কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার ৫০ বছর অতিক্রান্ত, বিচার অধরাই থেকে গেল
50 years have passed

১৯৭১ সালের ১২-১৩ আগস্ট পুলিশের সহযোগিতায় কংগ্রেসী ঘাতক বাহিনী কাশীপুর-বরানগর অঞ্চলে ভয়ঙ্কর নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। এ এক বিরলতম ঘটনা, রাজ্যের রাজধানী কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় দু'দিন ধরে প্রায় শতাধিক সিপিআই(এমএল) কর্মী ও সমর্থকদের হত্যা করা হয়েছিল। এর আগের বামফ্রন্ট সরকার তদন্ত কমিশন বসিয়েছিল, তার রিপোর্ট দিনের আলোর মুখ দেখেনি। বিপরীতে সেই সব হত্যাকারী পুলিশ অফিসার প্রোমোশন পেয়েছে এবং কংগ্রেসী ঘাতক বাহিনী রাজনৈতিক পুর্নবাসন পেয়েছে। এরা বর্তমানে অনেকেই শাসক দলের সাথে যুক্ত আছেন। তদন্তের প্রশ্নে তৃণমূল সরকারের একটাই কথা কাশীপুর বরানগর গণহত্যার ফাইলের খোঁজ চলছে।

প্রত্যক্ষদর্শী, মৃতদের পরিবারের জবানবন্দি এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন বিবরণ থেকে জানা যায় বারাসাত হত্যাকাণ্ড ও কাশীপুর-বরানগর গণহত্যাকাণ্ডে কংগ্রেসী ঘাতক বাহিনী প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল। বারাসাত হত্যাকাণ্ডে যিনি অন্যতম পরিকল্পক, তিনি আমৃত্যু বহাল তবিয়েতে কংগ্রেসী রাজনীতি করে গেছেন। ১৯৭০ সালের ১৯ নভেম্বর কানাই ভট্টাচার্য, যতীন দাস, সমীর মিত্র, গণেশ ঘটক, শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, তরুণ দাস, সমেন্দ্র দত্ত এবং স্বপন পাল — দক্ষিণেশ্বর আরিয়াদহের এই ৮ জন কমরেডকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে বারাসাতের রাস্তায় তাঁদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ ফেলে আসে।

বারাসাত গণহত্যার পর কংগ্রেসী ঘাতক বাহিনীর স্পর্ধা আরও বেড়ে যায়। তারই পরিণতিতে ঘটে কাশীপুর-বরানগর গণহত্যা। যার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবাংলার ভারপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। কাশীপুর-বরানগর গণহত্যা কাণ্ডের পর তাকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন ‘সারা রাত ধরে যেখানে গণহত্যা চললো, শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা কী তাহলে আক্রান্ত হলে পুলিশ প্রোটেকশন পাবে না?’ সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের দাম্ভিক উত্তর ‘আগে দেখতে হবে যারা মারা গেছে, তারা শান্তিপ্রিয় ছিল কিনা?’ (সূত্রঃ ‘যুগান্তর’ ১৫ আগস্ট ১৯৭১)।

পুলিশ কর্তা রুনু গুহ নিয়োগী ‘সাদা আমি কালো আমি’ রচনায় লেখে ‘আগস্ট ১২ তারিখে কংগ্রেস নেতা নির্মল চট্টোপাধ্যায়কে হত্যা করা হয় কাশীপুর রোড ও রতনবাবু রোডের মোড়ে। নির্মলবাবু ওই অঞ্চলের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন।... তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তারই পরিণাম, তাঁরা দলবদ্ধভাবে খুঁজে খুঁজে নকশালদের মেরে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেন।... এই প্রথম নকশালরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ পেল।’ সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের উক্তি এবং রুনু গুহ নিয়োগীর সংলাপ থেকে বোঝা যায় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের যোগসাজশেই অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল।

