মানুষ হয়রান হচ্ছে ভ্যাকসিনের জন্য। কেন্দ্রের মর্জি-মাতব্বরিতে এক ধরনের ভ্যাকসিন প্রতারণা চলছে, রাজ্যের চাহিদার তীব্রতা ও ব্যাপক জনসংখ্যা অনুপাতে সরবরাহ মিলছে অত্যন্ত ঢিমেতালে এবং বহু কম পরিমাণে। তার ওপর আরেক ধরনের ভ্যাকসিন প্রতারণা হাতে-নাতে ধরা পড়ল, ঘটেছে একাধিক ভূয়ো ভ্যাকসিন শিবির থেকে কয়েকশো মানুষকে ভূয়ো ভ্যাকসিন দিয়ে দেওয়ার ঘটনা। নাটের গুরুটি নামেও ‘দেবাঞ্জন’, আর ওস্তাদী দেখানোর ক্ষমতাও রপ্ত করেছিলেন মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো! নিজেকে পরিচিত করাতেন কলকাতা কর্পোরেশনের এক ‘যুগ্ম কমিশনার’! হয়ে উঠেছিলেন হরেক লেনাদেনার কারবারী। সবই ভূয়ো নথি দেখিয়ে। বেসরকারি ব্যাঙ্কে আট-দশটা একাউন্ট খুলে ফেলেছেন, কামিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা, ‘ভ্যাকসিন চার্জ’ বাবদ শুধুমাত্র নয়, আরও অনেক রকমের কারসাজি করে। সেই টাকার কিছু ঢেলেছেন ‘দান-অনুদানে’, থুড়ি, বড় মাপের ধান্দা ফাঁদতে, আর বাকি টাকা সরিয়েছেন ভ্যানিশ করে। পুলিশ প্রতারক দেবা ও তার কিছু সাগরেদকে গ্রেপ্তার করেছে, কিন্তু আত্মসাৎ করা বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধারের কোনও কিনারা এখনও করে উঠতে পারেনি। সবচেয়ে হাড়হিম ধরানো প্রশ্ন হল, কর্পোরেশন-পুলিশ-প্রশাসন ও শাসকদলের নেতা- মাথাদের নাকের ডগায় একটার পর একটা ভূয়ো শিবির করে ভূয়ো টিকা দেওয়ার ক্ষমতা গজিয়ে উঠল কিভাবে? ‘ভূয়ো’ ভায়াল থেকে দেওয়া হয়েছে এক রকমের অ্যান্টিবায়োটিক। যা শরীরে অহেতুক প্রবেশ করলে গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। হবে না এমন নিশ্চয়তা নেই, আশু না হোক বিলম্বে ক্ষতি হতে পারে। সেই অ্যান্টিবায়োটিক কেনা হয় সাজানো নথিপত্র দেখিয়ে, সইসাবুদ জালিয়াতি করে। অবশেষে ‘সেম সাইড’ হয়ে গিয়ে প্রতারণার প্রাথমিক পর্দা ফাঁস হল। এখনও সবটা প্রকাশ হয়নি। যে গুণধর এত সুপরিকল্পিত ও সুনিপুণভাবে এতদিন ধরে এত রকমের কারবার চালিয়ে এসেছেন, তিনি এমন কাঁচাভাবে ধরা পড়ে গেলেন কি করে! কারণ, ‘ভ্যাকসিন সাফল্যের সাথে দেওয়া হয়েছে’ ভূয়ো বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। তবু মরীয়া হয়েছিলেন উতরে যাওয়ায়। ভরসা ছিল শাসকদল-পুলিশ-প্রশাসনের কাছে তাঁর এযাবৎ নানা কিছু সরবরাহের বিনিময়ে বিজ্ঞাপনী ‘ভাবমূর্তি’ নির্মাণের ওপর, যা তৈরি হয়েছিল শাসন ব্যবস্থার প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জড়িয়ে।
এইখান থেকেই প্রশ্ন উঠেছে প্রতারণা কান্ডের অপর উৎস স্থল সম্পর্কে। সেই প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য উত্তরের দাবিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা চিল-চিৎকার করে উঠছেন ধৃত প্রতারককে ‘চিনি না, জানি না’! পরিষ্কার আঁত্কে ওঠার প্রতিক্রিয়া। যাবতীয় ফটোগ্রাফিক সঙ্গ-তথ্যকে স্রেফ ‘কতই না অচেনা মানুষের সাথে সেলফি তোলার আব্দার মেটাতে হয়’ বলে লঘু করে দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখানো হচ্ছে! কিন্তু শুধু তো ফটোদোষ নয়, এক সমান্তরাল ভূয়ো প্রতিষ্ঠান ও তার পরিচালনার প্রশ্নাতীত ভাবমূর্তি তৈরির সমস্ত নকল সরঞ্জাম প্রতারকটি যোগাড় করে ফেললেন কি করে? কলকাতা কর্পোরেশনে কতজন কমিশনার পদের অফিসার আছেন যে মেয়র-ডেপুটি মেয়র ও তাদের পারিষদবর্গের পক্ষে এহেন জালি অফিসার চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি! মুখ্যমন্ত্রী এই প্রতারণার প্রসঙ্গ ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, প্রতারকটি ‘টেররিস্ট’ প্রকৃতির, ‘কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত’, ‘পুলিশ-পুরসভার কেউ জড়িত থাকলে ছাড় পাবেন না’ বলেছেন। বিশেষ পুলিশী তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু দলের নাম জড়ানো নেতা ও ভারপ্রাপ্তদের ব্যাপারে উল্লেখ করে কোনও কথা বললেন না। উল্টে সেই ক্ষমতাবান নেতারা তদন্ত শুরুর আগেই যেভাবে দায়সারা গলাবাজি করে চলেছেন তাতে পুলিশী তদন্তের ওপর পক্ষপাতদুষ্টতার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিছু চুনোপুঁটি ধরেই তদন্তের জাল গুটিয়ে ফেলা হবে না তো? অথবা তদন্ত কেবল চলতেই থাকবে না তো? শঙ্কা থাকবে। কারণ, তৃণমূল আমলে ‘সারদা’র আর্থিক প্রতারণার কারবার বিশাল হয়ে ওঠার পেছনে আজও জড়িয়ে রয়েছে শাসকদলের গুচ্ছের নেতাদের নাম।
রাজ্যের সিআইডি-র সারদা তদন্তের দৌড়ও সবার বোঝা হয়ে গেছে। বিজেপির সিবিআই তদন্তের দাবি তোলার পেছনে উদ্দেশ্যই হল কেবল কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ ডেকে আন। সারদা জড়িত এক প্রাক্তন তৃণমূলী চাঁই এখন বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা বিজেপির। এক প্রতারণায় জড়িয়ে যাওয়া রাজনৈতিক নেতা ও তার আশ্রয়দাতা মদতদাতা দলের নৈতিক অধিকার থাকতে পারে না আরেকটি প্রতারণার তদন্ত প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করার। তাই উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির মাধ্যমে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিলে সেটাই হোত প্রশ্নাতীত নিরপেক্ষতার পরিচয়। আসলে নানান অপরাধের সাথে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরে সংশ্লিষ্ট পুলিশ-প্রশাসন ও শাসক নেতা-মন্ত্রীদের নাম জড়ানোর প্রবণতা খুবই বাড়ছে। তাই বিচার ব্যবস্থার গুরুত্ব বাড়ানোর দাবি জোরদার হচ্ছে। যদিও এপ্রশ্নে কোনও স্তরের আদালত গুরুতর ত্রুটিমুক্ত নয়। কর্পোরেট প্রভাব, শাসকের প্রভাব ও বিচারকের নৈতিক স্খলনের প্রভাবে বিচারের নামে অবিচার হয়। তবু ন্যায়বিচারের আশায় বিচার ব্যবস্থাই এখনও মূল ভরসা। তবে আদালতী ব্যবস্থার যে অপ্রতুলতা ক্রমশ বাড়ছে, মামলার পাহাড় জমছে, তাতে জনস্বার্থ জড়িত তদন্ত ও বিচারের বিষয়গুলিতে বিকল্প তদন্ত ও বিচারের পদক্ষেপ করাই শ্রেয়। রাজ্য সরকারের ওপর এই চাপ তোলা প্রয়োজন।