বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য টিকা সংরক্ষণ, সাধারণ জনগণের প্রতি বঞ্চনা
deprivation of the general public

নরেন্দ্র মোদীর কর্পোরেট প্রীতির কথা উঠলেই একযোগে উচ্চারিত হয় আদানি-আম্বানিদের নাম। নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় এই কর্পোরেট ঘরানাগুলো যেমন লাভবান হয়েছিল, তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের জমানাতেও এদের অগাধ শ্রীবৃদ্ধির পিছনে তার সঙ্গে এদের দোস্তির সম্পর্কই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থেকেছে বলে মনে করা হয়ে থাকে। তবে, আদানি-আম্বানিরাই একমাত্র কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব নন যাঁদের স্বার্থ রক্ষাই মোদীর ভাবনায় প্রাধান্য পায়। এই অতিমারীর সময়, দেশবাসীর চরম বিপর্যয়কালেও নরেন্দ্র মোদী টিকা প্রস্তুকারক কর্পোরেট সংস্থাগুলোর স্বার্থ রক্ষার কথা, তাদের বিপুল মুনাফাবাজিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভুলতে পারলেন না। মোদী সরকার তাদের টিকা নীতিতে পরিবর্তন এনে বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য মোট উৎপন্ন টিকার এক ভালো অংশ সংরক্ষিত রাখা এবং টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোকে বেসরকারি হাসপাতালের কাছে বিক্রির দাম নির্ধারণ করতে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেয় তা আপামর জনগণের স্বার্থের বিনিময়ে কর্পোরেট স্বার্থকে সুনিশ্চিত করারই নির্ধারক পদক্ষেপ।

প্রাপ্ত বয়স্কদের সবচেয়ে বড় অংশকে, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের বিনামূল্যে টিকা না দেওয়ার মোদী সরকারের প্রথম দিকের সিদ্ধান্তকে সুপ্রিম কোর্টের ‘স্বেচ্ছাচারী ও অন্যায্য’ বলা এবং টিকার জন্য বাজেটে বরাদ্দ ৩৫,০০০ কোটি টাকা থেকে তাদের বিনামূল্যে টিকা দেওয়া সম্ভব নয় কেন প্রশ্ন তোলার পর মোদী সরকার তাদের টিকা নীতিতে পরিবর্তন আনে। সরকার জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা করে যে ২১ জুন থেকে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কদের, অর্থাৎ, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদেরও বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার দায় সরকার নেবে। কিন্তু এর সাথেই সরকার আরও সিদ্ধান্ত নেয়, দেশে মোট যে টিকা উৎপন্ন হবে এবং বিদেশ থেকে যে টিকা আমদানি করা হবে তার ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত থাকবে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক এই নীতির নাম দেয় ‘উদারিকৃত টিকা নীতি’ এবং সরকারি উদারতার অভিমুখ যে টিকা তৈরির কর্পোরেট সংস্থা ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর দিকেই নির্দেশিত তা নীতির বিধানের মধ্যেই সুস্পষ্ট। বেসরকারি হাসপাতালগুলো টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তাদের নির্ধারণ করা, কি দামে টিকা কিনবে তাও সরকার বলে দেয়। প্রতি ডোজ টিকার এই দাম কোভ্যাক্সিনের জন্য হল ১,৪১০ টাকা, কোভিশিল্ডের জন্য ৭৮০ টাকা এবং স্পুটনিক ভি’র জন্য ১,১৪৫ টাকা, তিনটি দামের মধ্যেই হাসপাতালগুলোর প্রাপ্য সার্ভিস চার্জ ধরা আছে ১৫০ টাকা। দুটি ডোজ নিতে গেলে মোট খরচ যে এর দ্বিগুণ হবে এবং তা যে ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণের সাধ্যের অতীত হবে তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থাকতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের হিসেব, এই দাম থেকে টিকা প্রস্তুকারক সংস্থাগুলো ২,০০০ থেকে ৪,০০০ শতাংশ মুনাফা করবে এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোও যথেষ্ট লাভ করতে পারবে। এই নীতির পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটাও উঠছে যে -- বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য মোট টিকার ২৫ শতাংশ বরাদ্দ কি ধনীদের জন্যই সংরক্ষণ নয়?

