নির্বাচনের পরে বাংলা ভাগের একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একটা কেন, বলা উচিত কয়েকটা। উত্তর থেকে আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ জন বার্লা আওয়াজ তুলেছেন উত্তরবঙ্গকে আলাদা করতে হবে। বিষ্ণুপুর থেকে পদ্মফুলের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ ডাক তুলেছেন আলাদা রাঢ়বঙ্গ গঠনের। কেউ নাম দিচ্ছেন জঙ্গলমহল। এগুলো আলাদা রাজ্য হবে নাকি কেন্দ্রশাসিত এলাকা হবে, ঠিক কোন কোন এলাকা নিয়ে হবে, এসব এখনও অস্পষ্ট। যেটা স্পষ্ট সেটা হলো বিজেপি বাংলাকে ভাগ করতে চায়। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপবাবু অবশ্য বলছেন, এটা দলের অ্যাজেন্ডা নয়। কিছু সাংসদ ও নেতার ‘ব্যক্তিগত মত’।
দলের অ্যাজেন্ডা নয়, অথচ দলের নেতারা এই দাবিগুলো নিয়ে বাজার গরম করছেন আর দল কিছু বলছে না, এই রাজনীতিটা মানুষ বোঝে। এর মানে হচ্ছে এই প্রশ্নগুলো বাজারে ছেড়ে দেওয়া, দেখা যাক এর কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, আর এই দাবিগুলো নিয়ে রাজ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করা, সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করা। পদ্ধতি যাই হোক, যেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তা হল এই বুদ্ধিটা এসেছে নির্বাচনের পরে। এই দাবিগুলো যদি বিজেপির কাছে সত্যি আশু জরুরি দাবি হত তাহলে দলের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে তা স্থান পেত। এই দাবিগুলো তুলেই বিজেপি ভোট চাইত। তা মোটেই হয়নি। নির্বাচনে বিজেপি জিতে গেলে এই দাবিগুলো যে এখন মোটেও উঠত না সেটাও বোঝা কঠিন নয়।
নতুন নতুন রাজ্য গঠনের দাবি বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি কিন্তু আমাদের দেশে বা রাজ্যে নতুন নয়। দাবিগুলোর পেছনে যে কোন ভিত্তি নেই তাও নয়। গোর্খাল্যান্ডের দাবি দীর্ঘদিনের। সেখানে সবার আগে আছে নেপালী ভাষার প্রশ্ন। কামতাপুরী ভাষা বা রাজবংশী সামাজিক পরিচিতির ভিত্তিতে রাজ্য বা স্বায়ত্তশাসনের দাবিও বিগত দু’তিন দশক ধরে উঠে আসছে। গোটা উত্তরবঙ্গ জুড়ে রয়েছে আঞ্চলিক বৈষম্যের অভিযোগ। বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার আদিবাসী জনগণের কাছে ভাষা সংস্কৃতি ছাড়াও রয়েছে উন্নয়নের ক্ষেত্রে উপেক্ষা ও বঞ্চনার প্রশ্ন। কিন্তু এই মুহূর্তে বিজেপির এই দাবির পেছনে রয়েছে নির্বাচনের ফলাফল। এই অঞ্চলে নিজের সাফল্যকে সংহত করতেই বিজেপির এই নির্বাচনোত্তর রণকৌশল।
এই সব প্রশ্ন শুধু পশ্চিমবঙ্গে নেই, গোটা দেশ জুড়েই রয়েছে। সুষম উন্নয়ন ও এত বড় দেশের বিবিধতা ও বৈচিত্র্যের পূর্ণ সম্মান ও সমন্বয়ের জন্য নতুন রাজ্য গঠন ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে তাই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয় একটি রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন এই ব্যাপারে ব্যাপক অধ্যয়ন ও মতামত সংগ্রহের ভিত্তিতে কোনো প্রস্তাব অবশ্যই দিতে পারে। কিন্তু বিজেপি এই আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজন থেকে উঠে আসা দাবিগুলো নিয়ে ক্ষমতার রাজনীতির খেলা খেলছে। ওদের কাছে মূল লক্ষ্য হল কেন্দ্রের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত এলাকাগুলোকে কেন্দ্রের উপনিবেশ বানিয়ে দেওয়া।
দু’বছর আগে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকার হরণের মাধ্যমে আমরা এই ক্ষমতা কেন্দ্রিকরণের আগ্রাসী রূপ দেখতে পাই। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে রাতারাতি একটা রাজ্যকে দুটো কেন্দ্রশাসিত এলাকা বানিয়ে দেওয়া হল। দিল্লীতে নির্বাচিত সরকার থাকলেও রাজ্যের অধিকার ছেঁটে দিয়ে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের হাতে সব ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। পুদুচেরিতে গভর্নরের হস্তক্ষেপ বাড়াতে বাড়াতে সেখানে এখন বিজেপি সরকার চলে এসেছে। আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্য লাক্ষাদ্বীপ। উত্তরপ্রদেশেও নির্বাচনের আগে রাজ্য ভাগের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। গোটা দেশটাকে ছোট ছোট রাজ্য ও বেশ কিছু কেন্দ্রশাসিত এলাকায় ভাগ করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বদলে স্থায়ী কেন্দ্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতিশাসিত প্রণালী প্রবর্তন বিজেপি-আরএসএস বাহিনীর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
বাংলার মাটিতে অবশ্যই ক্ষমতার আরও বেশি বিকেন্দ্রীকরণ চাই। উন্নয়নের প্রশ্নে আঞ্চলিক বৈষম্যের অবসান চাই। বাংলার পাশাপাশি নেপালী, সাঁওতালি ও অন্যান্য ভাষা ও সংস্কৃতির পর্যাপ্ত সংবর্ধন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা চাই। বাংলার মাটিতে বন অধিকার আইন ও পঞ্চম তফসিল প্রয়োগের সম্ভাব্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে। দ্বিতীয় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করে দেশের অন্যান্য রাজ্যের সাথে পশ্চিমবঙ্গেও প্রয়োজনীয় পুনর্গঠনের প্রয়োজন ও সম্ভাবনা নিয়েও কথা হতেই পারে। কিন্তু বিজেপির বাংলা ভাগের দুরভিসন্ধিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আর শুধু বাংলা ভাগের চক্রান্ত নয়, ব্যর্থ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংসদীয় প্রণালীকে বদলে ফেলার যাবতীয় চক্রান্ত।
- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য