সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। অধিকার কর্মীদের ক্ষীণকণ্ঠের সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠনগুলির কিছুটা জোরালো কণ্ঠস্বর যুক্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে। অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই সংযুক্তিকে সমস্তরকম ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা অধিকার কর্মীদের দায়িত্ব।
রাজনৈতিক বন্দী বলতে সাধারণভাবে আমরা কাদের কথা বলছি? কারা রাজনৈতিক বন্দী, কারা নয় — এই প্রশ্নটা কিন্তু এখনও স্পষ্টভাবে মীমাংসিত নয়। সাধারণভাবে বলা হয়, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের কর্মী বন্দী হলে তাঁদের রাজনৈতিক বন্দী বলা হবে। এটা খুবই অস্পষ্ট সংজ্ঞা। নকশালপন্থী বা মাওবাদী ভাবধারার আন্দোলনের কর্মীদের এই সংজ্ঞায় রাজনৈতিক বন্দী বলাই যাবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা দেশে ‘মুসলিম সন্ত্রাসবাদী’ বলে চিহ্নিত করে যে অসংখ্য যুবককে বন্দী করে রাখা হয়েছে তারা কি রাজনৈতিক বন্দী? আমরা কি তাঁদের মুক্তির দাবি জানাব? না কি জানাব না? অনেকে বলেন, ওরা যেহেতু ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্রের (থেওক্র্যাটিক স্টেট) কথা বলেন তাই তাঁদের কর্মীদের রাজনৈতিক কর্মী বলা যাবে না, তবে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার বা দমনপীড়নের বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ হবে। কিন্তু রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদার জন্য যে লড়াই সে লড়াইয়ে ওরা ব্রাত্য। এই বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই আরো হাজারো প্রশ্নের জন্ম দেয়। রাজনৈতিক বন্দী নিয়ে আগামী দিনে লড়াই আরো জোরদার হবে। বন্দীসংখ্যা আরও বাড়বে — কাজেই এসব প্রশ্নের যথাযোগ্য গুরুত্ব সহযোগে আলোচনা হওয়াটা দরকার। মীমাংসা হওয়া সম্ভব না হলেও ধারণাগুলো স্পষ্ট হওয়া দরকার।
কেন আমরা রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চাইছি, কোন যুক্তিতে — এটাও বন্দীমুক্তি আন্দোলনের কাছে পরিস্কার থাকা দরকার। টিএমসি দলের বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২০১১ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বন্দিমুক্তি — তাই কি আমরা বন্দীমুক্তি চাইছি? এটা নিশ্চয় দাবি জানানোর সময়ের একটা বাড়তি যুক্তি। কিন্তু মূল যুক্তি নয়। এই প্রতিশ্রুতি না থাকলে কি আমরা বন্দীমুক্তির দাবি জানাতাম না? নিশ্চয়ই জানাতাম। রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি জানানোর ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান যুক্তি হল এই বন্দীরা যা করেছেন তা তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শের জন্য করেছেন। তাঁরা ব্যক্তিস্বার্থে বা পরিবারের স্বার্থে বা ব্যক্তিগত লাভ, লোভ-লালসার বশে কোনও কাজ করেননি। করেছেন বৃহত্তর সমাজের স্বার্থে। তাই তাঁদের কখনই সাধারণ অপরাধীদের সঙ্গে এক করে দেখা যাবে না। তাঁরা যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনও হিংসাশ্রয়ী কাজ, এমনকি খুনও করে থাকেন তবুও তাকে সাধারণ অপরাধী বা খুনি হিসেবে দেখা যাবে না। তাঁদের রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে। স্মরণ থাকতে পারে ১৯৭৭ সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার এবং কেন্দ্রে জনতা সরকার প্রতিষ্ঠার পর যে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দও ছিলেন। খুনের অভিযোগে বন্দী তো অসংখ্য ছিলেন। তাঁদের সবারই নিঃশর্ত মুক্তি সেদিন আদায় করা হয়েছিল। বামফ্রন্টের সময় পশ্চিমবঙ্গে তৈরি আইন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কারেকশনাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট ১৯৯২-তে একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল যেখানে এটা খুব স্পষ্টভাবে বলা ছিল যে, রাজনৈতিক কারণে খুন করে জেলে গেলেও তাঁকে রাজনৈতিক বন্দী বলা হবে এবং রাজনৈতিক বন্দীদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সুযোগগুলো তার প্রাপ্য হবে। ২০১৩ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সমস্ত প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে এই আইনটি আমূল বদলে দেয়। এবং এসব ধারা বাতিল করে দেয়।
