানা ছুতোয় এড়িয়ে যায় এবং জোর করে কিছু করলে একটু দূরে গিয়ে সেটা কুকুরকে খাইয়ে দেয়। এবং এই আবিষ্কারটা না করলে উনি আজও ওখানে থেকে যেতেন, সংঘে থেকে যেতেন।
অবিভক্ত বাংলায় দলিত সম্প্রদায়ের একটা নিজস্ব ধর্ম ছিল, আমরা জানি, তা প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সম্পূর্ণ বিরোধী। দেশভাগের পর অধিকাংশ নমশূদ্র পুববাংলা থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন চাষবাস জমিজমা ছেড়ে দিয়ে। এই বাংলায় এসে তাঁদের অত্যন্ত লড়াই করে কোনও মতে টিঁকে থাকতে হয়েছিল। এখন, সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় দেখাচ্ছেন, আরএসএস-এর লোকেরা তাঁদের মধ্যে অল্পস্বল্প সাহায্যের হাত এগিয়ে দেন। যেমন সংরক্ষণ পেতে সাহায্য করা, ওই কাগজপত্রগুলো নিয়ে ডিল করা। এগুলোতে ওরা সাহায্য করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ন্যূনতম সাহায্যের বদলে তাঁদের বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অংশীদার করে তোলে। তাঁদের মনে দেশভাগের সেই পুরোনো বহু পুরোনো তিক্ত স্মৃতি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আবার জাগিয়ে তোলে, খুঁচিয়ে ঘা করা যাকে বলে। অনবরত তাঁদের কানে ঢালতে থাকে, তোমাদের এই হয়েছিল ওই হয়েছিল, এবং অবশ্যই অনেক বেশি বাড়িয়ে বলেন। এবং এই করে করে একই সঙ্গে তাঁদের সাহায্যও করেন এবং তাঁদের নিজস্ব রাজনীতির মধ্যে টেনে আনেন। আমরা তো জানি মোদী বাংলাদেশে গিয়েও নমশূদ্র গুরুদের জন্মস্থানে মাথা ঠুকে এসেছেন, প্রতি নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতারা গিয়ে আম্বেদকরের মূর্তির সামনে মাথা ঠেকান। আমরা যখন প্রথম ১৯৯০ সালে বিজেপি অফিসে গিয়েছিলাম ইন্টারভিউ করতে তখন দেখেছিলাম অফিসে একটাই মাত্র ছবি রয়েছে, একটি ফোটোগ্রাফ এবং সেটি আম্বেদকরের। এসব প্রতীকী রাজনীতি। এতে কারও খুব একটা কিছু আসে যায় না। এবং তখনই আসে যায়, যখন দলিত মানুষেরা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হয়ে প্রবল প্রতিবাদ করেন। তখন তাঁদের কীভাবে কোনঠাসা করা হয় সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু, এই দুটোর মধ্যে একটা বিশাল জায়গা আছে সেখানে অনেকটা কাজ চলছে।
আদিবাসীদের জন্য অন্য নিয়ম। সাভারকর বলেছিলেন অনেকদিন আগেই, খুব ফ্র্যাঙ্কলি বলেছিলেন, আর্য সবর্ণ গোষ্ঠীর লোকেরা বাইরে থেকে এসে ভারতবর্ষ দখল করে, যারা আদিবাসী ছিলেন তাদের ক্রীতদাসে পরিণত করে। সেই ইতিহাস কিন্তু এখন নতুনভাবে লেখা হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে যে সবর্ণ আর্য এবং আদিবাসীদের উৎপত্তি একই সোর্স থেকে এবং তাঁরা পরস্পরের আত্মীয়, তাঁরা এক পরিবারের লোক। এবং পরিবারের ভেতরে তো একটা বৈষম্য থাকেই, কেউ বড় হয় কেউ ছোট হয়, কাজেই একই রক্ত যদি শরীরে বয় তাহলে সেই সব ভেদ নিয়ে আমাদের বেশি মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এবং তাঁরা অত্যন্ত চেষ্টা করে, মানে প্রচুর প্রয়াস করে আদিবাসী ধর্মের সাথে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের দেবদেবীর মিথকের মিলগুলো, বলা যায় আবিষ্কার করছেন বা বানাচ্ছেন। আদিবাসী উপকথাকে তাঁরা হিন্দু মিথকের সাথে গেঁথে দিচ্ছেন। কুলুর আদিবাসীদের মধ্যে যেমন বহুকালের প্রথা বা বিশ্বাস যে দেবতারা তাদের গুপ্ত জীবনকাহিনী বিশেষ কোনও আদিবাসী মিডিয়ামকে গোপনে জানান, এবং তিনি তা রাজাকে জানান এবং রাজা তা জনসমক্ষে ব্যক্ত