বিবৃতি
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শতবার্ষিকীতে সিপিআই(এমএল)-এর বিবৃতি
Centenary of Communist Party of China

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) বিপ্লবী পরম্পরাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। মাও সেতুঙ-এর অনুপ্রেরণাময় নেতৃত্ব ও সিপিসি’র পরিচালনায়, চীনের বীর জনগণ, সিপিসি’র জন্মের মাত্র আটাশ বছরের মধ্যেই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেছেন এবং এর পরে সাত বছরের ব্যবধানে এক অনগ্রসর কৃষিপ্রধান সমাজের বুনিয়াদী সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন।

সামন্তপ্রভু, বৃহৎ বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের আধিপত্য থেকে বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশের মুক্তি সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে এবং বিশেষত ভারতের মতো ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলির জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে প্রভূত উদ্দীপনা সঞ্চার করেছে। মহান তেলেঙ্গানা সংগ্রাম ও পরবর্তীতে নকশালবাড়ী আন্দোলনে চীনের সশস্ত্র কৃষিবিপ্লব ছিল অনুপ্রেরণার এক বৃহৎ উৎস। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিনগুলিতে আন্তর্জাতিক মহা বিতর্কের সময় বিশ্বজুড়ে আধুনিক সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের সিপিসি নেতৃত্ব প্রদান করেছে এবং তা ভারতে সিপিআই(এমএল)-এর উদ্ভবে বড়মাত্রায় অবদান জুগিয়েছে।

১৯৪৭-এ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর ভারতের যাত্রাপথের সঙ্গে ১৯৪৯এ (স্বাধীনতা অর্জনের) চীনের যাত্রাপথের তুলনার মাধ্যমে, আমরা চীন বিপ্লবের সম্পূর্ণ তাৎপর্যকে হয়ত উপলব্ধি করতে পারি। জীবনযাত্রার মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জননী ও শিশুমৃত্যুর হার সমেত সমাজ কল্যানের অধিকাংশ সূচকের নিরিখে চীন ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে এবং এই বাস্তবতাকে কেবলমাত্র এভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় যে, বিপ্লবী চীন তার প্রগতির জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক আমূল রূপান্তরের পদক্ষেপগুলির মধ্যে ভিত্তি স্থাপন করেছে যার বিপরীতে ভারতীয় মডেল নির্ভর করেছে সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের সঙ্গে সমঝোতা ও একচেটিয়া বেসরকারি পুঁজি ও বিদেশী কর্পোরেশনগুলিকে তোষণের উপর।

এই সমস্ত বিপ্লবী সাফল্য ও অবদানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার পাশাপাশি আমরা বিগত কয়েক দশকে কিছু অস্বস্তিকর প্রবণতা ও বিকাশ সম্পর্কে আমাদের উদ্বেগ ধ্বনিত করাকে আমাদের কর্তব্য বলেই মনে করি।

সমাজতান্ত্রিক আধুনিকীকরণ, চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক বাজার অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সিপিসি’র রেকর্ড কেবলমাত্র তার বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে জায়গা করে নেওয়ার চমকপ্রদ অর্থনৈতিক বিকাশ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে দুস্তর অগ্রগতিকেই সূচিত করে না বরং ক্রমবর্ধমান সামাজিক, আঞ্চলিক ও লিঙ্গ বৈষম্য, বেড়ে ওঠা ক্রোনিতন্ত্র ও দুর্নীতি, মতাদর্শগত-সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এবং প্রতিবাদী স্বরের নির্মম দমনকেও সূচিত করে।

২০১৭-র অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সিপিসি’র ১৯তম কংগ্রেস বা সাম্প্রতিক শতবার্ষিকী উদযাপনকালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর ভাষণে অনুসৃত পথের ভুলগুলি, বিশেষত ব্যক্তি বা সমষ্টিগত প্রতিবাদ, তিব্বত ও শিনজিয়াঙ অঞ্চলের জাতিসত্তা আন্দোলন তথা হংকং ও ম্যাকাও-এর স্বায়ত্ত শাসন আন্দোলন এবং উইঘুর মুসলিম সংখ্যালঘু জনগণের সমস্যায় পার্টির পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে ভুল শুধরে নেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা লক্ষিত হয় না। কড়া রাষ্ট্রীয় নজরদারির ক্রমবর্ধমান বিস্তারও আর এক উদ্বেগের বিষয়।

প্রেসিডেন্ট শি’র বক্তৃতায় ‘পার্টির নেতৃত্ব’, নির্দিষ্টভাবে ‘পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ও সামগ্রিকভাবে পার্টিতে সাধারণ সম্পাদকের মৌলিক অবস্থান’, সাথে সাথে ‘নেতৃত্বের কেন্দ্রকে অনুসরণ করা এবং কেন্দ্রীয় পার্টি নেতৃত্বের সাথে সারিবদ্ধ হওয়া’কে ‘চীনা চরিত্র সম্পন্ন সমাজতন্ত্রের নির্ধারক বৈশিষ্ট্য’ বলে বর্ণিত হয়েছে। এটি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতির থেকে একপ্রকার বিচ্যুতি কেননা সেখানে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকাকে এইভাবে মহিমান্বিত করা হয়না বা সেখানে দেশ বা রাষ্ট্রকে পার্টির সমার্থক ভাবা হয়না। উৎপাদনের উপকরণসমূহ ও শ্রমের উপর প্রত্যক্ষ উৎপাদকদের (শ্রমিক-কৃষকদের) নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করাই হতে পারে সমাজতন্ত্রের একমাত্র পরশ পাথর।

শি জিনপিং-এর ভাষণের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হল জাতীয় পুনরুজ্জীবন যা যথেষ্ট সদর্থক, কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, যে প্রশ্নগুলি নিয়ে প্রত্যেকের প্রত্যাশা ছিল তার প্রতিফলন ঘটল না, যেমন: চীন ও বিশ্বজুড়ে শ্রমিক ও জনগণের পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সংহতির কোন অভিব্যক্তি; সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি দায়বদ্ধতা, বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহীদের বিরুদ্ধে অগণিত গণআন্দোলনে ঐক্য স্থাপনের কোন আহ্বান। স্পষ্টতই, প্রেসিডেন্ট শি’র ভাষণে ঘটনাক্রমে যার উৎপত্তি চীন থেকেই — সেই চলমান কোভিড অতিমারী জনিত সুদূর প্রসারী সংকটের বিষয়টিও অনুচ্চারিত থেকে গেছে।

সিপিসি’র বিপ্লবী ঐতিহ্যকে অভিনন্দন জানানোর সাথে সাথে অর্থবহ সমাজতান্ত্রিক অগ্রগতি সাধন ও চীনের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য এবং স্থায়ী বিশ্বশান্তি ও এক সমতাপূর্ণ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার লক্ষ্যে চীনা জনগণ ও চীনা কমিউনিস্টদের প্রতি আমরা উষ্ণ আকাঙ্খা পোষণ করি। ভারত ও চীন – দুই দেশের ও জনগণের মৈত্রী ও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতাকে আমরা উর্দ্ধে তুলে ধরি।

- কেন্দ্রীয় কমিটি
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)

খণ্ড-28
সংখ্যা-25