বারবারই উত্তর প্রদেশ চলে আসে খবরের শিরোনামে। অপরাধমূলক কাজকর্ম, নানা বিতর্কিত পদক্ষেপের জন্য উৎকট হিন্দুত্বের পোস্টার বয় যোগী আদিত্যনাথ দমনের এক সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি।
সামনে বিধানসভা নির্বাচন। আর, নানা সংকটে জর্জরিত আদিত্যনাথ নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে, নতুন মেরুকরণের লক্ষ্যে এখন থেকে সলতে পাকানো শুরু করে দিলেন। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে যোগী ঘোষণা করলেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নতুন এক পলিসি। উত্তর প্রদেশ রাজ্য আইন কমিশনকে দিয়ে তৈরি করানো হয়েছে এক খসড়া। বিধানসভায় যা অনুমোদন করানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
আর, যা নিয়ে আবার দানা বেঁধে উঠেছে দেশজুড়ে নতুন বিতর্ক।
নতুন এই নীতির লক্ষ নাকি নিছক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নয়। বরং “বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যার এক ভারসাম্য বজায় রাখার” উদ্দেশ্যেই তা তৈরি হয়েছে। এই প্রস্তাবিত নতুন নীতিতে ‘পুরস্কার’ ও ‘শাস্তি’ — উভয়েরই সংস্থান রয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দুই সন্তানের নীতিকে কেউ লঙ্ঘন করলে তিনি স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না, সরকারি দপ্তরে কর্মরত ব্যক্তিরা এক্ষেত্রে পদন্নোতি থেকে বঞ্চিত হবেন এমনকি পাবেননা সরকারি ভর্তুকিও। অর্থাৎ, একজন নাগরিকের কিছু কিছু মৌলিক অধিকার থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হবেন। আর, যারা তা অনুসরণ করবেন, তাঁরা সরকারি চাকুরে হলে পাবেন দু’টো বাড়তি ইনক্রিমেন্ট, মাতৃত্ব বা পিতৃত্বকালীন ১২ মাসের সবেতন ছুটি, জাতীয় পেনশন প্রকল্পে নিয়োগকর্তার দেয় অনুদানের ৩ শতাংশ বৃদ্ধি, ইত্যাদি। আর, যারা সরকারি চাকুরে নন, তাঁদের জলকরের উপর ছাড় দেওয়া হবে, গৃহঋণ ও আবাসন প্রকল্পে পাওয়া যাবে বিশেষ সুবিধা।
আমাদের দেশ, বা উত্তরপ্রদেশ কি বিরাট এক জনসংখ্যাগত বিস্ফোরণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে? ২০১৯’র আর্থিক সমীক্ষা জানাচ্ছে যে দেশে জন্মহার কমছে। বর্তমানে যে জনসংখ্যা রয়েছে, তা ধরে রাখতে জন্মহার যত হওয়া দরকার, আমাদের রাজ্য সহ ন’টি রাজ্যে ওই হার তার থেকে কম। উত্তরপ্রদেশেও জন্মহার কমেছে। আগামী দু’দশকের মধ্যে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৫ শতাংশে নেমে আসবে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা বা ন্যাশনাল ফামিলি হেলথ সার্ভে ও সেন্সাস-এর তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে বেশির ভাগ রাজ্য ও সামগ্রিক ভাবে দেশে জন্মহার কমছে — ১৯৯৪ সালে যা ছিল ৩.৪ তা ২০১৫-তে নেমে এসেছে ২.২-তে। হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষমূলক প্রচারের বিপরীতে সরকারি সমস্ত সমীক্ষায় এটাই প্রমাণিত যে সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভেতরেই জন্মহার দ্রুতই কমছে, হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে তা কমছে আরও দ্রুত হারে। এমনকি সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশেও, গত একদশকের মধ্যে, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ ছাড়াই জন্মহার বেশ কমেছে।
দক্ষিণ ভারতে জন্মহার নিয়ন্ত্রণের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে তুলনামূলক আর্থিক বৃদ্ধি। তারসাথে হাতে হাত মিলিয়ে মহিলাদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও বেশ কিছু সামাজিক সুযোগ সুবিধা ভালোই কাজ করেছে। এজন্য রাজ্য সরকারগুলোর পক্ষ থেকে কোনো শাস্তিমুলক পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়নি। বার বার দেখা গেছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপে গরিব, প্রান্তিক মানুষদেরই আরও বেশি মাশুল দিতে হয়েছে। এটাও প্রমাণিত, আর্থিক ও সামাজিক স্তর নির্বিশেষে মহিলাদের বেছে নেওয়ার বা নিজেদের মতামত প্রকাশ করার পুরো অধিকার থাকলে তা জন্মহার নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটাই আজ সর্বজনগ্রাহ্য নীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আরেক বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী, অসমের হিমন্ত বিশ্বশর্মা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প পাওয়ার শর্ত হিসাবে দুই সন্তানের নীতি প্রয়োগ করেছেন। বলাই বাহুল্য, এই নীতি স্পষ্টতই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লক্ষ্যেই পরিচালিত।
যে রাজ্যটি কোভিড অতিমারীতে ছাড়খার, মৃত্যুর মিছিল ও মর্মান্তিক আখ্যান গোটা দেশকে আলোড়িত করে, যেখানে মৃতেরা পায়না সম্মান ও মর্যাদা, গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয় শত শত লাশ, এই অসহনীয় ট্রাজিক উপাখ্যানের থেকে নজর ঘুরিয়ে আবার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের অভিমুখে যোগী শুরু করেছে তার যাত্রা। নির্বাচনী ফায়দা তোলার সংকীর্ণ লক্ষ্যে। নির্বাচন জেতার জন্য নাগরিকদের যে আরও কত মাশুল দিতে হবে কে জানে!!
- অতনু চক্রবর্তী