করেন। এখন কুলুর প্রাক্তন রাজা ঘোর আরএসএস এবং তিনি দেবতাদের তথাকথিত এই বাণীগুলো সাম্প্রদায়িক একটা চেহারা দিয়ে চারদিকে প্রচার করেন এবং লোকে তাঁকে বিশ্বাসও করে। লক্ষ্যণীয় হল, যেটা সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার, এই যে নতুন করে ইতিহাস লেখা হচ্ছে, এরমধ্যে আরএসএস-এর লোকেরা খুব চেষ্টা করে স্থানীয় আদিবাসীদের, তারা টিচার হোন বা তারা পুরোহিতের কাজ করুন, বা যাই করুন না কেন, তাঁদেরও ইতিহাসবিদ হিসেবে টেনে নিচ্ছেন, তাঁদেরও ইতিহাসবিদের সম্মানটা দিচ্ছেন যেটা আমরা কখনও করিনি, কখনওই করিনি। এসবের পরিণাম আমরা গুজরাটে ২০০২ সালে দেখেছি যেখানে আদিবাসীরা নানা জায়গায় মুসলমানদের আক্রমণ করেছেন। অরুণাচল প্রদেশে সেখানে আবার আরএসএস রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে এই ধরনের ইতিহাস রচনা করছে, এই ধরণের ‘গঠনমূলক’ কাজ করছে। সেইখানে ক্রিশ্চানদের ওপরে আদিবাসীদের টেনে নিয়ে এসে আক্রমণ চালানো হয়। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে যদি আদিবাসী দলিতদের একটা ‘সাম্য’ দেওয়া হয় তাহলে সেটা খানিকটা কার্যকরী তো হতেই পারে। নাগা’দের মধ্যে ধর্মের ঐক্য প্রচার করতে গিয়ে সংঘ সেবকরা যেমন নিরন্তর পরিশ্রম করে চলেন বছরের পর বছর তার বিবরণ অর্ক লবকুমারের লেখায় পড়ে আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। তাঁদের ভাষা শিখে, তাঁদের মধ্যে থেকে তাঁদের খাবার খেয়ে — ভাবতে পারেন গুজরাটি বানিয়া স্বয়ংসেবক, তারা গিয়ে প্রতিদিন ওঁদের সাথে বিফ খেয়ে, দিনের বেলা বিফ খেয়ে রাত্রি বেলা সেটা উগরে দিয়ে, মানে বমি করে — ‘আমরা একই লোক দেখো, আমাদের মধ্যে কোনও ভাগ নেই’ দেখানো। এইভাবে তাদের দলে টেনে আনছে। মূলধারার বাম পার্টিগুলোর যে কাজ, আমি এখানে সব বাম পার্টির কথা বলছিনা, কিন্তু বড় বড় বাম পার্টি যেগুলো, লাগাতার এই ধরণের গঠনমূলক কাজ খুব কমই করেছে। এর জন্য বহু বহু বছর ধরে নিরলসভাবে, ফলের আশা না করে, লেগে থাকতে হবে। আমাদের নকশালবাড়িতে যেখানে বহু বছর চা বাগান বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে ১৯৯২ সালে যখন বিজেপির ক্ষমতায় আসার কোনও স্বপ্নও ছিল না, তখন একটি ছোট্ট স্কুল আরএসএস খোলে। দুটি কামরার স্কুল। সেখানে ১৯৯২ সালে কেউ আড়াইশো টাকা মাইনে মাসে নিয়ে কেউ কেউ পাঁচশো টাকা মাইনে মাসে নিয়ে পড়াতেন, এখন সেটা একটা বিশাল স্কুলে দাঁড়িয়ে গেছে। স্কুলের ছাত্রদের পাঠানো হয় চা-বাগানের বেকার শ্রমিকদের মধ্যে চ্যারিটি বা কৃপা বিতরণ করতে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সাম্প্রদায়িক শিক্ষা দিতে।
নির্বাচনী লড়াইয়ের বাইরে যে রাজনীতির বিশাল জগৎ পড়ে রয়েছে সেটা আমরা চাষ করিনি। আমরা কেউই সেটার দিকে তাকিয়ে দেখিনি। আমাদের সংগঠিত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলি বড় সহজে হাতে হাতে ফল পেতে চায়। এবং সরষের মধ্যে ভূতের মত তাদের মধ্যেও জাতিবিদ্বেষ ও ব্রাহ্মণ্য গরিমা যে নেই তা কি বলা যায়? জাতিপ্রথা নিয়ে যে তাঁরা এতকাল সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন, এবং বাংলাদেশে যে জাতিভেদ আছে একথাও তাঁরা স্বীকার করতে চাইতেন না, বারবার নাকচ করে দিতেন, সেটাও কি কাস্টিজমের একটা অংশ নয়, বা পরিচয় নয়? এই কটু কথাগুলো বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।
- তনিকা সরকার
