ভারতের অবস্থা এখন ত্রাহি ত্রাহি। কর্মহীনতাও বাড়ছে, বেঁচে থাকার উপকরণের নাগাল না-পাওয়ার যন্ত্রণাও বাড়ছে, কারণ সবকিছুই এখন অগ্নিমূল্যের। গত দেড় বছর যাবত গোটা বিশ্ব, ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, কোনোটাই আর আগের মতো চলছে না। কারণটা অভিন্ন — কোভিডের সর্বনাশা হানা। তবু বিশ্বের অধিকাংশ দেশ কোভিডের সার্বিক প্রকোপ মোকাবিলার মত ও পথ খুঁজে নিতে লড়ছে, সাফল্যও পেয়ে চলছে। বিপরীতে কিছু দেশ কেবল দেখিয়ে চলছে ব্যর্থতার ঘুরপাক খাওয়ার অপদার্থতা। এই তালিকায় নিঃসন্দেহে ভারতের স্থান সবার উপরে। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নির্মাণের মোদী নিনাদ উন্মোচিত হচ্ছে বুলি সর্বস্ব হিসেবে। চূড়ান্ত মতিভ্রম আর নিষ্ঠুর মানবতাবিরোধী কাকে বলে বাস্তবে সেই বার্তাই বাকি বিশ্বকে জানান দিচ্ছে ভারত সরকার। ভারত এখন কোভিডের শবদেহ মাটি চাপা কিংবা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া ‘গণতান্ত্রিক’ দেশ! শুধু কি তাই! এখানে শাসকের ক্ষমতায় পথের বাধা মনে করলে নৃশংসতার কোনও সীমা রাখা হয় না। সেই নাগরিক সত্তাকে ইচ্ছে মতো লাশ বানিয়ে দেওয়া হয় মাঠে-ঘাটে-রাষ্ট্রীয় হেফাজতে! ‘সন্ত্রাসবাদী’, ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’, ‘দেশ বিরোধী’, ‘জাতীয়তা বিরোধী’ তকমা সেঁটে দিলেই হয়।
কোভিড চলমান জনজীবনে এখন এক ভয়ঙ্কর পরিণাম। দ্বিতীয় ঢেউ থেমে যাওয়ার লক্ষণ এখনও অদেখা। তার মধ্যেই আবার উঁকি মারছে তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা। সর্বোপরি শাসক পক্ষের নির্মম নীতিহীনতার কারণে সমাজদেহে সবদিক থেকেই এখন করোনার সর্বনাশ। আবার এই পরিস্থিতিই ভারতীয় কর্পোরেট শ্রেণীর কাছে চরম মুনাফা কামিয়ে নেওয়ার পৌষমাস। সেটাও কেন্দ্রের অকৃপণ সহযোগিতায়। এ জন্য অতিমারী জনিত কোনও কর বসায়নি কেন্দ্র। এই যাতনাময় জীবনে আর্থজীবন ও কর্মজীবন কীভাবে আটকে যাচ্ছে, তার সমাধানের দাবিতে চর্চা হওয়া দরকার।
এযাবত বহু দাবি ও সুপারিশ সত্ত্বেও কেন্দ্র কাজ হারা শ্রমজীবী মানুষের জন্য অতিমারী অবস্থায় কোনও নগদ আর্থিক সাহায্য দেয়নি। অথচ কেন্দ্রের শাসক বাবুমশাইদের আমিরীতে বা রাজধানীর বুকে অহেতুক পুরাতন স্থাপত্যের ভাঙচুর করে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় তথাকথিত ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ নির্মাণে ঢালা হচ্ছে দেদার অর্থ। সরকার না করেছে সংকট জর্জরিত জনজীবনে — বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য জরুরি এক-দুকালীন আর্থিক অনুদানের পদক্ষেপ, না নিয়েছে কোভিড বিধি মানা সহ কর্মসংস্থান অব্যাহত রাখার ও নতুন নতুন কর্মপ্রকল্প প্রণয়ন করার গতিমুখ। কেবল রেশনে কিছু পরিমাণে চাল-ডাল বরাদ্দ সহ শেকল পরানো লক ডাউন কায়েম রেখে দিয়েছে।
লক ডাউন এখনও চলছে অঞ্চল ভিত্তিতে আংশিকভাবে। কিন্তু কর্মসংস্থান বা কাজের পরিবেশ পুনরুদ্ধার হওয়ার লক্ষণ বহুক্ষেত্রেই অনিশ্চিত, বাকি ক্ষেত্রে অত্যন্ত ধীর গতির। সবরকমের কাজের অবস্থাই গোলমেলে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ মোদীরাজ কায়েমের প্রথম পর্বে একটা গতিতে বেকারি বৃদ্ধি ঘটছিল। সেটা পূর্বতন মনমোহন আমলের তুলনায় বেশি হারে। কারণ, মোদীর হাতে উদারীকরণ-বিলগ্নীকরণ-বেসরকারিকরণের গতি অনেক বেড়ে যায়। ২০২০-তে কোভিড পর্ব শুরু হওয়ার পর কাজ বন্ধ, ছাঁটাই, কর্মসংকোচন, কর্মবিহীনতা, কাজের নিরাপত্তাহীনতা, কাজের সুযোগ ও পরিবেশের গুণগত আবশ্যিকতা এক ধাক্কায় ক্ষুণ্ণ হওয়া বহু মাত্রায় বেড়ে যায়।
