পশ্চিমবাংলার গণরায়ে বিজেপি পরাজিত হয়েছে, তবে বাম-কংগ্রেস-শূন্য বিধানসভায় গেরুয়া পরিসর পেয়েছে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। নির্বাচনে হেরে গেলেও ঘরে-বাইরে, তার কর্মীদের ও মানুষের মধ্যে প্রভাব ধরে রাখতে মরীয়া। তাই তুলে ধরছে “অতীতের চেয়ে জনপ্রতিনিধিত্ব পঁচিশ গুণ বৃদ্ধি” হওয়ার ঘটনা। বিধানসভায় শুরু থেকেই বিরোধী দলের ভূমিকার সূচনা করল প্রতিবাদ, পদত্যাগ, ওয়াক আউট করে। তৃণমূল ভেঙ্গে বিজেপির বপু বাড়ানোর কারিগর নেতার বিজেপি’র টিকিটে জেতার পরে ঘটনাক্রমে পুনরায় তাঁর পুরানো দল তৃণমূলে ফিরে যাওয়া, তাঁর বিরুদ্ধে দলত্যাগ আইনে ব্যবস্থা নিতে অনুমোদন না দিয়ে স্পিকারের দিক থেকে সভাঘরে তাঁর বসার আসন গেরুয়া দলের সারিতেই রাখা, তৃণমূলের তরফে ওই নেতাকে পুরস্কৃত করতে পিএসি’র চেয়ারম্যান করে দেওয়া, বিজেপি এসব রেয়াত করতে নারাজ। সেটা বুঝিয়ে দিতে বিধানসভার নবগঠিত সবকটি স্ট্যান্ডিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন দলের নির্বাচিত বিধায়করা। উদ্দেশ্য হল, ‘সংঘাতের জন্য হাজির’ — এই বার্তা দেওয়া।
বিজেপির এবারের বাংলার নির্বাচনী বাজিগুলো বহলাংশে ব্যুমেরাং হয়েছে। দলের ভেতরে চলছে এখন হরেক রকমের অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিস্তর অন্তর্কলহ। দিল্লীর কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে নির্বাচনী অভিযান পরিচালনার ক্ষমতা চরম কুক্ষিগত হওয়া, তৃণমূল ছেড়ে আসা নেতাদের অতিরিক্ত মাথায় তোলা, দলের পুরানো কার্যকর্তা ও সংঘ শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নেতাদের তেমন জনপরিচিতি গড়ে না ওঠা দুরবস্থা, নির্বাচনে তাদের দায়দায়িত্ব বা টিকিট প্রদানে গুরুত্ব ছাঁটা, প্রাক্তন তৃণমূলী মোড়লদের নিয়ে বেশি মাতামাতি, এইসব প্রতিক্রিয়া নিয়ে ঘর জেরবার হচ্ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে। বিজেপি এবার ১৪৯টি আসনে প্রার্থী করেছিল অন্যান্য দল থেকে আসা, প্রধানত তৃণমূল থেকে যোগদান করা ‘কেউকেটা’দের। অন্যদিকে যে ৭৭টি আসন বিজেপির দখলে এসেছে তার ৬৮ জন বিধায়ক দলের আদি অংশের, বলাবাহুল্য, আরএসএস অনুগত। তবে এই জেতাদের মধ্যে দলের প্রথম সারির আদি রাজ্য নেতাদের একজনও নেই। ফলাফলের এই চেহারা এবং ‘মুকুলাংশের’ তৃণমূলে ফেরার প্রবণতা বিজেপির হাতে ধরিয়ে দিয়েছে তৃণমূল ভাঙিয়ে চমকপ্রদ দ্রুত ফায়দা লোটার অসারতা। বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা নির্বাচন যেভাবে করা হল তা নিয়েও দলের ভেতরে দলবাজি থাকবে। বহিরঙ্গে যতই সদাশয় ‘অটুট’ ভাব দেখানো হোক যা করা হয়েছে তা একান্তই বাধ্য হয়ে। কারণ সংঘ পরিবারের প্রতি আনুগত্যের দীর্ঘ পটভূমি থাকা ছাড়া বিজেপির প্রধান প্রধান পদে স্থান সচরাচর হয় না।
বিজেপি বাংলার নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে শুধু নয়, এরফলে বাকি ভারতে তার দম্ভ আগ্রাসন ঘা খেয়েছে, উপরন্তু লাগাতার অন্তর্দ্বন্দ্বের জ্বলুনিতে জ্বলছে। ফলে যেরকম শক্তিমত্তায় আগ্রাসী হয়ে চলছিল তাকে এখন ধাক্কা সামাল দিতে হচ্ছে। তবে তার মানে এই নয় যে এই বেসামাল অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোর হাল ছেড়ে দিয়েছে। বরং চেষ্টা করছে ক্রমশ ঘুরে দাঁড়ানোর।
তারজন্য সবচেয়ে জোর দেওয়ার ইস্যু পাকিয়েছে নির্বাচন পরবর্তী তৃণমূলের সন্ত্রাসকে। রাজ্যপাল আর কেন্দ্র তার বিশেষ দুই হাতিয়ার। দলের প্রতিনিধিবর্গ ও বিধায়কবর্গের রাজ্যপালের কাছে ঘনঘন হত্যে দেওয়া, রাজ্যপালের অনবরত গণতন্ত্র ‘গেল গেল’ রব তোলা, প্রচলিত সংখ্যাগত বিধিনিষেধের নিয়ম ভেঙে রাজভবনে বিজেপি বিধায়কপালকে স্বাগত জানানো — এসব চলছেই। সেইসঙ্গে কেন্দ্রে মন্ত্রীসভা রদবদলের যে পদক্ষেপ করা হল তাতেও বাংলার জন্য পরবর্তী নিশানার সংকেত খুব স্পষ্ট। বাংলার দুজন মন্ত্রীকে বিদায় দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে নতুন চারজনকে। বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য হল, উত্তরে জনজাতি ভোট, দক্ষিণ জঙ্গলমহল সংলগ্ন আদিবাসী ভোট, বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে মতুয়া ভোট।