প্রত্যক্ষদর্শী দেবাশিস ঘোষের লেখা থেকে তা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি লিখছেন ‘১৩ আগস্টের ভোরে রতনবাবু রোড ও চন্দ্রকুমার রায় লেনের মোড় থেকে সশস্ত্র ‘খুনি’রা এগোতে থাকে। এরা হল বাবলু ঘোষ, লকা, পঞ্চম রজক, সমর মুখার্জী, অলোক সাউ, নিমাই দাস (ছোটবাবু) প্রভৃতি। এদের অনেকেরই হাতে পুলিশের রিভলবার। কেন না কর্ড ঝোলানো ছিল রিভলবারের বাটে।’ দেবাশিসবাবু আরও লিখেছেন ‘আবার প্রামাণিক ঘাট রোড হয়ে শ্মশানের পাশ দিয়ে তেড়ে আসছে পরেশ সাউ, ভোম্বল দত্ত, শুভেন্দু, দেবু দত্ত, বংশী, নিতাই, কেলো (হাতকাটা), ট্যারা শঙ্কর, গোরা মন্ডলের মতো মারকুটে কংগ্রেসীরা। স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিই শ্মশানের পাশে থাকা মাটির নৌকায়।’ দেবাশিস ঘোষের পুস্তিকায় মৃতদের ১৭ জনের অসম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাঁরা হলেন--করুণা সরকার, পাঁচু গোপাল দে, অষ্ট খাঁড়া, সমীর বড়াল, ভবানী বিশ্বাস, অমল বিশ্বাস, তপন সামন্ত, নেপাল চট্টোপাধ্যায়, শ্যামসুন্দর মাইতি, দীপু সরকার, পঞ্চানন রায়, অজিত মারিক, সুবোধ মারিক, কেলো, খোকন, খগেন এবং সুভাষ চক্রবর্তী। আটাপড়ায় গগণ চন্দ্র রায় (গোখনা), শ্যাম, শ্যামল চৌধুরী, বাবলা বিশ্বাসদের খুঁজতে গিয়ে জল্লাদরা যা করেছিল সেই নৃশংসতারও কোন নজির নেই। সেই সময়কার সাপ্তাহিকী ‘দর্পণ’ ও ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকায় বিস্তারিত রিপোর্ট বেরিয়েছিল।

চারু মজুমদার, সরোজ দত্তের হত্যা, হাওড়া, বারাসাত, কোন্নগর, ডায়মন্ডহারবার, বেলেঘাটা সহ প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি উঠুক। হাওড়া জেলে (মল্লিক ফটক) ১৯৭৫ সালে শহীদ হন শহীদ কমরেড প্রদীপ চৌধুরীর ভাই প্রবীর (পাখি) চৌধুরী, প্রতীক ঘোষ ও শ্যামল চক্রবর্তী। বেলঘরিয়ায় ফেক এ্যানকাউন্টারে শহীদ হন তপন শূর। নাট্যকর্মী প্রবীর দত্ত, পার্টি কর্মী ও কবি দ্রোনাচার্য ঘোষ, তিমির বরণ সিংহ, মুরারী মুখোপাধ্যায়, অমিয় চট্টোপাধ্যায় (সাগর) সহ সমস্ত শহীদকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করার দায় পার্টিকে নিতে হবে, যাতে তারা শহীদদের উত্তরসূরী হয়ে সংগ্রামে এগিয়ে যান।

আবারও ৭০ দশকের শাসকের আস্ফালন শোনা যাচ্ছে। এই সময়ও সারাদেশে প্রতিবাদীদের আশ্রয় হচ্ছে জেলখানায়, দানবীয় ইউএপিএ আইন দিয়ে বিনাবিচারে তিল তিল করে কারাগারে বন্দীদের হত্যা করা হচ্ছে। স্ট্যান স্বামীর হত্যাকাণ্ড, দিল্লির দাঙ্গা, ৮ আগস্ট পার্লামেন্ট স্ট্রীটে বিজেপির উদ্যোগে গণহত্যার উস্কানিমূলক প্রচার সভা প্রমাণ করে কেন্দ্রীয় শাসক দল নতুন করে বন্দীহত্যা ও গণহত্যার সলতে পাকানো শুরু করেছে। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, রুনু গুহ নিয়োগী, তারাপদ চক্রবর্ত্তী এবং সেদিনকার রাজনৈতিক দলের খুনে বাহিনীর অনেকেই মারা গেছে। তাই বলে কি সত্য উদঘাটিত হবে না? ১৯৭০-৭৫ সাল বা তার পরের সমস্ত বন্দী হত্যা ও গণহত্যার ঝাঁপি খুলতে হবে, ভবিষ্যতে গণহত্যা রোধের স্বার্থে। চিৎকার করে শাসকদের জানাতে হবে ‘আর নয় গণহত্যা’, বিচার চাই বিচার কর। কাশীপুর-বরানগর হত্যাকাণ্ডে নিহত সমস্ত শহীদ কমরেডদের জানাই লাল সেলাম।

 যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র তিমিরবরণ সিংহ বহরমপুর জেলে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে শহীদ হন। প্রিয় ছাত্রর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষ এই কবিতাটি লেখেন।

তিমির বিষয়ে দু-টুকরো

আন্দোলন
ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়
দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ
তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
তোমার ছিন্ন শির তিমির।

নিহত ছেলের মা
আকাশ ভরে যায় ভস্মে
দেবতাদের অভিমান এইরকম
আর আমাদের বুক থেকে চরাচরব্যাপী কালো হাওয়ার উত্থান
এছাড়া
আর কোন শান্তি নেই কোন অশান্তিও না।

 

- নবেন্দু দাশগুপ্ত
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার : ‘কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার (১৯৭১) রহস্য কি সত্যি উদঘাটিত হবে?’ পি সি রায়)

খণ্ড-28
সংখ্যা-30