মালদা জেলার কালিয়াচকের ১ ব্লক আলিপুর ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫২ বিঘি গ্রামের বাসিন্দা সাজিকুল মোমিন (৩৫) কালিয়াচক ২ ব্লকের ঘড়িয়ালিচক লেবার কমিশন সাহাদাত আলির মাধ্যমে ভিনরাজ্যে কাজ করতেন। কাজের বিনিময়ে ১ লক্ষ টাকা অগ্রিম নিয়েছিলেন এবং ৪ মাস কাজ করে প্রায় ৫০ হাজার টাকা শোধ করেছিলেন। লকডাইনে কাজ করতে যাওয়া হয়নি। সাজিকুল মোমিনের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য সাহাদাত আলি চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। নিজের লোকজন পাঠিয়ে ঘরের টালি ভেঙে দেয়। হুমকি চলে ৫০ হাজার টাকার সুদ সমেত ১ লক্ষ টাকা দিতে হবে। কমিশনের টাকা শোধ করতে না পারলে তুলে নিয়ে এসে বন্দি করে রাখা, এলাকায় নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারে এমন বন্দি শ্রমিককে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগ উঠল কালিয়াচকে। শুধু তাই নয়, অভিযুক্তদের আড়াল করতে পুলিশের অত্যাচার নামে প্রতিবাদীদের উপর।
২ জুলাই সাজিকুল মোমিনকে ঝাড়খন্ডের বারহারুয়া থেকে অপহরণ করে কালিয়াচকে নিয়ে আসে সাহাদাত আলি ও তার ভাড়াটে বাহিনী। সাহাদাত আলির বিশাল বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে আটকে রেখে সাজিকুল মোমিনকে প্রচন্ড মারধর করে চারদিন ধরে। তারফলে মারা যায় সাজিকুল। লেবার কমিশনে নিজেকে খুনের দায় থেকে বাঁচানোর জন্য সাহাদাত আলি পরিকল্পনা মাফিক মৃত সাজিকুল মোমিনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছে রটিয়ে দেয়। সাহাদাত আলির পুলিশের সাথে গোপন আঁতাত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা সাধারণ মানুষের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেলে, নতুন কৌশল হিসাবে লোক পাঠানো হয় সাজিকুল মোমিনের স্ত্রীর কাছে ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে। রাতারাতি কবর দিতে পারলেই প্রশাসনকে নীরব করিয়ে দেওয়া যাবে। ৫২ বিঘি এলাকার তৃণমুল প্রতীকে নির্বাচিত সদস্য মানব সেখের নেতৃত্বে ফারুক মোমিন, এস্রাউল, কাশিম ইত্যাদিরা ‘কমিশন’ থুড়ি লেবার সাপ্লায়ার হিসাবে পরিচিত। এরা সাজিকুলের স্ত্রী সুফিয়া বিবিকে ৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে মিটমাট করে নিতে বলে। সুফিয়া বিবি বলে আমার স্বামীকে যারা মেরে ফেলল তাদের বিচার চাই। কোনভাবেই মীমাংসা না মানার খবরটিও এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে রাত্রিবেলা কালিয়াচক থানার পুলিশ সুফিয়া বিবিকে তুলে নিয়ে যায়। এখানে মনে রাখা দরকার সাহাদাত আলির বাবা হলেন শওকত সর্দার, যিনি শাসকদলের নেতা এবং মাফিয়া ডন বলে পরিচিত। সুফিয়া বিবির সাথে যারা এসেছিলেন তারা দেখেন সাজিকুলকে প্রচন্ড অত্যাচার করে সাহাদাত আলি তার বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে। থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার সুফিয়া বিবিকে থানায় নিয়ে যায়। থানায় নিয়ে গিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে তার হাতে কোনও রিসিভ কপি না দিয়ে ছেড়ে দেয়।