এপ্রসঙ্গে বিচার করা হয়েছে ২০১৯’র লোকসভা নির্বাচনে বিধানসভা ভিত্তিক এগিয়ে থাকা আসনগুলির মধ্যে ২০২১’র বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের আসনগুলিকে। অগ্রাধিকার দেওয়া হল সেইমতো অঞ্চলভিত্তিক মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্তিকরণে। বিজেপি জিতেছে উত্তরবঙ্গে ৫৪টির মধ্যে ৩০টি আসনে, আর দক্ষিণবঙ্গে ২৪০টির মধ্যে ৪৭টি আসনে। সবচেয়ে ঘনীভূত জয় এসেছে উত্তরের আট জেলায়। আর দক্ষিণবঙ্গে জিতেছে বিশেষত জঙ্গলমহল সমেত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলাগুলির কেন্দ্রগুলিতে। তাই এই অঞ্চল সমূহকে ভিত্তি করে নতুন করে বিস্তারের ঘুঁটি সাজাতে চাইছে। প্রচারের মালমশলাও বানাচ্ছে।
সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে সন্ত্রাসের ইস্যুকে। তার সাথে জোড়া হচ্ছে দুরকম পরিকল্পনা। একদিকে ‘হিন্দুত্বের’ ভাবধারাকে বাংলার ইতিহাস-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ মাথায় রেখে ‘বাংলার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন’ করে তোলা, বিগত নির্বাচনী প্রচারে বাংলার জাতীয়তাবাদের পরম্পরাকে ‘খন্ড জাতীয়তাবাদ’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার অবস্থান পাল্টে নেওয়া, বাংলার জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যের সাথে বিজেপির জাতিয়তাবাদের ছদ্ম সংযোগ স্থাপনে প্রয়াসী হওয়া; অন্যদিকে পুরো বাংলার দখল যখন এযাত্রা এল না তখন যেসব অঞ্চল আসন লাভের নিরীখে নিবিড় দখলে এসেছে সেক্ষেত্রে তলায় তলায় কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত ‘বঙ্গভঙ্গ’র রব তোলা বাজিয়ে দেখা — এসব ছক কষাও হচ্ছে। নতুন করে উস্কে দেওয়া হচ্ছে যা আদতে ‘ইস্যু’ হওয়ার নয়, সেই ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্ব প্রদানের ইস্যুকে। বলা হচ্ছে, যেহেতু বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারেনি, এসেছে তৃণমূল, তাই সিএএ রূপায়ণ নির্ভর করছে মমতা সরকারের ওপর। এর সাথে নির্বিচারে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে বিদ্বেষের বিষ মাখানো আরও কিছু বিষয়কে। তদন্তের পরোয়া না করে বা তদন্তকে প্রভাবিত করতে কিছু ঘটনাকে পুঁজি করে রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে অনেককিছু। প্রচার করা হচ্ছে বাংলা হল মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের আঁতুরঘর, ঘাঁটি, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাসবাদী অনুপ্রবেশের আন্তর্জাতিক করিডোর!!!
বিজেপি হাইকমান্ড এভাবেই নতুন করে থাবা বাড়ানোর ছক কষছে। এজন্যে তাদের জাতীয় স্তরের ‘বঙ্গাল’ ভারপ্রাপ্ত মন্ডলীর অদল-বদল ঘটাতে শুরু করে দিয়েছে। একইসাথে আরএসএস’ও হাত লাগিয়েছে বাংলার দায়-দায়িত্ব পুনর্বিন্যাসের কাজে। আসছে সংঘ নেতাদের এমন এক টিম যার নেতৃত্বে রয়েছেন নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয় ভাগে বাংলায় ‘বিশেষ প্রচারক’ হিসেবে পোড় খাওয়া এক নেতা। এই পদক্ষেপ করা হয়েছে অতি সম্প্রতি সংঘ নেতৃমন্ডলীর চিত্রকূটের পাঁচ দিনব্যাপী সভা থেকে।
পশ্চিমবাংলায় সামনে হওয়ার কথা বেশ কয়েকটি বিধানসভা উপনির্বাচন। তারপরে পৌরসভা নির্বাচন। ২০২৩-এ পঞ্চায়েত নির্বাচন, ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচন। স্বভাবতই বিজেপি বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।
এর মোকাবিলায় তাই এতটুকু শিথিলতা দেখানো চলবে না।