সিএমআইই-র সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা বলছে, ২০২০-র এপ্রিল-মে থেকে ভারতে শ্রমের বাজার এখনও পর্যন্ত মারাত্মক উদ্বেগজনক। বেকারির হার ২০২১-এর মে মাস নাগাদ পৌঁছেছিল ১১.৯ শতাংশে। এবং এটা বেড়েই চলছে। শ্রমের বাজারে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার ২০২১-এর এপ্রিল-মে সময়ে হ্রাস পেয়ে পর্যবসিত হয়েছিল প্রথমে ৪০ শতাংশে, তারপরে হ্রাস পাওয়া কিঞ্চিৎ কমে দাঁড়ায় ৩৯.৭ শতাংশে। গত মে ও জুন মাসে শ্রমের অংশগ্রহণের হার থিতু হয় যথাক্রমে ৩৫.৩ ও ৩৪.৬ শতাংশে। সিএমআইই-র পর্যবেক্ষণ হল, ২০২০-তে অতিমারী প্রথমবার ধেয়ে আসার পর লক ডাউনের পরিণামে শ্রমের ক্ষেত্রগুলো ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। তারপরে করোনার প্রকোপ কমে আসার সাথে সাথে লক ডাউন শিথিল হয় এবং তার ফলে কাজের সুযোগ কিঞ্চিৎ পুনরুদ্ধার হয়। কিন্তু অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ আসায় কাজের সুযোগ আবার বেশ নষ্ট হয়। কাজ মার খায় সব ধরনের শ্রম ক্ষেত্রে। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অপ্রচলিত ক্ষেত্র অসংগঠিত ক্ষেত্র। যদিও লক ডাউন ফের শিথিল হওয়ার সাথে সাথে কাজের দিন আবার ফিরছে, তবু তার গতি এখনও বহু ধীর প্রকৃতির। ২০২১-এর জানুয়ারিতে মোট নন ফার্ম সেক্টরে কাজ চলে যায় ৩৬.৮ মিলিয়ন হাতের। এর মধ্যে দিন মজুরদের সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি, প্রায় ২৩.১ মিলিয়ন। বেতনপ্রাপক কর্মচারীর অংশ ছিল ৮.৫ মিলিয়ন। বাকি ভাগে রয়েছেন উৎপাদক সংস্থাসমূহের স্টাফেরা। শ্রম নিয়োগের ক্ষেত্রগুলো খুলতে থাকলেও ভারতীয় অর্থনীতির ২০১৯-২০-র অবস্থা পুনরুদ্ধার হওয়া বেশ কঠিন। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি প্রত্যাহার হয়ে গেলে লক ডাউন পর্বে চলে যাওয়া মোট কাজের দুই-তৃতীয়াংশ ফিরে পাওয়া সম্ভব হতে পারে।
গ্রাম ভারতে কোভিডের প্রথম ঝড় না পৌঁছানোয় কৃষি অ-কৃষি মিলে মোট শ্রমের ক্ষেত্র বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু জীবিকায় চাপ সৃষ্টি করেছিল লক ডাউনের কোপে কাজ খুইয়ে গ্রামাঞ্চলে ফিরে আসা আড়াই কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের ভীড়। এমএনআরইজিএ কাজে আবেদনকারীর সংখ্যা একলাফে তিন কোটিতে পৌঁছে যায়। কিন্তু সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণ নীতির চাপে প্রতি পাঁচজন পিছু এক-দুজনকে জব কার্ড দেওয়ার প্রশ্নে বঞ্চিত করা হতে থাকে। দাবি ওঠে পরিবার পিছু নয়, মাথা পিছু জব কার্ড দিতে হবে। তবু কেন্দ্র তার অবস্থান পাল্টায়নি। কেন্দ্র কোভিড পরিস্থিতির চাপে একদিকে রাজ্যগুলোকে বলছে এমএনআরইজিএ কাজে সংস্থান বাড়াতে, অন্যদিকে এই খাতে ২০২০-২১ আর্থিক বছরে প্রথমে যে পরিমাণ বরাদ্দ করেছিল, তারপরে তার আরও সত্তর শতাংশ বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কেন্দ্রের অবস্থানে ফের লক্ষ্য করা গেল অদ্ভুত পশ্চাদগামী প্রত্যাবর্তন। বরাদ্দ সংকোচন করে নিয়ে আসা হয় পূর্বাবস্থায়। এই আর্থিক বোঝা রাজ্যগুলোর ওপর চালান করে দেওয়ার অভিসন্ধি খুব স্পষ্ট। কর্মসংস্থানের জ্বলন্ত দাবিগুলো নিয়ে কেন্দ্রকে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া যায় না। একইসঙ্গে এইসমস্ত প্রশ্নে রাজ্য স্তরের সরকারকেও, যেমন পশ্চিমবাংলার মমতা সরকারকে গ্রামীণ ও শহুরে শ্রমজীবী স্বার্থ বিরোধী পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপোষণ, দলতন্ত্র চালাতে দেওয়া যায় না। সামনে আসছে দিন জোর লড়াইয়ের, প্রস্তুত হতে হবে গ্রাম ও নগরে।