কোটি কোটি মানুষের লাইফ লাইন লোকাল ট্রেন চালু করুক রাজ্য সরকার
should start local train service

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন রেলমন্ত্রক ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু তৃণমূল তখনো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায়। রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থলাভিষিক্ত হলেন ব্যারাকপুরের তৎকালীন তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী। তিনি পেশ করলেন পরবর্তী রেলবাজেট। আর তারপরেই ঘটল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ইউপি মন্ত্রীসভার অন্যান্য শরিকেরা সেই রেল বাজেটকে অভিনন্দন জানালো, কিন্তু মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে তৃণমূল সেই বাজেটকে ভাড়া বৃদ্ধির কারণে পুরোপুরি নাকচ করে দিল। এত তীব্র ছিল নিজেদের মন্ত্রীর বাজেটের বিরুদ্ধে সেই প্রতিবাদ যে দীনেশকে রেলমন্ত্রক থেকে সরে যেতে হল, নতুন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়ের হাত ধরে নতুন সাজে রেলবাজেট পাশ হল। ভাড়া বাড়ল না।

রেলের নিরাপত্তা, যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য, আধুনিকতার খাতিরে অনেকেই বলতেন রেলের ভাড়া বৃদ্ধির কথা। লালুপ্রসাদের জমানাতে এর আগে রেলে দীর্ঘদিন জেনারেল বা স্লিপার ক্লাসে ভাড়া বাড়েনি, অথচ খরচ বেড়েছে ক্রমাগত। তাই ভাড়া বৃদ্ধি করে ‘রেলের উন্নয়ন’এর জন্য সওয়াল করছিলেন একদল মানুষ। বিপরীতে অন্য একটি মতও ছিল প্রবল। ভারতের মতো গরিব দেশে রেল, তার সাধারণ কামরাগুলি হল গণপরিবহনের লাইফ লাইন। তার ভাড়া বৃদ্ধির অর্থ দেশের কোটি কোটি মানুষের ওপর চাপ বাড়ানো। রেলকে ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির বাইরে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে দেখে ভাড়া না বাড়িয়েই তার সুযোগ সুবিধে বাড়ানোর পক্ষে সওয়াল ছিল এই পক্ষের। অনেক তর্জা চলেছিল অনেকদিন ধরে, কিন্তু সকলেই মেনে নিয়েছিলেন যে রেল হল ভারতের লাইফ লাইন। তাকে ঘিরে যে নীতিমালা তা সরাসরি ভারতের কোটি কোটি মানুষের প্রতিদিনের জীবন জীবিকা ও স্বার্থের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত।

আরো বছর দু’তিন যদি পিছিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে আমরা দেখব ২০০৯ সালে লোকসভায় বিপুল বিজয়ের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কেন্দ্রের রেলমন্ত্রী হলেন, তখন তার রেল বাজেটগুলির মুখ্য অভিমুখ ছিল ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গের বিরাট সংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য পরপর কয়েকটি রেল বাজেটে নানা রেল কারখানা, হাসপাতাল, স্কুল, নার্সিং কলেজ ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের জন্য একগুচ্ছ নতুন ট্রেনের কথাই শুধু সেখানে এল না, এল নতুন নতুন মেট্রো প্রকল্পের কথা। তাই নিয়ে বিপুল আগ্রহও তৈরি হল মানুষের মধ্যে। এমনকি মেট্রো তৈরি শুরু হবার ঢের আগেই প্রস্তাবিত মেট্রো রুটগুলির আশেপাশের জমি বাড়ি আবাসনের দাম বাড়ল হু হু করে। বোঝা গেল শহর মফস্বলের গণপরিবহণের ক্ষেত্রে মেট্রো রেলের কি বিপুল চাহিদা। গত এক দশকে নানা রাজ্য রাজধানী সহ দেশের বড় বড় অনেক শহরেই মেট্রো রেল চালু হয়েছে এবং সেগুলিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

এই অতীতচারিতা কেন? শুধু জানা কথাটাকেই আরো একবার সামনে আনার জন্য যে ট্রেন বা মেট্রো রেল হল ভারতের লাইফ লাইন। কোটি কোটি মানুষের জীবন যাপনের সঙ্গে তা সরাসরি সম্পর্কিত। লোকাল রেল ও মেট্রো আমাদের রাজ্যে এখন অনেকদিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে রাজ্য সরকারের কোভিড বিধিনিষেধের কারণে। এই নীতির বিরুদ্ধে মানুষ ক্রমশ সরব হচ্ছেন, প্রতিবাদে নামছেন। নানা মহল থেকে লোকাল ট্রেন ও মেট্রো চালুর জন্য রাজ্য সরকারের কাছে নিয়মিত আবেদন জানানো হচ্ছে। কিন্তু সরকার এখনো তাতে কর্ণপাত করছেন না।