পুলিশ প্রশাসন ও হত্যাকরীর গোপন আঁতাতের কৌশলের বিরুদ্ধে ৬ জুলাই সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও পিডিএস-এর নেতৃত্বে ৫২ বিঘিতে প্রায় ২০০ মহিলা সহ সাধারণ মানুষদের সঙ্গে নিয়ে কালিয়াচকে রাস্তা অবরোধ হয়। দাবি ওঠে পুলিশ ও খুনির গোপন আঁতাত ধংস হোক। মোমিনের আত্মহত্যার গল্প ফেঁদে আসল খুনিকে আড়াল করা চলবে না। অবিলম্বে সাজিকুল মোমিনের খুনিকে গ্রেপ্তার করতে হবে। অবরোধ তুলতে পুলিশ ব্যাপক হারে লাঠি চালায়। পুলিশ টার্গেট করে সিপিআই(এমএল) নেতা এব্রাহিম ও সাজিকুলের স্ত্রী সুফিয়া বিবির উপর। সাজিকুলের ১৪ বছরের ছেলেও রেহায় পায়নি। এই অবরোধে অংশগ্রহণ করেন সিপিআই(এমএল) জেলা কমিটির সদস্য লুৎফুর রহমান, কয়েশ আলি, সামিরুদ্দিন, পিডিএস-এর নাসিমুল হক প্রমুখ। মামি সৎকাজে অংশ নিতে ৫২ বিঘি চলে যায়। কালিয়াচক থানার আইসি বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে রাত্রি প্রায় ৭টার সময় বাড়িতে চড়াও হয় এই প্রতিবেদককে ধরার জন্য। বাড়িতে আমার স্ত্রী, বৌমা এবং নাতি-নাতনিরা বাড়ির ভিতরে দরজা লাগিয়ে ছিল। আইসি সামনে থেকে দরজা খুলতে বললে আমার স্ত্রী বলেন আমার স্বামী বাড়িতে নেই, এছাড়া আর কোনও পুরুষ মানুষ কেউ নেই, তাই দরজা খুলতে পারব না — একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তারা দরজায় লাঠি মারতে থাকে। বলে দরজা না খুললে লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে দেব, কেউ বলে জেসিপি দিয়ে বাড়ি ভাঙ্গা হবে। বাড়িতে গিয়ে আমার স্ত্রী ও প্রতিবেশীর মুখে শুনে আমার একটা ধারণা হয়েছে, মনে হয় পুলিশের উর্দি পরে খুনিদের গুন্ডারা আমার প্রাণ নাশ করতে হাজির হয়েছিল।
বাড়িতে পুলিশের হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে খবর যায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি ও কেন্দ্রীয় পলিটবুরো সদস্য কার্তিক পালের নিকট। তিনি কালিয়াচক আইসি’র সঙ্গে কথা বললে আইসি হুমকির সুরে বলেন আগে ইব্রাহিমকে অ্যারেস্ট করব তারপরে আপনার সঙ্গে কথা বলব। এই কথা পিডিএস-এর রাজ্য নেত্রী অনুরাধা দেবের নিকট পৌঁছে যায়। অনুরাধা দেব কালিয়াচক থানার আইসি’র সঙ্গে কথা বললে সমস্যা শোনার বদলে হুমকীর সুরে বলে ইব্রাহিম ও নাসিমূলকে গ্রেফতার করার পরে কথা বলব। আইন রক্ষার শপথ নিয়ে যারা চাকরিতে আসেন, উর্দি আর অস্ত্র যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় দুষ্টের দমনের জন্য, তারা যখন সেই শপথকে অমর্যাদা করে দুষ্টের বন্ধু হয়ে ওঠে, তাদের কাছ থেকে প্রতিবাদীরা হুমকি ছাড়া অন্য কিছু আশা করতে পারে না। আমাদের আশা একমাত্র জনসাধারণ।
৭ জুলাই পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বে মালদা জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের নিকট ডেপুটেশন দেওয়া হয়। অপরদিকে অনুরাধা দেব ৯ আগস্ট পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর নিকট লিখিতভাবে জানান। ১০ জুলাই অনুরাধা দেব সহ সিপিআই(এমএল) ও পিডিএস সুফিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য এলাকাতে যায়, কিন্তু তার আগেই সুফিয়াকে পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে চলে যায়।
সুফিয়ার সঙ্গে কথা বলতে সকলে মিলে থানাতে এলে, থানার আইসি এবং শাসক দলের নেতারা অসভ্যের মতো আচরণ করে অনুরাধা দেব সহ সকলকে মার্ডার কেসের আসামী বানিয়ে এ্যারেস্ট করার হুমকি দেয়। এসপি’র হস্তক্ষেপে বাধ্য হয়ে আইসি অনুরাধা দেবের নিকট জোড় হাত করে ক্ষমা চায় এবং সকলকে মুক্ত করে। কালিয়াচক থানার আইসি’র এই ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে ১২ জুলাই অনুরাধা দেব, নাসিমুল হক, মোহাঃ ইব্রাহিম এসপি’র সাথে সাক্ষাত করে। এসপি’র হস্তক্ষেপে সাহাদাত আলিকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
== সমাপ্ত ==