আইনে যাই থাকুক, রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির আন্দোলনে কোনও রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কী অভিযোগে মামলা সাজিয়েছে বা তিনি আদালতের দ্বারা সাজাপ্রাপ্ত কি না সেটা মোটেও দেখা হয় না। দেখা হয়, তিনি রাজনৈতিক কাজের জন্য বন্দী কি না। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে বিচারাধীন এবং দণ্ডপ্রাপ্ত দুই ক্ষেত্রেই মামলা প্রত্যাহার করে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়ার ধারা আছে। সে সব ধারা বামফ্রন্ট যেমন ব্যবহার করেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারও টিএমসি কর্মীদের ও গোর্খাল্যাণ্ড আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা প্রত্যাহারের জন্য ব্যবহার করেছে। একটি দুটি নয় বহু ক্ষেত্রে। এমনকি খুনের মামলা প্রত্যাহার করেও মুক্তি দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের জেলে এই মুহূর্তে মাওবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে বন্দী আছেন ৭২ জন। তাঁদের মধ্যে ৫০ জনই জঙ্গলমহলের বাসিন্দা। ৬ জন মহিলা। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী মাওবাদী দলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরের নেতা ছিলেন — এরকম কয়েকজন এরাজ্যের জেলে বন্দী আছেন। যেমন আদুলা রামকৃষ্ণ, অসীম ভট্টাচার্য, অনুপ রায়, কল্পনা মাইতি, ভেঙ্কটেশ্বর রেড্ডি (তেলুগু দীপক), দীপক কুমার প্রমুখ। জঙ্গলমহলের বন্দীদের মধ্যে অধিকাংশ বয়সে তরুণ। কিন্তু অন্য বন্দীদের মধ্যে ৬/৭ জনের বয়স ৭০ বছর বা তার উপরে। বুদ্ধদেব মাহাতো, আদুলা রামকৃষ্ণ, কল্পনা মাইতি, পারো প্যাটেল — এরা খুবই অসুস্থ।
টিএমসির দশ বছরের শাসনকালে জেলেই ৭ জন রাজনৈতিক বন্দীর মৃত্যু ঘটেছে। কার্যত বিনা চিকিৎসায় তাঁদের মৃত্যু ঘটেছে বলে সহবন্দীদের অভিযোগ। ৭২ জন জেলবন্দীর মধ্যে ৮ জন আছেন সাজাপ্রাপ্ত। বাকিরা ১০-১২ বছর ধরে ‘বিচারাধীন’ অর্থাৎ বিনা বিচারে বন্দী আছেন। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৪ জনের ১৭ বছর জেল খাটা হয়ে গেছে। যাবজ্জীবন মানে ১৪ বছর জেল খাটার কথা। কিন্তু তা সত্বেও সরকার তাঁদের মুক্তি দিচ্ছে না বারবার আবেদন জানানো সত্বেও। ৭২ জনের মধ্যে ৬০/৬২ জনের ইউএপিএ ধারায় মামলা আছে।
মাওবাদী বন্দী ছাড়া এসইউসিআই(সি)-র দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ওই দলের ১৬ জন বন্দী আছেন। এরা সবাই বামফ্রন্টের সময়ের বন্দী। সবাই সাজাপ্রাপ্ত। সম্প্রতি ৯৪ বছর বয়সে বন্দী থাকা অবস্থায় তাঁদের এক বন্দীর মৃত্যু ঘটেছে বলে এসইউসিআই(সি)-র পক্ষে প্রেস বিবৃতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। মাওবাদী এসইউসিআই(সি) ছাড়াও তথাকথিত মুসলিম সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত এরকম বন্দী আছেন অন্তত ৭০ জন। তাঁদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই ইউএপিএ ধারায় মামলা আছে।
প্রসঙ্গত রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি আন্দোলনে মামলা প্রত্যাহারের দাবিটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড় আন্দোলনের সময়ের বহু মামলাই বছরের পর বছর ধরে চলছে। বহু বন্দী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের মামলাগুলি চলছে। ৩০/৪০ টা মামলা দেওয়া হয়েছে এরকম বন্দীও কম নয়। ৮/১০টা তো প্রায় সবার। ফলত, জামিনে মুক্তি পেলেও মামলা লড়তে লড়তেই তাঁদের জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যায়। ঘটিবাটি বিক্রি হয়ে যায়। কাজেই শুধু জেলবন্দীদের মুক্তিই নয়, একই সঙ্গে মামলা প্রত্যাহারের দাবি তোলাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই শেষ বিচারে জামিনে মুক্ত থাকলেও তাঁদের রাজনৈতিক বন্দীর তালিকায় রাখা দরকার এবং মামলাগুলি প্রত্যাহারের জন্য জোরদার দাবি জানানো দরকার।
সারা দেশেই সম্প্রতি বেকসুর খালাস পাওয়া রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবিটা উঠে আসছে। এরাজ্যে এবিষয়ে ক্ষীণভাবে দাবি উঠলেও এভাবে খালাস পাওয়া বন্দীরা মামলা করতে উৎসাহী না হওয়ায় ব্যাপারটা আর এগোয়নি। কিন্তু ক্ষতিপূরণের দাবি এবং মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তারের জন্য অফিসারদের শাস্তির দাবিও তোলা দরকার। নানা রাজ্যেই এবিষয়ে মামলা হয়েছে। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে জেলে থাকার সময়ে বন্দীর পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে এবং এজন্য বন্দীর পরিবারকে নিয়মিত মাসোহারা দিতে হবে — এই দাবিও তোলা দরকার। এটা নতুন কিছু নয়। এরাজ্যে বিষয়টি তেমন চালু নেই। এব্যাপারে ভারত সরকারের স্কীমও আছে। যদিও রাজনৈতিক বন্দীদের সরকারের টাকা নেওয়ার ব্যাপারে প্রবল নৈতিক আপত্তি থাকে। তবুও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। দীর্ঘ কারাবাসের ফলে বন্দীদের পরিবারগুলিকে যে অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট সহ্য করতে হয় তার দায় অবশ্যই সরকারের। কাজেই সরকারকেই তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত — এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দাবিটা তোলা দরকার।
- রঞ্জিত শূর