আমাদের দেশে এপর্যন্ত করোনায় ক্ষতি যে হয়েছে ব্যাপক তা এখন কেন্দ্র-রাজ্য সরকারি সব পক্ষ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। বেসরকারি সূত্রগুলোর সংগ্রহ করা তথ্য পরিসংখ্যান সরকার পক্ষকে বেশ চাপে রেখেছে। তবে এখনও ক্ষয়ক্ষতির হিসেব নিয়ে দুরকম গন্ডগোল চলছে। একদিকে চাপান উতোর চলছে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে, অন্যদিকে ফারাক রয়ে যাচ্ছে সরকারি এবং বেসরকারি তথ্যের মধ্যে। সরকারি হিসেবের চেয়ে বেসরকারি হিসেবে ক্ষতির পরিমাপ অনেক বেশি। যা সরকারের কেন্দ্রীয় স্তর ও রাজ্য স্তর তার তার প্রতি ‘কুৎসা’ ও ‘ষড়যন্ত্র’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছে। মোটামুটি পাওয়া হিসেব বলছে, এপর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দু'কোটি পঞ্চাশ লক্ষাধিক, আর মৃতের সংখ্যা তিন লক্ষাধিক। তথ্য চাপা দিতে গণ চিতা, মাটি চাপা, নদীবক্ষে ভাসিয়ে দেওয়া কত অনাচারই তো হল! কত তথ্য যে হিসেবের বাইরে বিলীন হয়ে রয়েছে! তবু ক্ষতির ব্যাপকতা ক্রমশ প্রকাশ হচ্ছে। তবে একমাত্র দেশজুড়ে জনগণনার মতো অভিযান চালালে সমস্ত তথ্য পঞ্জীভূত করা সম্ভব। ক্ষতির পরিমাপ করা মানে শুধু মৃত্যুর খতিয়ান নয়,সংক্রামিতের সংখ্যা, চিকিৎসা কেমন মিলেছে, কত নিরাময় হল, কত আর্থিক-পারিবারিক-মানসিক-সামাজিক ক্ষতি হয়েছে, সমস্ত তথ্য আসা দরকার। ২০২০-তে সুপ্রীম কোর্টের বাইরে ও ভিতরে একাধিকবার ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে সামাজিক রাজনৈতিক মহল থেকে দাবি ওঠে। যে সমস্ত পরিবারে এক বা একাধিক সদস্যের করোনায় মৃত্যু হয়েছে তাদের শিশুদের ও বাকিদের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবি উঠেছে। বিশেষত, এনসিপিসিআর অর্থাৎ শিশু অধিকার সুরক্ষা জাতীয় কমিশনের সুপারিশ ছিল। আকস্মিক পিতৃমাতৃহীন হয়ে পড়া হাজার হাজার শিশুদের অবিলম্বে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হোক। সুপ্রীম কোর্টের এন নাগেশ্বর রাও-অনিরুদ্ধ বসুর ডিভিশন বেঞ্চ সুপারিশ করেছিল আইসিপিএস অর্থাৎ সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্প থেকে করোনায় অনাথ হয়ে পড়া শিশুদের আর্থিক সহায়তা করা হোক। ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে আইনজীবীরা সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করেন প্রয়াতদের পরিবার পিছু আশু এককালীন চার লক্ষ টাকা দেওয়া হোক। আগে কেন্দ্র এটা দিক। প্রয়োজনে আরও বিভিন্ন সহায়তা দিতে হবে। কেন্দ্র-রাজ্য-কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল সবাই মিলে দিতে হবে। তবু মোদী সরকার এসব দায় পালনের নাম নেয় না। কেবল সাফাই দেয় রাজকোষে তহবিল নেই। এই অতিমারীর একটানা রোজগার পড়ে যাওয়া সময়ে, বেরোজগেরে হয়ে যাওয়া সময়ে, ক্রমাগত পেট্রোপণ্যে কর বসানোয় বিরাম নেই। কর হ্রাসের দাবি তুললে বলে সরকার করোনা মোকাবিলা করবে কি করে? কর না বাড়িয়ে উপায় নেই। যখন দাবি করা হয় করোনা কারণে আর্থিক সুরাহার, তখন আবার সরকার দেয় অর্থ না থাকার সাফাই। এভাবে অতিমারীর সময়কালীন ত্রাণ-পরিত্রাণের নিমর্ম প্রহসন চালানো হয়ে আসছে। নাহলে যে ধোঁকাবাজি, চাতুরি, তথ্যের কারচুপি সব ধরা পড়ে যাবে। তবে সরকার দায় থেকে পালাতে চাইলেও পালাতে দেওয়া যাবে না। বরং বাড়াতে হবে গণচাপ।
সুপ্রীম কোর্টের এক বিচারক বেঞ্চ শুনিয়েছে আরও কিছু কড়া মন্তব্য। বলেছে, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চলছে ক্ষয়রোগ। আর বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চলছে জমাটি ব্যবসা, অনেকটা রিয়েল এস্টেটের মতো, ‘ফেলো কড়ি, কর চিকিৎসা’, এ স্বাস্থ্য বাজারে কোনও নিয়ম মানার বালাই নেই, রোগী প্রতি যা হেঁকে নেওয়া যায় — পাঁচ-দশ-বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ লাখ টাকা। রোগী পক্ষ সর্বস্বান্ত হলেও নিরাপত্তা পাওয়ার কোনও ছাড় নেই, ‘স্বাস্থ্য সাথী’ বা ‘আয়ুস্মান’-এর সীমা আছে, তাও বহু ক্ষেত্রে মান্যতা মেলে না, এখনও পাওয়া থেকে না-পাওয়া জনতার অংশ অনেক বেশি, বানিয়া হাসপাতালের জুলুম বাধা দেওয়ার দায় কোনও সরকার নেয় না। রাজ্য সরকার যাও বা কিছু পদক্ষেপ করেছে নিয়ন্ত্রণের, কেন্দ্র কিছুই দেখে না। ব্যবসায়িক হাসপাতালগুলোর নিয়ম না মানার দুঃসাহস এতই যে, অনেকক্ষেত্রে হাসপাতাল ভবনও তৈরি করেছে আইন না মেনে। যেন জতুগৃহ। যার পরিণামে গত বছর অতিমারী সময়ের মধ্যেই গুজরাটে, মহারাষ্ট্রে পুড়ে মারা যান অনেক রোগী ও হাসপাতাল স্টাফ। এই মরণ পরিণামের উৎস হল অমানবিক স্বাস্থ্য নীতি।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হয় পরিষ্কার দুরকম। একটি জনকল্যাণমূলক, অন্যটি মুনাফা লোটার। কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে কাগুজে ‘জনকল্যাণমূলক’ ঘোষণা থাকলেও কার্যত অগ্রাধিকার পাচ্ছে মুনাফাখোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। কারণ জনসংখ্যা যেখানে ১৩০ কোটি, সেখানে জিডিপি’র মাত্র ০.৯৬ শতাংশ বরাদ্দ করে জনকল্যাণমূলক স্বাস্থ্য নীতির দাবি করা যায় না। মোদী সরকার যা নয় তাই ভন্ডামী চালাচ্ছে। পশ্চিমবাংলার রাজ্য সরকারের নীতি-পলিসিও ঠিকঠাক নেই। বহু গলদে ভরা। এর প্রতিটা হিসাব মনে রাখতে হবে, আন্দোলন ছাড়া প্রতিকার আদায় করার উপায় নেই।