ক্রমশ অফিস কাছারি সবই খুলেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাওই কিছু তেমন বন্ধ নেই, মানুষকে কাজের প্রয়োজনে যাতায়াত করতে হচ্ছে প্রতিদিন। অথচ এই যাতায়াতের প্রধান অবলম্বনগুলিই বন্ধ হয়ে আছে। রাজ্য সরকার ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে অটো বাস চালানোর কথা বলেছেন। এই নির্দেশিকার বাস্তব বিপরীতটি কি? কয়েকটি রুটের বাসে এমন ভিড় হচ্ছে যে পাদানিতে পর্যন্ত দাঁড়াবার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। স্টাফ স্পেশাল নামে যে নামমাত্র কয়েকটি ট্রেন চলছে তাতে গাদাগাদি ভীড়, অধিকাংশ মানুষ উঠতেই পারছেন না। অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ববৃদ্ধির যে কারণ দেখিয়ে লোকাল ট্রেন ও মেট্রো বন্ধ রাখা হয়েছে, কার্যক্ষেত্রে বাস ও স্টাফ স্পেশালের মারাত্মক ভীড় তাকে হাস্যকর জায়গায় নামিয়ে আনছে। অন্যদিকে এগুলি যেহেতু লোকাল ট্রেন ও মেট্রোর যাত্রীদের সামান্য এক ভগ্নাংশকেই কেবল বহন করতে পারে, তাই এগুলি যা চলছে তা দিয়ে প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা এক হাস্যকর অবাস্তব পরিকল্পনা। এমনিতেই এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে আমাদের গণপরিবহন যথেষ্ট দুর্বল। মেট্রো ও মূলত লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকায় তা এক গভীর সঙ্কটে পড়েছে।

government should start local train

 

একটি বাস্তব অবস্থার কথা বিবেচনা করা যাক। ধরা যাক নৈহাটির একটি পরিবারের কোনও একজন কেউ মেডিকেল কলেজ বা পিজি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বা ধর্মতলা চত্বরে কেউ অফিসে আসবেন নৈহাটি থেকে। এইবারে নৈহাটি থেকে তিনি মেডিকেল কলেজ বা পিজি বা ধর্মতলায় আগে কীভাবে পৌঁছতেন আর এখনই বা কীভাবে পৌঁছবেন? কতটা বেশি সময় লাগবে আর অর্থই বা কতটা বেশি খরচ হবে?

আগে নৈহাটি থেকে একজন শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে যেতেন কমবেশি একঘন্টায়। সেখান থেকে হেঁটে মেডিকেল কলেজ বা বাসে ধর্মতলা যেতে তার সময় লাগত আরো মিনিট পনেরো। পিজি হলে সেটা হয়ত আরো দশ মিনিট বেশি। খরচ হত ট্রেনে দশ টাকা আর বাসে আরো দশ বারো টাকা। তাঁর কাছে আরেকটা বিকল্প ছিল ট্রেনে দমদমে এসে সেখান থেকে মেট্রোয় একেবারে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া। তাতে খরচ আরো পাঁচ দশ টাকা বাড়লেও সময়ের সাশ্রয় হতো অনেকখানি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে এই পথটুকু বাস আর অটো মিলে পেরোতে তার সময় লাগবে কম করে তিন ঘন্টা। একটানা আসার সুযোগ তেমন নেই। বেশ কয়েকবার ভেঙে ভেঙে আসতে হবে। খরচ বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে। সেটা হিসেব করে ওঠাই বেশ কঠিন। তবে পাঁচগুণ বা দশগুণ হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। ওলা উবের জাতীয় অ্যাপ ক্যাবের সাহায্য নিতে হলে তো আর কথাই নেই। ট্রেন না চলায় ভীড় যে বাসগুলিতে কেমন হবে, ফিজিক্যাল ডিসটেন্সিং কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে – তা সহজেই অনুমেয়।

এই যে উদাহরণটি এখানে দেওয়া হল সেই যাত্রাপথটি কিন্তু কোনও কল্পিত উদাহরণ নয়। বেশ কয়েক হাজার মানুষের দৈন্যন্দিন বাস্তবতা। নৈহাটির জায়গায় বনগাঁ, বসিরহাট, বজবজ বা বারাসাত করে নিলেও বাস্তবতাটা একই রকম সমস্যা জনক থাকবে।

এরসঙ্গেই যদি যোগ করে নেওয়া যায় ট্রেন চললে স্টেশন চত্বর ও তার আশপাশ ঘিরে চলা নানা ব্যবসা, অটো, টোটো, রিক্সা ইত্যাদি পরিবহণ বা রেল হকারদের কথাটা – তাহলে লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকার ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়ের আরো বেশ কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি নজর পড়ে। লোকাল ট্রেন না চলায় এইসব পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা কতটা সঙ্কটে, রেলের নিত্যযাত্রী না হয়েও তারা কতটা হাহুতাশ করছেন ট্রেন চলছে না বলে আর দুশ্চিন্তা নিয়ে রোজ খবর নিচ্ছেন ট্রেন কবে চলবে – তা তাদের সঙ্গে কথা বললেই টের পাওয়া যাবে স্পষ্টভাবে।

রাজ্য সরকারের কাছে এই সমস্ত খবর নেই তা নয়। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও তারা প্রতি পনেরো দিন অন্তর যে নতুন নতুন নির্দেশিকা দিচ্ছেন, তাতে লোকাল ট্রেন আর মেট্রো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে অনড় থাকছেন। একদিকে তারা দুয়ারে সরকার কর্মসূচির কথা বলেন, মানুষের পাশে থাকায় তাদের অঙ্গীকার বোঝাতে চান। অন্যদিকে মানুষের অন্যতম চাহিদা ও দাবিকে তারা উপেক্ষা করে চলছেন। তাদের বোঝা দরকার গণপরিবহনের লাইফ লাইন বন্ধ রেখে মানুষকে সুরাহা দেওয়া সম্ভব নয়।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-28
সংখ্যা-25