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য ২৫ শতাংশ টিকা বরাদ্দ হলেও সরকারি ক্ষেত্রে টিকার বড় ধরনের আকাল চলছে। বিভিন্ন রাজ্যেই সরকারি টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে লম্বা লাইন পড়ছে, রাত থেকেই মানুষরা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, কিছু মানুষ টিকা পাচ্ছেন এবং অনেককেই টিকা না নিয়েই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কিছু রাজ্য সরকারকে শুধু দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ওপর জোর দিতে হচ্ছে, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের টিকা দান উপেক্ষিত হচ্ছে। এর মূল সমস্যাটা কোথায়? সরকার জানিয়েছে, টিকা পাওয়ার যোগ্য প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মোট সংখ্যা ৯৯.৪০ কোটি। এদের সবাইকে দু’ডোজ করে টিকা দিতে প্রয়োজন ১৮৬ থেকে ১৮৮ কোটি ডোজ। গত ৩০ জুন পর্যন্ত ভারতে টিকা দেওয়া হয়েছে সাড়ে তেত্রিশ কোটি ডোজ, এবং দু’ডোজ করে টিকা পেয়েছে প্রাপ্ত বয়স্ক জনসংখ্যার মাত্র ৪.৫ শতাংশ। সরকার দাবি করছে এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কর টিকা দান সম্পূর্ণ করা হবে। তা করতে গেলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন হবে। এখন যা অবস্থা তাতে ভারতে তৈরি হওয়া এবং আমদানি করা টিকা মিলিয়ে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব নয়। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, এবছরের এপ্রিল মাসে প্রতিদিন গড়ে দেওয়া হয়েছিল ২৯.৯ লক্ষ ডোজ, মে মাসে ১৯.৬ লক্ষ ডোজ, ১ জুন থেকে ২০ জুন গড়ে ৪০.৩ লক্ষ ডোজ এবং ২১ থেকে ২৮ জুন গড়ে ৫৭ লক্ষ ডোজ। জুলাই মাসের জন্য সরকার ৩৬টা রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ করেছে ১২ কোটি ডোজ। এই সংখ্যাগুলো প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজনীয় এক কোটি ডোজ থেকে অনেক কম, এবং সাধারণ যুক্তি বলে উৎপাদনকে অল্প সময়ের মধ্যে এমন পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব নয় যা প্রয়োজনীয় পরিমাণের কাছে যেতে পারে। এবছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সমস্ত প্রাপ্ত বয়স্কর টিকাকরণ সম্পূর্ণ করার যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নির্ধারণ করেছে, তা পূরণ করা যে সম্ভব নয় সে কথা স্বীকারে সরকারের কুণ্ঠা হচ্ছে। কিন্তু ঢাক পেটানো তো দরকার, আর তাই নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে সরকার বলছে যে, আমেরিকায় ৩২ কোটি ডোজ টিকা দিতে সেখানকার প্রশাসনের লেগেছিল ১৯৩ দিন, আর ভারত ১৬৩ দিনে, অর্থাৎ, তাদের চেয়ে এক মাস কম সময়েই এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু সংখ্যার হিসেব দিলেও তাদের পক্ষে অস্বস্তিকর বলে শতাংশের হিসেবকে এড়িয়ে যাচ্ছে। ঐ সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশের দু’ডোজ করে টিকাকরণ সম্পূর্ণ করেছে, ভারত সেখানে করেছে মাত্র ৪.৫ শতাংশের!

এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য ২৫ শতাংশ টিকার সংরক্ষণ কতটা যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত? ভারতে ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণ দরিদ্র, তাঁরা দারিদ্র সীমার নীচে ও গ্ৰামাঞ্চলে বাস করেন। টিকা পাওয়াটা এই মানুষদেরও অধিকার এবং তাঁদের কখনই সরকারি অনুকম্পার প্রাপক বলে গণ্য করা যাবে না। অতএব সাধারণ জনগণের টিকাকরণের হারকে বাড়াতে হবে এবং তারজন্য সরকারের হাতে টিকা বেশি মজুতও করতে হবে। কোভিড সংক্রমণের ছড়িয়ে পড়া এবং সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউকে রোখার জন্যও এটা জরুরি। আশু পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন এবং আমদানিকৃত টিকার বৃদ্ধির তেমন সম্ভাবনা যখন দেখা যাচ্ছে না, তখন বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য সংরক্ষিত টিকা নিজেদের হাতে নিয়ে রাজ্যগুলোকে বন্টন করলেই কেন্দ্রীয় সরকার সর্বজনীন টিকাকরণের দায়বদ্ধতার প্রতি সুবিচার করতে পারবে। সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশ পেল বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য সংরক্ষিত টিকা সম্পর্কে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের অভিমত। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিবকে লেখা চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন, ঝাড়খণ্ডে ৭৫ শতাংশ মানুষ গ্ৰামাঞ্চলে বাস করেন এবং বেসরকারি হাসপাতালের জন্য নির্ধারিত দাম দিয়ে টিকা কেনার সামর্থ্যও তাদের নেই। তিনি তাই অনুরোধ করেছেন, টিকা বন্টনকে ন্যায্য করতে ঐ রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য ২৫ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ টিকা বরাদ্দ করা হোক এবং এদের জন্য বরাদ্দের বাকিটা, অর্থাৎ, ২০ শতাংশও সরকারি কেন্দ্র থেকে টিকাদানের জন্য রাজ্য সরকারকে দেওয়া হোক। সরকারের রিপোর্ট থেকেই জানা যাচ্ছে, মে মাসে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে যে টিকা বিক্রি করা হয়েছিল তার ৫০ শতাংশই হস্তগত করেছিল সারা দেশের মাত্র ৯টা কর্পোরেট চালিত হাসপাতাল এবং বাকি ৫০ শতাংশ কিনেছিল ৩০০টা ছোট বেসরকারি হাসপাতাল। দেখা যাচ্ছে, মোদী সরকারের ‘উদারিকৃত টিকা নীতি’ যেমন টিকা প্রস্তুকারক কর্পোরেট কোম্পানিগুলো এবং গুটিকয়েক কর্পোরেট চালিত বেসরকারি হাসপাতালের জন্য বিপুল লাভ এনে দেবে, তেমনি সরকারি টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে টিকার আকাল সৃষ্টি করে সাধারণ জনগণকে টিকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবে। এরই সাথে শহরাঞ্চলের ধনীরাও লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা এড়িয়ে অনায়াসে ও দ্রুত টিকা নিতে পারবেন। সরকার গৃহীত টিকা নীতির মধ্যেই এইভাবে অন্তর্নিহিত বৈষম্য ও বিভেদের সুনির্দিষ্ট আয়োজন। কাজেই দাবি উঠেছে — সরকারের টিকা নীতি কর্পোরেট স্বার্থমুখী হওয়ার বদলে গণমুখী হতে হবে, উৎপাদিত ও আমদানিকৃত টিকার ১০০ শতাংশই সরকারকে নিজের হাতে নিয়ে বিনামূল্যে আপামর জনসাধারণের টিকাকরণ অভিযানে লাগাতে হবে। সর্বজনীন টিকাকরণের জন্য এটা যে অপরিহার্য তার স্বতঃসিদ্ধতা নিয়ে বোধকরি কেউ প্রশ্ন তুলবেন না। পোলিও, গুটিবসন্ত এবং অন্যান্য টিকার ক্ষেত্রে যে ধারা অনুসৃত হয়েছে, বিনামূল্যে সর্বজনীন টিকাকরণের যে দায়িত্ব সরকার পালন করে এসেছে, আজ তার থেকে বিচ্যুত হয়ে টিকা নীতিকে ‘উদারিকৃত’ করার কোনো যুক্তিগ্ৰাহ্য বিবেচনা থাকতে পারে না।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-28
সংখ্যা-25